সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চাই by ড. কাজী আবদুস সামাদ
নির্বাচনী
মহাসড়কে অবস্থান নিয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি
তো দূরের কথা, একেবারেই অপ্রস্তুত মাঠে রেফারি/আম্পায়ার, বলবিহীন অবস্থায়
নির্বাচনী খেলায় মেতে উঠেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী,
প্রতিমন্ত্রী সবাই। গতকালও কয়েকজন মন্ত্রী বলেছেন, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি
নির্বাচনী ট্রেন মিস করছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি তো ছয় মাসের
পুরনো কোনো সংগঠন নয় যে, তারা এ ফুসলানিতে পা দেবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের
পূর্বশর্ত হল- ১. সব দল ও মতের কাছে গ্রহণযোগ্য শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ
নির্বাচন কমিশন, ২. নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার
ব্যবস্থা চালু রাখা, ৩. সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড
প্রস্তুত রাখা ইত্যাদি। এর একটিরও ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। তাহলে গণতন্ত্রের
মূল মন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে প্রতিদিন
কোথাও না কোথাও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের নাম করে জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন। এসব
ভাষণে তিনি জামায়াত-বিএনপি-হেফাজতসহ অন্যান্য বিরোধী দলের বিরুদ্ধে
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে কঠোর সমালোচনা করে পরিশেষে ভোট চাইছেন।
কিছুদিন আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল প্রধানমন্ত্রীর
বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। নির্বাচন কমিশন
অবশ্য বলেছে, যেহেতু এ নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা নির্বাচনী তফসিলের আগেই
হচ্ছে, তাই তা সেই অর্থে আচরণবিধি লংঘনের পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু প্রশ্ন
হচ্ছে, নির্বাচনকে ঘিরে হাজারো প্রশ্নের সমাধান না করে তিনি নির্বাচনী মাঠে
একা একা প্রতিদিন বিরোধী শিবিরে এত এত গোল দিচ্ছেন, তার মানে কী? এসব
প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই এ লেখার উদ্দেশ্য।
দেশবাসী অবগত আছেন যে, কিছুদিন আগে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন একই দিনে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত দুই নেতা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে আলোচনা করেন। দেশবাসী যতটা বুঝতে পেরেছে, তারা দুজনই তাকে এ ব্যাপারে কার্যকর ইতিবাচক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন। এখানে বুঝতে হবে, বলটি কিন্তু সরকারি দল আওয়ামী লীগের কোর্টে। শেখ হাসিনা খোলা ও মুক্ত মনে বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনী ফর্মুলায় না আসা পর্যন্ত এই ইস্পাত কঠিন সমস্যার সমাধান হবে না। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ সব দেশের প্রতিনিধিরা বারবার বাংলাদেশের আসন্ন সংকট নিয়ে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন এবং এ ব্যাপারে বিশেষ করে সরকারি দলকে বারবার সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। চীন সচরাচর এ ব্যাপারে চুপচাপ থাকলেও এবার মুখ খুলেছে এবং সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যাওয়ার জন্য সরকারি দলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে। এ আহ্বান অবশ্য বিরোধী দলের প্রতিও। তবে যেহেতু বলটি সরকারি দলে অবস্থান করছে, তাই মূল উদ্যোগ সরকারি দলকেই নিতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারি দলের অনমনীয় ও একতরফা মনোভাবের কোনো বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা যে কোনো সমস্যার শেষ ভরসার স্থল হচ্ছে জাতিসংঘ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে জাতিসংঘের মহাসচিবের বক্তব্যও আমাদের রাজনীতিবিদদের এতটুকু বিচলিত করতে পারেনি। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষ যা বুঝতে পারছেন, মনে হয় সরকারি দল আওয়ামী লীগ তা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। ক্ষমতাসীন সরকারি দলের ব্যক্তিদের কাছে মনে হতে পারে একতরফা নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে পারলে অন্তত কিছুদিন তো ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা যাবে। কিন্তু বিষয় হচ্ছে, ক্ষমতাকে কিছুদিন দীর্ঘায়িত করে আবার ক্ষমতায় আসতে যদি আরও বেশি সময় লেগে যায় অবে তা কি সঠিক বিচারে ক্ষতিকারক নয়? স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম দফায় সাড়ে তিন বছরের শাসনামলের পর দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসতে ২১ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসতে এত বছর কেন লাগল তার প্রকৃত কারণ আওয়ামী লীগকেই খুঁজে বের করতে হবে।
