গল্প- বৃক্ষদের করুণ গান by নাসরীন জাহান
সেতুর আসমান টুটে গেল,
নীলিমার ঝাঁক পাখিরা গতি হারিয়ে বিহবল হলো
দুর্ঘটনার পৈশাচিক নখর অনন্তকে জীবনের জন্য কেড়ে নিয়ে গেল এই ধরিত্রী থেকে।
দিনরাতগুলো কাটে অগ্নিঝরা নিঃশ্বাসে চারপাশ পোড়াতে পোড়াতে। সেতুর চক্ষুকোটরে একবিন্দু আলো নেই, আত্মাপিঞ্জরে একফোঁটা জল নেই।
সে দিন-রাত্রির ওপর দিয়ে চলে না, যেন এক বিবশ প্রস্তরখ- সেতু, দিনরাত্রিগুলো কীভাবে তার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঠাহর হয় না তার।
এদিকে ঘাগরা ঢেউ তোলে শিশু বাতাস
সূর্য সাগরের প্রকা-তাকে ঢেকে রাখে তুমুল ধূসর ছায়া। চূর্ণ-বিচূর্ণ অবস্থার মধ্যে অনন্তর মুখটি স্থিত ছিলো।
কাফনে ঢাকা সেই মানুষটার মুখটা দু-আঁজলায় ধরে সেতু…।
একরাতে তেমনই নিঃসাড় পড়ে থেকে জাগ্রত রাত্রিকে বলছিল সেতু, আমাকে তুলে নাও,
দরজায় অনন্ত,
তুমি আমাকে এইভাবে মৃত ভেবে মাতম করবে, অনন্ত আহত, এ যে আমার কল্পনার বাইরে ছিল। একমাত্র তোমাকেই আমি বলে দেশের বাইরে গেছি, তুমি সেতু…।
সেতু ছিলাটান দিয়ে সোজা হয়। এরই ধারাস্রোতে সে দাঁড়ায়ও, এক আজব বিহবলতায় তার নিঃশ্বাস আটকে আসতে থাকে, তবে যে আমি নিজে তোমার লাশ দেখলাম, নিজ হাতে আমি।
সে তো তোমার স্বপ্ন। এ-জীবনে স্বপ্ন আর বাস্তবকে কম গুলিয়েছো তুমি!
তুমি এই এতো রাতে? চারপাশে তাকায় সেতু, আলো-আঁধারের অদ্ভুত প্রচ্ছায়া।
বিছানায় বসে অনন্ত সেতুকে আঁকড়ে ধরে, আমার ফ্লাইট ডিলে ছিলো, ভালো করে বাতিগুলো জ্বালাও সেতু, কতদিন তোমার মুখটা দেখি না।
উত্তেজনা, কম্পমানে দিশেহারা সেতু কাঁপতে কাঁপতে বাতিগুলো জ্বালায়, আমি চক্ষু ভরে দেখব তোমাকে, চিমটি কাটছি বারবার এই দেখো, এমনও বাস্তব হতে পারে? যেন ঘরে জ্বলজ্বল করছে বাতি নয়, সূর্যের স্ফটিক আলো। যেন পূর্ণ চন্দ্রাকাশে দুজন নিবিড় জ্যোৎস্নায় আসন পেতেছে, বিছানায় বসে অনন্তর মুখটার ওপর যেন হাতড়ে নয় হামলে পড়ে সেতু, এমন দুঃসহ স্বপ্ন কারো জীবনে যেন না আসে…
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে রাত তিনটে স্পর্শ করেছে। আচমকা সেতুর বুক খালি করে ফের অনন্ত হারিয়ে যায়।
এই যে বাতিগুলো আমি নিজ হাতে জ্বেলেছি। বিছানার যে-জায়গাটায় বসেছিল, স্পষ্ট কুঁচকে আছে। এ কী করে স্বপ্ন হয়?
