ইসলামভীতির ক্রসফায়ারে ইউরোপীয় মুসলিম by হোসাম শাকের
পশ্চিমের
দেশগুলোর অনেকেই এখন সন্ত্রাসী তৎপরতার জন্য ইসলামকে দায়ী করে।
প্রকারান্তরে এভাবেই দায়েশ বা ইসলামিক স্টেটকেই (আইএস) পুরস্কৃত করা হচ্ছে।
সন্ত্রাসীদের দাবি, তারা ইসলামের কট্টর অনুসারী। আর ইউরোপীয় বিশ্লেষকদের
মতে, ইসলাম ধর্মের ‘মৌলিক সংস্কারের’ প্রয়োজন- দুই পক্ষের মাঝে পড়ে খাবি
খাচ্ছে ইউরোপের মুসলমানরা। অসহনীয় একটা সময়ের মধ্যে যাচ্ছে তারা।
সন্ত্রাসীরা ইসলামকে বিকৃত করছে। আর এরই জেরে ইউরোপে মুসলিমবিদ্বেষী প্রচার চলছে। বৈষম্যের শিকার হচ্ছে মুসলমানরা। সমালোচকেরা দাবি তুলতে শুরু করেছেন, ধর্মে আমূল পরিবর্তন আনার। একই সাথে তাদের নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠ অবস্থান নিশ্চিত করারও চেষ্টা চলছে। এসব সমালোচক মুসলমানদের সাথে এমনভাবে কথা বলে যেন তারা প্রধান শিক্ষক। বিশৃঙ্খল শিক্ষার্থীদের শায়েস্তা করতে নেমেছে। তারা মুসলমানদের শুধু ‘বাড়ির কাজ’ দিয়েই থেমে নেই। চাপ দিয়ে ধর্মে ‘সংস্কার’ আনতেও তারা দৃঢ়প্রতীজ্ঞ।
ইউরোপের এসব সমালোচক কণ্ঠকে সাময়িকী আর পত্রিকার পাতায় কলামের পর কলাম জায়গা দেয়া হচ্ছে। টেলিভিশনে বিশেষভাবে সময় দেয়া হচ্ছে তাদের। সবাই মিলে মুসলমানদের হামলার কারণে তাদের কতটা বেদনা সৃষ্টি হয়েছে সেই বয়ানে ব্যস্ত। কেন এমন হচ্ছে সেই কারণ জানতে আগ্রহী নয় তারা। ইসলামের বাণী পড়ার আগ্রহও তাদের নেই; বরং মুসলমানদের বিশ্বাস নাকচ করে ধর্মকে বাতিল করে দিতেই তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
প্রথাগতভাবে ‘সংস্কার’ বা ‘পুনর্বিবেচনা’ বলতে যা বোঝায়, এসব তা নয়। সমালোচকেরা প্রকৃতপক্ষে এখন ধর্মের নিন্দায় ব্যস্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইউরোপে মুসলমানদের বলা হয়, ‘তোমার ধর্ম পুনর্বিবেচনা করো’ বা ‘তোমাদের ধর্মীয় নেতারা কী বলছেন বিশ্লেষণ করো, তাদের বিরোধিতা করতে পিছপা হয়ো না’- এখন আর অস্বাভাবিক কিছু নয়। সংখ্যাগুরুদের পক্ষ থেকে এ ধরনের দাবি উঠছে। তবে প্রশ্ন হলো, মুসলমানদের ধর্ম বাদ দেয়া বা পরিবর্তন করলেই কি বিশ্বে চলমান সন্ত্রাস থেমে যাবে? বাকিরা কি এমনটাই আশা করছেন?
