চার নেতার মুখে কোটা আন্দোলনের নেপথ্য কথা by ফররুখ মাহমুদ
বেনজির
এক ছাত্র বিক্ষোভ। স্বতঃস্ফূর্ত। লাখ লাখ ছাত্রের জমায়েত। ছিল না
সুনির্দিষ্ট কোনো নেতৃত্ব। আন্দোলনের ফল অবশ্য এখনো পরিষ্কার নয়। শুরুতে
ছাত্রলীগ এ আন্দোলনে তেমন কোনো বাধা না দিলেও এখন এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের
হাতে নানামুখী নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন কোটা আন্দোলনে যুক্তরা। হুমকি আর
ভয়ভীতির মধ্যে দিন কাটছে আন্দোলনের নেতাদের। তিন নেতাকে ডিবি পুলিশ তুলে
নিয়ে ছেড়েও দিয়েছে। কিন্তু এ ঘটনায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন তারা।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- কীভাবে গড়ে উঠলো এই আন্দোলন। আন্দোলনের মঞ্চ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের চার নেতার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছে মানজমিন। পেছনের দিনের ঘটনার বয়ানের পাশাপাশি তারা কথা বলেছেন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে।
আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ক হাসান আল মামুন বলেন, ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই আলোচনা শুরু করলেও প্রথম জমায়েত হই ১৭ই ফেব্রুয়ারি। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খানের কোটা নিয়ে বক্তব্য শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন পেজে শেয়ার হয়। এরপর থেকেই মূলত আলোচনা করতে থাকে শিক্ষার্থীরা। ১৭ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও পাবলিক লাইব্রেরি থেকে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে শাহবাগে যায়। মানববন্ধন করবে। কিন্তু পুলিশ বাধা দেয়। পরে রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করি। তিনি বলেন, আন্দোলনে অর্থ সহায়তা আসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। যারা লাইব্রেরিতে পড়ে এবং গ্রুপে যারা আছে তারা ৫ টাকা, ১০ টাকা দিয়ে সহায়তা করে। ওই টাকা দিয়ে ব্যানার করি। পুরো আন্দোলনটা এভাবেই পরিচালনা করি। মামুন বলেন, মানববন্ধনের পর আমরা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে সভা করি। ৪/৫ জন ছিল। পরে কমিটি হয়। কমিটি করার সময় আমরা সতর্ক থেকেছি যেন জামায়াত-শিবিরের কেউ না ঢুকে পড়ে। কারণ আমরা জানতাম এক সময় আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এভাবে ব্লেইম দেবে। প্রথমদিকে ছাত্রলীগ থেকে সমর্থন দেয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচির দিন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন নেতা হঠাৎ করে লাইব্রেরির সামনে বাধা দেয়। আমাকে মধুর ক্যান্টিনে নিয়ে যায়। বলা হয়, নেত্রী তো দাবি মেনেই নিছে। আবার আন্দোলন কেন? শূন্য পদ থেকে তো মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া হবে। নেত্রীর আশ্বাসে আমরা শান্ত হই। হঠাৎ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো, শূন্য পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাধারীদের প্রাধান্য দেয়া হবে। কোটাধারীদের মধ্য থেকে পাওয়া না গেলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে নেয়া হবে। পরে আমরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগের চেষ্টা করি। প্রতিটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেই। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করার চেষ্টা করি। কিন্তু পারিনি। আমরা সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করি এটা সময়ের দাবি। এটা প্রয়োজন। মামুন আরো বলেন, এরপর হাইকোর্টের মোড়ে পুলিশ আমাদের ওপর টিয়ারশেল মারে। আমরা একটা ইটও ছুড়িনি। একটা গাছের পাতাও ছিঁড়িনি। ৮ই এপ্রিল শাহবাগ মোড়ে বসার পেছনে একটা কারণ ছিল। সেদিন জাতীয় সংসদের অধিবেশন ছিল। আমরা চেয়েছি সেখানে এ বিষয়টি উঠুক। সবাই আলোচনা করুক। আমাদের একটা আশ্বাস দিক। কয়েকজন সংসদ সদস্যের সঙ্গেও আলোচনা করি। সংসদে উপস্থাপনের জন্য বলি। কিন্তু তারা করেননি। পুলিশকে বলেছি, আমাদের আশ্বাস দেয়া হোক। কোটা সংস্কার করা হবে। এর মধ্যে আমরা অ্যাম্বুলেন্সসহ রোগীদের গাড়ি পারাপারের সুযোগ দেই। পরে সাড়ে ৭টার পর পুলিশ অ্যাটাক করলো। এমন ভাবে করলো ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমি ১০০টি রাবার বুলেট সংগ্রহ করি যেগুলো বিস্ফোরিত হয়নি। তিনি বলেন, আমরা এখন নিরাপদ নই। আমাদের নামে নানারকমের প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। এসব অভিযোগের ভিত্তি নেই। বাংলাদেশে সবচেয়ে স্বচ্ছ একটা আন্দোলন করেছি। ভিসির বাসায় হামলার বিষয়েও আমরা জড়িত ছিলাম না। ভালো করে তদন্ত করলে সত্যটা বের হয়ে আসবে।
যুগ্ম সমন্বয়ক মোহাম্মদ রাশেদ খান বলেন, ১৭ই ফেব্রুয়ারির পর বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছি। ৮ই এপ্রিল কর্মসূচি দেয়ার আগে ১৪/১৫ দিনের একটা বিরতি দিই। বিরতি দেয়ার কারণ এই সময়টাতে দেশের মানুষকে আমরা আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন করি। লিফলেট বিতরণ করি। পরে ৮ই এপ্রিল শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পুলিশ হামলা করে। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা অন্যরকম ইতিহাস তৈরি করেছে। এক ছাত্রের বিপদে আরেক ছাত্র এগিয়ে এসেছে। ছাত্রীরা এগিয়ে এসেছে। শাহবাগে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ টিয়ারশেল, গুলি ছুড়েছে এ খবর জানার পর হলে কেউ বসে থাকেনি। সবাই দলে বেঁধে শাহবাগে চলে এসেছে। যে তিন নেতাকে পুলিশ তুলে নিয়েছিল তাদের মধ্যে রাশেদ একজন। তিনি বলেন, গুম করার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। হাতকড়া পরানো হয়েছিল। কিন্তু মিড়িয়ায় প্রচার হওয়ার কারণে ছাড়া পেয়েছি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুফিয়া কামাল হল থেকে ছাত্রীদের রাতের আঁধারে বের করে দিয়েছে হল প্রশাসন। এটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারী নির্যাতন। যেটা বাংলাদেশে আগে হয়নি। ঘটনার প্রতিবাদে লাইব্রেরির সামনে প্রোগ্রাম করতে চেয়েছিলাম। সেখানে একটি মহল আগে থেকে অবস্থান নেয়। আমরা পরে বাধ্য হয়ে প্রোগ্রাম রাজু ভাস্কর্যে স্থানান্তর করি। সেখানেও বাধা দেয়। আন্দোলন করার অধিকার তো সংবিধানে স্বীকৃত। তারপরও কেন বাধা? একটি মহল আমাদের ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয় দেখাচ্ছে। যাতে প্রোগ্রামে তারা না আসতে পারে। বিভিন্ন হল থেকে বের করে দিয়েছে। আতঙ্ক তৈরি করছে। ফেসবুকে একটা গ্রুপ খুলেছে। সেখানে আমাদের ছবি দিয়ে বলা হচ্ছে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানে হামলা করা হবে। বিভিন্নভাবে গালিগালাজ করছে। রাশেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেছি। নিরাপত্তা চেয়েছি। কিন্তু প্রশাসন নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা করেনি। বাইরে বের হলে কিছু লোক ফলো করে।
আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। অনিরাপদ রয়েছি। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে না তাই সরকারের কাছ থেকে আমরা নিরাপত্তা চাই। আমাদের আন্দোলন কোনো সরকার বিরোধী আন্দোলন ছিল না। সরকার বিরোধী কোনো স্লোগান দিইনি। রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের মারধর করা হয়েছে। প্রোগ্রাম করতে দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, ফেসবুক আইডি খুলতে পারছি না। যে আইডি ছিল সেটি তারা রিপোর্ট করে, হ্যাকড করে নষ্ট করে দিয়েছে। পরে আইডি খোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তারা রিপোর্ট করে বন্ধ করে দেয়। সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারছি না। গেজেটের বিষয়ে রাশেদ বলেন, আমরা অপেক্ষা করছি। প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি দেশে এসেছেন। গেজেট প্রকাশের জন্য আমরা যথেষ্ট অপেক্ষা করেছি। দ্রুত গেজেট প্রকাশ না করলে কেন্দ্রীয় কমিটি বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানানো হবে। মামলা উঠিয়ে নেয়ার জন্য আলটিমেটাম দেয়া আছে। কারণ অজ্ঞাতনামা মামলা দিয়ে রাঘব বোয়ালদের বাঁচিয়ে দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি করবে। আলটিমেটাম শেষ হলে আমরা বসে সিদ্ধান্ত নেবো। আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য ভিসির বাসায় হামলা চালানো হয়েছিল। এই হামলার সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জড়িত না।
আরেক যুগ্ম সমন্বয়ক নূরুল হক নূর গেজেট প্রকাশের বিষয়ে বলেন, আমরা চেয়েছি কোটা সংস্কার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিল করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের আস্থা আছে। তিনি এতদিন বাইরে ছিলেন। আশা করি দ্রুত গেজেট প্রকাশ করা হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করছে। কারণ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, এইচ টি ইমামসহ আরো কয়েকজন বলেছেন, কোটা বাতিল হবে না। এটা সংস্কার করা হবে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বাতিল করা হয়েছে সেখানে ওনারা এটা কিভাবে বলেন। এ নিয়ে সবার মধ্যে একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা শঙ্কা রয়েছে। তবে আমরা বরাবরই বলে এসেছি মন্ত্রী বা সচিব কে কি বললো সেটা বিবেচনার বিষয় নয়। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু বলেছেন তাই আমরা ধরে নিচ্ছি কোট পদ্ধতি বাতিল হচ্ছে। মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলে এসেছি সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত নয়। ভিসির বাসায় হামলার ঘটনায় মিড়িয়াতে অসংখ্য নিউজ হয়েছে। প্রমাণ এসেছে। ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। সেখানে অনেককে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের নামে মামলা দেয়া হোক। অজ্ঞাতনামা দিয়ে কোনো মামলা রাখা যাবে না। তিনি বলেন, ৮ই এপ্রিল রাতে পরিকল্পিতভাবে ক্যাম্পাসকে রণক্ষেত্র করা হয়েছে। বহিরাগত এনে রড, রামদা নিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর। গুলি করা হয়েছে। যারা বহিরাগত নিয়ে এসেছে তাদের বিচার হওয়া উচিত। বহিরাগত কারা নিয়ে এসেছে সেটা মিড়িয়ায় এসেছে। এই বহিরাগতরাই ভিসির বাসায় হামলা চালিয়েছে। পুলিশের হামলার সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েও পাননি বলে জানান নূর। তিনি বলেন, রাত ৯টার দিকে ভিসির বাসার সামনে যাই। হ্যান্ডমাইক দিয়ে ভিসি স্যারকে আহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে আহ্বান করি। আমরা বলেছি, স্যার আপনার সন্তানদের ওপর পুলিশ গুলি করছে, টিয়ারশেল মারছে। প্লিজ স্যার একটু আসেন। কিন্তু তিনি আসেননি। আমাদের সঙ্গে কথা বলেননি। ১৫ মিনিট বাসার সামনে অবস্থান করে পরে আমরা চলে আসি।
