প্রতারণার ভয়ঙ্কর ফাঁদ by মহিউদ্দিন অদুল

বর্ষার পানিতে ঢাকার আশপাশের বিলঝিলের জমির আইল বা সীমানা ডুবে গেলে সুবিধামতো জায়গায় বিশাল জমির মালিক বনে যান প্রতারক নিজাম মোল্লা। বর্ষা এলেই তার জমি বিক্রির ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বিভিন্নভাবে ভুলিয়ে কম মূল্যে অন্যের জমি বিক্রি করে দেন তিনি। সংশ্লিষ্ট এলাকার ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে জমির রেজিস্ট্রিও সম্পাদন করেন। তার এ প্রতারণার শিকার হয়েছেন অনেকে। তিন বছর আগে একই কায়দায় নিজাম মোল্লা আশুলিয়ায় মহাসড়কের পাশে সাড়ে চার লাখ টাকায় ১৬ শতক জমি বিক্রি করেন শাহবাগ বটতলা ক্ষুদ্রফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. আবুল কালাম আজাদকে। সম্প্রতি ওই জমি অন্য একজনকে বিক্রির চেষ্টার খরব পেয়ে জমিতে ছুটে যান আবুল কালাম। গিয়ে তাতে বাধা দেন। পরে জানতে পারেন ওই জমি আরও তিনজনের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। শেষে নিজাম মোল্লা ওই জমির মালিকই ছিলেন না জানতে পেরে হতবাক হয়ে যান তিনি। এরপর নিজাম মোল্লাকে এ প্রতারণায় হাতেনাতে ধরা হলে প্রতারণার কথা স্বীকার করে টাকা ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে আজ পর্যন্ত টাকা ফিরে পাননি তিনি। আবুল কালাম আজাদ মানবজমিনকে বলেন, নিজাম মোল্লা কয়েক বছর আগে আগ বাড়িয়ে আমার সঙ্গে পরিচয় ও সুসম্পর্ক গড়েন। এরপর আন্তরিকতা ও উপকারের মানসিকতা দেখিয়ে কমমূল্যে জমি দেয়ার নাম করে বর্ষায় আশুলিয়ায় নিয়ে জমি দেখান। জানান, ডুবে থাকা জমিগুলো তার। এরপর আমাকে জমি বিক্রি করে রেজিস্ট্রিও করে দেন। পরে তার প্রতারণা ধরা পড়ার পর দেখি ভিন্ন লোকের ওই জমিটি একই কায়দায় আরও তিনজনকে বিক্রি করেছেন। পরে জানতে পারি একইভাবে তিনি অনেক লোককে একইভাবে প্রতারণা করে জমি বিক্রির নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রয়োজনীয় সব দলিলপত্র, টাকা গ্রহণের ছবিসহ সব প্রমাণ থাকলেও আইনি জটিলতার কারণে এ প্রতারণার বিচারও চাইতে পারছি না। রাজধানীর চারদিকে ওত পেতে আছে এমনই নানা প্রতারণার ফাঁদ। রাস্তাঘাট, হাটবাজার, বিপণিবিতান, অফিস-আদালত, সচিবালয়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গায়। বাকি নেই বাস-ট্রেনও। সকাল-সন্ধ্যে যে কোনো সময় যে কেউ অচেনা-অর্ধচেনা লোকের মন ভোলানো নানা তৎপরতায় এমন বহু প্রতারণার শিকার হচ্ছে। প্রতারণায় রাজধানীতে প্রতিদিনই একাধিক মানুষ হারাচ্ছেন টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার, জায়গা-জমি। শুধু তা-ই নয়। প্রতারণায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে প্রায় প্রতি মাসে। এতেই শেষ নয়। অনেকে চেনা বা অর্ধচেনা মানুষের কাছেও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এসব প্রতারণার অভিযোগ থাকলেও নেই প্রতিকার। রাজধানীর সব থানায় প্রতারণার শত শত অভিযোগ গেলেও তা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) শিডিউলভুক্ত হওয়ায় থানা পুলিশ তদন্ত করতে পারছে না। আবার দুদকও লোকবল সংকটের অজুহাতে অভিযোগগুলো তদন্ত করছে না বললেই চলে। ফলে প্রতারণার প্রতিকার চাওয়ার রাস্তাও বর্তমানে কার্যত বন্ধ রয়েছে। এর ফল হিসেবে প্রতারণার ঘটনা বাড়লেও অভিযোগ ও মামলা করার প্রবণতা কমে গেছে। এ সুযোগে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে নানা প্রতারক চক্র।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান মানবজমিনকে বলেন, প্রায় সময় বিভিন্ন এলাকায় বহু মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। প্রতারণার অভিযোগের ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ করলে তথ্য-প্রমাণ নাও পাওয়া যেতে পারে। তাই প্রতারণার অভিযোগের তদন্ত দ্রুত সারতে হয়। কিন্তু লোকবল সংকটের পাশাপাশি সক্ষমতা না থাকলেও দুদককে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে এখন প্রতারণার তদন্ত প্রায় হচ্ছেই না। এতে প্রতারণার শিকার সাধারণ মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তারা ক্ষতির শিকার হলেও আইনি সুরক্ষা বা প্রতিকার পাচ্ছেন না, যা সুশাসন বাস্তবায়নে অন্তরায়।
