১ ভাগের বিরুদ্ধে ৯৯ ভাগের লড়াই by হায়দার আকবর খান রনো
প্রথম
আলোর ১৯ জানুয়ারি সংখ্যায় প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটা রিপোর্ট রীতিমতো
চমকে দেওয়ার মতো। রিপোর্টটি বিশ্ব অর্থব্যবস্থা–সংক্রান্ত। রিপোর্টের
হেড লাইনটি ছিল এ রকম, ‘৬২ ব্যক্তির সম্পদ হচ্ছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার
অর্ধেকের সমান’।
রিপোর্টটি তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক এনজিও অক্সফাম। সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সভায় রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়েছিল। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘ক্রেডিট সুইস’-এর একটি প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়েছিল এই রিপোর্ট। রিপোর্টটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অ্যান ইকোনমি ফর দ্য ওয়ান পারসেন্ট’।
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সেই দেশের বহুজাতিক ব্যাংক ও করপোরেশনসমূহের প্রধান কেন্দ্রস্থল ওয়াল স্ট্রিট দখল করে যাঁরা চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন, তাঁরাও তাঁদের আন্দোলনের নাম দিয়েছিলেন ‘১ শতাংশের বিরুদ্ধে ৯৯ শতাংশ।’ অক্সফামের সাম্প্রতিক রিপোর্টটিও বলছে, পৃথিবীর জনসংখ্যার একাংশের সম্পদ বাকি ৯৯ শতাংশের চেয়েও বেশি। তাই বিশ্বজুড়ে ১ শতাংশের বিরুদ্ধে ৯৯ শতাংশের সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনিক রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের এক বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী। ধনকুবেরদের কেন্দ্রস্থল ওয়াল স্ট্রিট দখল সেই বিদ্রোহের কর্মসূচি ছিল।
ধনবৈষম্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তা যদি একটা সীমা অতিক্রম করে যায়, তাহলে তা পুঁজিবাদভিত্তিক সমাজব্যবস্থার জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। দেখা যাচ্ছে, এই বৈষম্য এখন বিপদরেখা অতিক্রম করেছে। বৈষম্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে বৈষম্য বৃদ্ধির হারটাও মারাত্মক বিপদের সংকেতবহ।
উপরিউক্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল অর্থাৎ বিগত পাঁচ বছরে একদিকে যেমন স্বল্পসংখ্যক সর্বোচ্চ ধনীর হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে, অপরদিকে তেমনি ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদ কমেছে প্রায় অর্ধেক (৪১ শতাংশ)। একটা কথা অনেক সময় বলা হয় যে বৈষম্য বাড়লেও নিচের তলার লোকদেরও আয়-সম্পদ বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ গোটা বিশ্বের সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বর্ধিত সম্পদের বড় অংশ নাহয় অল্প কিছু লোক ভোগ করছে। কিন্তু বাকিদেরও তো আয়-উপার্জন বাড়ছে। একে বলা হয়, ওপর থেকে চুইয়ে পড়ার (trickle down) নীতি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সেই তত্ত্বও কার্যকরী হচ্ছে না। হবেও না। একটা সীমার পর বৈষম্য যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে এই তত্ত্ব আর কার্যকরী হবে না। বরং তা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং ঝুঁকিও তৈরি করবে।
