ধর্ষিত হওয়ার আত্মগ্লানি থেকে কেউই মুক্তি পায়নি- বীরাঙ্গনা ৭১ by মুনতাসীর মামুন
নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে যারা চিকিৎসা
নিতে এসেছিলেন তাদের সবাইকে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনার বর্তমান মানসিক
অবস্থা কী?’ প্রত্যেকে এক বাক্যে বলেছেন, ‘অবস্থা খুব খারাপ’ বা ‘মরে যেতে
ইচ্ছা করে।
’ ধর্ষিত হওয়ার আত্মগ্লানি থেকে কেউই মুক্তি পায়নি।
এই আত্মগ্লানি আরও চরম হয়েছে যখন ভিকটিম দেখেছেন অনেক ক্ষেত্রে, মা-বাবা
তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন ঘরে। মা-বাবা স্থান দিলেও পরিবারের অন্য সদস্যরা
মিশতে চাননি। গ্রামে অনেক ক্ষেত্রে একঘরে করে রাখা হয়েছে। স্বামী গ্রহণ
করলেও বা না জেনে গ্রহণ করে পরে জেনে ত্যাগ করেছে, দুর্ব্যবহার তো করেছেই।
কেউ যদি তাদের জিজ্ঞেস করতে পারত তখন যে, তোমাদের দায়িত্ব ছিল রক্ষা করার
তা তোমরা পারনি বা করনি এবং এ জন্য তোমরা দায়ী সে প্রশ্নের উত্তর কারও
পক্ষে দেয়া সম্ভব ছিল না। এখন অবস্থার খানিকটা উন্নতি হলেও এক দশক আগেও
পরিস্থিতি অনুকূল ছিল না। গণআদালতে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ১৯৯২ সালে এলেজান,
মাসুদা ও দুলজানকে ঢাকা আনা হয়েছিল। তাড়াতাড়ি আদালতের কাজ শেষ হয়ে গেলে
তারা ফিরে গিয়েছিলেন। গ্রামে ফিরে যাওয়ার পর জানাজানি হয়েছিল যে, তারা
বীরাঙ্গনা। তখন গ্রামবাসীরা তাদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করেছে। শাহরিয়ার কবির
তাঁর একটি চলচ্চিত্রে তাদের ক্ষোভ তুলে ধরেছিলেন। এখানে তা উদ্ধৃত করছি
দীর্ঘ হলেও যাতে বোঝা যায় এখনও সমাজ তাদের কীভাবে দেখে মাসুদা বলে, “সমাজের
লোক, পাড়া প্রতিবেশী আমাদের ঘেন্না করে। দেখতে পারে না। টিউবওয়েলের পানি
খেতে যাই, তাও দেয় না। এই অবস্থা। ছেলেপেলে আছে, বাড়ি থেকে বের হলে ওই বলে
গাল দেয়। গাল দেয় অমুকের অমুক হইছিল। বাড়িতে ঘর-দরজা যা ছিল সব লুটপাট করে
নিয়ে গেছে। কিছুই নেই। সবই সেই বছর থেকে। সব শেষ করে পথের ভিখারি হয়েছি।
আমাদের কোনো সম্পদ নেই।’
এলেজান এখন স্বামীর সঙ্গেও আমার অসুবিধা। স্বামীও আমাকে দেখতে পারে না। মেয়ে বিয়ে দেব। সেই মেয়েটাও এখন নিতে চাচ্ছে না যে তোমার মেয়ে আমি নিতে পারছি না। তুমি হলে ঘৃণ্য, তুমি খারাপ। তোমার মেয়ে নিয়ে আমি কি করব। নাই টাকা-পয়সা। আমার মেয়ে বিয়ে দেব কী করে? ওইভাবে পড়ে আছে। Ñঘরও নেই বাড়িও নেই। আমার জায়গাও নেই জমিও নেই। গরু বাছুরও নেই যে আমি সেই কাম করে খাব। এই ইয়েতে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসছি। আমার বলতে কেউ নেই। আমার এখন কেউ নেই। আমার মনে খুব দুঃখ। দুঃখের ঠেলায় বাড়ি থেকে বার হয়ে আসছি। যে সময় আমার এ রকম কাম করিছিল সেই সময় আমার জান হত্যা করে দিলে আমি চলে যেতাম। এই দুঃখের কাহিনী আর কাউকে বলতে হতো না।...