সরকারি দলের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত নির্বাচনের পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, উন্নত বিশ্বের কোনো উন্নয়ন মডেলই যেহেতু সরাসরি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, ঠিক তেমনি নির্বাচন মডেলও কোনো গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কারণ উন্নত বিশ্বে নির্বাচনের অনুমিত পূর্বশর্তগুলো যথাযথভাবে সমাধান করা আছে বহু দিন থেকেই। শত শত বছর ধরে গণতন্ত্রায়নের জন্য ওই সব দেশের জনগণ রক্ত দিয়েছে এবং ফলস্বরূপ প্রতিবছর নির্বাচনের সময় নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কোনো আলোচনা-সমালোচনার দরকার পড়ে ন সেখানে। বহু বছর জার্মানিতে অবস্থান করে সে দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা বোঝার সুযোগ হয়েছে আমার। জাতীয় নির্বাচন কিংবা প্রাদেশিক নির্বাচন যেটাই হোক না কেন, দিনব্যাপী নির্বাচন শেষে সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে সব দলের সভাপতিদের সমন্বয়ে টিভিতে নির্বাচনী হার-জিতের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। এটাই গণতন্ত্র। যারা নির্বাচনে হেরে যায় তারা তৎক্ষণাৎ তা মেনে নেয় এবং যারা জয়লাভ করে তারা আগামী দিনগুলোতে কিভাবে জনগণের আরও ভাগ্যোন্নয়ন করবেন তার পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। বহু বছরেও এ রীতির কোনো পরিবর্তন দেখিনি। এটাই গণতান্ত্রিক দেশ, এটাই কল্যাণ রাষ্ট্র। আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশে কি এ ধরনের বিধিবিধান সৃষ্টি করা হয়েছে? আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা কি সৃষ্টি হয়েছে? যেহেতু উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশে সেই নির্বাচনী সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি, তাই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সরকার এ সত্যতা স্বীকার করে এ ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা নেবে, সব দলের সঙ্গে কার্যকর সংলাপের মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা নেবে ততই জনগণের জন্য মঙ্গল হবে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, পার্লামেন্টকে বহাল রেখেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রশ্ন হল, যদি ৩০০ আসনে সংসদ সদস্য থেকেই থাকেন, তবে আবার নির্বাচন হলে মোট ৬০০ সংসদ সদস্য হবে? এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন নিজেও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেন না সরকারি দল কি বোঝাতে চাইছে। সত্যিকার অর্থে কিভাবে নির্বাচনটি পরিচালিত হবে। প্রশ্ন হল, নির্বাচন কমিশনই যদি না বুঝে কী হতে যাচ্ছে নির্বাচনে, তাহলে কী ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী? সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিশ্চিত করতে হয়, তবে সরকারকে দ্বিতীয়বার চিন্তা করে দেখতে হবে। একতরফা নির্বাচন যে কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না তা খুবই সহজবোধ্য। ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি সে কথা বর্তমান সরকারি দলের তো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তাহলে এবারের একতরফা নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্যতা পাবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর যে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না সেই নির্বাচনের পেছনে ছোটার কি কোনো কারণ আছে? বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করে তাদের দ্বারা সংগঠিত লগি-বৈঠার মাধ্যমে লোক হত্যার কথা মানুষ ভুলে গেছে। তাদের ১৭৩ দিন হরতাল পালনের মাধ্যমে দেশকে অচল করে দেয়া হয়েছিল এই তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুকে কেন্দ্র করে। এখন এই তত্ত্বাবধায়ক আর প্রয়োজন নেই, কারণ এখন তত্ত্বাবধায়ক হলে তাদের পায়ের নিচের মাটি সরে যাবে। তাদের নির্বাচনে জয়ের এতই যদি সম্ভাবনা থাকে, তাদের দ্বারা উন্নয়নের যে ফিরিস্তি দেয়া হচ্ছে তা যদি সব সত্যি হয়, তবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে নির্বাচন দেয়া হোক। জনগণ যদি সব ক্ষমতার উৎস হয়, তবে তারা যাকে ভোট দেয় তারাই সরকার গঠন করবে, এই গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী নয় কেন আওয়ামী লীগ? তাহলে কি ধরে নেয়া যায় গণতন্ত্র বলতে আওয়ামী লীগ অন্য কিছু বোঝে?
