গণতন্ত্রিক শাসন -নিয়মতান্ত্রিকতা ও দায়বদ্ধতা by বদিউল আলম মজুমদার
গণতন্ত্র হলো জনগণের সম্মতির শাসন, আর এটি একটি নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থা। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসনকার্য পরিচালনার কতগুলো নিয়ম বা পদ্ধতি থাকে। একই সঙ্গে পদ্ধতি থাকে শাসকদের দায়বদ্ধ করার। বস্তুত গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে হলে নিয়মতান্ত্রিকতা অপরিহার্য।
গণতান্ত্রিক শাসনে সুস্পষ্ট ‘রুলস অব এনগেজমেন্ট’ বা সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। আর এ সম্পৃক্ততা সৃষ্টি হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। তাই নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের প্রথম নিয়ম বা ধাপ। বস্তুত নির্বাচনের মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের সূচনা হয়।
তবে নির্বাচন হলেই গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের সূচনা হয় না। নির্বাচন হতে হয় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ। নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হলে সব যোগ্য ভোটার সব ধরনের ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে বিনা দ্বিধায় ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। নির্বাচন আরও হতে হয় নিরপেক্ষ, যাতে দলমতনির্বিশেষে সব প্রার্থীর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে এবং নির্বাচনে কর্তৃপক্ষের কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব না থাকে। এ ছাড়া নির্বাচন হতে হয় অর্থবহ। অর্থবহ নির্বাচনের মাধ্যমেই সত্, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়। নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ হলেও গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয় না, যদি নির্বাচনের মাধ্যমে সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, স্বার্থান্বেষী ও অযোগ্য ব্যক্তিরা নির্বাচিত হয়ে আসে। অর্থাত্ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গুণগত মানের ওপর গণতান্ত্রিক শাসন বহুলাংশে নির্ভরশীল।
কিন্তু নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, যদিও অনেকে এ দুটিকে এক ও অভিন্ন বলে ধরে নেন। এমন দৃষ্টিভঙ্গির ফলে বস্তুত ‘এক দিনের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এক দিনের গণতন্ত্রে নির্বাচনের দিনই মূলত গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্বাচনের পর ভোটারদের আর কোনো কদর ও ভূমিকা থাকে না। থাকে না স্বচ্ছতা-জবাবদিহির কোনো কার্যকর ব্যবস্থা, যার ফলে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ ধরনের ব্যবস্থায় গণতন্ত্র হয়ে পড়ে সাধারণত ‘উইনার-টেক-অল (winner-take-all) জিরো-সাম-গেম (zero-sum-game)’ বা ‘বিজয়ীদের সবকিছু এবং অন্যরা বঞ্চিত’ ধরনের খেলায়। তাই নির্বাচনই গণতন্ত্রের একমাত্র নিয়ামক নয়। বস্তুত নির্বাচন হলো শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ‘প্রসিডিউর’ বা পদ্ধতি মাত্র। নির্বাচনসর্বস্ব গণতন্ত্রকে পদ্ধতিগত গণতন্ত্র বা ‘প্রসিডিউরাল ডেমোক্রেসি’ বলা যায়।
সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলো কি না-হলো, তা নির্ভর করে দুই নির্বাচনের মাঝখানে কি ঘটে না-ঘটে মূলত তার ওপর। তাই ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতির বাইরেও গণতন্ত্রের আরও গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। আইনের শাসন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, একটি কার্যকর জাতীয় সংসদ, শাসন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, বিকেন্দ্রীকরণ, প্রশাসনের সব স্তরে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ, সমাজের বঞ্চিতদের অন্তর্ভুক্তিকরণ, সামজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক দল, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা ইত্যাদি হলো গণতন্ত্রের অন্যান্য ‘সাবসটেনটিভ’ বা গুরুত্বপূর্ণ দিক। আর এগুলোই হলো গণতান্ত্রিক শাসন পরিচালনার আবশ্যকীয় নিয়মাবলি।
