আমাদের ভালোবাসার মানুষ
মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার সোনামুড়া মহকুমার অনুচ্চ পাহাড়ি এলাকা মেলাঘর। যত দূর মনে পড়ে, একাত্তরের আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। স্টুডেন্ট কোম্পানির আজম খান নামের এক ছেলে, এত দিন তাঁবুতে বসে যে গানের আসর বসাত, সে আনুষ্ঠানিকভাবে রাতে গান গাইবে। তার জন্য সেক্টর সদর দপ্তর থেকে যৎসামান্য আয়োজনও করা হয়েছে। তখন আমিও একজন গণযোদ্ধা, কিন্তু থাকি সুইমিং প্লাটুনে। সকালে ক্যাপ্টেন হায়দারের মুখে সংবাদটা শুনে স্টুডেন্ট কোম্পানিতে গেলাম। রোগা-পাতলা এক ছেলে গলা ছেড়ে প্রায় চিৎকার করে গান গেয়ে চলেছে। অনেক শ্রোতা, সবাই মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণার্থী। প্রশিক্ষণের সেই দিনগুলো ছিল অত্যন্ত কঠিন। কষ্টেরই শুধু ছিল প্রাচুর্য—গায়ে-গতরের কষ্ট, খাওয়ার কষ্ট, থাকার কষ্ট, পরিধানের কষ্ট, অর্থকষ্ট, ওস্তাদদের শাস্তির কষ্ট। এর মধ্যে গান-বাজনা!
রাতে জম্পেশ অনুষ্ঠান হলো। কয়েক ঘণ্টার জন্য কষ্ট বলতে কিছুই রইল না ছেলেদের। আমার সঙ্গে কোনো কথাই হলো না আজম খানের। এক ফাঁকে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ এসে ‘একটু দেখে যাওয়া’র নাম করে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে গেলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মেজর মতিন, ক্যাপ্টেন হায়দারসহ অন্যরা। আজম খান গেয়েই চলেছে—ওরে সালেকা, ওরে মালেকা...। এ ধরনের গান আমি কখনো শুনিনি। সত্যি বলতে কি, ভালোও লাগছিল না। আমি হেমন্ত, সন্ধ্যা, মান্না, ধনঞ্জয়, মানবেন্দ্র, উৎপলা, শ্যামলদের গানের ভক্ত। কিন্তু আমার একার ভালো লাগা না-লাগায় কী যায়-আসে। সবার তো ভালো লাগছে। আমি ভাবছি, যে ছেলেদের পেটে ক্ষুধা, লঙ্গরে কুড়াল দিয়ে লাকড়ি চিরতে চিরতে আর অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে গোটা শরীরে ব্যথা, তাদের মনে এত ফুর্তি এল কোত্থেকে?
পপসংগীতের গায়ক হিসেবে তখন থেকেই আজম খানের উত্থান। সে তো ৪০ বছর আগের কথা। তারপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সংগীতজগতে তার অনুসারী আর অনুরাগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বেড়েছে ভক্ত আর শ্রোতার সংখ্যাও। যে ছেলেমেয়েরা এখন পপসংগীতে খ্যাতি অর্জন করেছে, তারা আজম খানকে শ্রদ্ধাভরে ডাকে ‘গুরু’। আমার শুনেই ভালো লাগে। সমাজ থেকে শ্রদ্ধা, ভক্তি যখন উঠে যাচ্ছে, তখনো গুরু-শিষ্যের সম্পর্কটা টিকে আছে সংগীতজগতে। কথায় বলে, সংগীত গুরুমুখী বিদ্যা। আমি বলি, সব বিদ্যাই গুরুমুখী। সামান্য যা পার্থক্য তা গুরু ও শিষ্যের সম্পর্কের ধরনে।
কিছুদিন আগে শুনলাম, আজম খানের মুখে ক্যানসার ধরা পড়েছে। আঁতকে উঠলাম। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। এ ব্যাধি, চিকিৎসার ধরন এবং পরিণতি সম্পর্কে আমার ধারণা খুব পরিষ্কার। ১৯৯৩ সালের ২১ আগস্ট আমার একমাত্র ছেলে তাসিত হাস্সান সাধিত তিন বছর ছয় মাস বয়সে ক্যানসারে মারা গেছে। অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছি। একদিন সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের ৭২ বছর বয়সের অনকোলজিস্ট অধ্যাপক টেন চ্যাং লিম আমার অসহায়ত্ব দেখে কাঁধে হাত রেখে ইংরেজিতে বললেন, ‘মেজর, তুমি পুত্রবৎসল পিতা হিসেবে ছেলেকে বাঁচানোর যে চেষ্টা তোমার করার, তার চেয়ে অনেক বেশি করেছ! দেশে ফিরে যাও। আর এ-দেশ ও-দেশ কোরো না। প্লেনের উচ্চতার কারণে তোমার ছেলে তোমাদের না বললেও অক্সিজেনের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে।’
দুঃখিত, অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিলাম। ২৬ মে দিবাগত রাত ১২টায় চ্যানেল আইয়ে সংবাদপত্র আলোচনায় আজম খানের চরম অসুস্থতার কথা শুনলাম। শুনলাম, রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছে। আমি অত্যন্ত কম জানার মানুষ। আসলে কিছু জানতেও চাই না।
ভাই আজম খান, তোমাকে কিছু বললেও তুমি আর কিছুই শুনবে না। এই লেখা এ জন্য নয় যে আমি তোমার গানের অনুরক্ত শ্রোতা। এই লেখা এ জন্য যে আমি তোমার একাত্তরের সহযোদ্ধা। তুমি যে অন্তহীন জগতে চলে গেছ, সে জগৎ থেকে একজনও ফিরে এসে বলেনি জগৎটি কেমন! দেশকে ভালোবেসেছ বলে দেশের ক্রান্তিকালে যুদ্ধে গিয়েছিলে। মানুষকে ভালোবেসেছ বলে গান গেয়ে তাদের নির্মল আনন্দ দিয়েছ। শিশু হোক আর পশু হোক আদর, স্নেহ, ঘৃণা, ভালোবাসা—এসবের মর্ম সবাই বোঝে। তোমার অসুস্থতার সংবাদে এ দেশের মানুষ তোমার জন্য চোখের পানি ফেলেছে। অন্তর থেকে দোয়া করেছে। তুমি তাদের চেনো না। টেলিভিশনের ফুটেজে তোমার কোলের ছোট্ট মেয়েটি দেখে অনুমান করলাম, হয়তো তোমার নাতনি। নানাভাই নাতি-নাতনিদের প্রাণ আর নাতি-নাতনিরা নানাভাইয়ের ভুবন। এই নাতি-নাতনিদের কাছে নানাভাইয়ের অভাব পূরণ করবে কে? শিশুদের অনুভূতি অত্যন্ত প্রখর। তাদের গোপন কষ্ট সহ্য করা যায় না। যত ভালো মানুষ চলে যাচ্ছেন, তত ভালো মানুষ তৈরি হচ্ছে না। অথবা হয়তো আরও বেশি তৈরি হচ্ছে, আমি দেখছি না। তুমি হয়তো তোমার প্রতি মানুষের হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসার কিছু দেখে গেছ। তাদের চোখের পানি দেখার সুযোগ তোমার আর হবে না।
তুমি ধন্য হতে আসোনি, ধন্য করতে এসেছিলে।
পরম করুণাময় আল্লাহ্ তাআলা তোমাকে তাঁর ক্ষমার মাঝে, অনুকম্পার মাঝে স্থান দিন, অশ্রুসিক্ত আমি সেই দোয়াই করি।
মেজর (অব.) কামরুল হাসান ভূঁইয়া
মুক্তিযোদ্ধা; চেয়ারম্যান ও প্রধান গবেষক, সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ।
cblws1971@yahoo.com
রাতে জম্পেশ অনুষ্ঠান হলো। কয়েক ঘণ্টার জন্য কষ্ট বলতে কিছুই রইল না ছেলেদের। আমার সঙ্গে কোনো কথাই হলো না আজম খানের। এক ফাঁকে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ এসে ‘একটু দেখে যাওয়া’র নাম করে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে গেলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মেজর মতিন, ক্যাপ্টেন হায়দারসহ অন্যরা। আজম খান গেয়েই চলেছে—ওরে সালেকা, ওরে মালেকা...। এ ধরনের গান আমি কখনো শুনিনি। সত্যি বলতে কি, ভালোও লাগছিল না। আমি হেমন্ত, সন্ধ্যা, মান্না, ধনঞ্জয়, মানবেন্দ্র, উৎপলা, শ্যামলদের গানের ভক্ত। কিন্তু আমার একার ভালো লাগা না-লাগায় কী যায়-আসে। সবার তো ভালো লাগছে। আমি ভাবছি, যে ছেলেদের পেটে ক্ষুধা, লঙ্গরে কুড়াল দিয়ে লাকড়ি চিরতে চিরতে আর অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে গোটা শরীরে ব্যথা, তাদের মনে এত ফুর্তি এল কোত্থেকে?
পপসংগীতের গায়ক হিসেবে তখন থেকেই আজম খানের উত্থান। সে তো ৪০ বছর আগের কথা। তারপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সংগীতজগতে তার অনুসারী আর অনুরাগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বেড়েছে ভক্ত আর শ্রোতার সংখ্যাও। যে ছেলেমেয়েরা এখন পপসংগীতে খ্যাতি অর্জন করেছে, তারা আজম খানকে শ্রদ্ধাভরে ডাকে ‘গুরু’। আমার শুনেই ভালো লাগে। সমাজ থেকে শ্রদ্ধা, ভক্তি যখন উঠে যাচ্ছে, তখনো গুরু-শিষ্যের সম্পর্কটা টিকে আছে সংগীতজগতে। কথায় বলে, সংগীত গুরুমুখী বিদ্যা। আমি বলি, সব বিদ্যাই গুরুমুখী। সামান্য যা পার্থক্য তা গুরু ও শিষ্যের সম্পর্কের ধরনে।
কিছুদিন আগে শুনলাম, আজম খানের মুখে ক্যানসার ধরা পড়েছে। আঁতকে উঠলাম। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। এ ব্যাধি, চিকিৎসার ধরন এবং পরিণতি সম্পর্কে আমার ধারণা খুব পরিষ্কার। ১৯৯৩ সালের ২১ আগস্ট আমার একমাত্র ছেলে তাসিত হাস্সান সাধিত তিন বছর ছয় মাস বয়সে ক্যানসারে মারা গেছে। অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছি। একদিন সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের ৭২ বছর বয়সের অনকোলজিস্ট অধ্যাপক টেন চ্যাং লিম আমার অসহায়ত্ব দেখে কাঁধে হাত রেখে ইংরেজিতে বললেন, ‘মেজর, তুমি পুত্রবৎসল পিতা হিসেবে ছেলেকে বাঁচানোর যে চেষ্টা তোমার করার, তার চেয়ে অনেক বেশি করেছ! দেশে ফিরে যাও। আর এ-দেশ ও-দেশ কোরো না। প্লেনের উচ্চতার কারণে তোমার ছেলে তোমাদের না বললেও অক্সিজেনের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে।’
দুঃখিত, অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিলাম। ২৬ মে দিবাগত রাত ১২টায় চ্যানেল আইয়ে সংবাদপত্র আলোচনায় আজম খানের চরম অসুস্থতার কথা শুনলাম। শুনলাম, রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছে। আমি অত্যন্ত কম জানার মানুষ। আসলে কিছু জানতেও চাই না।
ভাই আজম খান, তোমাকে কিছু বললেও তুমি আর কিছুই শুনবে না। এই লেখা এ জন্য নয় যে আমি তোমার গানের অনুরক্ত শ্রোতা। এই লেখা এ জন্য যে আমি তোমার একাত্তরের সহযোদ্ধা। তুমি যে অন্তহীন জগতে চলে গেছ, সে জগৎ থেকে একজনও ফিরে এসে বলেনি জগৎটি কেমন! দেশকে ভালোবেসেছ বলে দেশের ক্রান্তিকালে যুদ্ধে গিয়েছিলে। মানুষকে ভালোবেসেছ বলে গান গেয়ে তাদের নির্মল আনন্দ দিয়েছ। শিশু হোক আর পশু হোক আদর, স্নেহ, ঘৃণা, ভালোবাসা—এসবের মর্ম সবাই বোঝে। তোমার অসুস্থতার সংবাদে এ দেশের মানুষ তোমার জন্য চোখের পানি ফেলেছে। অন্তর থেকে দোয়া করেছে। তুমি তাদের চেনো না। টেলিভিশনের ফুটেজে তোমার কোলের ছোট্ট মেয়েটি দেখে অনুমান করলাম, হয়তো তোমার নাতনি। নানাভাই নাতি-নাতনিদের প্রাণ আর নাতি-নাতনিরা নানাভাইয়ের ভুবন। এই নাতি-নাতনিদের কাছে নানাভাইয়ের অভাব পূরণ করবে কে? শিশুদের অনুভূতি অত্যন্ত প্রখর। তাদের গোপন কষ্ট সহ্য করা যায় না। যত ভালো মানুষ চলে যাচ্ছেন, তত ভালো মানুষ তৈরি হচ্ছে না। অথবা হয়তো আরও বেশি তৈরি হচ্ছে, আমি দেখছি না। তুমি হয়তো তোমার প্রতি মানুষের হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসার কিছু দেখে গেছ। তাদের চোখের পানি দেখার সুযোগ তোমার আর হবে না।
তুমি ধন্য হতে আসোনি, ধন্য করতে এসেছিলে।
পরম করুণাময় আল্লাহ্ তাআলা তোমাকে তাঁর ক্ষমার মাঝে, অনুকম্পার মাঝে স্থান দিন, অশ্রুসিক্ত আমি সেই দোয়াই করি।
মেজর (অব.) কামরুল হাসান ভূঁইয়া
মুক্তিযোদ্ধা; চেয়ারম্যান ও প্রধান গবেষক, সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ।
cblws1971@yahoo.com
No comments