এই বিষয়টি বুঝেছিলেন অনেক আগেই বেশ কয়েকজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম মাহবুবুল হক। তিনি পাকিস্তানের নাগরিক হলেও আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর খ্যাতি ও প্রভাব ছিল। তাঁরই প্রচেষ্টায় ১৯৯০ সাল থেকে জাতিসংঘ প্রতিবছর মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করে। সেখানে মাহবুবুল হকের সঙ্গে আরেকজন বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনেরও ভূমিকা ছিল। আজ থেকে ২৫ বছর আগের কথা। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে বৈষম্যের এই খতিয়ান দেখে আমরা তখনই চমকে গিয়েছিলাম। কিন্তু বৈষম্য কমেনি। এখন তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
অক্সফামের রিপোর্ট বলছে, ২০১০ সালে ৫০ শতাংশের সম্পদের সমান ছিল মাত্র ৩৮৮ জনের সম্পদ। ২০১৪ সালে তা দাঁড়ায় ৮০ জনের সম্পদের সমান। আর এখন আরও কম। ৬২ জনের সম্পদ হচ্ছে পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের সম্পদের সমান। অর্থাৎ কী পরিমাণ সম্পদ মাত্র কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে! ওই রিপোর্ট কিন্তু সংখ্যাতত্ত্ব দিয়েই আমাদের ভড়কে দেয়নি। আরও একটি কথা বলেছে, যা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিপৎসংকেত দিচ্ছে। ‘বিশ্বের সর্বত্র শ্রম থেকে অর্জন, তার তুলনায় পুঁজি থেকে আয় অনেক বেশি।’ (প্রথম আলো, ১৯ জানুয়ারি)। এই যে অবস্থা, তার থেকেই ফিন্যান্স পুঁজির দাপট ও ফাটকা পুঁজির উদ্ভব ও মাত্রাতিরিক্ত প্রাধান্য দেখা দিয়েছে। ২০০৮ সালের ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মূলেও এটাই ছিল। এই রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, সেই প্রবণতা মোটেও কমেনি। এই বৈষম্যের সূত্রও বহুলাংশে এই বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভরশীল।
একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তাঁর বিখ্যাত নিউ ডিল (New Deal) প্রণয়নের সময় ফাটকা প্রবণতা প্রতিরোধকল্পে ‘গ্লাস স্টিগাল অ্যাক্ট’ করেছিলেন ১৯৩৩ সালে। পরে ১৯৫৬ সালে প্রণীত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্যাংক হোল্ডিং কোম্পানি অ্যাক্ট’। এসব আইনের দ্বারা ব্যাংক, বিমা, লগ্নিকারী ব্যাংক এবং ঋণপত্রের কারবারি সংস্থাসমূহকে পৃথক্করণ
করা হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে ক্লিনটন প্রশাসন ‘ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস মডার্নাইজেশন অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে ওই পৃথক্করণ বাতিল করে দিলেন। ক্রমে ক্রমে সারা বিশ্বই একই পথ অনুসরণ করেছিল। সেই থেকে ব্যাংক শেয়ার ও লগ্নিপত্র কেনাবেচা শুরু করে দিল। উৎপাদনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু টাকা দিয়ে টাকা বানানো। এটাই হলো ফাটকা ব্যবসা।
এর আগে ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিদেশি পুঁজি চলাচলে সব বাধা তুলে নিয়েছিল এবং কালক্রমে সব দেশকেই একই পথ অনুসরণ করতে বাধ্য করেছিল। ফলে ফাটকার ব্যাপারটি একটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না, ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে। ফিন্যান্স পুঁজির দাপট এবং দাপাদাপি চলল সারা বিশ্বে।
টাকা দিয়ে টাকা বানানোর এই যে ব্যবসা, তা আগেও ছিল কিন্তু এতটা পরিমাণে নয়। নব্বইয়ের দশকেই প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ পল সুইজি বলেছিলেন, ‘ঐতিহ্যগতভাবে লগ্নির প্রসার প্রকৃত অর্থনীতির সমৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে।...কিন্তু এখন আর তা নয়।’ এখন পুঁজির মালিক ‘লগ্নি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করবে, প্রকৃত উৎপাদনশীল সম্পদে নয়।’ অর্থাৎ ম্যানুফ্যাকচারিং অথবা সেবা খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। তাই ২০০৪ সালে দেখা গেল যুক্তরাষ্ট্রে করপোরেট মুনাফার ৪০ শতাংশ আসছে আর্থিক খাত থেকে অথচ তার ৪০ বছর আগে এই হার ছিল মাত্র ২ শতাংশ।
এই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অক্সফামের রিপোর্টে এটাকেই একটু অন্যভাবে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘শ্রম থেকে অর্জনের তুলনায় পুঁজি থেকে অর্জন অনেক বেশি।’ শুধু পুঁজি থেকে অর্জন, কোনো সম্পদ বৃদ্ধি করে না, শ্রমজীবীর জন্য কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে না, অর্থাৎ গরিব মানুষের উপার্জন বৃদ্ধি করে না। কিন্তু পুঁজির মালিকের লাভ বাড়ায়। ফলে বৈষম্য তো বাড়বেই।
এটাকেই বর্তমান সময়ের মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদ জন বেলামি ফেস্টার ২০০৯ সালেই বলেছিলেন, ‘অর্থনীতির আর্থিকীকরণ’ (ইংরেজিতে ফিন্যান্সিয়ালাইজেশন অব ইকোনমি)। তিনি বলেছেন, ‘উন্নত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আর্থিকীকরণের প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃত অর্থনীতির বদলে আর্থিক উপরিকাঠামোর বৃদ্ধি ঘটেছে কয়েক দশক ধরেই।’ তিনি এ কথা বলছিলেন ২০০৮ সালে শুরু হওয়া মহামন্দার পরিপ্রেক্ষিতে। তিনি এই প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন, ‘শোষণ ও বৈষম্যের মধ্যেই মন্দার বীজ নিহিত। নতুন উৎপাদিকা ক্ষমতায় বিনিয়োগের মন্দা ঢাকতেই আর্থিক ব্যবস্থার রমরমা বাড়ানো হয়েছে।’ এর সমাধানকল্পে অবশ্য তিনি বলছেন, পুঁজিবাদকেই বাতিল করতে হবে। তিনি সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা।
কিন্তু কোনোক্রমেই সমাজতন্ত্রী নন, এমন একজন অর্থনীতিবিদ-ইতিহাস বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকেই অর্থনীতির এই ধরনের বিকৃত প্রক্রিয়া এবং সেই কারণে উদ্ভূত ফাটকা পুঁজির ক্ষতিকর প্রভাবের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘উৎপাদন সংস্থার প্রবহমান স্রোতের ওপর ফাটকাবাজির বুদ্বুদ তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু সংস্থাটি যদি নিজেই ফাটকাবাজির ঘূর্ণিপাকে বুদ্বুদে পরিণত হয়, তখনই বিপদ দেখা দেয়। একটি দেশের পুঁজির বিকাশ যখন ক্যাসিনোর (জুয়া খেলার) উপজাত বিষয় হয়ে ওঠে, তখন উৎপাদনের কাজটাই আর ঠিকমতো করা যায় না।’
এখন প্রকৃত উৎপাদন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ফিন্যান্স পুঁজি অবধারিতভাবে হয়ে উঠেছে ফাটকা পুঁজি এবং তা সারা বিশ্ব অর্থনীতির ওপর প্রভুত্ব করছে। এতটা বোধ হয় কেইনসও ভাবতে পারেননি। এই যে মাত্র ৬২ জনের হাতে ৫০ শতাংশের বেশি জনগণের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়া অথবা ১ শতাংশের হাতে ৯৯ শতাংশ মানুষের সম্পদ জমা হওয়া—এই যে অবিশ্বাস্য রকমের ধনবৈষম্য, তা কেবল অর্থনীতিতে সংকট সৃষ্টি করছে না, এর সামাজিক ও রাজনৈতিক ফলাফলও বড় ধরনের। এই বৈষম্য সৃষ্টি করছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক অবক্ষয়। সুস্থ ও প্রগতিশীল রাজনীতির অনুপস্থিতিতে এই চরম ধনবৈষম্য ধর্মীয় মৌলবাদকেও বাড়িয়ে তুলতে পারে। খানিকটা করছেও বটে।
মোটকথা শুধু সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই নয়, মানবিক, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই চরম ধনবৈষম্যকে কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। যে ১ শতাংশ অতিকায় ধনী কেবল টাকা দিয়ে টাকা বানাচ্ছে এবং সেই প্রক্রিয়াকে রক্ষার জন্য সামরিক শক্তিও প্রয়োগ করছে, তার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম অর্থাৎ ৯৯ শতাংশের সংগ্রাম এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ১ শতাংশের বিরুদ্ধে ৯৯ শতাংশের যে লড়াই শুরু হয়েছে, তাই-ই বর্তমান যুগের বিশ্ব রাজনীতির মূল মর্মকথা।
