কুনিও হত্যা মামলার তদন্তে নতুন মোড়

কুনিও হোশি,সিজার তাবেলা
রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যার নয় সপ্তাহ পর মামলার তদন্ত নতুন মোড় নিয়েছে। শুরুতে এ ঘটনায় কুনিও হোশির এক ব্যবসায়িক সহযোগীসহ বিএনপির কয়েকজন স্থানীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এখন পুলিশ বলছে, এ হত্যায় নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি জড়িত।
মাসুদ রানা (৪০) নামে জেএমবির একজন ‘কমান্ডার’ গত সোমবার রংপুরের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে কুনিও হত্যাসহ রংপুরের সাম্প্রতিক তিনটি হামলার কথা স্বীকার করেছেন। স্বীকারোক্তির বিষয়টি গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন রংপুরের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল মালেক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
রংপুরে গত ৩ অক্টোবর জাপানি নাগরিক ও ঢাকায় ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালির নাগরিক হত্যায় বিএনপি-জামায়াত জড়িত থাকতে পারে বলে এর আগে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হয়েছিল। উভয় ঘটনায় ঢাকায় বিএনপির কয়েকজন স্থানীয় নেতা-কর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করে। এর মধ্যে ঢাকায় ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা হত্যার পরিকল্পনায় ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আবদুল কাইয়ুম জড়িত বলে পুলিশ দাবি করে। কাইয়ুমের ভাইকে গ্রেপ্তারও করা হয়।
গতকাল পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হুমায়ুন কবীর সাংবাদিকদের বলেন, জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে হত্যায় জড়িত জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাসুদই কুনিওকে গুলি করেছেন। তিনি বলেন, এই মাসুদ গত ১০ নভেম্বর কাউনিয়ায় মাজারের খাদেম রহমত আলীকে হত্যা এবং ৮ নভেম্বর বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা রুহুল আমিনকে গুলি করে হত্যার চেষ্টায় জড়িত ছিলেন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি বলেন, ‘জাপানি নাগরিক হত্যা ঘটনার আলামত ও সাক্ষ্য-প্রমাণ পেয়েছি। আশা করি খুব শিগগির প্রকৃত ঘটনা আপনাদের জানাতে পারব।’
মাসুদ রানাকে কবে, কোথা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে বিষয়ে ডিআইজি কিছু বলেননি। পুলিশসহ স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, মাসুদ রানার বাড়ি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কল্যাণী ইউনিয়নের পশুয়া টাঙ্গাইলপাড়া গ্রামে। তাঁকে গত বৃহস্পতিবার বাড়ি থেকে আটক করা হয়েছে।
এই দুই বিদেশি নাগরিককে হত্যার পরপরই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেট) ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে দায় স্বীকার করে। সাইট নামে একটি মার্কিন নজরদারি সংস্থার বরাতে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে এ খবর বের হলে বাংলাদেশ সরকার তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে।
কুনিও হত্যা মামলায় এর আগে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ ও র্যা ব। তাঁরা হলেন কুনিওর ব্যবসায়িক সহযোগী হুমায়ুন কবির (হীরা), রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ-উন-নবী খান ওরফে বিপ্লব, মহানগর যুবদলের সদস্য রাজীব হাসান ওরফে মেরিল সুমন, শহরের জুম্মাপাড়ার নওশাদ হোসেন ওরফে ব্ল্যাক রুবেল ও শালবন মিস্ত্রিপাড়ার কাজল চন্দ্র বর্মণ ওরফে ভরসা কাজল। তাঁদের মধ্যে রাশেদ-উন-নবী হলেন বিএনপির ঢাকা মহানগরের যুগ্ম আহ্বায়ক হাবিব-উন-নবী খানের (সোহেল) ভাই। এ ঘটনায় তখন হাবিব-উন-নবী খানকে খুঁজেছিল পুলিশ। তিনি আত্মগোপনে আছেন।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় মাজারের খাদেম হত্যা ও রংপুরে বাহাই সম্প্রদায়ের এক নেতাকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় এর আগে ছয় ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। খাদেম হত্যায় গ্রেপ্তার তিন ব্যক্তি হলেন কাউনিয়ার মধুপুর ইউনিয়ন জামায়াতের সদস্য মোর্শেদ আলী, শহিদুল ইসলাম ও আবু রায়হান ওরফে রঞ্জু। বাহাই সম্প্রদায়ের নেতা ও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী রুহুল আমিন হত্যাচেষ্টার ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুর রহমান ওরফে নয়ন, শহরের ধাপ এলাকার আবু রায়হান ও সজলকে।