অপর যুগ্ম সমন্বয়ক ফারুক হাসান বলেন, লাইব্রেরিতে যারা পড়তো তারাই এই আন্দোলন শুরু করে। পরে সবার মাঝে এটি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, আন্দোলনের এ পর্যায়ে এসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। অনেকে বলেছেন তাদের হুমকি দেয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসে সবার মাঝে আতঙ্ক কাজ করছে। কেউ আগের মতো পড়াশোনা বা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না। আমাদের তিনজনকে তুলে নেয়ার পর এই আতঙ্ক আরো বেড়েছে। যে কাউকেই তুলে নিয়ে যেতে পারে- এমন আতঙ্ক সবার মধ্যে কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, মামলা প্রত্যাহারের আলটিমেটাম শেষ হলে কেন্দ্রীয় কমিটি বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবো।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- কীভাবে গড়ে উঠলো এই আন্দোলন। আন্দোলনের মঞ্চ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের চার নেতার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছে মানজমিন। পেছনের দিনের ঘটনার বয়ানের পাশাপাশি তারা কথা বলেছেন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে।
আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ক হাসান আল মামুন বলেন, ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই আলোচনা শুরু করলেও প্রথম জমায়েত হই ১৭ই ফেব্রুয়ারি। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খানের কোটা নিয়ে বক্তব্য শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন পেজে শেয়ার হয়। এরপর থেকেই মূলত আলোচনা করতে থাকে শিক্ষার্থীরা। ১৭ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও পাবলিক লাইব্রেরি থেকে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে শাহবাগে যায়। মানববন্ধন করবে। কিন্তু পুলিশ বাধা দেয়। পরে রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করি। তিনি বলেন, আন্দোলনে অর্থ সহায়তা আসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। যারা লাইব্রেরিতে পড়ে এবং গ্রুপে যারা আছে তারা ৫ টাকা, ১০ টাকা দিয়ে সহায়তা করে। ওই টাকা দিয়ে ব্যানার করি। পুরো আন্দোলনটা এভাবেই পরিচালনা করি। মামুন বলেন, মানববন্ধনের পর আমরা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে সভা করি। ৪/৫ জন ছিল। পরে কমিটি হয়। কমিটি করার সময় আমরা সতর্ক থেকেছি যেন জামায়াত-শিবিরের কেউ না ঢুকে পড়ে। কারণ আমরা জানতাম এক সময় আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এভাবে ব্লেইম দেবে। প্রথমদিকে ছাত্রলীগ থেকে সমর্থন দেয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচির দিন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন নেতা হঠাৎ করে লাইব্রেরির সামনে বাধা দেয়। আমাকে মধুর ক্যান্টিনে নিয়ে যায়। বলা হয়, নেত্রী তো দাবি মেনেই নিছে। আবার আন্দোলন কেন? শূন্য পদ থেকে তো মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া হবে। নেত্রীর আশ্বাসে আমরা শান্ত হই। হঠাৎ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো, শূন্য পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাধারীদের প্রাধান্য দেয়া হবে। কোটাধারীদের মধ্য থেকে পাওয়া না গেলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে নেয়া হবে। পরে আমরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগের চেষ্টা করি। প্রতিটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেই। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করার চেষ্টা করি। কিন্তু পারিনি। আমরা সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করি এটা সময়ের দাবি। এটা প্রয়োজন। মামুন আরো বলেন, এরপর হাইকোর্টের মোড়ে পুলিশ আমাদের ওপর টিয়ারশেল মারে। আমরা একটা ইটও ছুড়িনি। একটা গাছের পাতাও ছিঁড়িনি। ৮ই এপ্রিল শাহবাগ মোড়ে বসার পেছনে একটা কারণ ছিল। সেদিন জাতীয় সংসদের অধিবেশন ছিল। আমরা চেয়েছি সেখানে এ বিষয়টি উঠুক। সবাই আলোচনা করুক। আমাদের একটা আশ্বাস দিক। কয়েকজন সংসদ সদস্যের সঙ্গেও আলোচনা করি। সংসদে উপস্থাপনের জন্য বলি। কিন্তু তারা করেননি। পুলিশকে বলেছি, আমাদের আশ্বাস দেয়া হোক। কোটা সংস্কার করা হবে। এর