মাসুদা খাতুনের ছেলে আবদুল বারিকÑ ১৯৭১ সালে আমার মা-আমি তখন একেবারে ছোট, তিন মাস বয়স। যখন আমার বয়স বিশ বছর হলো তখন শুনতে পেলাম যে, বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় যে ঘটনা হয়েছিল, এ ঘটনা আস্তে আস্তে তখন আমি বুঝতে পারলাম। যুদ্ধের সময় যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তখন অনেক মা-বোনের ইজ্জত দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু এই ব্যাপার নিয়ে অনেক কথা মানুষের কাছে শুনতে হয়। এর বিচার হয়নি। কেউ কোনো সাহায্য পায়নি। আমার একটাই দাবি। আমরা যেন মানুষের সামনে চলতে পারি, সবার সামনে যেতে পারি।
যে পরিবারে কেউ ধর্ষিত হয়েছেন বা নির্যাতিত তিনি তা গোপনে রাখতে চেয়েছেন। গ্রামে সেটি সব ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। শহরে হয়তো হয়েছে। অনেকে গোপন রেখে বিয়ে দিতে পেরেছেন। কেউ আজ পর্যন্ত তা জানেনি। অনেকে জেনে-শুনে বিয়ে করেছেন। অনেকে আর সমাজে ফিরতে চাননি, বিদেশে এনজিওদের সাহায্যে চলে গেছেন এবং ভালও আছেন। নীলিমা ইব্রাহিমের গ্রন্থে এ রকম কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক ধর্ষিতাকে হত্যা করা হয়েছে। শরণার্থী হিসেবে যারা ভারতে যাওয়ার পথে ধর্ষিত হয়েছেন তাদের অনেকে আর ফেরেননি। পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গেও অনেকে বাধ্য হয়ে চলে গেছেন বা যেতে বাধ্য হয়েছেন।
ডা. এম এ হাসান ২৬৭ জন নারীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন। সে প্রতিবেদন অনুসারে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা ৬৬.৫০%। অবিবাহিত ৩৩.৫০%। গণধর্ষণ/স্থানিক ধর্ষণ ৭০%, কারাগারে ও ক্যাম্পে নারী নির্যাতিত ১৮%, অন্যান্য অবস্থায় নির্যাতিত ১২%, নির্যাতনের কারণে স্বামী কর্তৃক লাঞ্ছিত বা পরিত্যক্ত ৭% ও আত্মীয় বা পরিজনদের দ্বারা ধর্ষিত ৯০%।
এই প্রতিবেদন সঠিক, তা নয়। একটি ধারণা মাত্র। ধর্ষিত হওয়ার পর বিবাহিতরা স্বাভাবিকভাবেই স্বামী কর্তৃক পরিত্যজ্য হবেন কিনা সেই ভয়ই করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত হয়েছেন বা গঞ্জনা সয়েছেন। আমাদের কেস স্টাডিগুলোতে সেই সংখ্যাই বেশি। তবে, আত্মীয়স্বজনরা বা পাড়া- প্রতিবেশীরা অনেককে সহায়তা করেছেন। ক্লিনিকে ভর্তি করে দিয়েছেন। ধর্ষিত, লাঞ্ছিত বা নির্যাতিতদের মধ্যে ধর্মীয় ভিত্তিতে ধরলে মুসলমানের সংখ্যা বেশি।
সামগ্রিকভাবে কিন্তু সমাজ ধর্ষিতাদের সানন্দে গ্রহণ করেনি। অধিকাংশ নারী সুচিকিৎসা পাননি। যারা পরিত্যজ্য হয়েছেন তাদের বেঁচে বর্তে থাকা ছিল মুশকিল। কাউন্সেলিং হয়নি। অধিকাংশই রোগাক্রান্ত অবস্থায় ভুগেছেন। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। স্বাধীনতার পর পর ডাক্তারের উচিত ছিল ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের স্বেচ্ছায় সুচিকিৎসা দেয়া। কিন্তু তারা তা দেননি, দিতে চাননি আইনের অজুহাত দেখিয়ে। ডা. ডেভিস তখন প্রায় ১০০০ ডাক্তারের এক সম্মেলনে তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “এই সব অন্তঃসত্ত্বা মহিলার গর্ভপাত আইনসম্মত করার জন্য সরকার বিশেষ আইন প্রবর্তন করেছেন বলে অধিকাংশ বাঙালী ডাক্তারই বিশ্বাস করেননি। প্রধানমন্ত্রীর অফিস কর্তৃক বার বার আশ্বস্ত হওয়া সত্ত্বেও ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের দ্রুত অবনতিশীল সমস্যার সমাধানে সাহায্য করার চাইতে বাঙালী ডাক্তাররা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপারে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন।”
ডা. ডেভিস বলেন, “একটি সেমিনারে তাকে ৯০ ভাগ প্রশ্ন করা হয়েছিল কর্মসূচিতে বৈধতা সম্পর্কে, বাকি ১০ ভাগ প্রশ্ন আমি যে টেকনিক সম্বন্ধে বক্তৃতা করি সে সম্পর্কে।”
অনেক নির্যাতিতা/ধর্ষিতা মহিলা আত্মহত্যা করেন যার নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। ডা. ডেভিস জানিয়েছিলেন, জানুয়ারি-১৯৭২ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত যে সব মহিলা আত্মহত্যা করেন তাদের আত্মীয়স্বজন তা জানাননি। কারণ যদি তদন্ত হয়।
ডা. ডেভিস সেই সব দুঃখজনক ঘটনার কিছু উল্লেখ করেছেন। যেমন ক্যাম্পে যে সব মেয়েকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের নগ্ন রাখা হতো। “হতভাগা বন্দী নারীদের যখনই শাড়ি পরতে দেয়া হয়েছে তখনই তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আত্মহত্যা করেছেন। অনেকে বুকে পাথর বেঁধে পুলের ওপর থেকে নিচে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। যারা প্রাণে বেঁচে গেছেন তেমন হাজার হাজার মহিলা তাদের পরিবার কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছেন।... বর্তমানে দেখতে ‘অপরিচ্ছন্ন’। এ ধরনের ঘটনা বড়ই মর্মান্তিক।”
ডা. ডেভিস বলেন, “চট্টগ্রামে আমি একজন মহিলাকে দেখেছি। তিনি বিধবা। যুদ্ধে তার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। তার সন্তান ছয়টি এবং তিনি অন্তঃসত্ত্বা। গর্ভপাত ঘটানোর পর এই মহিলার থাকার মতো স্থান নেই। ছেলেমেয়েদের আহার যোগানোর কোন সংস্থান নেই। আরেক মহিলার স্বামী যখন যুদ্ধে গেছেন তখন তাকে হানাদাররা ধর্ষণ করে। স্বামী এসে দেখেন স্ত্রী গর্ভবতী। তিনি স্ত্রী ও ছয়টি ছেলেমেয়েকে ফেলে চলে যান।”
১৯ বছরের আরেক তরুণী। ডা. ডেভিস যখন তাকে দেখেন তখন তিনি ছয় মাসের গর্ভবতী। তার আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধব তাকে ত্যাগ করে চলে যায়। সে স্বল্প সময়ের জন্য সাহায্য কেন্দ্রে আশ্রয় পায়। তারপর কোথায় যাবে কেউ জানে না।
বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের সঙ্গে নীলিমা ইব্রাহিম জড়িত ছিলেন। শাহরিয়ার ১৯৯৮ সালে তার একটি সাক্ষাতকার নেন। নীলিমা ইব্রাহিম জানিয়েছিলেন, ’৭২ সালে যখন পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীরা ভারতে চলে যাচ্ছে তখন তিনি খবর পান যে, প্রায় ৩০-৪০ জন ‘ধর্ষিতা নারী তাদের সঙ্গে দেশত্যাগ করছেন। (চলবে)
এলেজান এখন স্বামীর সঙ্গেও আমার অসুবিধা। স্বামীও আমাকে দেখতে পারে না। মেয়ে বিয়ে দেব। সেই মেয়েটাও এখন নিতে চাচ্ছে না যে তোমার মেয়ে আমি নিতে পারছি না। তুমি হলে ঘৃণ্য, তুমি খারাপ। তোমার মেয়ে নিয়ে আমি কি করব। নাই টাকা-পয়সা। আমার মেয়ে বিয়ে দেব কী করে? ওইভাবে পড়ে আছে। Ñঘরও নেই বাড়িও নেই। আমার জায়গাও নেই জমিও নেই। গরু বাছুরও নেই যে আমি সেই কাম করে খাব। এই ইয়েতে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসছি। আমার বলতে কেউ নেই। আমার এখন কেউ নেই। আমার মনে খুব দুঃখ। দুঃখের ঠেলায় বাড়ি থেকে বার হয়ে আসছি। যে সময় আমার এ রকম কাম করিছিল সেই সময় আমার জান হত্যা করে দিলে আমি চলে যেতাম। এই দুঃখের কাহিনী আর কাউকে বলতে হতো না।...