উপরিউক্ত পদ্ধতিগত ও ‘সাবসটেনটিভ’ নিয়ম মেনে চললে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়, যদিও তা নিশ্চিত হয় না। এগুলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ‘নেসেসারি’ বা প্রয়োজনীয়, কিন্তু ‘সাফিসিয়েন্ট’ বা যথেষ্ট নয়। সত্যিকারার্থে গণতন্ত্র কায়েম করতে হলে আরও প্রয়োজন শাসকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিত করার অনেকগুলো নিয়ম বা ধাপ রয়েছে। সংসদীয় পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ধাপ হলো জাতীয় সংসদের কাছে মন্ত্রিপরিষদের জবাবদিহি। আমাদের সংবিধানের ৫৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘মন্ত্রীসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন।’ এটি আনুষ্ঠানিক জবাবদিহির প্রথম পর্ব এবং এর ফলে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা, মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে সংসদীয় কমিটিগুলোর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য।
জবাবদিহির এমন কাঠামোর ফলে সংসদে পাস করা সব আইন সততা, নিষ্ঠা ও প্রয়োজনীয় কৃচ্ছ্রসাধন বাস্তবায়িত হয়েছে কি না তা সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে সংসদকে অবগত করানো মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের দায়িত্বের অংশ। তাঁদের আরও দায়িত্ব মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন সব দপ্তর, অধিদপ্তর ও বিভাগের সব কার্যক্রম সততা ও জনস্বার্থে পরিচালিত হয়েছে কি না তা চাহিদামতো কমিটিগুলোকে জানানো। তাই মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সব কার্যক্রম সম্পর্কে সংসদীয় কমিটিগুলোর প্রশ্ন তোলার ও জবাব চাওয়ার এখতিয়ার রয়েছে। এটাই জবাবদিহির সর্বজনস্বীকৃত নিয়ম বা পদ্ধতি।
সংসদীয় কমিটিগুলোর কার্যক্রমে বিরোধী দলের সদস্যরাই সাধারণত বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাঁরাই সরকারের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করতে বেশি আগ্রহী—এটাই বিরোধী দলের দায়িত্ব। তবে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে জনস্বার্থে সরকারি দলের সদস্যদেরও নির্বাহী বিভাগের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা কর্তব্য।
উল্লেখ্য, আমাদের সংসদীয় কমিটিগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কে শক্ত প্রশ্ন উত্থাপনের এবং জবাবদিহি দাবি করার ফলে কিছু পর্যবেক্ষক বর্তমানে দলীয় অন্তর্কলহের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার স্বার্থে এ ধরনের দলীয় অন্তর্কলহ বা সেইম সাইডের আশঙ্কা উত্থাপন করার কোনো অবকাশ নেই। আরও অবকাশ নেই প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্য কারোর ‘বিরোধ’ নিরসনের লক্ষ্যে হস্তক্ষেপের। কারণ জবাবদিহির এই আনুষ্ঠানিক কাঠামো অকার্যকর হয়ে পড়বে যদি সংসদীয় কমিটিগুলো গঠনমূলক প্রতিপক্ষের ভূমিকা পালন করতে না পারে। তবে এ কাঠামোয় যথাযথভাবে কাজ করতে হলে কমিটির সদস্যদের অবশ্যই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ ও তদবির করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
এ প্রসঙ্গে কয়েক সপ্তাহ আগে দুই জেলা জজকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান এবং পরবর্তী সময়ে তাঁদের পুনর্বহালের বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির তদন্ত সম্পর্কে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। নিঃসন্দেহে এ ধরনের তদন্ত সম্পূর্ণ সংগত এবং কমিটির সাংবিধানিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয়দের জবাবদিহির মুখোমুখি না করে কেন তাদের অধঃস্তন সচিবকে কমিটির সামনে ডাকা হলো? এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবশ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী অংশ নিয়েছিলেন। তাই এ ক্ষেত্রে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ (conflict of interest) বা স্বার্থের দ্বন্দ্বের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এমনি ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে মন্ত্রীদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য হওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে আজ প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে।