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
রিপোর্টটি তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক এনজিও অক্সফাম। সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সভায় রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়েছিল। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘ক্রেডিট সুইস’-এর একটি প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়েছিল এই রিপোর্ট। রিপোর্টটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অ্যান ইকোনমি ফর দ্য ওয়ান পারসেন্ট’।
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সেই দেশের বহুজাতিক ব্যাংক ও করপোরেশনসমূহের প্রধান কেন্দ্রস্থল ওয়াল স্ট্রিট দখল করে যাঁরা চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন, তাঁরাও তাঁদের আন্দোলনের নাম দিয়েছিলেন ‘১ শতাংশের বিরুদ্ধে ৯৯ শতাংশ।’ অক্সফামের সাম্প্রতিক রিপোর্টটিও বলছে, পৃথিবীর জনসংখ্যার একাংশের সম্পদ বাকি ৯৯ শতাংশের চেয়েও বেশি। তাই বিশ্বজুড়ে ১ শতাংশের বিরুদ্ধে ৯৯ শতাংশের সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনিক রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের এক বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী। ধনকুবেরদের কেন্দ্রস্থল ওয়াল স্ট্রিট দখল সেই বিদ্রোহের কর্মসূচি ছিল।
ধনবৈষম্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তা যদি একটা সীমা অতিক্রম করে যায়, তাহলে তা পুঁজিবাদভিত্তিক সমাজব্যবস্থার জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। দেখা যাচ্ছে, এই বৈষম্য এখন বিপদরেখা অতিক্রম করেছে। বৈষম্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে বৈষম্য বৃদ্ধির হারটাও মারাত্মক বিপদের সংকেতবহ।
উপরিউক্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল অর্থাৎ বিগত পাঁচ বছরে একদিকে যেমন স্বল্পসংখ্যক সর্বোচ্চ ধনীর হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে, অপরদিকে তেমনি ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদ কমেছে প্রায় অর্ধেক (৪১ শতাংশ)। একটা কথা অনেক সময় বলা হয় যে বৈষম্য বাড়লেও নিচের তলার লোকদেরও আয়-সম্পদ বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ গোটা বিশ্বের সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বর্ধিত সম্পদের বড় অংশ নাহয় অল্প কিছু লোক ভোগ করছে। কিন্তু বাকিদেরও তো আয়-উপার্জন বাড়ছে। একে বলা হয়, ওপর থেকে চুইয়ে পড়ার (trickle down) নীতি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সেই তত্ত্বও কার্যকরী হচ্ছে না। হবেও না। একটা সীমার পর বৈষম্য যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে এই তত্ত্ব আর কার্যকরী হবে না। বরং তা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং ঝুঁকিও তৈরি করবে।
এই বিষয়টি বুঝেছিলেন অনেক আগেই বেশ কয়েকজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম মাহবুবুল হক। তিনি পাকিস্তানের নাগরিক হলেও আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর খ্যাতি ও প্রভাব ছিল। তাঁরই প্রচেষ্টায় ১৯৯০ সাল থেকে জাতিসংঘ প্রতিবছর মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করে। সেখানে মাহবুবুল হকের সঙ্গে আরেকজন বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনেরও ভূমিকা ছিল। আজ থেকে ২৫ বছর আগের কথা। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে বৈষম্যের এই খতিয়ান দেখে আমরা তখনই চমকে গিয়েছিলাম। কিন্তু বৈষম্য কমেনি। এখন তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
