ভবিষ্যত জয় করার জন্য by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ববাংলার রাজনৈতিক দলগুলি : আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, মুজাফফর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পাকিস্তান রাষ্ট্রবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছে।
এই অবস্থানের দুটি দিক : একদিকে আছে পূর্ববাংলার কলোনিয়াল অবস্থান অস্বীকার করা, অপরদিকে আছে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভিতর থেকে ধ্বংস করা। পাকিস্তান রাষ্ট্র গণতন্ত্র উচ্ছেদ করার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্টিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেমন প্রবর্তন করেছে তেমনি পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি মুসলিম লীগ এবং জামায়াতে ইসলামীকে ফ্যাসিজমের এজেন্সি ও পাকিস্তানী রাজনৈতিক পুলিশে পর্যবসিত করেন। এভাবে রাজনৈতিক বিভাজন পাকিস্তান রাষ্ট্রকে বিভাজিত করে, রাজনৈতিক দলগুলো পাকিস্তানের পক্ষে ও পাকিস্তানের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া শুরু করে। পূর্ববাংলার রাজনৈতিক দলগুলো কৃষক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। বিপরীতে পাকিস্তানী রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক পুলিশের কাজ করে পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া শুরু করে। বাঙালী সমাজ লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে নিজেদের অতীত খুঁজে বার করে, যে অতীত ও ইতিহাস পাকিস্তানী সমাজ থেকে ভিন্ন। বাঙালী সমাজ, বিশেষ করে এই সমাজের তরুণ অংশ অসম্ভব পরিশ্রম করে ও বিভিন্ন বিপদ উপেক্ষা করে নিজেদের অতীত জেনেছে। এই অতীত তাদের ইতিহাস এবং এই ইতিহাস পাকিস্তানের রাষ্ট্রের ইতিহাস থেকে একেবারে আলাদা। লড়াকু কৃষকের বংশধর এসব তরুণ বিভিন্ন আলোচনাচক্র খুলেছে, গোপনে মিলিত হয়েছে, রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির লড়াই তীব্র থেকে তীব্র হয়েছে, এসব আলোচনাচক্র গোপন শিক্ষায়তনে পর্যবসিত হয়েছে, উর্দুওয়ালা সংস্কৃতি কিংবা পাকিস্তানমুখী সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে দখলদার সেনাবাহিনীর সংস্কৃতি। ভূতলের স্টাডি গ্রুপগুলো জোর দিয়েছে পূর্ববাংলার জাতীয় ইতিহাস শেখানোর ক্ষেত্রে, কৃষক বিদ্রোহের ক্ষেত্রে (তেভাগা আন্দোলন, হাজং আন্দোলন, নানকর আন্দোলন, জিরাতিয়া আন্দোলন বাঙালীদের ইতিহাসের জ্ঞান বিস্তৃত করেছে এভাবে), এভাবে বিস্তৃত হয়েছে সামাজিক ইতিহাস ও শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। সাধারণ মানুষের জীবনযাপন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী প্রতিরোধ মিলেমিশে গেছে। এসব প্রতিরোধ বিদেশীদের (পাকিস্তানীদের) আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একই সঙ্গে পূর্ববাংলার ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল ভাসানী, ন্যাপ মুজাফফর : রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস দুই দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা দরকার। একটা হচ্ছে পূর্ববাংলার অভ্যন্তরে শ্রেণীসংগ্রামের দৃষ্টিকোণ থেকে, অপরটা হচ্ছে ভারতীয় জাতীয়তার ইতিহাস এবং পাকিস্তানী জাতীয়তার ইতিহাস (শেষোক্ত ক্ষেত্রে ইসলাম ও মুসলমানের ইতিহাস) বিভিন্নমুখী প্রক্রিয়া থেকে। এ দুটি ফ্যাক্টর ধারাবাহিকভাবে পরস্পরের ক্ষেত্রে প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। কোন অন্বেষণই সম্পূর্ণ হবে না কোন একটিকে বাদ দিলে। যত দিন গেছে, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ইসলামী প্রক্রিয়া ও ভারতের ক্ষেত্রে সেক্যুলার প্রক্রিয়ার টানাপোড়েন পূর্ববাংলার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর প্রতিক্রিয়া ও ভূমিকা