এ ছাড়া সংসদীয় বিশেষ অধিকার (Parliamentary privileges) প্রয়োগ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টাকেও ডাকার সম্ভাবনার কথা কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ‘এক্সিকিউটিভ প্রিভিলেজ’ (Executive Privileges) বা প্রধান নির্বাহীর গোপনীয়তার সঙ্গে উপদেষ্টাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার অধিকারের বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। অর্থাত্ সংসদীয় কমিটির যেমন সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও অধিকার রয়েছে দ্বিধাহীনভাবে পরামর্শ গ্রহণের, যা সংসদীয় কমিটির নজরদারিত্বের (scrutiny) আওতার মধ্যে পড়বে না। তাহলেই নির্বাহী ও আইনসভার মধ্যকার চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সেসের সম্পর্ক কার্যকর হবে। কারণ এর মাধ্যমে শুধু চেকই নয়, নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার মধ্যে ব্যালেন্সেস বা ভারসাম্যও প্রতিষ্ঠিত হবে।
জবাবদিহির একটি অনানুষ্ঠানিক কাঠামো হলো স্বয়ং মন্ত্রিপরিষদ। সত্যিকারের সংসদীয় পদ্ধতিতে মন্ত্রিপরিষদ একটি যৌথ সত্তা। এর সব সদস্য সমান, যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী প্রথম। সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকারের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের ভিত্তিতে গৃহীত হয়। এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মন্ত্রিপরিষদের প্রত্যেক সদস্যকে তাঁর সহকর্মীদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, যার মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক দায়বদ্ধতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এ ধরনের সম্পর্কের ফলে নিঃসন্দেহে সিদ্ধান্তের মান বৃদ্ধি পায়। তবে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর মতামত চাপিয়ে দিতে চাইলে কিংবা প্রধানমন্ত্রীর ওপর সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার অর্পণ করলে এ পদ্ধতি বিফল হতে বাধ্য।
গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উত্সস্থল হলো রাজনৈতিক দল— বিশেষত সরকারি দল। কোনো বিশেষ আদর্শ বা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে দল তার কর্মসূচি ভোটারদের সামনে উপস্থাপন করে। আর এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং প্রার্থী মনোনয়ন দেয়, ফায়দা প্রাপ্তির জন্য নয়। প্রসঙ্গত, ফায়দা প্রদান বা প্রাপ্তির জন্য দল গঠিত বা দলের সঙ্গে যুক্ত হলে, দল সিন্ডিকেটের রূপ নেয়। তাই দলের পক্ষ থেকে নির্বাচিত হয়ে যাঁরা সরকার গঠন করেন, দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তাঁদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা দলের দায়িত্ব। এ কারণে দলীয় কাউন্সিলে সাধারণত সরকারের কার্যক্রম নিয়ে তির্যক প্রশ্ন তোলা হয়, বিতর্ক হয় এবং প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। তবে একই ব্যক্তি সরকার ও দলীয় প্রধান হলে জবাবদিহির এ কাঠামো ভেঙে পড়ে, যার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে। দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা না হলে এবং দ্বিধাহীনভাবে কথা বলার অধিকার না থাকলেও এ কাঠামো অকার্যকর হতে বাধ্য।
দলের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার পদ্ধতি সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে যদি দল সরকারের মধ্যে হারিয়ে যায়। বর্তমানে তাই ঘটেছে বলে অনেকের আশঙ্কা। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসার ভাষায়, সরকার কর্তৃক গলাধঃকরণের কারণে আওয়ামী লীগ বর্তমানে নিষ্ক্রিয় হওয়ার আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগই শুধু দল হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, আমাদের গণতান্ত্রিকব্যবস্থার যথাযথ চর্চাও ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে গণতন্ত্র একটি নিয়মভিত্তিক পদ্ধতি। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসন কায়েমের জন্য সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ নির্বাচন প্রয়োজন। এর জন্য আরও প্রয়োজন আইনের শাসন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, সমাজে বঞ্চিতদের অন্তর্ভুক্ত করা, সামাজিক ন্যায়বিচার, বিকেন্দ্রীকরণ, একটি কার্যকর জাতীয় সংসদ, প্রশাসনের সব পর্যায়ে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণে নিবেদিত রাজনৈতিক দল, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রয়োজন শাসনকার্যে নিয়োজিতদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণ। সংসদীয় পদ্ধতিতে সংসদীয় কমিটি ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সক্রিয়তার উপরই গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা মূলত নির্ভর করে। এ ধরনের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির চর্চা করলেই গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জনগণের সব ন্যায্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ উন্মোচিত হয়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক: সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
গণতান্ত্রিক শাসনে সুস্পষ্ট ‘রুলস অব এনগেজমেন্ট’ বা সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। আর এ সম্পৃক্ততা সৃষ্টি হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। তাই নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের প্রথম নিয়ম বা ধাপ। বস্তুত নির্বাচনের মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের সূচনা হয়।
তবে নির্বাচন হলেই গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের সূচনা হয় না। নির্বাচন হতে হয় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ। নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হলে সব যোগ্য ভোটার সব ধরনের ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে বিনা দ্বিধায় ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। নির্বাচন আরও হতে হয় নিরপেক্ষ, যাতে দলমতনির্বিশেষে সব প্রার্থীর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে এবং নির্বাচনে কর্তৃপক্ষের কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব না থাকে। এ ছাড়া নির্বাচন হতে হয় অর্থবহ। অর্থবহ নির্বাচনের মাধ্যমেই সত্, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়। নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ হলেও গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয় না, যদি নির্বাচনের মাধ্যমে সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, স্বার্থান্বেষী ও অযোগ্য ব্যক্তিরা নির্বাচিত হয়ে আসে। অর্থাত্ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গুণগত মানের ওপর গণতান্ত্রিক শাসন বহুলাংশে নির্ভরশীল।
কিন্তু নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, যদিও অনেকে এ দুটিকে এক ও অভিন্ন বলে ধরে নেন। এমন দৃষ্টিভঙ্গির ফলে বস্তুত ‘এক দিনের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এক দিনের গণতন্ত্রে নির্বাচনের দিনই মূলত গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্বাচনের পর ভোটারদের আর কোনো কদর ও ভূমিকা থাকে না। থাকে না স্বচ্ছতা-জবাবদিহির কোনো কার্যকর ব্যবস্থা, যার ফলে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ ধরনের ব্যবস্থায় গণতন্ত্র হয়ে পড়ে সাধারণত ‘উইনার-টেক-অল (winner-take-all) জিরো-সাম-গেম (zero-sum-game)’ বা ‘বিজয়ীদের সবকিছু এবং অন্যরা বঞ্চিত’ ধরনের খেলায়। তাই নির্বাচনই গণতন্ত্রের একমাত্র নিয়ামক নয়। বস্তুত নির্বাচন হলো শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ‘প্রসিডিউর’ বা পদ্ধতি মাত্র। নির্বাচনসর্বস্ব গণতন্ত্রকে পদ্ধতিগত গণতন্ত্র বা ‘প্রসিডিউরাল ডেমোক্রেসি’ বলা যায়।
সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলো কি না-হলো, তা নির্ভর করে দুই নির্বাচনের মাঝখানে কি ঘটে না-ঘটে মূলত তার ওপর। তাই ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতির বাইরেও গণতন্ত্রের আরও গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। আইনের শাসন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, একটি কার্যকর জাতীয় সংসদ, শাসন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, বিকেন্দ্রীকরণ, প্রশাসনের সব স্তরে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ, সমাজের বঞ্চিতদের অন্তর্ভুক্তিকরণ, সামজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক দল, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা ইত্যাদি হলো গণতন্ত্রের অন্যান্য ‘সাবসটেনটিভ’ বা গুরুত্বপূর্ণ দিক। আর এগুলোই হলো গণতান্ত্রিক শাসন পরিচালনার আবশ্যকীয় নিয়মাবলি।
উপরিউক্ত পদ্ধতিগত ও ‘সাবসটেনটিভ’ নিয়ম মেনে চললে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়, যদিও তা নিশ্চিত হয় না। এগুলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ‘নেসেসারি’ বা প্রয়োজনীয়, কিন্তু ‘সাফিসিয়েন্ট’ বা যথেষ্ট নয়। সত্যিকারার্থে গণতন্ত্র কায়েম করতে হলে আরও প্রয়োজন শাসকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিত করার অনেকগুলো নিয়ম বা ধাপ রয়েছে। সংসদীয় পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ধাপ হলো জাতীয় সংসদের কাছে মন্ত্রিপরিষদের জবাবদিহি। আমাদের সংবিধানের ৫৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘মন্ত্রীসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন।’ এটি আনুষ্ঠানিক জবাবদিহির প্রথম পর্ব এবং এর ফলে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা, মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে সংসদীয় কমিটিগুলোর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য।
