শিক্ষানীতির যিকঞ্চিত্ by দ্বিজেন শর্মা
শিক্ষকতার যেটুকু অভিজ্ঞতা আমার আছে, তাতে বক্ষ্যমাণ আলোচনার একটি নাতিদীর্ঘ ভূমিকা লেখা সম্ভব। কিন্তু তার কোনো প্রয়োজন দেখি না। ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯’ পাঠই এ জন্য যথেষ্ট।
স্বাধীনতার পর দেশের বৈষয়িক উন্নতি কম হয়নি। কিন্তু উন্নতি তো শুধু বস্তুগত বিষয় নয়, আত্মিকও বটে এবং তা মিলিতভাবেই পরিমাপ্য। বলা বাহুল্য, শেষোক্ত ক্ষেত্রে আমাদের বড় ঘাটতি আছে। আমাদের মনোজগত্ আজও ঔপনিবেশিকতার জের ও সামন্ত সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন। আমাদের নির্বাচন আছে, সংসদ আছে, কিন্তু সমাজে ও জীবনে গণতন্ত্রের বড়ই আকাল। মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ, বিভেদ ও বৈষম্য বিলয়ের আলামত কোথাও নেই। শিক্ষাব্যবস্থা এ প্রকোপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সর্বাধিক; তা আজ রুগ্ণ ও ধ্বস্ত। শিক্ষার যেটুকু উন্নতি দৃশ্যমান, তা-ও ভৌতকাঠামোগত, চৈতন্যগত নয়। শিক্ষাঙ্গনের প্রাণপুরুষ শিক্ষক, দীর্ঘকাল অবহেলিত থাকায় তাঁরাও এখন হতাশ ও অনেকে অপসংস্কৃতিতে আক্রান্ত। বর্তমান শিক্ষানীতিতে আছে তা থেকে উদ্ধারলাভের দিকনির্দেশনা; আর এ জন্যই এটি একটি মহত্ জাতীয় দলিল। যেহেতু শিক্ষাবিদ নই, তাই কয়েকটি মাত্র বিষয়েই আমার মতামত সীমিত থাকবে।
১. মাধ্যমিকের সাধারণ ধারায় বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায়—এ শ্রেণীবিভাজন যৌক্তিক নয়। প্রবণতা ও সম্ভাব্য পেশা নির্বাচনের জন্য অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের বয়স খুবই কম। তারা অভিভাবক ও বন্ধুদের দিয়ে প্রভাবিত হয়ে যে কোর্স পড়ে, তা আরোপিত ও আখেরে ক্ষতিকর। দশম শ্রেণী পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষাই বাঞ্ছনীয়, অন্যথা পূর্ণ মানুষের বদলে খণ্ডিত মানুষ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনে বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল, বিরোধী পক্ষে শেষ পর্যন্ত আমি ছিলাম একা এবং ‘বিজ্ঞানের যুগ’ এ অকাট্য যুক্তিতে বিভাজন প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু এখন কী দেখছি? উন্নত দেশ ও আমাদের দেশ—উভয় জগতেই বিজ্ঞান পাঠে ইচ্ছুক ছাত্রের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। সিপি স্নোর ‘টু কালচার’ প্রসঙ্গটির মর্মকথা, কমিশনের উচ্চশিক্ষা অধ্যায়ে উল্লিখিত হয়েছে, কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষায় এর প্রয়োগ নেই আর সেটাই আশ্চর্যের।
২. মাধ্যমিক স্তরে (ষষ্ঠ-দশম শ্রেণী) ইতিহাস ও ভূগোলের পরিবর্তে সমাজবিদ্যাকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আইডিয়াটি সাম্প্রতিক কালের এবং মার্কিন দেশ থেকে আহূত। ভারতে দুই বছর পরই এটি বাতিল এবং পুনরায় ইতিহাস ও ভূগোল পঠন চালু হয়। কিন্তু পাকিস্তান সেটা অটুট রাখে, বাংলাদেশেও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি এবং কমিশনও তা রেখেছে। কিন্তু কেন? আমরা পৃথিবী নামের একটি গ্রহের বাসিন্দা এবং সব মানুষ একটিমাত্র প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। আমাদের অস্তিত্ব ও অগ্রগতি এ দুটি অভগ্ন বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত আর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ও ভূগোল পাঠ ছাড়া এ বোধ কিশোরমনে প্রোথিত হওয়ার নয়। তাই মাধ্যমিকে বাধ্যতামূলকভাবে দেশ, বিশ্বের ইতিহাস ও ভূগোল রাখা জরুরি মনে করি। ইতিহাস তো এখন আর রাজরাজড়ার কাহিনী নয়। সামাজিক ইতিবৃত্ত, তাতে আছে সব যুগের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিদ্যা ও সংস্কৃতি এবং ভূগোলে রয়েছে ভূচিত্রের সঙ্গে ভূতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, জলবায়ু, পরিবেশ, জীবজগত্ সবই। বিষয়গুলো সমাজবিদ্যা ও পরিবেশবিদ্যার চেয়ে অনেক বেশি সর্বস্পর্শী। বাংলাদেশ স্টাডিজসহ শেষোক্ত দুটি বিষয়ও ইতিহাস ও ভূগোলে সহজেই আত্তীকৃত হতে পারে। বিদেশের সব দৃষ্টান্ত অনুকরণীয় নয়।
৩. উচ্চমাধ্যমিক কলেজে নবম ও দশম শ্রেণীভুক্তি এবং চার বছরের ডিগ্রিকে সাধারণ শিক্ষার শেষ ডিগ্রি ঘোষণা বহুকাল আগেই করণীয় ছিল। এ ধরনের শিক্ষাক্রম উন্নত দেশে চালু রয়েছে। কিন্তু তাদের আছে পর্যাপ্ত সহায়-সম্পদ ও শ্রেণীকক্ষে সীমিত ছাত্রসংখ্যা। আমাদের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি চালু থাকলে সেখানে ছাত্রের চাপ কমবে এবং গবেষণার সুযোগ বাড়বে। কিন্তু চাকরি ক্ষেত্রে শিক্ষানীতিতে উল্লিখিত নীতি বাস্তবায়নের জন্য স্নাতকদের জন্য নির্দিষ্ট চাকরিতে স্নাতকোত্তরদের অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর আইন প্রয়োগ প্রয়োজন হবে। এ পরিস্থিতিতে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত করার মতো কলেজগুলোর উন্নয়নেও বিপুল অর্থ ব্যয় আবশ্যক। অন্যথা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির মতো চার বছরের শিক্ষাকোর্সও পরিহাসে পরিণত হবে। কলেজগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ইংরেজি ভাষাভাষী উন্নত দেশ থেকে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের কথা ভাবা যেতে পারে। বিপ্লবোত্তর রাশিয়া ও জাপান এভাবেই সফলতা অর্জন করেছিল। শুনেছি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরম্ভকালে এমন কিছু ভাবা হয়েছিল, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বিরোধিতায় তা আর সম্ভব হয়নি।
৪. উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলা ও ইংরেজি দুটি মাধ্যমই কমিশন বজায় রেখেছে। কিন্তু বাংলা মাধ্যমে কি উচ্চশিক্ষায় আন্তর্জাতিক মান অর্জন সম্ভব? পাঠ্যপুস্তক ও সহায়ক গ্রন্থ অনুবাদের কথা প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা হতাশাজনক। ৪০ বছরের অর্জন বারিবিন্দুবত্। আগামী ৪০ বছরেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের সম্ভাবনা কম। দক্ষ অনুবাদকের প্রকট অভাব এবং জ্ঞানের ক্রমবর্ধমান পরিধি এভাবে মোকাবিলা দুরূহ কাজ। শিক্ষার মাধ্যম ও মাতৃভাষা আমাদের জন্য একটি জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়, অথচ সমস্যাটির যৌক্তিক একটি সমাধান জরুরি।
৫. অন্যান্য
ক. উচ্চশিক্ষায় বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম দুটি থাকার দরুন উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ে ইংরেজি মাধ্যমের টেকনিক্যাল শব্দের বাংলা এবং বাংলা মাধ্যমের জন্য ইংরেজি পরিভাষা শেখা বাধ্যতামূলক হওয়া আবশ্যক। এ জন্য ৫০ নম্বর রাখা যেতে পারে। স্বাধীনতার পর উচ্চমাধ্যমিক জীববিদ্যায় এ নিয়ম চালু হয়েছিল এবং ১০ নম্বর বরাদ্দ ছিল। কিন্তু পরে তা পরিত্যক্ত হয়।
