আইন কমিশনের উদ্দেশে বলছি by পলাশ কুমার রায়
একটি গণতান্ত্রিক দেশে আইন কমিশনের
গুরুত্ব অনেক। ১৯৯৬ সালের আইন অনুসারে আইন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয় দেওয়ানি ও
ফৌজদারি মামলাগুলোর বিচারিক কাজে দীর্ঘসূত্রতা রোধে করণীয় নির্ধারণসহ অচল
আইনগুলো বাতিল, প্রচলিত অন্যান্য আইন সংস্কার এবং ক্ষেত্রবিশেষে নতুন আইন
প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করার জন্য।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ২৩ জুলাই তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেয়েছেন। কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি প্রধান বিচারপতির প্রাপ্য বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন। ২০১০ সালের অক্টোবরে হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি আবদুর রশিদের পদত্যাগের পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। বিচারপতি হক হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অনেক মামলার রায় দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১১ সালের ১৭ মে পর্যন্ত আলোচিত বহু মামলার রায় দেন। একজন বিচারক কখনোই মামলার দুপক্ষের বিচারপ্রার্থীদের খুশি করতে পারেন না। এটাই স্বাভাবিক। এসব রায়ে এক পক্ষের বিচারপ্রার্থীরা খুশি হয়েছেন, অসন্তুষ্ট হয়েছেন অনেকেই। বিচারপ্রার্থীদের পাশাপাশি রাজনীতিক ও বড় বড় রাজনৈতিক দলের সমর্থকরাও সন্তুষ্ট-অসন্তুষ্ট হয়েছেন বিচারপতি হকের রায়ে। রাজনীতিক ও তাদের সমর্থকদের অখুশি-অসন্তুস্ট হওয়ার কারণ হল আমাদের দেশে সব কিছুতেই রাজনীতি থাকে, হয়তো সে কারণেই।
বিচারপতি হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হওয়ার পর তিন দিনের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথিতযশা অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রথম আলোয় বিচারপতি হকের নিয়োগকে প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এসএম মাসুম বিল্লাহ ওই লেখার প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, বিচারপতি খায়রুল হকের মতো একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিকে সরকার এই পদে নিয়োগ দিয়ে বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। আইন কমিশনের মর্যাদা এক ধাপ ওপরে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক যে যার অবস্থান, চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন বলেই আমার মনে হয়। দুজন শিক্ষকেরই হাত ধরে প্রতি বছর শত শত শিক্ষার্থী নবীন আইনজীবী হিসেবে সারাদেশে আইন পেশায় প্রবেশ করছেন। আবার অনেকেই হচ্ছেন নিু আদালতের বিচারক। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক পদ্ধতিগতভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার পাট চুকিয়ে প্রথমে আইন পেশা, অতঃপর যোগ্যতাবলে বিচারক হিসেবে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন। বিচারপতি হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হওয়ার পর পক্ষে-বিপক্ষে যারা লিখছেন তারাই বিচারক, আইনজীবী, আইন বিষয়ে গবেষক, মানবাধিকার কর্মীর গর্ভজাত পিতামাতা। এই শিক্ষকদ্বয় বিচারপতি হকের পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য না করে তারা কিভাবে যোগ্য, চৌকস, আদর্শবান, ন্যায়পরায়ণ এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন আইনজীবী এবং বিচারক তৈরি করতে পারেন, সেদিকে মনোযোগ দিলেই ভালো হয় বৈকি! দেশে এখন নীতিবান ও পেশাদার আইনজীবী এবং পক্ষপাতহীনভাবে ন্যায়বিচার করার মতো বিচারকের অভাব লক্ষণীয়। অধিকাংশ আইনজীবী যতটা সময় বিচারপ্রার্থী মক্কেলের আইনি অধিকার সুরক্ষার জন্য ব্যয় করেন, তার চেয়েও বেশি সময় ব্যয় করেন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর পক্ষে স্লোগান আর জয়ধ্বনি দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি আদর্শবান, ন্যায়পরায়ণ, যোগ্য, দায়িত্বশীল, কর্মঠ বিচারক তৈরি করতে প্রাণান্তভাবে প্রচেষ্টা চালান, তাহলে সেই বিচারকরা যখন অদূর ভবিষ্যতে আইন কমিশন কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে নিয়োগ লাভ করবেন, তখন তারা সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানিত হবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষকরা কি সেই বিষয়টি অনুভব করেন? আর আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরাই বা ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের কিভাবে তৈরি করার চিন্তা করেন?