এখন তিনটি ঘটনাতেই জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন জেএমবির ‘আঞ্চলিক কমান্ডার’। এ অবস্থায় আগে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে পুলিশ কী করবে? জানতে চাইলে গতকাল রংপুরের ডিআইজি সরাসরি কোনো জবাব দেননি। তিনি কেবল বলেন, ‘এসব ঘটনার সঙ্গে একটি বিরাট সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে। সবকিছুই বেরিয়ে আসবে।’
কুনিও হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও কাউনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ বি এম জাহিদুল ইসলাম বলেন, পীরগাছা উপজেলার আরও দুজন জেএমবির জঙ্গি গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন। তাঁদের শিগগির গ্রেপ্তার করা হবে।
কুনিও হত্যা মামলায় আগে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বিএনপির স্থানীয় নেতাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে যাঁরা কারাগারের বাইরে আছেন, তাঁরা আত্মগোপনে, মুঠোফোনও বন্ধ।
কুনিও হোশির হত্যায় জেএমবি জড়িত থাকার খবর প্রকাশের পর ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেলা হত্যার তদন্তও নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
আইএসের নিজস্ব সাময়িকী দাবিক-এর সর্বশেষ সংস্করণে (১৮ নভেম্বর অনলাইনে প্রকাশিত) দুই বিদেশি হত্যাসহ চারটি ঘটনায় আইএসের দায় স্বীকার করা হয়। একই সঙ্গে জেএমবির প্রশংসা ও এর প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমানকে ‘শহীদ মুজাহিদ’ আখ্যা দেওয়া হয়। অপর দুটি হলো ঢাকায় হোসেনি দালানে ও আশুলিয়ায় পুলিশ হত্যার ঘটনা।
দাবিক-এর এ দাবিও বরাবরের মতোই সরকার ও পুলিশ প্রত্যাখ্যান করে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, বাংলাদেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব বা সাংগঠনিক তৎপরতা নেই। তাবেলা হত্যায় বিএনপি নেতা কাইয়ুম জড়িত। তাঁর ভাইকে দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
এ অবস্থায় ঢাকায় সিজার তাবেলা হত্যা মামলার তদন্ত আবার নতুন মোড় নেওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না—জানতে চাইলে মামলার তদন্ত-তদারক কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. মাহফুজুল ইসলাম গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে সিজার তাবেলা হত্যা মামলার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। রংপুরের প্রেক্ষাপটে এখন পর্যন্ত তাবেলার মামলার তদন্তে অন্য কিছু তাঁরা ভাবছেন না।
তদন্তসংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, সিজার তাবেলা হত্যায় বিএনপি নেতা কাইয়ুমসহ সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র তৈরি হচ্ছে। বাকি ছয়জন হচ্ছেন কাইয়ুমের ছোট ভাই এম এ মতিন, তামজিদ আহম্মেদ ওরফে রুবেল, রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল, মিনহাজুল আরেফিন ওরফে ভাগনে রাসেল, শাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরীফ ও ভাঙারি সোহেল। তাঁরা সবাই বাড্ডা এলাকার বিএনপির কর্মী-সমর্থক হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে এম এ কাইয়ুম ও ভাঙারি সোহেল ছাড়া সবাই গ্রেপ্তার আছেন। আর তামজিদ, রাসেল চৌধুরী, মিনহাজুল আরেফিন ও শাখাওয়াত হোসেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
যদিও মতিন, তামজিদ, রাসেল চৌধুরী, মিনহাজুল ও শাখাওয়াতের স্বজনেরা দাবি করে আসছেন, ওই পাঁচজন তাবেলা হত্যায় জড়িত নন। ডিবি ভয়ভীতি দেখিয়ে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করেছে।

No comments

Powered by Blogger.