মাসুদা খাতুনের ছেলে আবদুল বারিকÑ ১৯৭১ সালে আমার মা-আমি তখন একেবারে ছোট, তিন মাস বয়স। যখন আমার বয়স বিশ বছর হলো তখন শুনতে পেলাম যে, বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় যে ঘটনা হয়েছিল, এ ঘটনা আস্তে আস্তে তখন আমি বুঝতে পারলাম। যুদ্ধের সময় যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তখন অনেক মা-বোনের ইজ্জত দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু এই ব্যাপার নিয়ে অনেক কথা মানুষের কাছে শুনতে হয়। এর বিচার হয়নি। কেউ কোনো সাহায্য পায়নি। আমার একটাই দাবি। আমরা যেন মানুষের সামনে চলতে পারি, সবার সামনে যেতে পারি।
যে পরিবারে কেউ ধর্ষিত হয়েছেন বা নির্যাতিত তিনি তা গোপনে রাখতে চেয়েছেন। গ্রামে সেটি সব ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। শহরে হয়তো হয়েছে। অনেকে গোপন রেখে বিয়ে দিতে পেরেছেন। কেউ আজ পর্যন্ত তা জানেনি। অনেকে জেনে-শুনে বিয়ে করেছেন। অনেকে আর সমাজে ফিরতে চাননি, বিদেশে এনজিওদের সাহায্যে চলে গেছেন এবং ভালও আছেন। নীলিমা ইব্রাহিমের গ্রন্থে এ রকম কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক ধর্ষিতাকে হত্যা করা হয়েছে। শরণার্থী হিসেবে যারা ভারতে যাওয়ার পথে ধর্ষিত হয়েছেন তাদের অনেকে আর ফেরেননি। পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গেও অনেকে বাধ্য হয়ে চলে গেছেন বা যেতে বাধ্য হয়েছেন।
ডা. এম এ হাসান ২৬৭ জন নারীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন। সে প্রতিবেদন অনুসারে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা ৬৬.৫০%। অবিবাহিত ৩৩.৫০%। গণধর্ষণ/স্থানিক ধর্ষণ ৭০%, কারাগারে ও ক্যাম্পে নারী নির্যাতিত ১৮%, অন্যান্য অবস্থায় নির্যাতিত ১২%, নির্যাতনের কারণে স্বামী কর্তৃক লাঞ্ছিত বা পরিত্যক্ত ৭% ও আত্মীয় বা পরিজনদের দ্বারা ধর্ষিত ৯০%।
এই প্রতিবেদন সঠিক, তা নয়। একটি ধারণা মাত্র। ধর্ষিত হওয়ার পর বিবাহিতরা স্বাভাবিকভাবেই স্বামী কর্তৃক পরিত্যজ্য হবেন কিনা সেই ভয়ই করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত হয়েছেন বা গঞ্জনা সয়েছেন। আমাদের কেস স্টাডিগুলোতে সেই সংখ্যাই বেশি। তবে, আত্মীয়স্বজনরা বা পাড়া- প্রতিবেশীরা অনেককে সহায়তা করেছেন। ক্লিনিকে ভর্তি করে দিয়েছেন। ধর্ষিত, লাঞ্ছিত বা নির্যাতিতদের মধ্যে ধর্মীয় ভিত্তিতে ধরলে মুসলমানের সংখ্যা বেশি।
সামগ্রিকভাবে কিন্তু সমাজ ধর্ষিতাদের সানন্দে গ্রহণ করেনি। অধিকাংশ নারী সুচিকিৎসা পাননি। যারা পরিত্যজ্য হয়েছেন তাদের বেঁচে বর্তে থাকা ছিল মুশকিল। কাউন্সেলিং হয়নি। অধিকাংশই রোগাক্রান্ত অবস্থায় ভুগেছেন। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। স্বাধীনতার পর পর ডাক্তারের উচিত ছিল ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের স্বেচ্ছায় সুচিকিৎসা দেয়া। কিন্তু তারা তা দেননি, দিতে চাননি আইনের অজুহাত দেখিয়ে। ডা. ডেভিস তখন প্রায় ১০০০ ডাক্তারের এক সম্মেলনে তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “এই সব অন্তঃসত্ত্বা মহিলার গর্ভপাত আইনসম্মত করার জন্য সরকার বিশেষ আইন প্রবর্তন করেছেন বলে অধিকাংশ বাঙালী ডাক্তারই বিশ্বাস করেননি। প্রধানমন্ত্রীর অফিস কর্তৃক বার বার আশ্বস্ত হওয়া সত্ত্বেও ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের দ্রুত অবনতিশীল সমস্যার সমাধানে সাহায্য করার চাইতে বাঙালী ডাক্তাররা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপারে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন।”
ডা. ডেভিস বলেন, “একটি সেমিনারে তাকে ৯০ ভাগ প্রশ্ন করা হয়েছিল কর্মসূচিতে বৈধতা সম্পর্কে, বাকি ১০ ভাগ প্রশ্ন আমি যে টেকনিক সম্বন্ধে বক্তৃতা করি সে সম্পর্কে।”
অনেক নির্যাতিতা/ধর্ষিতা মহিলা আত্মহত্যা করেন যার নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। ডা. ডেভিস জানিয়েছিলেন, জানুয়ারি-১৯৭২ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত যে সব মহিলা আত্মহত্যা করেন তাদের আত্মীয়স্বজন তা জানাননি। কারণ যদি তদন্ত হয়।
ডা. ডেভিস সেই সব দুঃখজনক ঘটনার কিছু উল্লেখ করেছেন। যেমন ক্যাম্পে যে সব মেয়েকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের নগ্ন রাখা হতো। “হতভাগা বন্দী নারীদের যখনই শাড়ি পরতে দেয়া হয়েছে তখনই তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আত্মহত্যা করেছেন। অনেকে বুকে পাথর বেঁধে পুলের ওপর থেকে নিচে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। যারা প্রাণে বেঁচে গেছেন তেমন হাজার হাজার মহিলা তাদের পরিবার কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছেন।... বর্তমানে দেখতে ‘অপরিচ্ছন্ন’। এ ধরনের ঘটনা বড়ই মর্মান্তিক।”
ডা. ডেভিস বলেন, “চট্টগ্রামে আমি একজন মহিলাকে দেখেছি। তিনি বিধবা। যুদ্ধে তার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। তার সন্তান ছয়টি এবং তিনি অন্তঃসত্ত্বা। গর্ভপাত ঘটানোর পর এই মহিলার থাকার মতো স্থান নেই। ছেলেমেয়েদের আহার যোগানোর কোন সংস্থান নেই। আরেক মহিলার স্বামী যখন যুদ্ধে গেছেন তখন তাকে হানাদাররা ধর্ষণ করে। স্বামী এসে দেখেন স্ত্রী গর্ভবতী। তিনি স্ত্রী ও ছয়টি ছেলেমেয়েকে ফেলে চলে যান।”
১৯ বছরের আরেক তরুণী। ডা. ডেভিস যখন তাকে দেখেন তখন তিনি ছয় মাসের গর্ভবতী। তার আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধব তাকে ত্যাগ করে চলে যায়। সে স্বল্প সময়ের জন্য সাহায্য কেন্দ্রে আশ্রয় পায়। তারপর কোথায় যাবে কেউ জানে না।
বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের সঙ্গে নীলিমা ইব্রাহিম জড়িত ছিলেন। শাহরিয়ার ১৯৯৮ সালে তার একটি সাক্ষাতকার নেন। নীলিমা ইব্রাহিম জানিয়েছিলেন, ’৭২ সালে যখন পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীরা ভারতে চলে যাচ্ছে তখন তিনি খবর পান যে, প্রায় ৩০-৪০ জন ‘ধর্ষিতা নারী তাদের সঙ্গে দেশত্যাগ করছেন। (চলবে)
No comments