কমিশনের ওয়েবসাইট পর্যালোচনায় দেখা যায়, আইন কমিশন ২০০১ সালে মিথ্যা মামলা (প্রতিরোধ ও প্রতিকার) আইন প্রণয়নের প্রস্তাব সরকারকে দেয়। তৎকালীন আইন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিচারপতি বিমলেন্দু বিকাশ রায় চৌধুরী এবং সদস্য বিচারপতি নাঈমদ্দিন আহমেদ প্রস্তাবিত এই আইনটি সময়োপযোগী করে অতিদ্রুত কার্যকর করার জোর দাবি জানাচ্ছি। আমরা এখন এমন একটি সমাজে বাস করছি যেখানে মিথ্যা বা কাল্পনিক ঘটনা সাজিয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল, আর্থিকভাবে অসচ্ছল, ক্ষমতাহীন মানুষজনকে হয়রানি বা শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে সমাজের উঁচু শ্রেণীওয়ালার লোকরা মিথ্যা মামলা দায়ের করে থাকেন। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ওই পরিবারের সদস্যরা আর্থিক, সামাজিক, মানসিকভাবে চরম ক্ষতির শিকার হন। থানা পুলিশ, কোর্ট-কাছারি আর উকিল সাহেবের চেম্বারে দৌড়াতে দৌড়াতে তারা এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েন, অবশেষে কাল্পনিক বা মিথ্যা ঘটনায় উদ্ভূত মিথ্যা মামলা প্রমাণের আর্থিক সামর্থ্য না থাকার দরুন ওই পরিবারের সদস্যরা জেলের ঘানি টানতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন। এভাবে প্রতিদিন কতগুলো মিথ্যা মামলা দায়ের হয় এবং সারাদেশে মিথ্যা মামলা এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা কত তা নির্ধারণের জন্য কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ নেই দেশে। এসব নিয়ে চিন্তা করার সময় কোথায় সরকারের? তাই সমাজের উঁচু শ্রেণীওয়ালাদের মিথ্যা মামলা দায়ের করার পরও কোনো ধরনের শাস্তি পেতে হয় না বলেই দেশে ক্রমাগতভাবে মিথ্যা মামলার সংখ্যা বাড়ছে (যদিও মিথ্যা মামলাবাজের বিরুদ্ধে আদালত উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারেন)। আমরা আন্তরিকভাবে আইন কমিশনকে অনুরোধ করব, মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর আইন প্রণয়ন করার প্রস্তাব সরকারকে দেয়া হোক। এ ধরনের একটি সুনির্দিষ্ট আইন থাকলে বর্তমানে যারা মিথ্যা মামলা করে অপর কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের হয়রানি করছে বা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, তারা এ ধরনের একটি সময়োপযোগী আইন প্রণয়নের ফলে ভবিষ্যতে মিথ্যা মামলা না করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হবে।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান কে হল, তা নিয়ে বিতর্ক না করে বরং আইন কমিশনকে কিভাবে গতিশীল ও কার্যকর করা যায় তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আইন কমিশন কর্তৃক প্রণীত সুপারিশমালা যা সরকারকে সময়ে সময়ে দেয়া হয়, তা বাস্তবায়নের জন্য আমরা সম্মিলিতভাবে সরকারকে কিভাবে সহায়তা ও প্রায়োগিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি, তাই ভাবতে হবে আমাদের। তা না করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কে হলেন, তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ বিষয়াবলী নিয়ে সমালোচনা-আলোচনা করার যৌক্তিকতা কতটুকু? এতে করে আমরা কি আমাদের প্রজ্ঞার পরিচয় দিচ্ছি? আইন কমিশন ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১২৫ আইন সংক্রান্ত সুপারিশ সরকারকে দিয়েছে। সরকার সেসব প্রস্তাবনা থেকে অতি সামান্যই কার্যকর ও বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আইন কমিশন দেশের হাজার হাজার মিথ্যা মামলার শিকার লাখ লাখ বিচারপ্রার্থীর কথা চিন্তা করে মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হবে। আমরা অসহায়, পঙ্গু ও খুঁড়িয়ে চলা আইন কমিশনকে আরও এক ধাপ অগ্রসর করার জন্য প্রতিষ্ঠানটির পাশে অকৃপণভাবে দাঁড়াতে চাই। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কে হলেন- তা নিয়ে সমালোচনা করার সময়টুকু দেশের গরিব অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার পাইয়ে দেয়ার জন্য ব্যয় করতে চাই।
পলাশ কুমার রায় : আইনজীবী ও আহ্বায়ক, সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন (সুপ্রা)