১/১১-এর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের এত ক্ষতিসাধন করল, সেই তত্ত্বাবধায়কের সব কাজের বৈধতা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু কেন? আওয়ামী লীগের অনেকের মতে, ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক আওয়ামী লীগকে ২০০৮ সালের নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। সে কারণেই আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল।
কী কারণে অন্তিম মুহূর্তে জনগণ ও সব বিদেশী বন্ধুর আশা-আকাক্সক্ষা অনুযায়ী সংসদীয় রীতিনীতির ভিত্তিতে সরকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনমুখী না হয়ে একতরফাভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় লিপ্ত হয়েছেন তা দেশে-বিদেশে কেউ বুঝতে পারছে না। কিছুদিন আগে পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সেখানে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা বিরাজমান থাকলেও নির্বাচন নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি। সরকার যদি মনে করে থাকে যে, ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা যাবে এবং একতরফা নির্বাচন করেও কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না, তা হবে সবচেয়ে বড় ভুল। ইতিহাস বলে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে গেলে বিরাট সমস্যায় পড়তে হয়। যে সরকার যত বেশি দিন ক্ষমতায় থাকে, সে সরকারকে তত বেশি মন্দভাবে সরকার থেকে বিদায় হতে হয়। কারণ জনপ্রিয়তা এতই দ্রুত কমতে থাকে যে, শেষে আর কূলকিনারা পাওয়া যায় না। আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি, রূপকার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদকেও ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছিল পরবর্তী নেতাদের সুযোগ দেয়ার জন্য। যারাই ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হতে চেয়েছেন, তারাই তত বেশি ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদও বলেছেন, সব দল নির্বাচনে না এলে তার দলও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। প্রধানমন্ত্রীর কর্ণকুহরে কি এসব প্রবেশ করছে না?
যেখানে এখনও নির্বাচন কমিশন পূর্ণ আস্থা লাভে সমর্থ হয়নি, যেখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি, যেখানে নির্বাচনকালীন কী সরকার ব্যবস্থা চালু থাকবে তা ঠিক হয়নি, যেখানে দুই দলের দূরত্ব কমিয়ে নিয়ে এসে পারস্পরিক আস্থার জায়গা তৈরি হয়নি, সেখানে কী করে ক্ষমতাসীন দল আশা করছে, বিরোধী দল নির্বাচনে আসবে? আর বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে সমস্যা আরও ঘনীভূত করবে। তাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতিকে হতাশ না করে একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেবেন এই প্রত্যাশা করি।
ড. কাজী আবদুস সামাদ : অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
দেশবাসী অবগত আছেন যে, কিছুদিন আগে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন একই দিনে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত দুই নেতা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে আলোচনা করেন। দেশবাসী যতটা বুঝতে পেরেছে, তারা দুজনই তাকে এ ব্যাপারে কার্যকর ইতিবাচক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন। এখানে বুঝতে হবে, বলটি কিন্তু সরকারি দল আওয়ামী লীগের কোর্টে। শেখ হাসিনা খোলা ও মুক্ত মনে বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনী ফর্মুলায় না আসা পর্যন্ত এই ইস্পাত কঠিন সমস্যার সমাধান হবে না। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ সব দেশের প্রতিনিধিরা বারবার বাংলাদেশের আসন্ন সংকট নিয়ে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন এবং এ ব্যাপারে বিশেষ করে সরকারি দলকে বারবার সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। চীন সচরাচর এ ব্যাপারে চুপচাপ থাকলেও এবার মুখ খুলেছে এবং সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যাওয়ার জন্য সরকারি দলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে। এ আহ্বান অবশ্য বিরোধী দলের প্রতিও। তবে যেহেতু বলটি সরকারি দলে অবস্থান করছে, তাই মূল উদ্যোগ সরকারি দলকেই নিতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারি দলের অনমনীয় ও একতরফা মনোভাবের কোনো বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা যে কোনো সমস্যার শেষ ভরসার স্থল হচ্ছে জাতিসংঘ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে জাতিসংঘের মহাসচিবের বক্তব্যও আমাদের রাজনীতিবিদদের এতটুকু বিচলিত করতে পারেনি। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষ যা বুঝতে পারছেন, মনে হয় সরকারি দল আওয়ামী লীগ তা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। ক্ষমতাসীন সরকারি দলের ব্যক্তিদের কাছে মনে হতে পারে একতরফা নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে পারলে অন্তত কিছুদিন তো ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা যাবে। কিন্তু বিষয় হচ্ছে, ক্ষমতাকে কিছুদিন দীর্ঘায়িত করে আবার ক্ষমতায় আসতে যদি আরও বেশি সময় লেগে যায় অবে তা কি সঠিক বিচারে ক্ষতিকারক নয়? স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম দফায় সাড়ে তিন বছরের শাসনামলের পর দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসতে ২১ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসতে এত বছর কেন লাগল তার প্রকৃত কারণ আওয়ামী লীগকেই খুঁজে বের করতে হবে।
সরকারি দলের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত নির্বাচনের পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, উন্নত বিশ্বের কোনো উন্নয়ন মডেলই যেহেতু সরাসরি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, ঠিক তেমনি নির্বাচন মডেলও কোনো গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কারণ উন্নত বিশ্বে নির্বাচনের অনুমিত পূর্বশর্তগুলো যথাযথভাবে সমাধান করা আছে বহু দিন থেকেই। শত শত বছর ধরে গণতন্ত্রায়নের জন্য ওই সব দেশের জনগণ রক্ত দিয়েছে এবং ফলস্বরূপ প্রতিবছর নির্বাচনের সময় নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কোনো আলোচনা-সমালোচনার দরকার পড়ে ন সেখানে। বহু বছর জার্মানিতে অবস্থান করে সে দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা বোঝার সুযোগ হয়েছে আমার। জাতীয় নির্বাচন কিংবা প্রাদেশিক নির্বাচন যেটাই হোক না কেন, দিনব্যাপী নির্বাচন শেষে সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে সব দলের সভাপতিদের সমন্বয়ে টিভিতে নির্বাচনী হার-জিতের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। এটাই গণতন্ত্র। যারা নির্বাচনে হেরে যায় তারা তৎক্ষণাৎ তা মেনে নেয় এবং যারা জয়লাভ করে তারা আগামী দিনগুলোতে কিভাবে জনগণের আরও ভাগ্যোন্নয়ন করবেন তার পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। বহু বছরেও এ রীতির কোনো পরিবর্তন দেখিনি। এটাই গণতান্ত্রিক দেশ, এটাই কল্যাণ রাষ্ট্র। আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশে কি এ ধরনের বিধিবিধান সৃষ্টি করা হয়েছে? আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা কি সৃষ্টি হয়েছে? যেহেতু উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশে সেই নির্বাচনী সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি, তাই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সরকার এ সত্যতা স্বীকার করে এ ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা নেবে, সব দলের সঙ্গে কার্যকর সংলাপের মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা নেবে ততই জনগণের জন্য মঙ্গল হবে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, পার্লামেন্টকে বহাল রেখেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রশ্ন হল, যদি ৩০০ আসনে সংসদ সদস্য থেকেই থাকেন, তবে আবার নির্বাচন হলে মোট ৬০০ সংসদ সদস্য হবে? এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন নিজেও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেন না সরকারি দল কি বোঝাতে চাইছে। সত্যিকার অর্থে কিভাবে নির্বাচনটি পরিচালিত হবে। প্রশ্ন হল, নির্বাচন কমিশনই যদি না বুঝে কী হতে যাচ্ছে নির্বাচনে, তাহলে কী ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী? সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিশ্চিত করতে হয়, তবে সরকারকে দ্বিতীয়বার চিন্তা করে দেখতে হবে। একতরফা নির্বাচন যে কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না তা খুবই সহজবোধ্য। ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি সে কথা বর্তমান সরকারি দলের তো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তাহলে এবারের একতরফা নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্যতা পাবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর যে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না সেই নির্বাচনের পেছনে ছোটার কি কোনো কারণ আছে? বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করে তাদের দ্বারা সংগঠিত লগি-বৈঠার মাধ্যমে লোক হত্যার কথা মানুষ ভুলে গেছে। তাদের ১৭৩ দিন হরতাল পালনের মাধ্যমে দেশকে অচল করে দেয়া হয়েছিল এই তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুকে কেন্দ্র করে। এখন এই তত্ত্বাবধায়ক আর প্রয়োজন নেই, কারণ এখন তত্ত্বাবধায়ক হলে তাদের পায়ের নিচের মাটি সরে যাবে। তাদের নির্বাচনে জয়ের এতই যদি সম্ভাবনা থাকে, তাদের দ্বারা উন্নয়নের যে ফিরিস্তি দেয়া হচ্ছে তা যদি সব সত্যি হয়, তবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে নির্বাচন দেয়া হোক। জনগণ যদি সব ক্ষমতার উৎস হয়, তবে তারা যাকে ভোট দেয় তারাই সরকার গঠন করবে, এই গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী নয় কেন আওয়ামী লীগ? তাহলে কি ধরে নেয়া যায় গণতন্ত্র বলতে আওয়ামী লীগ অন্য কিছু বোঝে?
১/১১-এর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের এত ক্ষতিসাধন করল, সেই তত্ত্বাবধায়কের সব কাজের বৈধতা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু কেন? আওয়ামী লীগের অনেকের মতে, ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক আওয়ামী লীগকে ২০০৮ সালের নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। সে কারণেই আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল।
কী কারণে অন্তিম মুহূর্তে জনগণ ও সব বিদেশী বন্ধুর আশা-আকাক্সক্ষা অনুযায়ী সংসদীয় রীতিনীতির ভিত্তিতে সরকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনমুখী না হয়ে একতরফাভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় লিপ্ত হয়েছেন তা দেশে-বিদেশে কেউ বুঝতে পারছে না। কিছুদিন আগে পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সেখানে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা বিরাজমান থাকলেও নির্বাচন নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি। সরকার যদি মনে করে থাকে যে, ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা যাবে এবং একতরফা নির্বাচন করেও কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না, তা হবে সবচেয়ে বড় ভুল। ইতিহাস বলে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে গেলে বিরাট সমস্যায় পড়তে হয়। যে সরকার যত বেশি দিন ক্ষমতায় থাকে, সে সরকারকে তত বেশি মন্দভাবে সরকার থেকে বিদায় হতে হয়। কারণ জনপ্রিয়তা এতই দ্রুত কমতে থাকে যে, শেষে আর কূলকিনারা পাওয়া যায় না। আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি, রূপকার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদকেও ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছিল পরবর্তী নেতাদের সুযোগ দেয়ার জন্য। যারাই ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হতে চেয়েছেন, তারাই তত বেশি ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদও বলেছেন, সব দল নির্বাচনে না এলে তার দলও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। প্রধানমন্ত্রীর কর্ণকুহরে কি এসব প্রবেশ করছে না?
যেখানে এখনও নির্বাচন কমিশন পূর্ণ আস্থা লাভে সমর্থ হয়নি, যেখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি, যেখানে নির্বাচনকালীন কী সরকার ব্যবস্থা চালু থাকবে তা ঠিক হয়নি, যেখানে দুই দলের দূরত্ব কমিয়ে নিয়ে এসে পারস্পরিক আস্থার জায়গা তৈরি হয়নি, সেখানে কী করে ক্ষমতাসীন দল আশা করছে, বিরোধী দল নির্বাচনে আসবে? আর বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে সমস্যা আরও ঘনীভূত করবে। তাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতিকে হতাশ না করে একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেবেন এই প্রত্যাশা করি।
ড. কাজী আবদুস সামাদ : অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments