এখনো বিভাজনের কাল চলছে by কুলদীপ নায়ার
ভারত সাম্প্রদায়িকতা তুলে ধরছে, আজ একুশ শতকে, এ ভারত আমাদের অচেনা |
ভারতের
অন্যতম শীর্ষ অভিনেতা আমির খান যে অনুষ্ঠানে বললেন, তাঁর স্ত্রী বলেছেন,
সন্তানদের ভালোভাবে মানুষ করার জন্য তাঁদের অন্য দেশে চলে যাওয়া উচিত কি
না, সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। না, তাঁর কণ্ঠে তিক্ততা ছিল না, ছিল কিছুটা
দুঃখবোধ। তারপরও আমিরের কথা আমাকে নাড়া দিয়েছে। সম্ভবত, পুরো জাতিকেই সেটা
নাড়া দিয়েছে।
এর আগে আমি কখনোই মনে করিনি যে পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে গেছে যে আমির খানের মতো মানুষকে ভাবতে হয়, তাঁকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। তাহলে তো আমিরের সম্প্রদায়ের ক্ষমতাহীন মানুষেরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ভারতের ৫০০ শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী আসলে কোন কারণে বিভিন্ন পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন, তা বোধগম্য। এটা আসলে তাঁদের মর্মবেদনা প্রকাশের তরিকা। আর যাঁরা সেই পর্যায়ে যাননি, তাঁরা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন।
আমিরের মন্তব্যে সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভাবা উচিত, সংখ্যালঘুদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেল কেন? এমনকি তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ও পরিশীলিত মানুষ আমির খানও মনে করেন, তিনি অনিরাপদ। এর পরিণামে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তাঁর ওপর হামলে পড়েছে, আক্ষরিকভাবে তাঁকে হেনস্তা করেছে। বিজেপি বলেছে, ভারত যাঁকে আমির খান বানাল, সেই তিনিই কিনা এমন অকৃতজ্ঞের মতো কথা বললেন। তিনি আজ এ জায়গায় এসেছেন কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। ভারত অভিনয়ের জন্য তাঁকে মূল্যায়ন করেছে।
আমি মনে করি, এমন কিছু ঘটেনি যে আমির সম্পর্কে এমন কথা বলা যায়। তাঁর অনুভূতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। আমাদের সবাইকে অন্তর্বীক্ষণ করতে হবে, আমির খানের মতো মানুষ যিনি দেশজুড়ে এত সমাদৃত ও প্রশংসিত, তাঁকে কেন এমন কথা বলতে হলো। এই কথা বলার পরিণাম কী হবে, সেটা নিশ্চয়ই তিনি ভেবে দেখেছেন। তিনি একজন সংবেদনশীল মানুষ। তিনি নিশ্চয়ই মনে করেছেন, ভারতে যেভাবে অসহিষ্ণুতা শিকড় গেড়ে বসেছে, তাতে তাঁর মতো একজন মানুষও সেখানে অনাবশ্যক হয়ে পড়েছেন। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কারও সন্দেহ নেই, আর তাঁর পুরো জীবনই তো একটা উন্মুক্ত খাতার মতো।
দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, তাঁর মন্তব্যকে ঘিরে যে বিতর্ক হচ্ছে, সেটা তেমন স্বাস্থ্যকর নয়। তিনি এ কথা কেন বললেন, তার সম্ভাব্য কারণ খোঁজা উচিত। জাতিকে এই প্রশ্ন পূর্ণাঙ্গরূপে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। সংখ্যালঘুদের উচিত, নিজেদের নিরাপদ মনে করা। কারণ, তাঁরা যেটা বলেন, সমাজে তার প্রতিক্রিয়া হয়, সংখ্যাগুরুর কথার ক্ষেত্রে তা হয় না।
দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, বিভাজনই কিন্তু এখন পর্যন্ত মূল বিষয়। বিভাজন একটা বাস্তবতা। জওহরলাল নেহরু ও সরদার প্যাটেল এটা মেনে নিয়েছিলেন, যাঁরা তখন স্বাধীনতার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এটা সত্য যে তাঁরা দুজনেই দেশভাগ মেনে নিতে অনাগ্রহী ছিলেন। কিন্তু যখন তাঁরা মনে করলেন যে ব্রিটিশ শাসন অবসানের আর রাস্তা নেই, তখন তাঁরা ভারত ভাগ করতে রাজি হলেন।
গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেন যখন দেশভাগের পালে হাওয়া দিলেন, তখন মহাত্মা গান্ধী তাঁর কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। এ ব্যাপারে তিনি কিছু করতে নারাজ ছিলেন। কিন্তু যখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি বললেন, তাঁরা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে মীমাংসা ছাড়াই দেশ ত্যাগ করবেন, তখন নেহরু ও প্যাটেল সত্যের মুখোমুখি হয়ে দেশভাগ মেনে নিলেন, যদিও অনেক দুঃখ ও বেদনা নিয়ে।
