বাংলাদেশে অডিও সিডি-ভিসিডি বিক্রি বন্ধ, লাইক-সাবসক্রাইবার বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় প্রযোজকরা by শফিক রহমান

এক ধরনের ধসের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের অডিও সিডি-ভিসিডির মার্কেট। বন্ধ হয়ে গেছে দেশটির এক সময়ের ক্যাসেট এবং কিছু দিন আগের অডিও সিডি-ভিসিডির প্রযোজনা ও বিক্রয়ের একমাত্র হাব হিসেবে পরিচিত পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর বিক্রয় কেন্দ্রগুলো। আগে পাটুয়াটুলীর নূরুল হক মার্কেট, সালাম ম্যানশন, হাজী নূর মার্কেট এবং আরেফিন প্লাজাসহ আশপাশের মার্কেট থেকে অখ্যাত-বিখ্যাত নানা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে প্রকাশ হতো বাউল, বিচ্ছেদ, জারি-সারি, পালাগান, ইসলামী গজল, হামদ-নাত, ওয়াজ, কোরআন তেলাওয়াতসহ আধুনিক ও ব্যান্ড সঙ্গীতের জনপ্রিয়সব ক্যাসেট। প্রায় দেড় দশক আগে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো জড়ো হয়েছিল ওই এলাকারই ঐতিহাসিক ও আলোচিত মুন সিনেমা হল ভেঙ্গে গড়ে ওঠা মুন কমপ্লেক্সের তৃতীয় তলায়।
সম্প্রতি ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যায় নগরীর ব্যস্ততম ওই অংশের ঘড়ি, চশমা, কাপড় ও বোরকার দোকানের হাজার ওয়াটের লাইটের নিচে বসে বিক্রেতারা যখন পাইকারি ক্রেতাদের নিয়ে ব্যস্ত, যখন  সামনের ছোট-চাপা রাস্তায় রিকশা, ভ্যান আর ঠেলা গাড়ির ঠাসা-ঠাসি, তখন মুন কমপ্লেক্সের তৃতীয় তলায় অডিও সিডি-ভিসিডির মার্কেট জুড়ে অন্ধকার। সাটার নামানো দোকানগুলো ঘিরে তৈরি হয়েছে ভৌতিক এক নিরবতা। দুই একটি দোকানে আলো জ্বলছে। সেগুলোর সামনের অংশে সিডি-ভিসিডি বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড থাকলেও ভেতরে কাজ করছে পাঞ্জাবি, বোরকা ও টি শার্ট প্যাকেজিং এর শ্রমিকরা। এর মধ্যেই খুঁজে পাওয়া গেল ‘মা সিডি ভিশন’।
প্রতিষ্ঠানটির মালিক শিবু কৌতুহলী হয়ে নড়েচড়ে বসে জানালেন, ‘বিক্রি নাই, ব্যবসা বন্ধ।’ সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, ফেসবুক, ইউটিউবের যুগে এসবের কি আর চাহিদা থাকে?
