কিশোরী মাতৃত্ব রোধে হেরে যাচ্ছে লাতিন আমেরিকা by নাজনীন আখতার
রান্নাঘরে
বসে নুনেজ স্মৃতিচারণা করছিলেন। তাঁর শারীরিক আকৃতি জানান দিচ্ছিল, তিনি
মা হতে যাচ্ছেন। ১৮ বছর বয়সী এই তরুণীর পুরো নাম রাধাইসিস মার্তিনেজ নুনেজ।
তিনি যখন কথা বলছিলেন, তখন তাঁর গা ঘেঁষে দুই বছর বয়সী এক নগ্ন শিশু
নড়াচড়া করছিল। শিশুটি নুনেজেরই ছেলে। মাকে বিরক্ত করছিল বলে আয়া তাকে
সরানোর চেষ্টা করছিলেন। নুনেজ জানান, মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি প্রথম
গর্ভধারণ করেন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ছেলের বাবা মারা গেছেন। গর্ভের
সন্তানটি তাঁর আরেক সঙ্গীর। নুনেজ বিদ্যালয়ে পড়তেন, তবে সন্তান গর্ভধারণের
পর পড়াশোনায় আর ফিরে যাননি।
নুনেজের দেশের নাম ডমিনিকান রিপাবলিক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর লাতিন আমেরিকার একটি দেশ। নুনেজের শহরের নাম ইস্তেবানিয়া। দেশটির দক্ষিণ উপকূলের শহরটি পরিচিত ‘লা ভিলা দে লাস বেলাস’ বলে, অর্থাৎ ‘সৌন্দর্যের শহর’ নামে। তবে জলরাশিঘেরা অপরূপ শহরটিতে কলঙ্কের দাগের মতো বসে আসে কিশোরী মাতৃত্ব। বিশ্বজুড়ে কিশোরী মাতৃত্বের বিরুদ্ধে যে এত লড়াই, এর কোনো প্রভাব নেই সেখানে। বেশির ভাগ মেয়ে কৈশোরে পা দিয়েই মাতৃত্বকে বরণ করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। দুই-পঞ্চমাংশ মা সেখানে কিশোরী। আফ্রিকার পর কিশোরী মাতৃত্ব হারের দিক দিয়ে এই শহরের অবস্থান।
শহরের এক নার্সের ভাষায়, এত কম বয়সে মা হওয়া মানে এটা বোঝায় না যে শহরের মেয়েরা দারুণ সুন্দর। এর জন্য যৌনতা নিয়ে যথাযথ জ্ঞানের অভাব এবং যথেচ্ছ মেলামেশাকে দায়ী করেন তিনি।
লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর কমবেশি ইস্তেবানিয়ার মতোই দশা! লাতিন আমেরিকার এক-তৃতীয়াংশ নারী ২০ বছর বয়স পেরোনোর আগেই মা হন। সাব-সাহারা আফ্রিকা ছাড়া আর কোনো অঞ্চলে এত বেশি হারে কিশোরী মায়েদের সন্তান জন্ম দেওয়ার ঘটনা ঘটে না। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক শাখা প্যান আমেরিকান স্বাস্থ্য সংস্থা (পিএএইচও), জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ ও জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক তহবিলের (ইউএনএফপিএ) যৌথ প্রতিবেদনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর কিশোরী মাতৃত্বের উচ্চহার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এতে এই পরিস্থিতির জন্য জন্মনিরোধক পাওয়ার ঘাটতি ও নারীর প্রতি সহিংসতাকে দায়ী করা হয়। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রতি এক হাজার কিশোরীর সন্তান জন্মদানের হার ৬৬ দশমিক ৫ শতাংশ। যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশে একই বয়সী কিশোরীদের সন্তান জন্মদানের হার প্রতি হাজারে ৪৬ শতাংশ।
লাতিন আমেরিকা একমাত্র অঞ্চল, যেখানে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে মাতৃত্বের হার বাড়ছে। লাতিন আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের মা হওয়ার হার ১৯৯০ থেকে ২০১২ সালের তুলনায় তিন গুণ বেড়েছে।
এই অঞ্চলের সরকারগুলো এখন উপলব্ধি করতে পারছে যে এটা একটি সমস্যা। কিশোরী মাতৃত্বের হার কমাতে এক দশক ধরে জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এ খাতে ধীরগতিতে অগ্রগতি হচ্ছে। কম বয়সী মা ও শিশু দেশের জন্য খারাপ পরিণতি ডেকে আনে। ১৬ বছরের কম বয়সের মায়ের মৃত্যুহার ২০ বছর বয়সী মায়ের তুলনায় চার গুণ বেশি। আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় লাতিন আমেরিকার নারীরা দেরিতে বিয়ে করেন। ফলে, সামঞ্জস্যহীনভাবে কিশোরী মায়েদের একাকী মা হতে হয়। মেক্সিকোতে গড়ে ২৭ বছর বয়সে নারীরা বিয়ে করেন। তবে সেখানে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রায় এক–চতুর্থাংশ একাকী মা রয়েছেন।
কম বয়সে মা হওয়ার কারণে ওই নারীদের পেশাগত জীবনও বাধাগ্রস্ত হয়। ব্রাজিলের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সেখানে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ কমছে। মেয়ের সন্তান দেখাশোনা করতে গিয়ে কাজ ছাড়তে হয় নানিকে। ডমিনিকান রিপাবলিকে কিশোরী মায়েরা অন্য মেয়েদের তুলনায় বিদ্যালয়ে গড়ে দুই বছর কম পড়ে। অর্ধেকের কম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।
লাতিন আমেরিকার সংস্কৃতিতে কৈশোরে মা হওয়াকেই উৎসাহিত করা হয়। এই অবস্থা পরিবর্তনে সরকারের তরফ থেকে পদক্ষেপ খুব কম। দরিদ্র পরিবার থেকে আসা মেয়েরা পড়াশোনার চেয়ে মা হওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। এক-তৃতীয়াংশ ডমিনিকান নারী মা হওয়ার জন্য বিদ্যালয় ছেড়ে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্লেয়ার ব্রিনডিসের মতে, গর্ভধারণকে কিছু মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার প্রথম ধাপ বলে মনে করে। তাদের মতে, মা হলে যত্ন পাওয়া যায়, পরিবারের মনোযোগ পাওয়া যায়। এই অধ্যাপকের কথার প্রমাণ পাওয়া গেছে ইস্তেবানিয়ার ১৬ বছর বয়সী এক মা দারলেনিসের কথায়। ওই কিশোরী মা বলে, মা হলে পুরো বিশ্ব শ্রদ্ধা করে।
আবার অনেক মেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে নিজেদের নিরাপত্তা বাড়াতে নতুন পরিবার গড়ে তোলে। নির্যাতন করে—এমন পরিবার থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রেমিকের হাত ধরে তারা বেরিয়ে যায়।
বিশ্ব ব্যাংকের রাফায়েল কর্তেজ অপরাধপ্রবণ এল সালভেদরের কম বয়সী মায়েদের একবার সাক্ষাৎকার নেন। ওই সময় তিনি অবাক হন যে ওই মায়েদের অর্ধেকেরই গর্ভধারণের আগ্রহ ছিল।
বেশির ভাগ কিশোরীর কাছে গর্ভধারণ একধরনের বিস্ময় নিয়েই আসে। অনেক বিদ্যালয়ে যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে কোনো শিক্ষা দেওয়া হয় না। জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায় না।
ইস্তেবানিয়ার নুনেজ জানান, তিনি এলাকার এক ক্লিনিকে দিয়ে জন্মনিরোধক চেয়েছিলেন, কিন্তু পাননি। সেখানে পুরুষেরা নারীদের যৌন সম্পর্কের জন্য চাপ দেয়, আর নারীরা তা প্রত্যাখ্যান করতে শেখেনি।