এটা সত্য যে ধর্মের ভিত্তিতে যে বিভাজন রেখা টানা হলো, তার ফলাফল বিপর্যয়কর। ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্য মানুষকে এই মূল্য দিতে হয়েছে। দুঃখজনকভাবে বিব্রতকর সত্য হচ্ছে, দেশভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের জাতশত্রুতে পরিণত হয়। এর জন্য দুই তরফের রাজনীতিকদেরই দায়ী করতে হবে। বিশেষ করে পাকিস্তানের রাজনীতিকেরা এখনো বিভাজনের পথেই হাঁটছেন।
ক্ষমতা হস্তান্তর শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছিল, এটা শুধু কথার কথা। রাজনৈতিক নেতারা শান্তি ও বন্ধুত্বের অনেক আশ্বাস শোনালেও মানুষ এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গেছে, যেখানে তাদের সম্প্রদায়ের মানুষ থাকে। ইতিহাসে এর আগে এমন রক্তাগঙ্গা সৃষ্টি হয়নি, দুই সম্প্রদায়ের মোট প্রায় এক কোটি মানুষ মারা গেছে এবং তার কয়েক গুণ ঘরছাড়া হয়েছে।
এখনো সেই ক্ষত শুকায়নি। এর বিপরীতে ভারত-পাকিস্তান তিনটি যুদ্ধ করেছে, আর দীর্ঘস্থায়ী শান্তির সম্ভাবনাও নেই। ভারতের মুসলমানরা সংখ্যায় ১৫ কোটি হলেও তারা সেখানে গুরুত্ব হারিয়েছে আর পাকিস্তানের হিন্দুরা দেশটির জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম। স্বাধীনতার পর পাকিস্তান নিজেকে ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করল, তারা সেই ধারায় সংবিধানও প্রণয়ন করল। ওদিকে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলো। দেশটির ৮০ শতাংশ মানুষ হিন্দু হলেও হিন্দুরা এমন একটি সংবিধান অধিকতর শ্রেয় মনে করল, যার মুখবন্ধেই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা রয়েছে। সেখানে আইনের সামনে সবাই সমান আর ধর্মের কারণে কেউ নিকৃষ্ট নয়। যদিও এই রাষ্ট্রের পরিচালনায় মুসলমানদের ভূমিকা খুবই নগণ্য।
ভারতে এখন ভোটারদের মধ্যে বিভেদ নেই, স্বাধীনতার আগে যেটা ছিল। ফলে সংখ্যালঘুরা সেখানে অসহায় নয়। কিন্তু নির্বাচন হয়ে গেলে অন্য বিষয়গুলো সামনে চলে আসে, আর মুসলমানরা উপেক্ষিত হয়। নির্বাচনের আগে যেমন থাকে, নির্বাচনের পরও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার বিভেদই প্রধান হয়ে ওঠে। ভারত এখনো এই পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
এর আগে আমি কখনোই মনে করিনি যে পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে গেছে যে আমির খানের মতো মানুষকে ভাবতে হয়, তাঁকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। তাহলে তো আমিরের সম্প্রদায়ের ক্ষমতাহীন মানুষেরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ভারতের ৫০০ শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী আসলে কোন কারণে বিভিন্ন পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন, তা বোধগম্য। এটা আসলে তাঁদের মর্মবেদনা প্রকাশের তরিকা। আর যাঁরা সেই পর্যায়ে যাননি, তাঁরা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন।
আমিরের মন্তব্যে সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভাবা উচিত, সংখ্যালঘুদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেল কেন? এমনকি তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ও পরিশীলিত মানুষ আমির খানও মনে করেন, তিনি অনিরাপদ। এর পরিণামে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তাঁর ওপর হামলে পড়েছে, আক্ষরিকভাবে তাঁকে হেনস্তা করেছে। বিজেপি বলেছে, ভারত যাঁকে আমির খান বানাল, সেই তিনিই কিনা এমন অকৃতজ্ঞের মতো কথা বললেন। তিনি আজ এ জায়গায় এসেছেন কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। ভারত অভিনয়ের জন্য তাঁকে মূল্যায়ন করেছে।
আমি মনে করি, এমন কিছু ঘটেনি যে আমির সম্পর্কে এমন কথা বলা যায়। তাঁর অনুভূতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। আমাদের সবাইকে অন্তর্বীক্ষণ করতে হবে, আমির খানের মতো মানুষ যিনি দেশজুড়ে এত সমাদৃত ও প্রশংসিত, তাঁকে কেন এমন কথা বলতে হলো। এই কথা বলার পরিণাম কী হবে, সেটা নিশ্চয়ই তিনি ভেবে দেখেছেন। তিনি একজন সংবেদনশীল মানুষ। তিনি নিশ্চয়ই মনে করেছেন, ভারতে যেভাবে অসহিষ্ণুতা শিকড় গেড়ে বসেছে, তাতে তাঁর মতো একজন মানুষও সেখানে অনাবশ্যক হয়ে পড়েছেন। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কারও সন্দেহ নেই, আর তাঁর পুরো জীবনই তো একটা উন্মুক্ত খাতার মতো।
দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, তাঁর মন্তব্যকে ঘিরে যে বিতর্ক হচ্ছে, সেটা তেমন স্বাস্থ্যকর নয়। তিনি এ কথা কেন বললেন, তার সম্ভাব্য কারণ খোঁজা উচিত। জাতিকে এই প্রশ্ন পূর্ণাঙ্গরূপে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। সংখ্যালঘুদের উচিত, নিজেদের নিরাপদ মনে করা। কারণ, তাঁরা যেটা বলেন, সমাজে তার প্রতিক্রিয়া হয়, সংখ্যাগুরুর কথার ক্ষেত্রে তা হয় না।
দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, বিভাজনই কিন্তু এখন পর্যন্ত মূল বিষয়। বিভাজন একটা বাস্তবতা। জওহরলাল নেহরু ও সরদার প্যাটেল এটা মেনে নিয়েছিলেন, যাঁরা তখন স্বাধীনতার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এটা সত্য যে তাঁরা দুজনেই দেশভাগ মেনে নিতে অনাগ্রহী ছিলেন। কিন্তু যখন তাঁরা মনে করলেন যে ব্রিটিশ শাসন অবসানের আর রাস্তা নেই, তখন তাঁরা ভারত ভাগ করতে রাজি হলেন।
গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেন যখন দেশভাগের পালে হাওয়া দিলেন, তখন মহাত্মা গান্ধী তাঁর কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। এ ব্যাপারে তিনি কিছু করতে নারাজ ছিলেন। কিন্তু যখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি বললেন, তাঁরা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে মীমাংসা ছাড়াই দেশ ত্যাগ করবেন, তখন নেহরু ও প্যাটেল সত্যের মুখোমুখি হয়ে দেশভাগ মেনে নিলেন, যদিও অনেক দুঃখ ও বেদনা নিয়ে।
এটা সত্য যে ধর্মের ভিত্তিতে যে বিভাজন রেখা টানা হলো, তার ফলাফল বিপর্যয়কর। ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্য মানুষকে এই মূল্য দিতে হয়েছে। দুঃখজনকভাবে বিব্রতকর সত্য হচ্ছে, দেশভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের জাতশত্রুতে পরিণত হয়। এর জন্য দুই তরফের রাজনীতিকদেরই দায়ী করতে হবে। বিশেষ করে পাকিস্তানের রাজনীতিকেরা এখনো বিভাজনের পথেই হাঁটছেন।
ক্ষমতা হস্তান্তর শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছিল, এটা শুধু কথার কথা। রাজনৈতিক নেতারা শান্তি ও বন্ধুত্বের অনেক আশ্বাস শোনালেও মানুষ এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গেছে, যেখানে তাদের সম্প্রদায়ের মানুষ থাকে। ইতিহাসে এর আগে এমন রক্তাগঙ্গা সৃষ্টি হয়নি, দুই সম্প্রদায়ের মোট প্রায় এক কোটি মানুষ মারা গেছে এবং তার কয়েক গুণ ঘরছাড়া হয়েছে।
এখনো সেই ক্ষত শুকায়নি। এর বিপরীতে ভারত-পাকিস্তান তিনটি যুদ্ধ করেছে, আর দীর্ঘস্থায়ী শান্তির সম্ভাবনাও নেই। ভারতের মুসলমানরা সংখ্যায় ১৫ কোটি হলেও তারা সেখানে গুরুত্ব হারিয়েছে আর পাকিস্তানের হিন্দুরা দেশটির জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম। স্বাধীনতার পর পাকিস্তান নিজেকে ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করল, তারা সেই ধারায় সংবিধানও প্রণয়ন করল। ওদিকে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলো। দেশটির ৮০ শতাংশ মানুষ হিন্দু হলেও হিন্দুরা এমন একটি সংবিধান অধিকতর শ্রেয় মনে করল, যার মুখবন্ধেই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা রয়েছে। সেখানে আইনের সামনে সবাই সমান আর ধর্মের কারণে কেউ নিকৃষ্ট নয়। যদিও এই রাষ্ট্রের পরিচালনায় মুসলমানদের ভূমিকা খুবই নগণ্য।
ভারতে এখন ভোটারদের মধ্যে বিভেদ নেই, স্বাধীনতার আগে যেটা ছিল। ফলে সংখ্যালঘুরা সেখানে অসহায় নয়। কিন্তু নির্বাচন হয়ে গেলে অন্য বিষয়গুলো সামনে চলে আসে, আর মুসলমানরা উপেক্ষিত হয়। নির্বাচনের আগে যেমন থাকে, নির্বাচনের পরও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার বিভেদই প্রধান হয়ে ওঠে। ভারত এখনো এই পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
No comments