পালন করেছে। পূর্ববাংলার সমাজের ক্ষেত্রে শ্রেণীসংগ্রাম এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র ও ভারতীয় রাষ্ট্র মধ্যকার মতাদর্শিক প্রক্রিয়াগুলো পূর্ববাংলার রাজনৈতিক দলগুলোকে লড়াকু করে রেখেছে। আবার এসব লড়াকু রোধের সঙ্গে ক্ষান্তিহীন সংগ্রাম হয়েছে মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে। জাতীয় স্বাধীনতার লড়াই এভাবে তৈরি হয়েছে। মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থার কেন্দ্রীয় অংশ হিসেবে পূর্ববাংলার রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে এবং এই পরিকল্পিত হস্তক্ষেপ থেকে তৈরি হয়েছে এক ধরনের স্টালিনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থ শক্তি হচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, যে বাহিনীর রাজনীতির অংশ হচ্ছে দুটি রাজনৈতিক দল : মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী। পাকিস্তান থেকে সেনাবাহিনীর অথরিটি নিয়ে গণতন্ত্র এবিউস করেছে। মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি দিয়ে পূর্ববাংলার আওয়ামী লীগের রাজনীতি, কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি, ভাসানী ন্যাপের রাজনীতি, মুজাফফর ন্যাপের রাজনীতি খ-বিখ- করার চেষ্টা করেছে মুসলিম মতাদর্শ অনুপ্রবেশ করিয়ে। বাঙালী জাতীয়তাবাদে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে বিভিন্ন সম্প্রদায়, পাহাড়ী ও আরণ্যক সমাজ, বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শ এসব মিলে তৈরি হয় বাঙালী জাতি, উত্তরে হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত, পূর্বে আরাকান ও বার্মার পাহাড়ের স্রোত থেকে পশ্চিমে ভারতীয় পশ্চিম বাংলার সমতলভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত এই জাতি। বাংলাদেশের ইতিহাস এই বিস্তৃতির মধ্যে বেড়ে উঠেছে।
গ্রেফতার বেশুমার হয়েছে। বিচারের প্রসেস মেলা ঘটেছে (তার মধ্যে সবচেয়ে প্রধান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা)। নির্যাতনের ধারায় অসংখ্য মানুষ কারাবন্দী হয়েছে (আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ভাসানী, ন্যাপ মুজাফফরপন্থী কর্মী ও নেতায় ভরে গেছে জেলখানা)। যেন বিদ্রোহ চতুর্দিকে, যেন বিদ্রোহ তৈরি করেছে বিপ্লব, বিপ্লবে অংশ নিয়েছে মানুষ এবং মানুষ। আসাদ গেট এই বিদ্রোহের, এই বিপ্লবের প্রতীক। তিনি কি করে প্রতীক হলেন, প্রগতিশীল ও বিপ্লবী আন্দোলনের ছাত্র নেতা আসাদের ওপর কর্তৃপক্ষের (আইয়ুব খানের নফর মোনায়েম খানের) পূর্ব থেকে আক্রোশ ছিল। পূর্ববর্তী বছরের ২৮ নভেম্বর হাতিরদিয়া বাজারে কৃষক সমিতি বিভিন্ন দাবির ভিত্তিতে হরতাল আহ্বান করেছিল। পুলিশ হরতালের দিন গুলি চালালে চারজন নিহত এবং এমএ পাস করার পর আইন বিভাগে অধ্যয়নরত ছাত্র আসাদ আহত হন। আহত আসাদকে পুলিশ সেদিন গ্রেফতার করতে পারেনি। হাতিরদিয়ায় গুলিবর্ষণের খবর আহত আসাদই ঢাকায় এসে পত্রিকাগুলোতে পরিবেশন করেছিলেন। আসাদ গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান। পার্শ্ববর্তী ব্যক্তিদের অনেকে আসাদকে চিনতেন। তারাই আসাদকে হাসপাতালে নিয়ে যান। আমরা একই সময় অর্ধচেতন অবস্থায় আহত ফটোগ্রাফার মোজাম্মেলকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে জানতে পারি যে, গুলিবিদ্ধ মৃত ব্যক্তি আসাদ। এই হত্যার জন্য দায়ী বলে নির্দিষ্ট করে ছাত্ররা একজন পুলিশ অফিসারের নাম উল্লেখ করেছিল। ডিএসপি বাহাউদ্দিন। এই হত্যাকা-ের তদন্ত ও বিচারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি নিয়েই প্রতিবাদী আসাদ গেট ঢাকার বুকে দাঁড়িয়ে আছে।
বিদ্রোহ ও বিপ্লবের কখনও মৃত্যু হয় না। বিদ্রোহ ও বিপ্লবের রাজনীতির কখনও ক্ষয় হয় না। অতীত জানতে হয় ভবিষ্যত জয় করার জন্য।

No comments

Powered by Blogger.