খ. দক্ষ শিক্ষক ও গবেষক কোথাও কোনোকালে সহজলভ্য নয়। তাই প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব পর্যায়ে অবসর নেওয়ার পরও তাদের শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত রাখার একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন আবশ্যক। আরেকটি বিষয়ও দীর্ঘকাল অবহেলিত হয়ে আছে। সব দেশেই ডিগ্রিহীন কিছু পণ্ডিত থাকেন, যাঁদের জ্ঞান ও দক্ষতা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় সদ্ব্যবহূত হতে পারে এবং হয়েও থাকে। প্রসঙ্গত, ভারতের পাখিবিশারদ সালিম আলী এবং পশ্চিমবঙ্গের কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মরণীয়। আমাদের দেশেও এমন পণ্ডিত ছিলেন ও আছেন। আমলাতান্ত্রিকতা ও রক্ষণশীলতা এ পথের প্রধান অন্তরায়। আশা করি, কমিশন বৃহত্ স্বার্থে বিষয়টি বিবেচনা করবে।
গ. উচ্চমাধ্যমিকের জীববিদ্যার পাঠ্যসূচিতে দীর্ঘকাল বিবর্তনবাদ গুরুত্বসহকারে পড়ানো হয়ে আসছিল। কয়েক বছর আগে থেকে বিবর্তনবাদের পরিবর্তে জীবপ্রযুক্তি পড়ানো হচ্ছে। কেন এ পরিবর্তন, কেন তত্ত্ব থেকে প্রয়োগের এ পৃথক্করণ? জীবপ্রযুক্তি আসলে বিবর্তনবাদেরই একটি ফলিত রূপ। প্রয়োগের সঙ্গে তত্ত্বও প্রয়োজন, তাই দুটি বিষয় এক সঙ্গে পড়ানোর নিয়মটি আশা করি কমিশনের অনুমোদন পাবে।
স্বল্পতম সময়ে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য কমিশনের সদস্য ও সংশ্লিষ্ট সব কর্মীকে ধন্যবাদ।
বরিশাল, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
দ্বিজেন শর্মা: সাবেক শিক্ষক, লেখক ও নিসর্গী।
স্বাধীনতার পর দেশের বৈষয়িক উন্নতি কম হয়নি। কিন্তু উন্নতি তো শুধু বস্তুগত বিষয় নয়, আত্মিকও বটে এবং তা মিলিতভাবেই পরিমাপ্য। বলা বাহুল্য, শেষোক্ত ক্ষেত্রে আমাদের বড় ঘাটতি আছে। আমাদের মনোজগত্ আজও ঔপনিবেশিকতার জের ও সামন্ত সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন। আমাদের নির্বাচন আছে, সংসদ আছে, কিন্তু সমাজে ও জীবনে গণতন্ত্রের বড়ই আকাল। মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ, বিভেদ ও বৈষম্য বিলয়ের আলামত কোথাও নেই। শিক্ষাব্যবস্থা এ প্রকোপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সর্বাধিক; তা আজ রুগ্ণ ও ধ্বস্ত। শিক্ষার যেটুকু উন্নতি দৃশ্যমান, তা-ও ভৌতকাঠামোগত, চৈতন্যগত নয়। শিক্ষাঙ্গনের প্রাণপুরুষ শিক্ষক, দীর্ঘকাল অবহেলিত থাকায় তাঁরাও এখন হতাশ ও অনেকে অপসংস্কৃতিতে আক্রান্ত। বর্তমান শিক্ষানীতিতে আছে তা থেকে উদ্ধারলাভের দিকনির্দেশনা; আর এ জন্যই এটি একটি মহত্ জাতীয় দলিল। যেহেতু শিক্ষাবিদ নই, তাই কয়েকটি মাত্র বিষয়েই আমার মতামত সীমিত থাকবে।