যেসব বিশেষজ্ঞ হামলাকারীদের ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপট নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন তারা জানিয়েছেন, এসব জঙ্গি ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করেননি। তাদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা তেমন একটা নেই বললেই চলে। এরা ইউরোপের সরকারি স্কুলে লেখাপড়া করেছে, বেড়ে উঠেছে ক্রেতাবান্ধব সমাজে। সেখানেই মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা সঙ্কটের মুখে পড়ে তারা। তাদের বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কারণ সেখানেই প্রথিত।
অন্য দিকে মুসলিম বিশ্বে যে লড়াই এবং সঙ্কট চলছে তা-ও সন্ত্রাসী সহিংসতার নতুন নতুন সংস্করণ তৈরির অন্যতম কারণ। এসব সহিংসতার কালো মেঘই ইউরোপের দিকে উড়ছে।
ইউরোপে যে ব্যথা সৃষ্টি হয়েছে, সে প্রসঙ্গে আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। একগুঁয়ে কলাম লেখকেরা যেসব ভুল যুক্তি দেখিয়ে চলেছেন, সেগুলোর ছড়িয়ে পড়াও বন্ধ করার বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে। প্রতিটি সন্ত্রাসী হামলার পর ইসলাম ধর্মকে পুনর্বিবেচনা এবং সংস্কারের যে দাবি উঠছে, সেটাও ভুলে ভরা এবং পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। বর্তমানে সন্ত্রাসী হামলার যে স্রোত বয়ে চলেছে তার প্রকৃত কারণ অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। হামলার জন্য সরাসরি ইসলামকে দায়ী করে এর পেছনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণগুলোকে চাপা দেয়া হচ্ছে। ফলে সঙ্কট সমাধানের জন্য যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা প্রয়োজন তা-ও সম্ভব হচ্ছে না।
গত শতাব্দীতে যখন বামপন্থী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো নানা স্থানে হামলা চালিয়ে বেড়াচ্ছিল, তখন কি মার্কস ও এঙ্গেলসকে এর জন্য দায়ী করা হয়েছিল? মিয়ানমারে যে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন চলছে তার জন্য বুদ্ধকে দায়ী করা হয়েছে কখনো? লর্ড রেজিস্টেন্স আর্মি দাবি করেছে খ্রিষ্টান ঈশ্বরের আদেশে তারা উগান্ডায় তাণ্ডব চালিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সে কারণে তো খ্রিষ্টান ধর্মে পরিবর্তন আনার দাবি কেউ করছে না।
যারা সন্ত্রাসী হামলার জন্য ইসলামকে দায়ী করছে, তারা প্রকারান্তরে আইএসকেই পুরস্কৃত করছে। তাদের স্লোগানটিও গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। অর্থাৎ মূলধারার মুসলমানরা সন্ত্রাসকে যে ভাষাতেই নিন্দা জানান না কেন তা অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে।
সব ক্ষেত্রেই সংস্কারের প্রয়োজন। এটা আমাদের মানতে হবে। তবে কয়েকটি দেশ কি তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এনে সে সাহস দেখাতে পারবে? ইসরাইলের দখলদারিত্ব এবং তাদের নির্যাতনের নতুন ধারাকে সমর্থনকারী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলে তার ফলাফল কেমন দাঁড়াবে? অথবা গণতন্ত্রের ধার ধারে, এমন একনায়ক শাসকদের সাথে সম্পর্ক যদি পুনর্বিবেচনা করা হয়?
তবে যারা নীতিনির্ধারকদের বিরক্ত করতে চান না তারা ইতিহাস পুনর্বিবেচনা করে দেখতে পারেন। কারণ ইতিহাস থেকে আসা কম্পনই আমরা আজো অনুভব করে চলেছি। উদারহণ হিসেবে ঔপনিবেশিক আমলের কথা বলা যায়। তখন কয়েকটি দেশ যে তীব্র অনাচার-অত্যাচার চালিয়েছে আজ পর্যন্ত তার জন্য কারো বিচার হয়নি। কেউ ক্ষমা চায়নি।
ভিয়েনায় বসবাসকারী হোসাম শাকের গবেষক ও লেখক। ইউরোপ ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ এবং সামাজিক ও গণমাধ্যমের নানা বিষয় বিশ্লেষণে তার আগ্রহ রয়েছে। লেখাটির অনুবাদ করেছেন। তানজিলা কাওকাব
সন্ত্রাসীরা ইসলামকে বিকৃত করছে। আর এরই জেরে ইউরোপে মুসলিমবিদ্বেষী প্রচার চলছে। বৈষম্যের শিকার হচ্ছে মুসলমানরা। সমালোচকেরা দাবি তুলতে শুরু করেছেন, ধর্মে আমূল পরিবর্তন আনার। একই সাথে তাদের নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠ অবস্থান নিশ্চিত করারও চেষ্টা চলছে। এসব সমালোচক মুসলমানদের সাথে এমনভাবে কথা বলে যেন তারা প্রধান শিক্ষক। বিশৃঙ্খল শিক্ষার্থীদের শায়েস্তা করতে নেমেছে। তারা মুসলমানদের শুধু ‘বাড়ির কাজ’ দিয়েই থেমে নেই। চাপ দিয়ে ধর্মে ‘সংস্কার’ আনতেও তারা দৃঢ়প্রতীজ্ঞ।
ইউরোপের এসব সমালোচক কণ্ঠকে সাময়িকী আর পত্রিকার পাতায় কলামের পর কলাম জায়গা দেয়া হচ্ছে। টেলিভিশনে বিশেষভাবে সময় দেয়া হচ্ছে তাদের। সবাই মিলে মুসলমানদের হামলার কারণে তাদের কতটা বেদনা সৃষ্টি হয়েছে সেই বয়ানে ব্যস্ত। কেন এমন হচ্ছে সেই কারণ জানতে আগ্রহী নয় তারা। ইসলামের বাণী পড়ার আগ্রহও তাদের নেই; বরং মুসলমানদের বিশ্বাস নাকচ করে ধর্মকে বাতিল করে দিতেই তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
প্রথাগতভাবে ‘সংস্কার’ বা ‘পুনর্বিবেচনা’ বলতে যা বোঝায়, এসব তা নয়। সমালোচকেরা প্রকৃতপক্ষে এখন ধর্মের নিন্দায় ব্যস্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইউরোপে মুসলমানদের বলা হয়, ‘তোমার ধর্ম পুনর্বিবেচনা করো’ বা ‘তোমাদের ধর্মীয় নেতারা কী বলছেন বিশ্লেষণ করো, তাদের বিরোধিতা করতে পিছপা হয়ো না’- এখন আর অস্বাভাবিক কিছু নয়। সংখ্যাগুরুদের পক্ষ থেকে এ ধরনের দাবি উঠছে। তবে প্রশ্ন হলো, মুসলমানদের ধর্ম বাদ দেয়া বা পরিবর্তন করলেই কি বিশ্বে চলমান সন্ত্রাস থেমে যাবে? বাকিরা কি এমনটাই আশা করছেন?