গলা উজাড় করে চিৎকার করে সেতু।
এইভাবে দিনগুলো রাত্রিগুলো যায়।
সবাই পিকনিকে এসেছে। অনন্তর মৃত্যুর মাস পরেও সেতুর কোনো বিবর্তন নেই। সবাই চেয়েছে, তাই এসেছে পিকনিকে।
সেতুকে আচ্ছন্ন করেছিলো প্রগাঢ় বিষাদের ছায়া। রৌদ্র-উজ্জ্বল দিনেও তার আত্মার করোটিতে কেবলই গাঢ় অন্ধকার। সবার হুল্লোড় ছেড়ে সে অরণ্যের এক অদ্ভুত নির্জনে এসে দাঁড়ায়।
হুজ্জতে মাতা কেউ খেয়াল করে না।
হৃদয় আচ্ছন্ন করা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। তক্ষুনি যেন এতোক্ষণ পাশেই ছিলো এমনভাবে সেতুর ঘাড়ে হাত রেখে বলে অনন্ত, নির্জন অরণ্যের নিজেরও যে আলাদা একটা গান আছে, সত্যিকারভাবে কান পাতলে বোঝা যায়।
ফের ভূকম্পন, ফের আত্মার আরক্ষেতে ধুকপুক, এ যে সত্যিই জ্যান্ত অনন্ত – অরণ্যের ছায়াছায়া আলোয় স্পষ্ট দেখে ফের তার শরীর হাতড়ায় সেতু, তুমি ফের চলে যাবে, ফের ফাঁকি দেবে আমাকে, সাবধান স্বপ্ন বলো না, আমি তা শুনতে চাই না,
তুমি আমাকে দেখে এভাবে চমকে উঠলে আমার অসম্মান হয় না, যেন গানের ঘোরে অনন্ত বলে, অথচ আমরা বিয়ের রাতেই পরস্পরকে কথা দিয়েছিলাম, আমরা একজন আরেকজনের পরিপূরক থাকবো। যেন আমি অচেনা, এভাবে যদি চমকে ওঠো…।
তুমি জানো না অনন্ত, তুমি জানো না, সেতু কাঙালের মতো আঁকড়ে ধরে অনন্তকে, এইভাবে খেলো না তুমি আমার সঙ্গে, এমন মজা করো না, আমি এরকম বারবার মরতে পারবো না অনন্ত।
তুমি মরছো? ওপরের গাছেদের মাথার ফালির ভাঁজে ভাঁজে ছলকে ছলকে রোদ্দুর গড়িয়ে পড়ছে। আর সত্যিই অরণ্যে মিহি বাতাস ওঠায় এক অদ্ভুত মিহি দেহমন আচ্ছন্ন করা সুর উঠেছে।
এমন মাতাল করা সুর, অভিভূত বোধে মাঝখানের সময়টা পুরো ভুলে সেতু আমূল জড়িয়ে ধরে অনন্তকে। অনন্তের গায়ে একটা অদ্ভুত সুন্দর মাতাল করা ঘ্রাণ, সব বেদনা রশ্মির ওপর গিয়ে অনন্তকে পুরোটাই উপভোগ করার স্পৃহায় সেতু আচমকা চুম্বন করে তাকে।
এখানে না, এখানে না, অনন্ত সচকিত হয়ে ওঠে। ভুলে যেয়ো না, আমরা দম্পতি। বনের মধ্যে এসব কা- করে প্রেমিক-প্রেমিকারা।
যেন ঝিল্লিমুখর পূর্ণিমারাত্রির গায়ে কেউ ঢিল ছুড়ল। যেন ছলকে এক কালো মেঘ ঢেকে দিলো সেতুর মুখ, তার মানে, বিয়ের পর প্রেমিক-প্রেমিকাদের মতো আমাদের স্পৃহা থাকতে নেই, আমাদের লিগ্যাল ঘর আছে বলে আমাদের মধ্যে আর প্রেম থাকতে নেই।
কেন তা থাকবে না? এইবার অনন্ত জড়িয়ে ধরে সেতুকে, আমি জানতাম এই পয়েন্টে এমনই রিঅ্যাক্ট করবে তুমি, বলে দুজন যখন একজন আরেকজনের খোলসগুলো খুলছে… তখন কাছেই কোথাও হলো রোল আর আর্তনাদ-ধ্বনি, শুনে সচকিত হতেই সেতু দেখে, তার প্রাণকে শূন্য করে অনন্ত চলে গেছে।
বিমূঢ় বিস্ময়ে আত্মার কান্নার হলাহল নিয়েও সে স্থবিরের মতো সেই কোরাসের দিকে এগিয়ে যায়, এতো রকম চিৎকার-ধ্বনির মধ্যে একটাই উচ্চকিত বেশি, এ কী করে হয়?
চিত্রার্পিতের মতো আলুথালু সেতু ভিড়ের কাছটায় যেতেই ওকে দেখে অনেকে সরে যায়।
ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দেখে সেতু, একটা রক্তেভেজা ডালের কাছে হুবহু কিছু আগের অনন্ত মরে পড়ে আছে।
নীলিমার ঝাঁক পাখিরা গতি হারিয়ে বিহবল হলো
দুর্ঘটনার পৈশাচিক নখর অনন্তকে জীবনের জন্য কেড়ে নিয়ে গেল এই ধরিত্রী থেকে।
দিনরাতগুলো কাটে অগ্নিঝরা নিঃশ্বাসে চারপাশ পোড়াতে পোড়াতে। সেতুর চক্ষুকোটরে একবিন্দু আলো নেই, আত্মাপিঞ্জরে একফোঁটা জল নেই।
সে দিন-রাত্রির ওপর দিয়ে চলে না, যেন এক বিবশ প্রস্তরখ- সেতু, দিনরাত্রিগুলো কীভাবে তার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঠাহর হয় না তার।
এদিকে ঘাগরা ঢেউ তোলে শিশু বাতাস
সূর্য সাগরের প্রকা-তাকে ঢেকে রাখে তুমুল ধূসর ছায়া। চূর্ণ-বিচূর্ণ অবস্থার মধ্যে অনন্তর মুখটি স্থিত ছিলো।
কাফনে ঢাকা সেই মানুষটার মুখটা দু-আঁজলায় ধরে সেতু…।
একরাতে তেমনই নিঃসাড় পড়ে থেকে জাগ্রত রাত্রিকে বলছিল সেতু, আমাকে তুলে নাও,
দরজায় অনন্ত,
তুমি আমাকে এইভাবে মৃত ভেবে মাতম করবে, অনন্ত আহত, এ যে আমার কল্পনার বাইরে ছিল। একমাত্র তোমাকেই আমি বলে দেশের বাইরে গেছি, তুমি সেতু…।
সেতু ছিলাটান দিয়ে সোজা হয়। এরই ধারাস্রোতে সে দাঁড়ায়ও, এক আজব বিহবলতায় তার নিঃশ্বাস আটকে আসতে থাকে, তবে যে আমি নিজে তোমার লাশ দেখলাম, নিজ হাতে আমি।
সে তো তোমার স্বপ্ন। এ-জীবনে স্বপ্ন আর বাস্তবকে কম গুলিয়েছো তুমি!
তুমি এই এতো রাতে? চারপাশে তাকায় সেতু, আলো-আঁধারের অদ্ভুত প্রচ্ছায়া।
বিছানায় বসে অনন্ত সেতুকে আঁকড়ে ধরে, আমার ফ্লাইট ডিলে ছিলো, ভালো করে বাতিগুলো জ্বালাও সেতু, কতদিন তোমার মুখটা দেখি না।
উত্তেজনা, কম্পমানে দিশেহারা সেতু কাঁপতে কাঁপতে বাতিগুলো জ্বালায়, আমি চক্ষু ভরে দেখব তোমাকে, চিমটি কাটছি বারবার এই দেখো, এমনও বাস্তব হতে পারে? যেন ঘরে জ্বলজ্বল করছে বাতি নয়, সূর্যের স্ফটিক আলো। যেন পূর্ণ চন্দ্রাকাশে দুজন নিবিড় জ্যোৎস্নায় আসন পেতেছে, বিছানায় বসে অনন্তর মুখটার ওপর যেন হাতড়ে নয় হামলে পড়ে সেতু, এমন দুঃসহ স্বপ্ন কারো জীবনে যেন না আসে…
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে রাত তিনটে স্পর্শ করেছে। আচমকা সেতুর বুক খালি করে ফের অনন্ত হারিয়ে যায়।
এই যে বাতিগুলো আমি নিজ হাতে জ্বেলেছি। বিছানার যে-জায়গাটায় বসেছিল, স্পষ্ট কুঁচকে আছে। এ কী করে স্বপ্ন হয়?
গলা উজাড় করে চিৎকার করে সেতু।
এইভাবে দিনগুলো রাত্রিগুলো যায়।
সবাই পিকনিকে এসেছে। অনন্তর মৃত্যুর মাস পরেও সেতুর কোনো বিবর্তন নেই। সবাই চেয়েছে, তাই এসেছে পিকনিকে।
সেতুকে আচ্ছন্ন করেছিলো প্রগাঢ় বিষাদের ছায়া। রৌদ্র-উজ্জ্বল দিনেও তার আত্মার করোটিতে কেবলই গাঢ় অন্ধকার। সবার হুল্লোড় ছেড়ে সে অরণ্যের এক অদ্ভুত নির্জনে এসে দাঁড়ায়।
হুজ্জতে মাতা কেউ খেয়াল করে না।
হৃদয় আচ্ছন্ন করা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। তক্ষুনি যেন এতোক্ষণ পাশেই ছিলো এমনভাবে সেতুর ঘাড়ে হাত রেখে বলে অনন্ত, নির্জন অরণ্যের নিজেরও যে আলাদা একটা গান আছে, সত্যিকারভাবে কান পাতলে বোঝা যায়।
ফের ভূকম্পন, ফের আত্মার আরক্ষেতে ধুকপুক, এ যে সত্যিই জ্যান্ত অনন্ত – অরণ্যের ছায়াছায়া আলোয় স্পষ্ট দেখে ফের তার শরীর হাতড়ায় সেতু, তুমি ফের চলে যাবে, ফের ফাঁকি দেবে আমাকে, সাবধান স্বপ্ন বলো না, আমি তা শুনতে চাই না,
তুমি আমাকে দেখে এভাবে চমকে উঠলে আমার অসম্মান হয় না, যেন গানের ঘোরে অনন্ত বলে, অথচ আমরা বিয়ের রাতেই পরস্পরকে কথা দিয়েছিলাম, আমরা একজন আরেকজনের পরিপূরক থাকবো। যেন আমি অচেনা, এভাবে যদি চমকে ওঠো…।
তুমি জানো না অনন্ত, তুমি জানো না, সেতু কাঙালের মতো আঁকড়ে ধরে অনন্তকে, এইভাবে খেলো না তুমি আমার সঙ্গে, এমন মজা করো না, আমি এরকম বারবার মরতে পারবো না অনন্ত।
তুমি মরছো? ওপরের গাছেদের মাথার ফালির ভাঁজে ভাঁজে ছলকে ছলকে রোদ্দুর গড়িয়ে পড়ছে। আর সত্যিই অরণ্যে মিহি বাতাস ওঠায় এক অদ্ভুত মিহি দেহমন আচ্ছন্ন করা সুর উঠেছে।
এমন মাতাল করা সুর, অভিভূত বোধে মাঝখানের সময়টা পুরো ভুলে সেতু আমূল জড়িয়ে ধরে অনন্তকে। অনন্তের গায়ে একটা অদ্ভুত সুন্দর মাতাল করা ঘ্রাণ, সব বেদনা রশ্মির ওপর গিয়ে অনন্তকে পুরোটাই উপভোগ করার স্পৃহায় সেতু আচমকা চুম্বন করে তাকে।
এখানে না, এখানে না, অনন্ত সচকিত হয়ে ওঠে। ভুলে যেয়ো না, আমরা দম্পতি। বনের মধ্যে এসব কা- করে প্রেমিক-প্রেমিকারা।
যেন ঝিল্লিমুখর পূর্ণিমারাত্রির গায়ে কেউ ঢিল ছুড়ল। যেন ছলকে এক কালো মেঘ ঢেকে দিলো সেতুর মুখ, তার মানে, বিয়ের পর প্রেমিক-প্রেমিকাদের মতো আমাদের স্পৃহা থাকতে নেই, আমাদের লিগ্যাল ঘর আছে বলে আমাদের মধ্যে আর প্রেম থাকতে নেই।
কেন তা থাকবে না? এইবার অনন্ত জড়িয়ে ধরে সেতুকে, আমি জানতাম এই পয়েন্টে এমনই রিঅ্যাক্ট করবে তুমি, বলে দুজন যখন একজন আরেকজনের খোলসগুলো খুলছে… তখন কাছেই কোথাও হলো রোল আর আর্তনাদ-ধ্বনি, শুনে সচকিত হতেই সেতু দেখে, তার প্রাণকে শূন্য করে অনন্ত চলে গেছে।
বিমূঢ় বিস্ময়ে আত্মার কান্নার হলাহল নিয়েও সে স্থবিরের মতো সেই কোরাসের দিকে এগিয়ে যায়, এতো রকম চিৎকার-ধ্বনির মধ্যে একটাই উচ্চকিত বেশি, এ কী করে হয়?
চিত্রার্পিতের মতো আলুথালু সেতু ভিড়ের কাছটায় যেতেই ওকে দেখে অনেকে সরে যায়।
ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দেখে সেতু, একটা রক্তেভেজা ডালের কাছে হুবহু কিছু আগের অনন্ত মরে পড়ে আছে।
No comments