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ২৩ জুলাই তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেয়েছেন। কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি প্রধান বিচারপতির প্রাপ্য বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন। ২০১০ সালের অক্টোবরে হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি আবদুর রশিদের পদত্যাগের পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। বিচারপতি হক হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অনেক মামলার রায় দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১১ সালের ১৭ মে পর্যন্ত আলোচিত বহু মামলার রায় দেন। একজন বিচারক কখনোই মামলার দুপক্ষের বিচারপ্রার্থীদের খুশি করতে পারেন না। এটাই স্বাভাবিক। এসব রায়ে এক পক্ষের বিচারপ্রার্থীরা খুশি হয়েছেন, অসন্তুষ্ট হয়েছেন অনেকেই। বিচারপ্রার্থীদের পাশাপাশি রাজনীতিক ও বড় বড় রাজনৈতিক দলের সমর্থকরাও সন্তুষ্ট-অসন্তুষ্ট হয়েছেন বিচারপতি হকের রায়ে। রাজনীতিক ও তাদের সমর্থকদের অখুশি-অসন্তুস্ট হওয়ার কারণ হল আমাদের দেশে সব কিছুতেই রাজনীতি থাকে, হয়তো সে কারণেই।
বিচারপতি হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হওয়ার পর তিন দিনের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথিতযশা অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রথম আলোয় বিচারপতি হকের নিয়োগকে প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এসএম মাসুম বিল্লাহ ওই লেখার প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, বিচারপতি খায়রুল হকের মতো একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিকে সরকার এই পদে নিয়োগ দিয়ে বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। আইন কমিশনের মর্যাদা এক ধাপ ওপরে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক যে যার অবস্থান, চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন বলেই আমার মনে হয়। দুজন শিক্ষকেরই হাত ধরে প্রতি বছর শত শত শিক্ষার্থী নবীন আইনজীবী হিসেবে সারাদেশে আইন পেশায় প্রবেশ করছেন। আবার অনেকেই হচ্ছেন নিু আদালতের বিচারক। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক পদ্ধতিগতভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার পাট চুকিয়ে প্রথমে আইন পেশা, অতঃপর যোগ্যতাবলে বিচারক হিসেবে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন। বিচারপতি হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হওয়ার পর পক্ষে-বিপক্ষে যারা লিখছেন তারাই বিচারক, আইনজীবী, আইন বিষয়ে গবেষক, মানবাধিকার কর্মীর গর্ভজাত পিতামাতা। এই শিক্ষকদ্বয় বিচারপতি হকের পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য না করে তারা কিভাবে যোগ্য, চৌকস, আদর্শবান, ন্যায়পরায়ণ এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন আইনজীবী এবং বিচারক তৈরি করতে পারেন, সেদিকে মনোযোগ দিলেই ভালো হয় বৈকি! দেশে এখন নীতিবান ও পেশাদার আইনজীবী এবং পক্ষপাতহীনভাবে ন্যায়বিচার করার মতো বিচারকের অভাব লক্ষণীয়। অধিকাংশ আইনজীবী যতটা সময় বিচারপ্রার্থী মক্কেলের আইনি অধিকার সুরক্ষার জন্য ব্যয় করেন, তার চেয়েও বেশি সময় ব্যয় করেন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর পক্ষে স্লোগান আর জয়ধ্বনি দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি আদর্শবান, ন্যায়পরায়ণ, যোগ্য, দায়িত্বশীল, কর্মঠ বিচারক তৈরি করতে প্রাণান্তভাবে প্রচেষ্টা চালান, তাহলে সেই বিচারকরা যখন অদূর ভবিষ্যতে আইন কমিশন কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে নিয়োগ লাভ করবেন, তখন তারা সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানিত হবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষকরা কি সেই বিষয়টি অনুভব করেন? আর আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরাই বা ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের কিভাবে তৈরি করার চিন্তা করেন?