জবাবদিহির এমন কাঠামোর ফলে সংসদে পাস করা সব আইন সততা, নিষ্ঠা ও প্রয়োজনীয় কৃচ্ছ্রসাধন বাস্তবায়িত হয়েছে কি না তা সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে সংসদকে অবগত করানো মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের দায়িত্বের অংশ। তাঁদের আরও দায়িত্ব মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন সব দপ্তর, অধিদপ্তর ও বিভাগের সব কার্যক্রম সততা ও জনস্বার্থে পরিচালিত হয়েছে কি না তা চাহিদামতো কমিটিগুলোকে জানানো। তাই মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সব কার্যক্রম সম্পর্কে সংসদীয় কমিটিগুলোর প্রশ্ন তোলার ও জবাব চাওয়ার এখতিয়ার রয়েছে। এটাই জবাবদিহির সর্বজনস্বীকৃত নিয়ম বা পদ্ধতি।
সংসদীয় কমিটিগুলোর কার্যক্রমে বিরোধী দলের সদস্যরাই সাধারণত বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাঁরাই সরকারের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করতে বেশি আগ্রহী—এটাই বিরোধী দলের দায়িত্ব। তবে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে জনস্বার্থে সরকারি দলের সদস্যদেরও নির্বাহী বিভাগের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা কর্তব্য।
উল্লেখ্য, আমাদের সংসদীয় কমিটিগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কে শক্ত প্রশ্ন উত্থাপনের এবং জবাবদিহি দাবি করার ফলে কিছু পর্যবেক্ষক বর্তমানে দলীয় অন্তর্কলহের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার স্বার্থে এ ধরনের দলীয় অন্তর্কলহ বা সেইম সাইডের আশঙ্কা উত্থাপন করার কোনো অবকাশ নেই। আরও অবকাশ নেই প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্য কারোর ‘বিরোধ’ নিরসনের লক্ষ্যে হস্তক্ষেপের। কারণ জবাবদিহির এই আনুষ্ঠানিক কাঠামো অকার্যকর হয়ে পড়বে যদি সংসদীয় কমিটিগুলো গঠনমূলক প্রতিপক্ষের ভূমিকা পালন করতে না পারে। তবে এ কাঠামোয় যথাযথভাবে কাজ করতে হলে কমিটির সদস্যদের অবশ্যই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ ও তদবির করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
এ প্রসঙ্গে কয়েক সপ্তাহ আগে দুই জেলা জজকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান এবং পরবর্তী সময়ে তাঁদের পুনর্বহালের বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির তদন্ত সম্পর্কে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। নিঃসন্দেহে এ ধরনের তদন্ত সম্পূর্ণ সংগত এবং কমিটির সাংবিধানিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয়দের জবাবদিহির মুখোমুখি না করে কেন তাদের অধঃস্তন সচিবকে কমিটির সামনে ডাকা হলো? এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবশ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী অংশ নিয়েছিলেন। তাই এ ক্ষেত্রে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ (conflict of interest) বা স্বার্থের দ্বন্দ্বের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এমনি ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে মন্ত্রীদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য হওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে আজ প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে।
এ ছাড়া সংসদীয় বিশেষ অধিকার (Parliamentary privileges) প্রয়োগ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টাকেও ডাকার সম্ভাবনার কথা কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ‘এক্সিকিউটিভ প্রিভিলেজ’ (Executive Privileges) বা প্রধান নির্বাহীর গোপনীয়তার সঙ্গে উপদেষ্টাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার অধিকারের বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। অর্থাত্ সংসদীয় কমিটির যেমন সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও অধিকার রয়েছে দ্বিধাহীনভাবে পরামর্শ গ্রহণের, যা সংসদীয় কমিটির নজরদারিত্বের (scrutiny) আওতার মধ্যে পড়বে না। তাহলেই নির্বাহী ও আইনসভার মধ্যকার চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সেসের সম্পর্ক কার্যকর হবে। কারণ এর মাধ্যমে শুধু চেকই নয়, নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার মধ্যে ব্যালেন্সেস বা ভারসাম্যও প্রতিষ্ঠিত হবে।
