চট্টগ্রামে আদালত চত্বরে সংঘাত আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা
নিহত সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায় চুনতি ইউনিয়নের জামাল হোসেনের পুত্র। তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সহকারী প্রসিকিউটর ছিলেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও কমপক্ষে ৩০ জন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জামিন নামঞ্জুর হওয়ার পর অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভরত সনাতনীরা আদালত চত্বরে প্রায় তিন ঘণ্টা পুলিশের প্রিজন ভ্যান আটকে রাখেন। এক পর্যায়ে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে এবং লাঠিচার্জ করে। এরপর চিন্ময় সমর্থকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে রঙ্গম কনভেনশন হলের সামনে অবস্থান নেন। এর মধ্যে আদালত প্রাঙ্গণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতিতে স্থানীয় ও আইনজীবীদের সঙ্গে তাদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা করে।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি ফজলুল কাদের বলেন, বিকাল পৌনে ৪টার দিকে কোর্ট হিলে সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চন্দন কুমার ধর ওরফে চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় আদালত কারাগারে প্রেরণ করার আদেশ প্রদান করেন। এসময় ইসকনের লোকজন আসামি বহনকারী প্রিজন ভ্যান অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ আন্দোলনকারীদের সরিরে দেয়ার সময় মোটরসাইকেল, গাড়ি ভাঙচুর ও মসজিদ ভাঙচুর করে। একপর্যায়ে তারা আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে নিয়ে নিকটস্থ রঙ্গম টাওয়ারের সামনে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন জানিয়েছেন, চিন্ময়ের অনুসারীদের যারা আদালতে বিক্ষোভ করেছেন তারাই সাইফুলকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। সাইফুল হত্যার প্রতিবাদে আজ আদালতের কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা করেছেন আইনজীবীরা। সকাল ১১টায় জমি’আতুল ফালাহ মাঠে নিহত আইনজীবীর জানাজা হবে। বিকালে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নগরীতে বিক্ষোভ করার ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময়ও নিউমার্কেট মোড়ে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করছিলেন ছাত্র-জনতা।
জানা যায়, জামিন শুনানির পর বেলা ১২টা ২০ মিনিটে চিন্ময়কে পুলিশের প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। তখন তার সমর্থকরা প্রিজন ভ্যানটি ঘেরাও করে ও আটকে রাখে। আদালত চত্বর থেকে বের হওয়ার সড়কটিতে পুরাতন পিকআপ ভ্যান দিয়ে পথ রোধ করা হয়। পুলিশ তাদের অনুরোধ করে ও বুঝিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলেও তারা পথ অবরোধ করে রাখেন। পুলিশের প্রিজন ভ্যানটির চাকা পাংচার করে দেয়া হয়। এরপর বেলা ২টা ৫০ মিনিটে সাউন্ড গ্রেনেড ফাটিয়ে এবং লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়। পরে চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে পুলিশের একটি পিকআপে করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় পুলিশের পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, এপিবিএনের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সনাতনী ইসকন সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করতে ধাওয়া দিলে আদালত এলাকা ত্যাগ করার সময় তারা মোটরসাইকেল, গাড়ি ও আদালত মসজিদ মার্কেটের নিচতলা লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়েন। তাদের ইটপাটকেলের আঘাতে কয়েক জন আহত হয়েছেন। লালদীঘি চত্বরের নাসির উদ্দিন নামে একজন পিঠা ব্যবসায়ীর মাথা ফেটে যায়। এসময় ইসকন সমর্থকদের হাতে রাম-দা ও লাঠিসোটা ছিল। ইসকন কর্মীরা এসময় চট্টগ্রাম আদালত মসজিদেও ভাঙচুর চালায়। এই ঘটনার জেরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন আইনজীবী ও স্থানীয়রা।
জানা যায়, সংঘর্ষের ঘটনায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও আহত হয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৯ জন। তবে এই ১৯ জনের সকলেই আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল মন্নান। তিনি বলেন, ‘কেউ মাথায় আঘাত পেয়েছেন, কেউ হাতে, কেউ শরীরের অন্যান্য জায়গায় আঘাত পেয়ে আহত হয়েছেন। তাদেরকে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে।’
এর আগে মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে চিন্ময়কে কঠোর নিরাপত্তার সঙ্গে আদালতে আনা হয়। এরপর বেলা পৌনে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম ৬ষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক কাজী শরীফুল ইসলাম জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আদেশের পরপরই এজলাসের বাইরে বিক্ষোভ শুরু করেন চিন্ময় সমর্থকরা।
বেলা সোয়া ১২টার দিকে প্রিজন ভ্যানের ভেতর থেকেই চিন্ময় কৃষ্ণ তার ভক্ত-অনুসারীদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানান। হ্যান্ডমাইকে তিনি বলেন, আমরা রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে নই। ৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানে যে রাষ্ট্র নির্মাণের আশা করা হয়েছে আমরা সনাতনীরা তার অংশীদার। সুতরাং রাষ্ট্র অস্থিতিশীল হয় এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নষ্ট হয় আমরা এমন কিছু করবো না। আবেগকে সংযত করে শক্তিতে পরিণত করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করবেন।
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ৮ দফা দাবি মৌলিক দাবি। এটা অযৌক্তিক দাবি নয়। এটা পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আপনারা আন্দোলন চালাবেন। কিন্তু দয়া করে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং পরস্পর সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করবেন। এটা আমি আপনাদের কাছে আশা করছি।
প্রসঙ্গত, গত ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশব্যাপী সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আট দফা দাবিতে সনাতনী সমপ্রদায়ের মুখপাত্র হিসেবে বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণ। গত ২৫শে অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে জনসভার পর ৩০শে অক্টোবর রাতে তাকেসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়। এই মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ঢাকায় লংমার্চের ঘোষণাও দিয়েছিল সনাতনী জাগরণ মঞ্চ। পরে সেই কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। সর্বশেষ গতকাল বিকালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা তাকে গ্রেপ্তার করেন।
No comments