শিবু জানান, তিনি মুলত বাউল, বিচ্ছেদ, জারি-সারি ও পালা গানের ক্যাসেট প্রযোজনা ও বিক্রি করতেন। ১৯৮৪ সালে জনি এন্টারপ্রাইজের ব্যানারে প্রথম প্রকাশ করেন মালেক সরকারের গাওয়া সুলায়মান পয়গম্বরের জারির ক্যাসেট। এর ধারাবাহিকতায় একে একে প্রকাশ করেন ঐতিহাসিক চরিত্র হানিফ পালোয়ান, সোহরাব-রুস্তুম, মা ফাতেমার শক্তি পরীক্ষাসহ নানা শিরোনামের জারি গানের ক্যাসেট।
শিবু আরও জানান, ১৯৯৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘মা সিডি ভিশন’ এবং ওই বছরই তিনি প্রথম প্রকাশ করেন লোক সঙ্গীত শিল্পী মমতাজের ‘মরার কোকিলে’ সিডিটি। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সিডিটির শিরোনামের গানটি পৌঁছে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। শিবুর দাবি, এই গানটির মাধ্যমেই মমতাজ যুক্ত হন সঙ্গীত জগতের ‘মূল ধারায়’। তিনি বলেন, মমতাজের খ্যাতি আগেও ছিল। কিন্তু তা পালা গানের শিল্পী হিসেবে। এই গানটিই তাকে এনে দেয় ভিন্ন পরিচয়।
পরবর্তীতে মমতাজ সমান তালে গেয়েছেন রেডিও, টেলিভিশন, দেশি-বিদেশি কনসার্টসহ নানা অনুষ্ঠানে। পরিচিতি পেয়েছেন বাংলাদেশের ফোক সম্রাজ্ঞী হিসেবে।
জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন প্রথমে সংরক্ষিত মহিলা আসনে। বর্তমানে নির্বাচিত।
জানা গেছে, পাকিস্তান আমলেই পাটুয়াটুলিতে দেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির গোড়াপত্তন ঘটে। বিশেষ করে তখন দুই তিনটি ব্যবসায়ি প্রতিষ্ঠান গ্রামোফোন থেকে গান-মিউজিক কপি করে বিক্রি শুরু করে। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিস ওউনারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমআইবি) জানায়, এর ধারাবাহিকতায় ওই এলাকায় ১১২টি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। যদিও সারা দেশে তখন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৭১টি।
ক্ষিণ আলোতে মোবাইলের ক্যামেরায় সারি সারি বন্ধ দোকানের ছবি তুলতে গেলে উদ্দেশ্য জানতে চান স্বপন দাস। নিজেকে ‘সুর সঙ্গীত’ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের মালিক পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘ব্যবসায়ী হিসেবে আমরা বুদ্ধিমান না। এক সময় যখন ক্যাসেট বের করা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম ততোদিনে বাজার দখল করে নিয়েছে অডিও সিডি-ভিসিডি। ওই সময় আর্থিকভাবে বড় একটা ধরা খেয়েছি। পরে আবার যখন সিডি-ভিসিডি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি ততোদিনে ফেসবুক, ইউটিউবের যুগ চলে এসেছে। আবার আর্থিক ক্ষতি।’
তবে এবার ক্ষতির ধকল কাটিয়ে ওঠার চেষ্টার কথা জানালেন স্বপন দাস। তিনি বলেন, ‘ইউটিউবে সুরসঙ্গীত’ নামে একটি চ্যানেল খুলেছি। পুরোনো প্রযোজনাগুলো ওখানে ছাড়া হয়েছে। নতুনগুলোও ছাড়া হচ্ছে। তাতে খরচ কিছুটা উঠে আসা শুরু হয়েছে।’
স্বপন দাস জানান, তার বাবা সুবল চন্দ্র দাস ছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত ঢোল বাদক। ১৯৯৪ সালে তিনিই শুরু করেন ‘সুর সঙ্গীত’ এবং প্রতিষ্ঠানটির লোগো হিসেবে রাখেন ঢোলকে। তাদের প্রথম এবং বিখ্যাত প্রযোজনা মমতাজের ‘ভাব বৈঠকী’।
ইউটিউবে সার্চ দিয়ে দেখা গেল বাংলার ঢোলের ছবি দিয়ে তৈরি করা লোগো এবং ‘সুরসঙ্গীতে’র ব্যানারে ইতোমধ্যে ১৯৪টি ভিডিও আপ হয়েছে। শুরুতেই দেখা যায় মমতাজের ছবি সম্বলিত সেই অ্যালবামটি। যার শিরোনামে লেখা রয়েছে ‘মমতাজের শ্রেষ্ঠ অ্যালবাম-ভাববৈঠকী’। এক বছর আগে আপ হওয়া অ্যালবামটি ইতোমধ্যে ভিউয়ারের সংখ্যা পার করেছে ১২ লাখ ৩৪ হাজার।