মধ্যে আমরা অ্যাম্বুলেন্সসহ রোগীদের গাড়ি পারাপারের সুযোগ দেই। পরে সাড়ে ৭টার পর পুলিশ অ্যাটাক করলো। এমন ভাবে করলো ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমি ১০০টি রাবার বুলেট সংগ্রহ করি যেগুলো বিস্ফোরিত হয়নি। তিনি বলেন, আমরা এখন নিরাপদ নই। আমাদের নামে নানারকমের প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। এসব অভিযোগের ভিত্তি নেই। বাংলাদেশে সবচেয়ে স্বচ্ছ একটা আন্দোলন করেছি। ভিসির বাসায় হামলার বিষয়েও আমরা জড়িত ছিলাম না। ভালো করে তদন্ত করলে সত্যটা বের হয়ে আসবে।
যুগ্ম সমন্বয়ক মোহাম্মদ রাশেদ খান বলেন, ১৭ই ফেব্রুয়ারির পর বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছি। ৮ই এপ্রিল কর্মসূচি দেয়ার আগে ১৪/১৫ দিনের একটা বিরতি দিই। বিরতি দেয়ার কারণ এই সময়টাতে দেশের মানুষকে আমরা আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন করি। লিফলেট বিতরণ করি। পরে ৮ই এপ্রিল শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পুলিশ হামলা করে। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা অন্যরকম ইতিহাস তৈরি করেছে। এক ছাত্রের বিপদে আরেক ছাত্র এগিয়ে এসেছে। ছাত্রীরা এগিয়ে এসেছে। শাহবাগে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ টিয়ারশেল, গুলি ছুড়েছে এ খবর জানার পর হলে কেউ বসে থাকেনি। সবাই দলে বেঁধে শাহবাগে চলে এসেছে। যে তিন নেতাকে পুলিশ তুলে নিয়েছিল তাদের মধ্যে রাশেদ একজন। তিনি বলেন, গুম করার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। হাতকড়া পরানো হয়েছিল। কিন্তু মিড়িয়ায় প্রচার হওয়ার কারণে ছাড়া পেয়েছি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুফিয়া কামাল হল থেকে ছাত্রীদের রাতের আঁধারে বের করে দিয়েছে হল প্রশাসন। এটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারী নির্যাতন। যেটা বাংলাদেশে আগে হয়নি। ঘটনার প্রতিবাদে লাইব্রেরির সামনে প্রোগ্রাম করতে চেয়েছিলাম। সেখানে একটি মহল আগে থেকে অবস্থান নেয়। আমরা পরে বাধ্য হয়ে প্রোগ্রাম রাজু ভাস্কর্যে স্থানান্তর করি। সেখানেও বাধা দেয়। আন্দোলন করার অধিকার তো সংবিধানে স্বীকৃত। তারপরও কেন বাধা? একটি মহল আমাদের ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয় দেখাচ্ছে। যাতে প্রোগ্রামে তারা না আসতে পারে। বিভিন্ন হল থেকে বের করে দিয়েছে। আতঙ্ক তৈরি করছে। ফেসবুকে একটা গ্রুপ খুলেছে। সেখানে আমাদের ছবি দিয়ে বলা হচ্ছে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানে হামলা করা হবে। বিভিন্নভাবে গালিগালাজ করছে। রাশেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেছি। নিরাপত্তা চেয়েছি। কিন্তু প্রশাসন নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা করেনি। বাইরে বের হলে কিছু লোক ফলো করে।
আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। অনিরাপদ রয়েছি। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে না তাই সরকারের কাছ থেকে আমরা নিরাপত্তা চাই। আমাদের আন্দোলন কোনো সরকার বিরোধী আন্দোলন ছিল না। সরকার বিরোধী কোনো স্লোগান দিইনি। রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের মারধর করা হয়েছে। প্রোগ্রাম করতে দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, ফেসবুক আইডি খুলতে পারছি না। যে আইডি ছিল সেটি তারা রিপোর্ট করে, হ্যাকড করে নষ্ট করে দিয়েছে। পরে আইডি খোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তারা রিপোর্ট করে বন্ধ করে দেয়। সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারছি না। গেজেটের বিষয়ে রাশেদ বলেন, আমরা অপেক্ষা করছি। প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি দেশে এসেছেন। গেজেট প্রকাশের জন্য আমরা যথেষ্ট