জবাবদিহির একটি অনানুষ্ঠানিক কাঠামো হলো স্বয়ং মন্ত্রিপরিষদ। সত্যিকারের সংসদীয় পদ্ধতিতে মন্ত্রিপরিষদ একটি যৌথ সত্তা। এর সব সদস্য সমান, যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী প্রথম। সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকারের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের ভিত্তিতে গৃহীত হয়। এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মন্ত্রিপরিষদের প্রত্যেক সদস্যকে তাঁর সহকর্মীদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, যার মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক দায়বদ্ধতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এ ধরনের সম্পর্কের ফলে নিঃসন্দেহে সিদ্ধান্তের মান বৃদ্ধি পায়। তবে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর মতামত চাপিয়ে দিতে চাইলে কিংবা প্রধানমন্ত্রীর ওপর সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার অর্পণ করলে এ পদ্ধতি বিফল হতে বাধ্য।
গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উত্সস্থল হলো রাজনৈতিক দল— বিশেষত সরকারি দল। কোনো বিশেষ আদর্শ বা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে দল তার কর্মসূচি ভোটারদের সামনে উপস্থাপন করে। আর এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং প্রার্থী মনোনয়ন দেয়, ফায়দা প্রাপ্তির জন্য নয়। প্রসঙ্গত, ফায়দা প্রদান বা প্রাপ্তির জন্য দল গঠিত বা দলের সঙ্গে যুক্ত হলে, দল সিন্ডিকেটের রূপ নেয়। তাই দলের পক্ষ থেকে নির্বাচিত হয়ে যাঁরা সরকার গঠন করেন, দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তাঁদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা দলের দায়িত্ব। এ কারণে দলীয় কাউন্সিলে সাধারণত সরকারের কার্যক্রম নিয়ে তির্যক প্রশ্ন তোলা হয়, বিতর্ক হয় এবং প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। তবে একই ব্যক্তি সরকার ও দলীয় প্রধান হলে জবাবদিহির এ কাঠামো ভেঙে পড়ে, যার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে। দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা না হলে এবং দ্বিধাহীনভাবে কথা বলার অধিকার না থাকলেও এ কাঠামো অকার্যকর হতে বাধ্য।
দলের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার পদ্ধতি সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে যদি দল সরকারের মধ্যে হারিয়ে যায়। বর্তমানে তাই ঘটেছে বলে অনেকের আশঙ্কা। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসার ভাষায়, সরকার কর্তৃক গলাধঃকরণের কারণে আওয়ামী লীগ বর্তমানে নিষ্ক্রিয় হওয়ার আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগই শুধু দল হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, আমাদের গণতান্ত্রিকব্যবস্থার যথাযথ চর্চাও ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে গণতন্ত্র একটি নিয়মভিত্তিক পদ্ধতি। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসন কায়েমের জন্য সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ নির্বাচন প্রয়োজন। এর জন্য আরও প্রয়োজন আইনের শাসন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, সমাজে বঞ্চিতদের অন্তর্ভুক্ত করা, সামাজিক ন্যায়বিচার, বিকেন্দ্রীকরণ, একটি কার্যকর জাতীয় সংসদ, প্রশাসনের সব পর্যায়ে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণে নিবেদিত রাজনৈতিক দল, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রয়োজন শাসনকার্যে নিয়োজিতদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণ। সংসদীয় পদ্ধতিতে সংসদীয় কমিটি ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সক্রিয়তার উপরই গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা মূলত নির্ভর করে। এ ধরনের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির চর্চা করলেই গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জনগণের সব ন্যায্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ উন্মোচিত হয়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক: সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments