এশিয়ার উন্নয়নযাত্রা ও বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত
মধ্যবিত্ত শ্রেণী কীভাবে বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও এশিয়ার প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে এবং এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এই গবেষণায় বেশ কিছু চিত্তাকর্ষক উপাদান রয়েছে উন্নয়ন তাত্ত্বিক এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য।
সংস্থার গবেষকদের মতে, আগামী ২০ বছরে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার মধ্যে একটি বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এই সময়কালে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক দাপট কমবে। এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি বাড়বে। এভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন একটি ভারসাম্য আসতে যাচ্ছে আগামী দুই দশকে। আর এই ভারসাম্য পরিবর্তনে অন্যতম ভূমিকা রাখছে এশিয়ার মধ্যবিত্ত শ্রেণী।
মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা যাই ধরা হোক না কেন, এডিবির গবেষকদের হিসাবে এশিয়ায় ৫০ থেকে ১০০ কোটি মধ্যবিত্তের বসবাস। প্রতিবছর তারা তিন লাখ কোটি ডলারের ওপরে খরচ করছে। আর যেভাবে ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনৈতিক বিকাশ পর্বে সে অঞ্চলের মধ্যবিত্তরা জোরালো ভূমিকা রেখেছে, এশিয়াতেও তেমনটাই ঘটতে চলেছে।
মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা: সাধারণত মধ্যবিত্ত হিসেবে একটি দেশের জনগোষ্ঠীর সেই অংশকে বিবেচনা করা হয়, যারা সীমিত আয়ের জীবনযাপন করেন। বাংলাদেশে পেশা বিচার করলে এদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, এনজিও কর্মী, গবেষক, আইনজীবী, চিকিত্সক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, গ্রামীণ উদ্যোক্তা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকেরা পড়েন।
তবে অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্তকে চিহ্নিত করতে গেলে একটি আয়ের সীমা নির্ধারণ করতে হয়। এডিবি ২০০৫ সালের ক্রয়ক্ষমতার সমতার (পিপিপি) নিরিখে দৈনিক দুই থেকে ২০ ডলার পর্যন্ত যারা খরচ করতে পারে, তাদেরই মধ্যবিত্তের কাতারে ফেলেছে। (বর্তমানে এক পিপিপি ডলার = ১৭ টাকা)
বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত: এই মানদণ্ডে ২০০৫ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য-পর্যালোচনায় এডিবি দেখেছে, বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটির ওপরে মধ্যবিত্ত মানুষ রয়েছে, যাদের দৈনিক ব্যয় দুই থেকে ২০ ডলারের ভেতরে আছে।
এডিবির এই হিসাবটি কিছুটা পুুরোনো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০০৯ সালে ‘মৌলিক সুযোগ-সুবিধা পরিবীক্ষণ জরিপ: ২০০৯’ নামে খানা আয়-ব্যয় জরিপের চেয়ে বড় আকারের একটি জরিপ পরিচালনা করে। এ বছর তারা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। বিবিএসের নতুন জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশের মোট পরিবারের মধ্যে ৫৪ শতাংশ মধ্যবিত্ত পরিবার। এর মধ্যে উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবার ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ। চলনসই মধ্যবিত্ত পরিবারের হার ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ। এই হারকে বিবেচনায় নিলে বর্তমানে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক বা প্রায় আট কোটি মানুষ মধ্যবিত্তের কাতারে আছে।
অর্থনৈতিক ভূমিকা: বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে, ক্রয়ক্ষমতার সমতার (পিপিপি) বিচার তারা প্রতিবছর তিন হাজার ৭০০ কোটি ডলার বা দুই লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা খরচ করে থাকে। অর্থনীতিকে অব্যাহতভাবে পাঁচ শতাংশের ওপরে ধরে রাখা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের অন্যতম প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বাংলাদেশের উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এই মধ্যবিত্ত তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখন বছরে দেশে পাঠাচ্ছে এক হাজার কোটি ডলার বা প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। গ্রাম থেকে শহর, সর্বত্রই পড়ছে এর প্রভাব। ব্যবসা-বাণিজ্য, নতুন শিল্পকারখানা ও বেসরকারি খাতের বিকাশও মধ্যবিত্ত তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখছে।
এদের ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়ার কারণে বাড়ছে জমির দাম। রাজধানী থেকে জেলা পর্যায়ে সর্বত্রই গড়ে উঠছে বহুতল শপিং মল। রাজধানী থেকে বিভাগীয় শহরে প্রতিদিনই নামছে প্রাইভেট কার। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এক হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকায় দৈনিক গড়ে ২২৭টি যানবাহন নিবন্ধন নিচ্ছে। এর মধ্যে প্রাইভেট গাড়ির নিবন্ধন হচ্ছে গড়ে ১০০টি। মটরসাইকেলের নিবন্ধন দৈনিক ৮৮টি। আবার দেখা যাচ্ছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ছে। শেয়ারবাজারে অনেকটা হঠাৎ করেই বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডে (সিডিবিএল) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২৮ লাখ বিও অ্যাকাউন্টরি ব্যক্তি রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের বাজার-অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়েছে, দেশের এই উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণী।
উন্নয়ন বিতর্ক: এডিবির হিসাব বা বিবিএসের মৌলিক সুযোগ-সুবিধার জরিপ দুটোরই সামষ্টিক তথ্য নিলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের আকার যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছে। তবে বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের ব্যপ্তির মধ্যে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে যা এডিবিও স্বীকার করছে। এডিবির হিসাবে বাংলাদেশের তিন কোটি ১০ লাখ মধ্যবিত্তের মধ্যে আড়াই কোটি মানুষই নিম্ন-মধ্যবিত্ত, যারা গড়ে দৈনিক দুই থেকে চার ডলার (পিপিপি) খরচ করে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই মধ্যবিত্তরা সামাজিক স্তর বিন্যাসে এখনো স্থিতিশীল হয়নি, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন দৃঢ় নয়। যেকোনো সময়ই তারা আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে যেতে পারে। ২০০৫ সালের হিসাবে তিন কোটি মধ্যবিত্তের মধ্যে মাত্র ৫০ লাখ আছে, যারা দৈনিক চার থেকে ১০ ডলার ব্যয় করার ক্ষমতা রাখে। আর ১০ থেকে ২০ ডলার খরচ করার ক্ষমতা রাখে মাত্র আট লাখ মধ্যবিত্ত মানুষ।
ফলে যে মধ্যবিত্ত এশিয়ার দিন বদলের বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, বাংলাদেশে তাদের অবস্থানটা তেমন জোরালো নয়। এডিবি বলছে. দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, চীন—এসব অঞ্চলের মধ্যবিত্তের বিকাশ অনেকটা সুষম আকারে ও বিস্তৃত পরিসরে রয়েছে। কিন্তু ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ—এই দেশগুলোয় মধ্যবিত্তের আকার বড় হলেও তার মধ্যে সুষম কোনো চরিত্র নেই।
বাংলাদেশের এই বিষয়টি আরও গভীরভাবে পাওয়া যায়, মৌলিক সুযোগ-সুবিধা পরিবীক্ষণ জরিপ থেকে। দেশের ৫০ শতাংশের বেশি পরিবার মধ্যবিত্তের কাতারভুক্ত হলেও শিক্ষার স্তর বিশ্লেষণে দেখা যায়, যারা প্রাথমিক স্তরে ভর্তি হয়, তাদের মধ্যে মাত্র ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে পারে। এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ২২ দশমিক ৭ শতাংশ। আর উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি পাসের সংখ্যা মাত্র ৫ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্য অনসুারে, দেশের ৭২ শতাংশ পরিবার থাকে মাটি ও টিনের ঘরে। আর মাত্র ৮ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবার পাকা বাড়ি ও ফ্ল্যাটে বসবাস করে। দেশের মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষের স্থায়ী ল্যান্ড ফোনের সংযোগ আছে। তবে মুঠোফোনের সংযোগ আছে ৪৮ দশমিক ৩ শতাংশের। আধুনিক জীবনে কম্পিউটার অপরিহার্য হলেও বাংলাদেশ মাত্র ৬ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষের ব্যক্তিগত কম্পিউটার আছে।
ফলে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশের এখনো ভালো আবাসন, স্বাস্থ্য পরিষেবা, কর্মসংস্থান ও শিক্ষা নেই।
বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের বিকাশ ও বিবর্তন নিয়ে কাজ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো: বাংলাদেশের বিত্ত গঠনের প্রক্রিয়ায় সফল মধ্যবিত্তের সংখ্যা আসলে খুবই কম। এই কম অংশের বিত্ত অর্জনের প্রক্রিয়ায় অর্থনীতির বিকাশের সম্ভাবনা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা এবং অর্থনীতির নিজস্ব শক্তি যেভাবে বিপর্যস্ত হয়, তাতে মধ্যবিত্তের অবশিষ্ট বিরাট অংশের ওপরই বিপর্যয় নেমে আসে।
ফলে, শুধু আকারগত দিক দিয়ে মধ্যবিত্তের প্রসার বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করে না। মধ্যবিত্তের মধ্যে একটি সুষম স্বত্বাধিকার ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে তা বিকাশের বড় চালক হিসেবে আবির্ভূত হয়। বাংলাদেশে সেই পর্যায়ে যাওয়ার এখনো অনেক পথ বাকি রয়েছে।
সংস্থার গবেষকদের মতে, আগামী ২০ বছরে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার মধ্যে একটি বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এই সময়কালে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক দাপট কমবে। এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি বাড়বে। এভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন একটি ভারসাম্য আসতে যাচ্ছে আগামী দুই দশকে। আর এই ভারসাম্য পরিবর্তনে অন্যতম ভূমিকা রাখছে এশিয়ার মধ্যবিত্ত শ্রেণী।
মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা যাই ধরা হোক না কেন, এডিবির গবেষকদের হিসাবে এশিয়ায় ৫০ থেকে ১০০ কোটি মধ্যবিত্তের বসবাস। প্রতিবছর তারা তিন লাখ কোটি ডলারের ওপরে খরচ করছে। আর যেভাবে ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনৈতিক বিকাশ পর্বে সে অঞ্চলের মধ্যবিত্তরা জোরালো ভূমিকা রেখেছে, এশিয়াতেও তেমনটাই ঘটতে চলেছে।
মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা: সাধারণত মধ্যবিত্ত হিসেবে একটি দেশের জনগোষ্ঠীর সেই অংশকে বিবেচনা করা হয়, যারা সীমিত আয়ের জীবনযাপন করেন। বাংলাদেশে পেশা বিচার করলে এদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, এনজিও কর্মী, গবেষক, আইনজীবী, চিকিত্সক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, গ্রামীণ উদ্যোক্তা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকেরা পড়েন।
তবে অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্তকে চিহ্নিত করতে গেলে একটি আয়ের সীমা নির্ধারণ করতে হয়। এডিবি ২০০৫ সালের ক্রয়ক্ষমতার সমতার (পিপিপি) নিরিখে দৈনিক দুই থেকে ২০ ডলার পর্যন্ত যারা খরচ করতে পারে, তাদেরই মধ্যবিত্তের কাতারে ফেলেছে। (বর্তমানে এক পিপিপি ডলার = ১৭ টাকা)
বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত: এই মানদণ্ডে ২০০৫ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য-পর্যালোচনায় এডিবি দেখেছে, বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটির ওপরে মধ্যবিত্ত মানুষ রয়েছে, যাদের দৈনিক ব্যয় দুই থেকে ২০ ডলারের ভেতরে আছে।
এডিবির এই হিসাবটি কিছুটা পুুরোনো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০০৯ সালে ‘মৌলিক সুযোগ-সুবিধা পরিবীক্ষণ জরিপ: ২০০৯’ নামে খানা আয়-ব্যয় জরিপের চেয়ে বড় আকারের একটি জরিপ পরিচালনা করে। এ বছর তারা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। বিবিএসের নতুন জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশের মোট পরিবারের মধ্যে ৫৪ শতাংশ মধ্যবিত্ত পরিবার। এর মধ্যে উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবার ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ। চলনসই মধ্যবিত্ত পরিবারের হার ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ। এই হারকে বিবেচনায় নিলে বর্তমানে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক বা প্রায় আট কোটি মানুষ মধ্যবিত্তের কাতারে আছে।
অর্থনৈতিক ভূমিকা: বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে, ক্রয়ক্ষমতার সমতার (পিপিপি) বিচার তারা প্রতিবছর তিন হাজার ৭০০ কোটি ডলার বা দুই লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা খরচ করে থাকে। অর্থনীতিকে অব্যাহতভাবে পাঁচ শতাংশের ওপরে ধরে রাখা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের অন্যতম প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বাংলাদেশের উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এই মধ্যবিত্ত তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখন বছরে দেশে পাঠাচ্ছে এক হাজার কোটি ডলার বা প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। গ্রাম থেকে শহর, সর্বত্রই পড়ছে এর প্রভাব। ব্যবসা-বাণিজ্য, নতুন শিল্পকারখানা ও বেসরকারি খাতের বিকাশও মধ্যবিত্ত তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখছে।
এদের ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়ার কারণে বাড়ছে জমির দাম। রাজধানী থেকে জেলা পর্যায়ে সর্বত্রই গড়ে উঠছে বহুতল শপিং মল। রাজধানী থেকে বিভাগীয় শহরে প্রতিদিনই নামছে প্রাইভেট কার। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এক হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকায় দৈনিক গড়ে ২২৭টি যানবাহন নিবন্ধন নিচ্ছে। এর মধ্যে প্রাইভেট গাড়ির নিবন্ধন হচ্ছে গড়ে ১০০টি। মটরসাইকেলের নিবন্ধন দৈনিক ৮৮টি। আবার দেখা যাচ্ছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ছে। শেয়ারবাজারে অনেকটা হঠাৎ করেই বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডে (সিডিবিএল) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২৮ লাখ বিও অ্যাকাউন্টরি ব্যক্তি রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের বাজার-অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়েছে, দেশের এই উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণী।
উন্নয়ন বিতর্ক: এডিবির হিসাব বা বিবিএসের মৌলিক সুযোগ-সুবিধার জরিপ দুটোরই সামষ্টিক তথ্য নিলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের আকার যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছে। তবে বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের ব্যপ্তির মধ্যে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে যা এডিবিও স্বীকার করছে। এডিবির হিসাবে বাংলাদেশের তিন কোটি ১০ লাখ মধ্যবিত্তের মধ্যে আড়াই কোটি মানুষই নিম্ন-মধ্যবিত্ত, যারা গড়ে দৈনিক দুই থেকে চার ডলার (পিপিপি) খরচ করে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই মধ্যবিত্তরা সামাজিক স্তর বিন্যাসে এখনো স্থিতিশীল হয়নি, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন দৃঢ় নয়। যেকোনো সময়ই তারা আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে যেতে পারে। ২০০৫ সালের হিসাবে তিন কোটি মধ্যবিত্তের মধ্যে মাত্র ৫০ লাখ আছে, যারা দৈনিক চার থেকে ১০ ডলার ব্যয় করার ক্ষমতা রাখে। আর ১০ থেকে ২০ ডলার খরচ করার ক্ষমতা রাখে মাত্র আট লাখ মধ্যবিত্ত মানুষ।
ফলে যে মধ্যবিত্ত এশিয়ার দিন বদলের বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, বাংলাদেশে তাদের অবস্থানটা তেমন জোরালো নয়। এডিবি বলছে. দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, চীন—এসব অঞ্চলের মধ্যবিত্তের বিকাশ অনেকটা সুষম আকারে ও বিস্তৃত পরিসরে রয়েছে। কিন্তু ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ—এই দেশগুলোয় মধ্যবিত্তের আকার বড় হলেও তার মধ্যে সুষম কোনো চরিত্র নেই।
বাংলাদেশের এই বিষয়টি আরও গভীরভাবে পাওয়া যায়, মৌলিক সুযোগ-সুবিধা পরিবীক্ষণ জরিপ থেকে। দেশের ৫০ শতাংশের বেশি পরিবার মধ্যবিত্তের কাতারভুক্ত হলেও শিক্ষার স্তর বিশ্লেষণে দেখা যায়, যারা প্রাথমিক স্তরে ভর্তি হয়, তাদের মধ্যে মাত্র ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে পারে। এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ২২ দশমিক ৭ শতাংশ। আর উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি পাসের সংখ্যা মাত্র ৫ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্য অনসুারে, দেশের ৭২ শতাংশ পরিবার থাকে মাটি ও টিনের ঘরে। আর মাত্র ৮ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবার পাকা বাড়ি ও ফ্ল্যাটে বসবাস করে। দেশের মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষের স্থায়ী ল্যান্ড ফোনের সংযোগ আছে। তবে মুঠোফোনের সংযোগ আছে ৪৮ দশমিক ৩ শতাংশের। আধুনিক জীবনে কম্পিউটার অপরিহার্য হলেও বাংলাদেশ মাত্র ৬ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষের ব্যক্তিগত কম্পিউটার আছে।
ফলে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশের এখনো ভালো আবাসন, স্বাস্থ্য পরিষেবা, কর্মসংস্থান ও শিক্ষা নেই।
বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের বিকাশ ও বিবর্তন নিয়ে কাজ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো: বাংলাদেশের বিত্ত গঠনের প্রক্রিয়ায় সফল মধ্যবিত্তের সংখ্যা আসলে খুবই কম। এই কম অংশের বিত্ত অর্জনের প্রক্রিয়ায় অর্থনীতির বিকাশের সম্ভাবনা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা এবং অর্থনীতির নিজস্ব শক্তি যেভাবে বিপর্যস্ত হয়, তাতে মধ্যবিত্তের অবশিষ্ট বিরাট অংশের ওপরই বিপর্যয় নেমে আসে।
ফলে, শুধু আকারগত দিক দিয়ে মধ্যবিত্তের প্রসার বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করে না। মধ্যবিত্তের মধ্যে একটি সুষম স্বত্বাধিকার ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে তা বিকাশের বড় চালক হিসেবে আবির্ভূত হয়। বাংলাদেশে সেই পর্যায়ে যাওয়ার এখনো অনেক পথ বাকি রয়েছে।
No comments