স্বজনদের কান্নায় ভারি সাভার by হাফিজ উদ্দিন
সাভার
বাজার বাসস্ট্যান্ডে স্মরণকালের ভয়াবহ রানা প্লাজা ধসে স্বজনহারাদের
কান্না, প্রতিবাদী শ্রমিকদের খণ্ড খণ্ড মিছিল আর স্লোগানে পালিত হয়েছে
পঞ্চম বর্ষ। গতকাল সকাল থেকেই ফুল হাতে শ্রমিকরা আসেন রানা প্লাজার
পরিত্যক্ত জমিতে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ বেদির সামনে। কেউ এসেছিলেন শ্রদ্ধা
জানাতে, কেউ এসেছিলেন স্বজনদের মৃত্যুভূমি একনজর দেখার জন্য। আবার কেউ
এসেছিলেন আর্থিক সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ নিয়ে। সকাল ৭টায় রানা প্লাজার
সামনে নির্মিত শহীদ বেদিতে নিহতদের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন
ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাভারের সংসদ সদস্য ডা. এনামুর রহমান।
এসময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ রাসেল হাসান, সহকারী কমিশনার
(ভূমি) প্রণব কুমার ঘোষসহ উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাগণ
উপস্থিত ছিলেন। এরপর ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সংবিধান প্রণেতা ড.
কামাল হোসেন, বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের উপদেষ্টা, মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, সাবেক এমপি
শাহ আবু জাফর। এসময় রানা প্লাজা ধসে নিহত ও আহত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা
পাঁচ বছর পূর্তিতে শ্রদ্ধা জানাতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আহাজারিতে
ভারি হয়ে উঠে এখানকার আকাশ বাতাস। এর আগে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের ব্যানারে
রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ ভবন ধসের ঘটনায় দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির
দাবি জানায় তারা। শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসে সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল
হোসেন বেতন-ভাতাসহ শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে মালিক-শ্রমিক ও
সরকারকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। পোশাক শিল্পকে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির
গুরুত্বপূর্ণ অংশ উল্লেখ করে শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য দ্রুত তাদের দাবি
মেনে নেয়ার কথা বলেন। এছাড়া রানা প্লাজা ধসের স্থানটির পবিত্রতা রক্ষার
জন্য সেখানে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
এছাড়া নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভসহ শ্রমিকদের জন্য
একটি হাসপাতাল নির্মাণ করার চেষ্টা চলছে বলেও জানান ড. কামাল হোসেন।
সুলতানা কামাল বলেন, রানা প্লাজা ধসকে অনেকেই দুর্ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন
করলেও আমি মনে করি এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। যারা এসব
প্রতিষ্ঠান এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন তারা তাদের দায়িত্বে
অবহেলা করেছিল বলেই এতো বড় একটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এই ধরনের ঘটনার যাতে আর
পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে
আহত শ্রমিকদের সঠিক চিকিৎসা ও পুনর্বাসন এবং নিহত-নিখোঁজ শ্রমিকদের উপযুক্ত
ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। সেদিনের কথা
মনে পড়লে শিওরে উঠেন রানা প্লাজার আহত শ্রমিক শিলা, বিউটি, মামুন, সাজু ও
রাশিদা বেগমরা। ভবন ধসের পাঁচ বছর পার হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।
মাথাব্যথা, হাত-পা ও পিঠের ব্যথা নিয়ে এখনো লড়ে যাচ্ছেন অনিশ্চিত জীবনের
সঙ্গে। পূর্ণ চিকিৎসা সেবার অভাবে শারীরিক এবং মানসিক সমস্যার কারণে
মানবেতর জীবনযাপন করছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। নিখোঁজ আঁখি আক্তারের মা হেনা বেগম
ডিএনএ টেস্ট করিয়েও মেয়ের লাশের সন্ধান পাননি। স্বামী শ্বাসকষ্টের রোগী
হওয়ায় তেমন কোনো কাজ করতে পারে না। সংসারের উপার্জনকারী মেয়েকে হারিয়ে
অভাব-অনটনে চলছে তার সংসার। এজন্য এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছোট মেয়ের পড়ালেখাও
বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষতিপূরণ কি চাইবেন তিনি তা নিয়ে ভাবেননি কখনও। মেয়ের
লাশটি পেলেও মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন জানান হেনা বেগম। তবে স্বামীর
চিকিৎসা এবং ছোট মেয়ের পড়ালেখার জন্য যদি সরকার কোনো ব্যবস্থা করে দিতো
তাহলে কোনো রকমে খেয়ে পরে চলে যেতে পারতেন বলে জানান এই মা। আহত শ্রমিক
আল্পনা খাতুন ধসে পড়া রানা প্লাজার ৭ তলায় সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করতো।
সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা এ মা বেতনের জন্য সেদিন সকাল ৮টায় কাজে যোগ দেন
কারখানায়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলে কিছুক্ষণ পর একটা ঝাঁকুনি
দিয়ে ধসে পড়ে রানা প্লাজা। দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় উদ্ধার হলেও
হাসপাতালে নেয়ার পথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। আগামী জুলাইয়ে ছেলে নীরবের ছয় বছর
পূর্ণ হবে। মাথা, পা ও কোমরসহ শরীরের একপাশ অবশ থাকায় এবং ছোট ছেলেকে রেখে
কোনো কাজই করতে পারেন না তিনি। এরপর ছেলে বড় হচ্ছে তাকে স্কুলে ভর্তি
করানো এবং সংসার চালানোর চিন্তা সবসময় তাকে তাড়া করে বেড়ায়। অভাবের সংসারে
নিজের ছেলেটাকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকারি
সহযোগিতার পাশাপাশি দোষীদের শাস্তি দাবি করেন আল্পনা। এসময় আরো শ্রদ্ধা
জানান গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড
ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স
সলিডারিটি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ
কমিউনিস্ট পার্টি, স্বাধীন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনসহ
বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং নিহত ও আহত শ্রমিকদের পরিবারের
সদস্যরাও শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অন্যদিকে রানা প্লাজার
পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে নিহত ও আহত শ্রমিকদের স্মরণে সাভার অধরচন্দ্র
উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া ধসে পড়া
রানা প্লাজার সামনেও নিহতদের স্মরণে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য
২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত নয় তলাবিশিষ্ট
রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ভবনটিতে থাকা ৫টি তৈরি পোশাক কারখানায় প্রায় সাড়ে তিন
হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করতো। পোশাক শিল্পের ইতিহাসে ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায়
মারা যায় ১১৩৬ জন শ্রমিক, জীবিত উদ্ধার করা হয় ২৪৩৮ জনকে। এর মধ্যে গুরুতর
আহত হয় ১১৬৯ জন। যারা প্রাণে বেঁচে আছে তারা জীবিত থেকেও মৃত এবং অসহনীয়
কষ্টে জীবনযাপন করছেন।
No comments