কমিশনের ওয়েবসাইট পর্যালোচনায় দেখা যায়, আইন কমিশন ২০০১ সালে মিথ্যা মামলা (প্রতিরোধ ও প্রতিকার) আইন প্রণয়নের প্রস্তাব সরকারকে দেয়। তৎকালীন আইন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিচারপতি বিমলেন্দু বিকাশ রায় চৌধুরী এবং সদস্য বিচারপতি নাঈমদ্দিন আহমেদ প্রস্তাবিত এই আইনটি সময়োপযোগী করে অতিদ্রুত কার্যকর করার জোর দাবি জানাচ্ছি। আমরা এখন এমন একটি সমাজে বাস করছি যেখানে মিথ্যা বা কাল্পনিক ঘটনা সাজিয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল, আর্থিকভাবে অসচ্ছল, ক্ষমতাহীন মানুষজনকে হয়রানি বা শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে সমাজের উঁচু শ্রেণীওয়ালার লোকরা মিথ্যা মামলা দায়ের করে থাকেন। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ওই পরিবারের সদস্যরা আর্থিক, সামাজিক, মানসিকভাবে চরম ক্ষতির শিকার হন। থানা পুলিশ, কোর্ট-কাছারি আর উকিল সাহেবের চেম্বারে দৌড়াতে দৌড়াতে তারা এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েন, অবশেষে কাল্পনিক বা মিথ্যা ঘটনায় উদ্ভূত মিথ্যা মামলা প্রমাণের আর্থিক সামর্থ্য না থাকার দরুন ওই পরিবারের সদস্যরা জেলের ঘানি টানতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন। এভাবে প্রতিদিন কতগুলো মিথ্যা মামলা দায়ের হয় এবং সারাদেশে মিথ্যা মামলা এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা কত তা নির্ধারণের জন্য কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ নেই দেশে। এসব নিয়ে চিন্তা করার সময় কোথায় সরকারের? তাই সমাজের উঁচু শ্রেণীওয়ালাদের মিথ্যা মামলা দায়ের করার পরও কোনো ধরনের শাস্তি পেতে হয় না বলেই দেশে ক্রমাগতভাবে মিথ্যা মামলার সংখ্যা বাড়ছে (যদিও মিথ্যা মামলাবাজের বিরুদ্ধে আদালত উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারেন)। আমরা আন্তরিকভাবে আইন কমিশনকে অনুরোধ করব, মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর আইন প্রণয়ন করার প্রস্তাব সরকারকে দেয়া হোক। এ ধরনের একটি সুনির্দিষ্ট আইন থাকলে বর্তমানে যারা মিথ্যা মামলা করে অপর কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের হয়রানি করছে বা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, তারা এ ধরনের একটি সময়োপযোগী আইন প্রণয়নের ফলে ভবিষ্যতে মিথ্যা মামলা না করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হবে।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান কে হল, তা নিয়ে বিতর্ক না করে বরং আইন কমিশনকে কিভাবে গতিশীল ও কার্যকর করা যায় তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আইন কমিশন কর্তৃক প্রণীত সুপারিশমালা যা সরকারকে সময়ে সময়ে দেয়া হয়, তা বাস্তবায়নের জন্য আমরা সম্মিলিতভাবে সরকারকে কিভাবে সহায়তা ও প্রায়োগিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি, তাই ভাবতে হবে আমাদের। তা না করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কে হলেন, তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ বিষয়াবলী নিয়ে সমালোচনা-আলোচনা করার যৌক্তিকতা কতটুকু? এতে করে আমরা কি আমাদের প্রজ্ঞার পরিচয় দিচ্ছি? আইন কমিশন ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১২৫ আইন সংক্রান্ত সুপারিশ সরকারকে দিয়েছে। সরকার সেসব প্রস্তাবনা থেকে অতি সামান্যই কার্যকর ও বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আইন কমিশন দেশের হাজার হাজার মিথ্যা মামলার শিকার লাখ লাখ বিচারপ্রার্থীর কথা চিন্তা করে মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হবে। আমরা অসহায়, পঙ্গু ও খুঁড়িয়ে চলা আইন কমিশনকে আরও এক ধাপ অগ্রসর করার জন্য প্রতিষ্ঠানটির পাশে অকৃপণভাবে দাঁড়াতে চাই। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কে হলেন- তা নিয়ে সমালোচনা করার সময়টুকু দেশের গরিব অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার পাইয়ে দেয়ার জন্য ব্যয় করতে চাই।
পলাশ কুমার রায় : আইনজীবী ও আহ্বায়ক, সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন (সুপ্রা)
No comments