লাতিন আমেরিকায় ক্যাথলিক গির্জার প্রভাব রয়েছে। তাই সেখানে যৌনতা নিয়ে সেভাবে খোলামেলা আলোচনা করা হয় না। হন্ডুরাসে ক্যাথলিক ও ইভানজেলিকাল গির্জাগুলো গত বছর দেশটির পাঠ্যপুস্তকে যৌনবিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে। জন্মনিয়ন্ত্রণেরও বিরোধিতা করে গির্জাগুলো। এসব কারণেও সরকারগুলো কিশোরী মাতৃত্ব হ্রাসে জোরালো ভূমিকা রাখতে চায় না।
এর মধ্যেও ব্যতিক্রম রয়েছে। কলাম্বিয়ার রাজধানী বগোটের একটি দরিদ্র এলাকার বিদ্যালয়ে ‘সেক্সুয়াল সিটিজেনশিপ’ পাঠ্য কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এতে বয়সে বড় শিক্ষার্থীরা ছোট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যৌন শিক্ষার বিষয়ে আলোচনা করে। এই কর্মসূচির পর এক বছরে ওই বিদ্যালয়ের চার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে গর্ভধারণ ৭০ থেকে কমে শূন্যে নেমে আসে।
লাতিন আমেরিকার সরকারগুলো জানিয়েছে, তারা কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের হার কমানোর চেষ্টা করছে। গত ১৫ বছরে এ–সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা তারা প্রকাশ করেছে। তবে সেগুলোর বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরকে লক্ষ্য করেই নেওয়া হয়েছে। অথচ গ্রামের পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। কখনো কখনো সরকারগুলো তাদের পরিকল্পনার কোনোটাই বাস্তবায়ন করে না। আর্জেন্টিনা ও চিলির দুই প্রেসিডেন্ট নিজ দেশের পাঠ্যসূচি যৌনবিষয়ক শিক্ষা কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর্জেন্টিনায় অর্ধেকেরও কম প্রদেশে তা গ্রহণ করা হয়েছে। আর চিলির বিদ্যালয়গুলোয় যৌনবিষয়ক শিক্ষার কথা শোনাই যায় না। মেক্সিকো এ বিষয়ে ২০১৫ সালে কৌশলগত পরিকল্পনা নেওয়ার কথা জানালেও তা বাস্তবায়নে এক সংস্থা অন্য সংস্থার ওপর অব্যাহতভাবে দায়িত্ব চাপিয়ে যাচ্ছে। ভেনেজুয়েলা ২০১৩ সালে পরিকল্পনা নিলেও বাস্তবায়ন করেনি। আর এখন দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা চরম আকার ধারণ করেছে। সরকার বিনা মূল্যে জন্মনিরোধক সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
তবে এর মধ্যে ব্যতিক্রম হাইতি। সেখানে ৩০ বছরে কিশোরী মাতৃত্ব উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে। দেশটি ডমিনিকান রিপাবলিকের সঙ্গে লাগোয়া। দুটি দেশ সেখানে দ্বীপগুলো ভাগাভাগি করে অবস্থান করে। ওই অঞ্চলে হাইতি সবচেয়ে দরিদ্র হলেও সেখানে কিশোরীদের মধ্যে মা হওয়ার প্রবণতা কম। সেখানে সরকার এতটা দুর্বল যে কিশোরী মাতৃত্বকে নিরুৎসাহিত করার মতো কর্মসূচিগুলো বেসরকারি সংগঠনগুলো নিয়ে থাকে। হয়তো সে কারণেই কর্মসূচিগুলো সফলতা পাচ্ছে। কারণ, সরকারি সংস্থার চেয়ে বেসরকারি সংগঠনগুলো রাজনৈতিক চাপের মধ্যে তুলনামূলক কম নাজুক পরিস্থিতিতে থাকে এবং বেশি দক্ষ হয়। কলাম্বিয়ায় গত এক দশকে বড় আকারে কিশোরী মাতৃত্ব কমেছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা বিদ্রোহ শেষ হওয়ায় দেশটি গেরিলা যোদ্ধা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশিকার পেয়েছে। ওই অঞ্চলগুলোয় কিশোরী মাতৃত্ব খুব সাধারণ বিষয় ছিল। সরকারের প্রবেশিকারে এ হার কমে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, রয়টার্স
নুনেজের দেশের নাম ডমিনিকান রিপাবলিক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর লাতিন আমেরিকার একটি দেশ। নুনেজের শহরের নাম ইস্তেবানিয়া। দেশটির দক্ষিণ উপকূলের শহরটি পরিচিত ‘লা ভিলা দে লাস বেলাস’ বলে, অর্থাৎ ‘সৌন্দর্যের শহর’ নামে। তবে জলরাশিঘেরা অপরূপ শহরটিতে কলঙ্কের দাগের মতো বসে আসে কিশোরী মাতৃত্ব। বিশ্বজুড়ে কিশোরী মাতৃত্বের বিরুদ্ধে যে এত লড়াই, এর কোনো প্রভাব নেই সেখানে। বেশির ভাগ মেয়ে কৈশোরে পা দিয়েই মাতৃত্বকে বরণ করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। দুই-পঞ্চমাংশ মা সেখানে কিশোরী। আফ্রিকার পর কিশোরী মাতৃত্ব হারের দিক দিয়ে এই শহরের অবস্থান।
শহরের এক নার্সের ভাষায়, এত কম বয়সে মা হওয়া মানে এটা বোঝায় না যে শহরের মেয়েরা দারুণ সুন্দর। এর জন্য যৌনতা নিয়ে যথাযথ জ্ঞানের অভাব এবং যথেচ্ছ মেলামেশাকে দায়ী করেন তিনি।
লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর কমবেশি ইস্তেবানিয়ার মতোই দশা! লাতিন আমেরিকার এক-তৃতীয়াংশ নারী ২০ বছর বয়স পেরোনোর আগেই মা হন। সাব-সাহারা আফ্রিকা ছাড়া আর কোনো অঞ্চলে এত বেশি হারে কিশোরী মায়েদের সন্তান জন্ম দেওয়ার ঘটনা ঘটে না। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক শাখা প্যান আমেরিকান স্বাস্থ্য সংস্থা (পিএএইচও), জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ ও জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক তহবিলের (ইউএনএফপিএ) যৌথ প্রতিবেদনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর কিশোরী মাতৃত্বের উচ্চহার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এতে এই পরিস্থিতির জন্য জন্মনিরোধক পাওয়ার ঘাটতি ও নারীর প্রতি সহিংসতাকে দায়ী করা হয়। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রতি এক হাজার কিশোরীর সন্তান জন্মদানের হার ৬৬ দশমিক ৫ শতাংশ। যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশে একই বয়সী কিশোরীদের সন্তান জন্মদানের হার প্রতি হাজারে ৪৬ শতাংশ।
লাতিন আমেরিকা একমাত্র অঞ্চল, যেখানে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে মাতৃত্বের হার বাড়ছে। লাতিন আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের মা হওয়ার হার ১৯৯০ থেকে ২০১২ সালের তুলনায় তিন গুণ বেড়েছে।