১. মাধ্যমিকের সাধারণ ধারায় বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায়—এ শ্রেণীবিভাজন যৌক্তিক নয়। প্রবণতা ও সম্ভাব্য পেশা নির্বাচনের জন্য অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের বয়স খুবই কম। তারা অভিভাবক ও বন্ধুদের দিয়ে প্রভাবিত হয়ে যে কোর্স পড়ে, তা আরোপিত ও আখেরে ক্ষতিকর। দশম শ্রেণী পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষাই বাঞ্ছনীয়, অন্যথা পূর্ণ মানুষের বদলে খণ্ডিত মানুষ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনে বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল, বিরোধী পক্ষে শেষ পর্যন্ত আমি ছিলাম একা এবং ‘বিজ্ঞানের যুগ’ এ অকাট্য যুক্তিতে বিভাজন প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু এখন কী দেখছি? উন্নত দেশ ও আমাদের দেশ—উভয় জগতেই বিজ্ঞান পাঠে ইচ্ছুক ছাত্রের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। সিপি স্নোর ‘টু কালচার’ প্রসঙ্গটির মর্মকথা, কমিশনের উচ্চশিক্ষা অধ্যায়ে উল্লিখিত হয়েছে, কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষায় এর প্রয়োগ নেই আর সেটাই আশ্চর্যের।
২. মাধ্যমিক স্তরে (ষষ্ঠ-দশম শ্রেণী) ইতিহাস ও ভূগোলের পরিবর্তে সমাজবিদ্যাকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আইডিয়াটি সাম্প্রতিক কালের এবং মার্কিন দেশ থেকে আহূত। ভারতে দুই বছর পরই এটি বাতিল এবং পুনরায় ইতিহাস ও ভূগোল পঠন চালু হয়। কিন্তু পাকিস্তান সেটা অটুট রাখে, বাংলাদেশেও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি এবং কমিশনও তা রেখেছে। কিন্তু কেন? আমরা পৃথিবী নামের একটি গ্রহের বাসিন্দা এবং সব মানুষ একটিমাত্র প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। আমাদের অস্তিত্ব ও অগ্রগতি এ দুটি অভগ্ন বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত আর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ও ভূগোল পাঠ ছাড়া এ বোধ কিশোরমনে প্রোথিত হওয়ার নয়। তাই মাধ্যমিকে বাধ্যতামূলকভাবে দেশ, বিশ্বের ইতিহাস ও ভূগোল রাখা জরুরি মনে করি। ইতিহাস তো এখন আর রাজরাজড়ার কাহিনী নয়। সামাজিক ইতিবৃত্ত, তাতে আছে সব যুগের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিদ্যা ও সংস্কৃতি এবং ভূগোলে রয়েছে ভূচিত্রের সঙ্গে ভূতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, জলবায়ু, পরিবেশ, জীবজগত্ সবই। বিষয়গুলো সমাজবিদ্যা ও পরিবেশবিদ্যার চেয়ে অনেক বেশি সর্বস্পর্শী। বাংলাদেশ স্টাডিজসহ শেষোক্ত দুটি বিষয়ও ইতিহাস ও ভূগোলে সহজেই আত্তীকৃত হতে পারে। বিদেশের সব দৃষ্টান্ত অনুকরণীয় নয়।
৩. উচ্চমাধ্যমিক কলেজে নবম ও দশম শ্রেণীভুক্তি এবং চার বছরের ডিগ্রিকে সাধারণ শিক্ষার শেষ ডিগ্রি ঘোষণা বহুকাল আগেই করণীয় ছিল। এ ধরনের শিক্ষাক্রম উন্নত দেশে চালু রয়েছে। কিন্তু তাদের আছে পর্যাপ্ত সহায়-সম্পদ ও শ্রেণীকক্ষে সীমিত ছাত্রসংখ্যা। আমাদের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি চালু থাকলে সেখানে ছাত্রের চাপ কমবে এবং গবেষণার সুযোগ বাড়বে। কিন্তু চাকরি ক্ষেত্রে শিক্ষানীতিতে উল্লিখিত নীতি বাস্তবায়নের জন্য স্নাতকদের জন্য নির্দিষ্ট চাকরিতে স্নাতকোত্তরদের অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর আইন প্রয়োগ প্রয়োজন হবে। এ পরিস্থিতিতে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত করার মতো কলেজগুলোর উন্নয়নেও বিপুল অর্থ ব্যয় আবশ্যক। অন্যথা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির মতো চার বছরের শিক্ষাকোর্সও পরিহাসে পরিণত হবে। কলেজগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ইংরেজি ভাষাভাষী উন্নত দেশ থেকে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের কথা ভাবা যেতে পারে। বিপ্লবোত্তর রাশিয়া ও জাপান এভাবেই সফলতা অর্জন করেছিল। শুনেছি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরম্ভকালে এমন কিছু ভাবা হয়েছিল, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বিরোধিতায় তা আর সম্ভব হয়নি।
৪. উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলা ও ইংরেজি দুটি মাধ্যমই কমিশন বজায় রেখেছে। কিন্তু বাংলা মাধ্যমে কি উচ্চশিক্ষায় আন্তর্জাতিক মান অর্জন সম্ভব? পাঠ্যপুস্তক ও সহায়ক গ্রন্থ অনুবাদের কথা প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা হতাশাজনক। ৪০ বছরের অর্জন বারিবিন্দুবত্। আগামী ৪০ বছরেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের সম্ভাবনা কম। দক্ষ অনুবাদকের প্রকট অভাব এবং জ্ঞানের ক্রমবর্ধমান পরিধি এভাবে মোকাবিলা দুরূহ কাজ। শিক্ষার মাধ্যম ও মাতৃভাষা আমাদের জন্য একটি জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়, অথচ সমস্যাটির যৌক্তিক একটি সমাধান জরুরি।
৫. অন্যান্য
ক. উচ্চশিক্ষায় বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম দুটি থাকার দরুন উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ে ইংরেজি মাধ্যমের টেকনিক্যাল শব্দের বাংলা এবং বাংলা মাধ্যমের জন্য ইংরেজি পরিভাষা শেখা বাধ্যতামূলক হওয়া আবশ্যক। এ জন্য ৫০ নম্বর রাখা যেতে পারে। স্বাধীনতার পর উচ্চমাধ্যমিক জীববিদ্যায় এ নিয়ম চালু হয়েছিল এবং ১০ নম্বর বরাদ্দ ছিল। কিন্তু পরে তা পরিত্যক্ত হয়।
খ. দক্ষ শিক্ষক ও গবেষক কোথাও কোনোকালে সহজলভ্য নয়। তাই প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব পর্যায়ে অবসর নেওয়ার পরও তাদের শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত রাখার একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন আবশ্যক। আরেকটি বিষয়ও দীর্ঘকাল অবহেলিত হয়ে আছে। সব দেশেই ডিগ্রিহীন কিছু পণ্ডিত থাকেন, যাঁদের জ্ঞান ও দক্ষতা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় সদ্ব্যবহূত হতে পারে এবং হয়েও থাকে। প্রসঙ্গত, ভারতের পাখিবিশারদ সালিম আলী এবং পশ্চিমবঙ্গের কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মরণীয়। আমাদের দেশেও এমন পণ্ডিত ছিলেন ও আছেন। আমলাতান্ত্রিকতা ও রক্ষণশীলতা এ পথের প্রধান অন্তরায়। আশা করি, কমিশন বৃহত্ স্বার্থে বিষয়টি বিবেচনা করবে।
গ. উচ্চমাধ্যমিকের জীববিদ্যার পাঠ্যসূচিতে দীর্ঘকাল বিবর্তনবাদ গুরুত্বসহকারে পড়ানো হয়ে আসছিল। কয়েক বছর আগে থেকে বিবর্তনবাদের পরিবর্তে জীবপ্রযুক্তি পড়ানো হচ্ছে। কেন এ পরিবর্তন, কেন তত্ত্ব থেকে প্রয়োগের এ পৃথক্করণ? জীবপ্রযুক্তি আসলে বিবর্তনবাদেরই একটি ফলিত রূপ। প্রয়োগের সঙ্গে তত্ত্বও প্রয়োজন, তাই দুটি বিষয় এক সঙ্গে পড়ানোর নিয়মটি আশা করি কমিশনের অনুমোদন পাবে।
স্বল্পতম সময়ে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য কমিশনের সদস্য ও সংশ্লিষ্ট সব কর্মীকে ধন্যবাদ।
বরিশাল, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
দ্বিজেন শর্মা: সাবেক শিক্ষক, লেখক ও নিসর্গী।
No comments