বৃহস্পতিবার সকালে সরজমিনে দেখা তিন বেদেকন্যার আরেক প্রতারণা ছিল এমনই- ‘তোমার কপাল তো খুলে গেছে। এখন থেকে শুধুই উন্নতি হবে তোমার। তবে হাদিয়া ছাড়া তা জানানো যাবে না। অশুভ। ভাগ্য হাতছাড়া হয়ে যাবে। ২০ টাকা দাও।’ হঠাৎ এই বলে কাকরাইল মোড়ে ওই তিন মহিলা পথ আগলে দাঁড়ায় মধ্য বয়সী সুনিল চন্দ্র সাধুর। টাকা বের করতেই পুরনো টাকা না নিয়ে নতুন ১০০ টাকার একটি নোট পছন্দ করে বসে তারা। ৮০ টাকা ফেরত দেয়ার নাম করে তা হাতিয়ে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে একজনের হাতে থাকা কৌটায় ঢুকিয়ে নেয়। বলে ‘পুরো টাকাই নিলাম। তোমার অনেক মঙ্গল হবে।’ একাধিকবার অনুরোধেও ওই টাকা ফিরে পায়নি সুনিল। এর কারণ জানতে চাইলে ওই তিন বেদেকন্যা জানায়, এমনি চাইলে তো কেউ টাকা দেয় না। তারা আরও জানায়, এভাবে প্রতিদিন ২০ থেকে ৫০ জন মানুষের কাছ থেকে প্রতিজন ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত আয় করে। প্রতিদিন ৫০০-এর মতো মহিলা সাভার থেকে ঢাকা শহরে এসে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে এ প্রতারণার কাজ করে বলে জানায় তারা। তবে তারা নিজেদের নাম ও দলনেত্রীর নাম জানাতে অস্বীকৃতি জানায়।
এর আগে গত ২৪শে নভেম্বর সকালে মিরপুরে ছদ্মবেশী ডাববিক্রেতা হাজি মহসিন (৫৫) নামের এক ব্যক্তিকে ভুলিয়ে ডাব খাওয়ায়। এরপর মেরুল বাড্ডার বাসায় যাওয়ার জন্য বাসে উঠে বসতেই তিনি অজ্ঞান। এরপর হাতিয়ে দেয়া হয় তাকে। ওই দিন অচেতন মহসিনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পর শেষরাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হয়।
গত এপ্রিলে কলাবাগান থানায় কর্মরত উপপরিদর্শক এস এম ফারুক আলমের (বর্তমানে বাড্ডা থানায় কর্মরত) মোবাইলে ফোন আসে। বিকাশের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে অপর প্রান্ত থেকে বলা হয় ‘এজেন্ট কমিশন বা চার্জ ছাড়া বিকাশে টাকা লেনদেনের সিস্টেম আছে। সে সুযোগ নিন। এজন্য নতুন বিকাশ আইডি খুলতে হবে। আমি যেভাবে বলি সেভাবে আপনি নতুন আইডি খোলতে থাকুন।’ এই বলে সে আমাকে দিয়ে নতুন আইডি খুলিয়ে নিচ্ছিল। তাতে আমার বিকাশে থাকা ৮ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এমন সময় সঙ্গে থাকা অন্য একজনের পরামর্শে শেষ কাজটুকু বাকি রেখে বলি ‘একটু অপেক্ষা করুন। বিষয়টি কাছে থাকা এক এজেন্টের কাছ থেকে জেনে নিই। এর পরই তিনি এজেন্টের কাছে না যেতে অনুনয়-বিনয় করতে শুরু করে। তা না শুনলে একপর্যায়ে গালাগাল শুরু করে। পরে নিজেই প্রতারণার কথা স্বীকার করে মোবাইলের সংযোগ কেটে দেয়।’ তবে বিকাশ নম্বরে ভিন্ন এক প্রতারণায় ৬ হাজার টাকা খুইয়েছে দক্ষিণ বাড্ডা বাজার এলাকার স্বয়ং বিকাশ এজেন্ট ফারুক হোসেন। সম্প্রতি তার বিকাশ নম্বরে বিকাশ কার্যালয় থেকে পাঠানোর আদলে ৮ হাজার টাকার একটি ভুয়া খুদে বার্তা আসে। এরপর সন্ধ্যার ব্যস্ততম সময়ে বারবার ফোন আসে আর বলতে থাকে ‘একজন লোকের জন্য ২ হাজার টাকা পাঠাতে গিয়ে ভুলে ৮ হাজার টাকা চলে গেছে। ৬ হাজার টাকা আমার নম্বরে ফেরত পাঠান।’ খুদে বার্তা দেখে তিনি ৬ হাজার টাকা বিকাশে ফেরত পাঠান। পরে ব্যালেন্স দেখে বুঝতে পারেন প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে ওপারের মোবাইল নম্বর।
এদিকে গত ২৭শে নভেম্বর সকালে রাজধানীর উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ১৫ নম্বর সড়ক থেকে মো. শহিদুল ইসলাম নামের এক প্রতারককে বিভিন্নজনের ২৭টি পাসপোর্ট ও প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয়া সাড়ে তিন লাখ টাকাসহ আটক করে র‌্যাব-১। জিজ্ঞাসাবাদে শহিদ বিদেশে পাঠানোর নামে বিভিন্নজনের পাসপোর্ট নিয়ে প্রতরণা ও জিম্মি করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে টাকা আদায়ের কথা স্বীকার করে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তৎপরতা ও সক্ষমতার অভাবে এসব নানা প্রতারণার প্রতিকারই চাইতে পারছেন না ভোক্তভোগীরা। প্রতারণায় সর্বস্ব হারালেও ক্ষতিপূরণ চাওয়ার সুযোগই যেন নেই।
জানা যায়, রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন ব্যস্ততম এলাকা, অফিস-আদালত, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় রয়েছে প্রতারক ও সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। নানা কায়দায় তারা প্রতারণার ফাঁদ পাতে। সাধারণ সহজ-সরল মানুষই তাদের লক্ষ্য। সুযোগ বুঝেই নানা ছল-চাতুরী ও মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে তারা প্রতারণা করছে। এসব প্রতারণার মধ্যে রয়েছে কম দামে জমি বিক্রি, চাকরি প্রদান, কম খরচে বিদেশ প্রেরণ, বিকাশ বা মুঠোফোনে বড় পুরস্কার জেতা, উন্নত ওষুধ বিক্রি, কম দামে বিদেশি ভালো জিনিস বিক্রি, ভাগ্য পরিবর্তন ইত্যাদি। এসব প্রতারণার কৌশলগুলো বিচিত্র ও অভিনব। প্রথমে পরিচয়, তার নানা কায়দায় বিশ্বাস জমানো, প্রয়োজনে আগে বিনিয়োগ, এরপর সুযোগ বুঝে সর্বস্ব হাতিয়ে নেয়া ইত্যাদি নানা পর্যায় ও স্তরে চলে প্রতারণায় কার্যসিদ্ধি। রাজধানী ঢাকায় কয়েক সহস্রাধিক লোক ও প্রতারক চক্র শতাধিক রকমের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ ঘটনাচক্রে ধরপাকড় হলেও জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার প্রতারণায় জড়াচ্ছে। তবে চার বছর ধরে প্রতারণার অভিযোগ তদন্তের অভাবে মামলা করা প্রায়ই হচ্ছে না। এতে পার পেয়ে যাচ্ছে প্রতারক চক্র।
দুদক ও আদালত সূত্র জানায়, গত ২০১৩ সালের ২০শে নভেম্বর প্রতারণার মামলাগুলো আইন করে দুদক শিডিউলভুক্ত করা হয়। এরপর থেকে আদালত, থানা পুলিশ বা দুদকের কাছে প্রতারণার অভিযোগ গেলে সব অভিযোগ তদন্তের ক্ষমতা (আদালত ও পুলিশের পরিবর্তে) দুদকের ওপর ন্যস্ত হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ৮ হাজারের বেশি প্রতারণার অভিযোগ থাকলেও তদন্ত হচ্ছে মাত্র হাতেগুনা কয়েকটির। লোকবল সংকটের কথা বলে দুদক প্রতারণার মামলা তদন্ত করছে না। এ সুযোগে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং প্রতারণার ঘটনা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সদস্য ও আইনজীবী। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়লেও কমেছে অভিযোগ।
দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, প্রতারণাকে আমরা দুই ভাগে দেখে থাকি। কিছু হচ্ছে সরকারি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্পর্কিত। আর কিছু হচ্ছে এর বাইরের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার প্রতারণা। এর আগে সব প্রতারণার মামলাই দুদকের তফসিলভুক্ত করা হয়েছিল। লোকবল সংকটসহ বিরাজমান সীমাবদ্ধতায় দুদকের পক্ষে এত মামলা তদন্তের চাপ নেয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে সারা দেশে পুলিশের নেটওয়ার্ক রয়েছে। আমরা সরকার সংশ্লিষ্ট মামলা ছাড়া বাকিগুলো তদন্তের দায়িত্ব পুলিশকে দেয়ার জন্য সরকারকে জানিয়েছি। অচিরেই সংসদে বিল আকারে পাস হতে পারে। তা হলেই পুলিশ তা তদন্ত করবে।
এজন্যই বর্তমানে ব্যক্তি খাতের প্রতারণার অভিযোগগুলো তদন্ত ছাড়াই ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, একেবারে বন্ধ নেই। তবে এখন ওই অভিযোগ বা মামলাগুলোর তদন্ত ধীরগতিতে চলছে।

No comments

Powered by Blogger.