এদিকে একই তথ্য জানালেন এমআইবি’র সেক্রেটারি জেনারেল এবং সেন্ট্রাল মিউজিক এন্ড ভিডিওস (সিএমভি)-এর কর্ণধার শাহেদ আলী পাপ্পু। তিনি বলেন, অডিও সিডি-ভিসিডি’র দোকান কেন্দ্রীক ব্যবসা বন্ধ। ব্যবসাটা এখন করপোরেট পর্যায়ে চলে গেছে। মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো আমাদের কাছ থেকে কনটেন্ট নেয়। এছাড়া ফেসবুক গ্রুপ আছে, ইউটিউবে চ্যানেল আছে।
আয়ের হিসাব বিশেষ করে দোকান ভিত্তিক বিক্রির তুলনায় বর্তমান প্রক্রিয়ায় আয় বেশি না কম জানতে চাইলে শাহেদ আলী পাপ্পু বলেন, পুরনো একটি ধারা থেকে একেবারেই নতুন একটি পথে আমরা চলতে শুরু করেছি। এ পথে আয় আসছে কিন্তু পুরো মাত্রায় আসতে হয়তো একটু সময় লাগবে।
ইউটিউবে সার্চ দিয়ে দেখা গেল সিএমভি’র সাবসক্রাইবার ১.৫ মিলিয়ন ছাড়িয়েছে।
এছাড়া সিডি চয়েসের ০.৫ মিলিয়ন, সিডি ভিশনের ০.২ মিলিয়ন, সুরঞ্জলীর ০.৬ মিলিয়ন, মিউজিক হেভেনের ০.৭ মিলিয়ন, বাউল মেলার ০.২ মিলিয়ন, চেনাসুরের ০.২ মিলিয়ন, লেজার ভিশনের ০.৭ মিলিয়ন, অনুপমের ০.১ মিলিয়ন, সাউন্ডটেকের ১.৪ মিলিয়ন, সঙ্গীতার ০.২ মিলিয়ন। তবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সাবসক্রাইবার জি সিরিজের থলিতে। তাদের মোট সংখ্যা ২.৪ মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। আর সবচেয়ে কম সুরের মেলার। তাদের মাত্র ২৭টি।
এদের মধ্যে ‘সঙ্গীতা’ শুরু হয় আশির দশকের শুরুর দিকে। প্রতিষ্ঠানটির আদি নাম ছিল সামাদ ইলেক্ট্রনিকস। পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘সঙ্গীতা’। বাংলাদেশের বিখ্যাত শিল্পীদের অধিকাংশ গানই সঙ্গীতার ব্যানারে বাজারে এসেছে।
মুলত ওই আশির দশককেই বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির বিকাশের দশক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর ধারাবাহিকতা চলে পরের দশক জুড়েও। ওই সময়ের মধ্যে বের হওয়া অধিকাংশ অ্যালবামই আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা পায়।
তবে শুধু প্রযোজনা ও বিক্রিই নয় ক্যাসেট প্রস্তুতেরও কেন্দ্র ছিল পাটুয়াটুলি। সাউন্ডটেক ও কেটি ছিল মূল প্রস্তুতকারক। যদিও প্রতিষ্ঠান দুটি স্থানীয়ভাবে শুধু ক্যাসেটের কেসিং তৈরি করতো এবং তার মধ্যে আমদানি করা টেপ বসিয়ে দিত। পরবর্তীতে সাউন্ডটেক প্রযোজনা প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় এবং বের করে জনপ্রিয়সব গানের অ্যালবাম।
ইউটিউবে সাউন্ডটেকের দুটি সেকশন দেখা যাচ্ছে। একটি সাউন্ডটেক মিউজিক, আরেকটি সাউন্ডটেক নাটক। অন্যান্য প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোরও এমন একাধিক সেকশন দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে লেজার ভিশনের সেকশনগুলোর মধ্যে বাড়তি দেখা যাচ্ছে ‘লেজার ভিশন বাউলিয়ানা’; ‘লেজার ভিশন মুভি’ ও ‘লেজার ভিশন ডকুমেন্টারি’।
তবে প্রতিষ্ঠিত সবকয়টি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানেরই কমন একটি সেকশন ‘ইসলামিক’। যেখানে রয়েছে ইসলামিক গান, কোরআন তেলাওয়াত ও ওয়াজ।
‘পরিবর্তন’ তা যে ধরনেরই হোক তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন মিউজিক শিল্প উদ্যোক্তারা। গ্রামোফোন থেকে ক্যাসেট, ক্যাসেট থেকে সিডি-ভিসিডি-ডিভিডি। এবার ডিজিটাল প্রযুক্তিতে লাইক-সাবসক্রাইবার বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। সঙ্গীত চলছেই।

No comments

Powered by Blogger.