অপেক্ষা করেছি। দ্রুত গেজেট প্রকাশ না করলে কেন্দ্রীয় কমিটি বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানানো হবে। মামলা উঠিয়ে নেয়ার জন্য আলটিমেটাম দেয়া আছে। কারণ অজ্ঞাতনামা মামলা দিয়ে রাঘব বোয়ালদের বাঁচিয়ে দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি করবে। আলটিমেটাম শেষ হলে আমরা বসে সিদ্ধান্ত নেবো। আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য ভিসির বাসায় হামলা চালানো হয়েছিল। এই হামলার সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জড়িত না।
আরেক যুগ্ম সমন্বয়ক নূরুল হক নূর গেজেট প্রকাশের বিষয়ে বলেন, আমরা চেয়েছি কোটা সংস্কার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিল করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের আস্থা আছে। তিনি এতদিন বাইরে ছিলেন। আশা করি দ্রুত গেজেট প্রকাশ করা হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করছে। কারণ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, এইচ টি ইমামসহ আরো কয়েকজন বলেছেন, কোটা বাতিল হবে না। এটা সংস্কার করা হবে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বাতিল করা হয়েছে সেখানে ওনারা এটা কিভাবে বলেন। এ নিয়ে সবার মধ্যে একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা শঙ্কা রয়েছে। তবে আমরা বরাবরই বলে এসেছি মন্ত্রী বা সচিব কে কি বললো সেটা বিবেচনার বিষয় নয়। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু বলেছেন তাই আমরা ধরে নিচ্ছি কোট পদ্ধতি বাতিল হচ্ছে। মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলে এসেছি সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত নয়। ভিসির বাসায় হামলার ঘটনায় মিড়িয়াতে অসংখ্য নিউজ হয়েছে। প্রমাণ এসেছে। ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। সেখানে অনেককে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের নামে মামলা দেয়া হোক। অজ্ঞাতনামা দিয়ে কোনো মামলা রাখা যাবে না। তিনি বলেন, ৮ই এপ্রিল রাতে পরিকল্পিতভাবে ক্যাম্পাসকে রণক্ষেত্র করা হয়েছে। বহিরাগত এনে রড, রামদা নিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর। গুলি করা হয়েছে। যারা বহিরাগত নিয়ে এসেছে তাদের বিচার হওয়া উচিত। বহিরাগত কারা নিয়ে এসেছে সেটা মিড়িয়ায় এসেছে। এই বহিরাগতরাই ভিসির বাসায় হামলা চালিয়েছে। পুলিশের হামলার সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েও পাননি বলে জানান নূর। তিনি বলেন, রাত ৯টার দিকে ভিসির বাসার সামনে যাই। হ্যান্ডমাইক দিয়ে ভিসি স্যারকে আহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে আহ্বান করি। আমরা বলেছি, স্যার আপনার সন্তানদের ওপর পুলিশ গুলি করছে, টিয়ারশেল মারছে। প্লিজ স্যার একটু আসেন। কিন্তু তিনি আসেননি। আমাদের সঙ্গে কথা বলেননি। ১৫ মিনিট বাসার সামনে অবস্থান করে পরে আমরা চলে আসি।
অপর যুগ্ম সমন্বয়ক ফারুক হাসান বলেন, লাইব্রেরিতে যারা পড়তো তারাই এই আন্দোলন শুরু করে। পরে সবার মাঝে এটি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, আন্দোলনের এ পর্যায়ে এসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। অনেকে বলেছেন তাদের হুমকি দেয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসে সবার মাঝে আতঙ্ক কাজ করছে। কেউ আগের মতো পড়াশোনা বা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না। আমাদের তিনজনকে তুলে নেয়ার পর এই আতঙ্ক আরো বেড়েছে। যে কাউকেই তুলে নিয়ে যেতে পারে- এমন আতঙ্ক সবার মধ্যে কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, মামলা প্রত্যাহারের আলটিমেটাম শেষ হলে কেন্দ্রীয় কমিটি বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবো।
No comments