এই অঞ্চলের সরকারগুলো এখন উপলব্ধি করতে পারছে যে এটা একটি সমস্যা। কিশোরী মাতৃত্বের হার কমাতে এক দশক ধরে জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এ খাতে ধীরগতিতে অগ্রগতি হচ্ছে। কম বয়সী মা ও শিশু দেশের জন্য খারাপ পরিণতি ডেকে আনে। ১৬ বছরের কম বয়সের মায়ের মৃত্যুহার ২০ বছর বয়সী মায়ের তুলনায় চার গুণ বেশি। আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় লাতিন আমেরিকার নারীরা দেরিতে বিয়ে করেন। ফলে, সামঞ্জস্যহীনভাবে কিশোরী মায়েদের একাকী মা হতে হয়। মেক্সিকোতে গড়ে ২৭ বছর বয়সে নারীরা বিয়ে করেন। তবে সেখানে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রায় এক–চতুর্থাংশ একাকী মা রয়েছেন।
কম বয়সে মা হওয়ার কারণে ওই নারীদের পেশাগত জীবনও বাধাগ্রস্ত হয়। ব্রাজিলের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সেখানে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ কমছে। মেয়ের সন্তান দেখাশোনা করতে গিয়ে কাজ ছাড়তে হয় নানিকে। ডমিনিকান রিপাবলিকে কিশোরী মায়েরা অন্য মেয়েদের তুলনায় বিদ্যালয়ে গড়ে দুই বছর কম পড়ে। অর্ধেকের কম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।
লাতিন আমেরিকার সংস্কৃতিতে কৈশোরে মা হওয়াকেই উৎসাহিত করা হয়। এই অবস্থা পরিবর্তনে সরকারের তরফ থেকে পদক্ষেপ খুব কম। দরিদ্র পরিবার থেকে আসা মেয়েরা পড়াশোনার চেয়ে মা হওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। এক-তৃতীয়াংশ ডমিনিকান নারী মা হওয়ার জন্য বিদ্যালয় ছেড়ে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্লেয়ার ব্রিনডিসের মতে, গর্ভধারণকে কিছু মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার প্রথম ধাপ বলে মনে করে। তাদের মতে, মা হলে যত্ন পাওয়া যায়, পরিবারের মনোযোগ পাওয়া যায়। এই অধ্যাপকের কথার প্রমাণ পাওয়া গেছে ইস্তেবানিয়ার ১৬ বছর বয়সী এক মা দারলেনিসের কথায়। ওই কিশোরী মা বলে, মা হলে পুরো বিশ্ব শ্রদ্ধা করে।
আবার অনেক মেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে নিজেদের নিরাপত্তা বাড়াতে নতুন পরিবার গড়ে তোলে। নির্যাতন করে—এমন পরিবার থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রেমিকের হাত ধরে তারা বেরিয়ে যায়।
বিশ্ব ব্যাংকের রাফায়েল কর্তেজ অপরাধপ্রবণ এল সালভেদরের কম বয়সী মায়েদের একবার সাক্ষাৎকার নেন। ওই সময় তিনি অবাক হন যে ওই মায়েদের অর্ধেকেরই গর্ভধারণের আগ্রহ ছিল।
বেশির ভাগ কিশোরীর কাছে গর্ভধারণ একধরনের বিস্ময় নিয়েই আসে। অনেক বিদ্যালয়ে যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে কোনো শিক্ষা দেওয়া হয় না। জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায় না।
ইস্তেবানিয়ার নুনেজ জানান, তিনি এলাকার এক ক্লিনিকে দিয়ে জন্মনিরোধক চেয়েছিলেন, কিন্তু পাননি। সেখানে পুরুষেরা নারীদের যৌন সম্পর্কের জন্য চাপ দেয়, আর নারীরা তা প্রত্যাখ্যান করতে শেখেনি।
লাতিন আমেরিকায় ক্যাথলিক গির্জার প্রভাব রয়েছে। তাই সেখানে যৌনতা নিয়ে সেভাবে খোলামেলা আলোচনা করা হয় না। হন্ডুরাসে ক্যাথলিক ও ইভানজেলিকাল গির্জাগুলো গত বছর দেশটির পাঠ্যপুস্তকে যৌনবিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে। জন্মনিয়ন্ত্রণেরও বিরোধিতা করে গির্জাগুলো। এসব কারণেও সরকারগুলো কিশোরী মাতৃত্ব হ্রাসে জোরালো ভূমিকা রাখতে চায় না।
এর মধ্যেও ব্যতিক্রম রয়েছে। কলাম্বিয়ার রাজধানী বগোটের একটি দরিদ্র এলাকার বিদ্যালয়ে ‘সেক্সুয়াল সিটিজেনশিপ’ পাঠ্য কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এতে বয়সে বড় শিক্ষার্থীরা ছোট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যৌন শিক্ষার বিষয়ে আলোচনা করে। এই কর্মসূচির পর এক বছরে ওই বিদ্যালয়ের চার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে গর্ভধারণ ৭০ থেকে কমে শূন্যে নেমে আসে।
লাতিন আমেরিকার সরকারগুলো জানিয়েছে, তারা কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের হার কমানোর চেষ্টা করছে। গত ১৫ বছরে এ–সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা তারা প্রকাশ করেছে। তবে সেগুলোর বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরকে লক্ষ্য করেই নেওয়া হয়েছে। অথচ গ্রামের পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। কখনো কখনো সরকারগুলো তাদের পরিকল্পনার কোনোটাই বাস্তবায়ন করে না। আর্জেন্টিনা ও চিলির দুই প্রেসিডেন্ট নিজ দেশের পাঠ্যসূচি যৌনবিষয়ক শিক্ষা কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর্জেন্টিনায় অর্ধেকেরও কম প্রদেশে তা গ্রহণ করা হয়েছে। আর চিলির বিদ্যালয়গুলোয় যৌনবিষয়ক শিক্ষার কথা শোনাই যায় না। মেক্সিকো এ বিষয়ে ২০১৫ সালে কৌশলগত পরিকল্পনা নেওয়ার কথা জানালেও তা বাস্তবায়নে এক সংস্থা অন্য সংস্থার ওপর অব্যাহতভাবে দায়িত্ব চাপিয়ে যাচ্ছে। ভেনেজুয়েলা ২০১৩ সালে পরিকল্পনা নিলেও বাস্তবায়ন করেনি। আর এখন দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা চরম আকার ধারণ করেছে। সরকার বিনা মূল্যে জন্মনিরোধক সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
তবে এর মধ্যে ব্যতিক্রম হাইতি। সেখানে ৩০ বছরে কিশোরী মাতৃত্ব উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে। দেশটি ডমিনিকান রিপাবলিকের সঙ্গে লাগোয়া। দুটি দেশ সেখানে দ্বীপগুলো ভাগাভাগি করে অবস্থান করে। ওই অঞ্চলে হাইতি সবচেয়ে দরিদ্র হলেও সেখানে কিশোরীদের মধ্যে মা হওয়ার প্রবণতা কম। সেখানে সরকার এতটা দুর্বল যে কিশোরী মাতৃত্বকে নিরুৎসাহিত করার মতো কর্মসূচিগুলো বেসরকারি সংগঠনগুলো নিয়ে থাকে। হয়তো সে কারণেই কর্মসূচিগুলো সফলতা পাচ্ছে। কারণ, সরকারি সংস্থার চেয়ে বেসরকারি সংগঠনগুলো রাজনৈতিক চাপের মধ্যে তুলনামূলক কম নাজুক পরিস্থিতিতে থাকে এবং বেশি দক্ষ হয়। কলাম্বিয়ায় গত এক দশকে বড় আকারে কিশোরী মাতৃত্ব কমেছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা বিদ্রোহ শেষ হওয়ায় দেশটি গেরিলা যোদ্ধা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশিকার পেয়েছে। ওই অঞ্চলগুলোয় কিশোরী মাতৃত্ব খুব সাধারণ বিষয় ছিল। সরকারের প্রবেশিকারে এ হার কমে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, রয়টার্স
No comments