অক্সফামের রিপোর্ট বলছে, ২০১০ সালে ৫০ শতাংশের সম্পদের সমান ছিল মাত্র ৩৮৮ জনের সম্পদ। ২০১৪ সালে তা দাঁড়ায় ৮০ জনের সম্পদের সমান। আর এখন আরও কম। ৬২ জনের সম্পদ হচ্ছে পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের সম্পদের সমান। অর্থাৎ কী পরিমাণ সম্পদ মাত্র কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে! ওই রিপোর্ট কিন্তু সংখ্যাতত্ত্ব দিয়েই আমাদের ভড়কে দেয়নি। আরও একটি কথা বলেছে, যা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিপৎসংকেত দিচ্ছে। ‘বিশ্বের সর্বত্র শ্রম থেকে অর্জন, তার তুলনায় পুঁজি থেকে আয় অনেক বেশি।’ (প্রথম আলো, ১৯ জানুয়ারি)। এই যে অবস্থা, তার থেকেই ফিন্যান্স পুঁজির দাপট ও ফাটকা পুঁজির উদ্ভব ও মাত্রাতিরিক্ত প্রাধান্য দেখা দিয়েছে। ২০০৮ সালের ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মূলেও এটাই ছিল। এই রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, সেই প্রবণতা মোটেও কমেনি। এই বৈষম্যের সূত্রও বহুলাংশে এই বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভরশীল।
একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তাঁর বিখ্যাত নিউ ডিল (New Deal) প্রণয়নের সময় ফাটকা প্রবণতা প্রতিরোধকল্পে ‘গ্লাস স্টিগাল অ্যাক্ট’ করেছিলেন ১৯৩৩ সালে। পরে ১৯৫৬ সালে প্রণীত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্যাংক হোল্ডিং কোম্পানি অ্যাক্ট’। এসব আইনের দ্বারা ব্যাংক, বিমা, লগ্নিকারী ব্যাংক এবং ঋণপত্রের কারবারি সংস্থাসমূহকে পৃথক্করণ
করা হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে ক্লিনটন প্রশাসন ‘ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস মডার্নাইজেশন অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে ওই পৃথক্করণ বাতিল করে দিলেন। ক্রমে ক্রমে সারা বিশ্বই একই পথ অনুসরণ করেছিল। সেই থেকে ব্যাংক শেয়ার ও লগ্নিপত্র কেনাবেচা শুরু করে দিল। উৎপাদনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু টাকা দিয়ে টাকা বানানো। এটাই হলো ফাটকা ব্যবসা।
এর আগে ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিদেশি পুঁজি চলাচলে সব বাধা তুলে নিয়েছিল এবং কালক্রমে সব দেশকেই একই পথ অনুসরণ করতে বাধ্য করেছিল। ফলে ফাটকার ব্যাপারটি একটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না, ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে। ফিন্যান্স পুঁজির দাপট এবং দাপাদাপি চলল সারা বিশ্বে।
টাকা দিয়ে টাকা বানানোর এই যে ব্যবসা, তা আগেও ছিল কিন্তু এতটা পরিমাণে নয়। নব্বইয়ের দশকেই প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ পল সুইজি বলেছিলেন, ‘ঐতিহ্যগতভাবে লগ্নির প্রসার প্রকৃত অর্থনীতির সমৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে।...কিন্তু এখন আর তা নয়।’ এখন পুঁজির মালিক ‘লগ্নি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করবে, প্রকৃত উৎপাদনশীল সম্পদে নয়।’ অর্থাৎ ম্যানুফ্যাকচারিং অথবা সেবা খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। তাই ২০০৪ সালে দেখা গেল যুক্তরাষ্ট্রে করপোরেট মুনাফার ৪০ শতাংশ আসছে আর্থিক খাত থেকে অথচ তার ৪০ বছর আগে এই হার ছিল মাত্র ২ শতাংশ।
এই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অক্সফামের রিপোর্টে এটাকেই একটু অন্যভাবে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘শ্রম থেকে অর্জনের তুলনায় পুঁজি থেকে অর্জন অনেক বেশি।’ শুধু পুঁজি থেকে অর্জন, কোনো সম্পদ বৃদ্ধি করে না, শ্রমজীবীর জন্য কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে না, অর্থাৎ গরিব মানুষের উপার্জন বৃদ্ধি করে না। কিন্তু পুঁজির মালিকের লাভ বাড়ায়। ফলে বৈষম্য তো বাড়বেই।
এটাকেই বর্তমান সময়ের মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদ জন বেলামি ফেস্টার ২০০৯ সালেই বলেছিলেন, ‘অর্থনীতির আর্থিকীকরণ’ (ইংরেজিতে ফিন্যান্সিয়ালাইজেশন অব ইকোনমি)। তিনি বলেছেন, ‘উন্নত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আর্থিকীকরণের প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃত অর্থনীতির বদলে আর্থিক উপরিকাঠামোর বৃদ্ধি ঘটেছে কয়েক দশক ধরেই।’ তিনি এ কথা বলছিলেন ২০০৮ সালে শুরু হওয়া মহামন্দার পরিপ্রেক্ষিতে। তিনি এই প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন, ‘শোষণ ও বৈষম্যের মধ্যেই মন্দার বীজ নিহিত। নতুন উৎপাদিকা ক্ষমতায় বিনিয়োগের মন্দা ঢাকতেই আর্থিক ব্যবস্থার রমরমা বাড়ানো হয়েছে।’ এর সমাধানকল্পে অবশ্য তিনি বলছেন, পুঁজিবাদকেই বাতিল করতে হবে। তিনি সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা।
কিন্তু কোনোক্রমেই সমাজতন্ত্রী নন, এমন একজন অর্থনীতিবিদ-ইতিহাস বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকেই অর্থনীতির এই ধরনের বিকৃত প্রক্রিয়া এবং সেই কারণে উদ্ভূত ফাটকা পুঁজির ক্ষতিকর প্রভাবের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘উৎপাদন সংস্থার প্রবহমান স্রোতের ওপর ফাটকাবাজির বুদ্বুদ তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু সংস্থাটি যদি নিজেই ফাটকাবাজির ঘূর্ণিপাকে বুদ্বুদে পরিণত হয়, তখনই বিপদ দেখা দেয়। একটি দেশের পুঁজির বিকাশ যখন ক্যাসিনোর (জুয়া খেলার) উপজাত বিষয় হয়ে ওঠে, তখন উৎপাদনের কাজটাই আর ঠিকমতো করা যায় না।’
এখন প্রকৃত উৎপাদন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ফিন্যান্স পুঁজি অবধারিতভাবে হয়ে উঠেছে ফাটকা পুঁজি এবং তা সারা বিশ্ব অর্থনীতির ওপর প্রভুত্ব করছে। এতটা বোধ হয় কেইনসও ভাবতে পারেননি। এই যে মাত্র ৬২ জনের হাতে ৫০ শতাংশের বেশি জনগণের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়া অথবা ১ শতাংশের হাতে ৯৯ শতাংশ মানুষের সম্পদ জমা হওয়া—এই যে অবিশ্বাস্য রকমের ধনবৈষম্য, তা কেবল অর্থনীতিতে সংকট সৃষ্টি করছে না, এর সামাজিক ও রাজনৈতিক ফলাফলও বড় ধরনের। এই বৈষম্য সৃষ্টি করছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক অবক্ষয়। সুস্থ ও প্রগতিশীল রাজনীতির অনুপস্থিতিতে এই চরম ধনবৈষম্য ধর্মীয় মৌলবাদকেও বাড়িয়ে তুলতে পারে। খানিকটা করছেও বটে।
মোটকথা শুধু সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই নয়, মানবিক, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই চরম ধনবৈষম্যকে কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। যে ১ শতাংশ অতিকায় ধনী কেবল টাকা দিয়ে টাকা বানাচ্ছে এবং সেই প্রক্রিয়াকে রক্ষার জন্য সামরিক শক্তিও প্রয়োগ করছে, তার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম অর্থাৎ ৯৯ শতাংশের সংগ্রাম এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ১ শতাংশের বিরুদ্ধে ৯৯ শতাংশের যে লড়াই শুরু হয়েছে, তাই-ই বর্তমান যুগের বিশ্ব রাজনীতির মূল মর্মকথা।
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
No comments