যেসব বিশেষজ্ঞ হামলাকারীদের ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপট নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন তারা জানিয়েছেন, এসব জঙ্গি ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করেননি। তাদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা তেমন একটা নেই বললেই চলে। এরা ইউরোপের সরকারি স্কুলে লেখাপড়া করেছে, বেড়ে উঠেছে ক্রেতাবান্ধব সমাজে। সেখানেই মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা সঙ্কটের মুখে পড়ে তারা। তাদের বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কারণ সেখানেই প্রথিত।
অন্য দিকে মুসলিম বিশ্বে যে লড়াই এবং সঙ্কট চলছে তা-ও সন্ত্রাসী সহিংসতার নতুন নতুন সংস্করণ তৈরির অন্যতম কারণ। এসব সহিংসতার কালো মেঘই ইউরোপের দিকে উড়ছে।
ইউরোপে যে ব্যথা সৃষ্টি হয়েছে, সে প্রসঙ্গে আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। একগুঁয়ে কলাম লেখকেরা যেসব ভুল যুক্তি দেখিয়ে চলেছেন, সেগুলোর ছড়িয়ে পড়াও বন্ধ করার বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে। প্রতিটি সন্ত্রাসী হামলার পর ইসলাম ধর্মকে পুনর্বিবেচনা এবং সংস্কারের যে দাবি উঠছে, সেটাও ভুলে ভরা এবং পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। বর্তমানে সন্ত্রাসী হামলার যে স্রোত বয়ে চলেছে তার প্রকৃত কারণ অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। হামলার জন্য সরাসরি ইসলামকে দায়ী করে এর পেছনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণগুলোকে চাপা দেয়া হচ্ছে। ফলে সঙ্কট সমাধানের জন্য যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা প্রয়োজন তা-ও সম্ভব হচ্ছে না।
গত শতাব্দীতে যখন বামপন্থী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো নানা স্থানে হামলা চালিয়ে বেড়াচ্ছিল, তখন কি মার্কস ও এঙ্গেলসকে এর জন্য দায়ী করা হয়েছিল? মিয়ানমারে যে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন চলছে তার জন্য বুদ্ধকে দায়ী করা হয়েছে কখনো? লর্ড রেজিস্টেন্স আর্মি দাবি করেছে খ্রিষ্টান ঈশ্বরের আদেশে তারা উগান্ডায় তাণ্ডব চালিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সে কারণে তো খ্রিষ্টান ধর্মে পরিবর্তন আনার দাবি কেউ করছে না।
যারা সন্ত্রাসী হামলার জন্য ইসলামকে দায়ী করছে, তারা প্রকারান্তরে আইএসকেই পুরস্কৃত করছে। তাদের স্লোগানটিও গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। অর্থাৎ মূলধারার মুসলমানরা সন্ত্রাসকে যে ভাষাতেই নিন্দা জানান না কেন তা অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে।
সব ক্ষেত্রেই সংস্কারের প্রয়োজন। এটা আমাদের মানতে হবে। তবে কয়েকটি দেশ কি তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এনে সে সাহস দেখাতে পারবে? ইসরাইলের দখলদারিত্ব এবং তাদের নির্যাতনের নতুন ধারাকে সমর্থনকারী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলে তার ফলাফল কেমন দাঁড়াবে? অথবা গণতন্ত্রের ধার ধারে, এমন একনায়ক শাসকদের সাথে সম্পর্ক যদি পুনর্বিবেচনা করা হয়?
তবে যারা নীতিনির্ধারকদের বিরক্ত করতে চান না তারা ইতিহাস পুনর্বিবেচনা করে দেখতে পারেন। কারণ ইতিহাস থেকে আসা কম্পনই আমরা আজো অনুভব করে চলেছি। উদারহণ হিসেবে ঔপনিবেশিক আমলের কথা বলা যায়। তখন কয়েকটি দেশ যে তীব্র অনাচার-অত্যাচার চালিয়েছে আজ পর্যন্ত তার জন্য কারো বিচার হয়নি। কেউ ক্ষমা চায়নি।
ভিয়েনায় বসবাসকারী হোসাম শাকের গবেষক ও লেখক। ইউরোপ ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ এবং সামাজিক ও গণমাধ্যমের নানা বিষয় বিশ্লেষণে তার আগ্রহ রয়েছে। লেখাটির অনুবাদ করেছেন। তানজিলা কাওকাব
No comments