আড়াইহাজারে গণপিটুনিতে নিহত ৮

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে চাল লুট করতে এসে গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে ডাকাতদলের ৮ সদস্য নিহত হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছে আরও ৪ জন। ডাকাতির সময় ধাওয়া দিয়ে গ্রামবাসী সংঘবদ্ধ ডাকাতদলের ১২ সদস্যকে আটক করে গণপিটুনি দিলে ঘটনাস্থলে ৭জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন মারা যায়। নিহত ডাকাতদের মধ্যে ৪ জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলো-ফেনীর সোনাগাজী থানার আলমপুরের এবায়দুলের ছেলে ট্রাকচালক রাজিব ওরফে রনি (৩০), ময়মনসিংহের কোতোয়ালি মধ্য বায়রা এলাকার রুবেল (২৫), জুয়েল ওরফে টিটু (৩০) ও ময়মনসিংহের মধ্যপাড়া এলাকার শওকত (৩০)। বাকি ৪ জনের পরিচয় (এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত) পাওয়া যায়নি। আহত ডাকাতরা হল- ময়মনসিংহ জেলার কোতোয়ালি থানার মিলন মিয়ার ছেলে সাব্বির (২৫), ছানা মিয়ার ছেলে সজিব (২৬), লতিফের ছেলে মানিক (৩২), চাঁদপুর সদরের ওছমান মিয়ার ছেলে লোকমান (২৮)। আহতদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। দুর্ধর্ষ ঘটনাটি ঘটেছে বৃহস্পতিবার ভোরে উপজেলার সাতগ্রাম ইউনিয়নের পুরিন্দা বাজারে।
পুলিশ ও গ্রামবাসীর সূত্রমতে, বৃহস্পতিবার ভোররাতে সংঘবদ্ধ একটি ডাকাতদল ট্রাকযোগে এসে উপজেলার সাতগ্রাম ইউনিয়নের পুরিন্দা বাজারে আসে। বাজারের পাহারাদার নজরুল ইসলাম জানান প্রথমে ডাকাতদল পর্যায়ক্রমে মোতালিব মিয়া, আউয়াল ও নিয়ত আলীকে হাত-পা-মুখ বেঁধে ফেলে। পরে বাজারের হাজী আবদুল গফুর ভুইয়ার মালিকানাধীন ভাই ভাই স্টোরের তালা কেটে চাউলের আড়ৎ থেকে চাউলের বস্তা লুট করে ডাকাতরা তাদের নিয়ে আসা ট্রাকে তুলতে থাকে। ওই সময় বাজারের মসজিদে মুসল্লিরা নামাজ পড়তে এসে বিষয়টি আঁচ করতে পেরে মসজিদের মাইকে প্রচার করে বাজারে ডাকাত পড়েছে। এ সময় মাইকে মুসল্লিদের ডাক চিৎকারে আশপাশের মসজিদ থেকেও ডাকাতির সংবাদ মাইকে প্রচার করতে থাকলে পুরিন্দা ও আশপাশের কয়েকটি গ্রামের শত শত গ্রামবাসী লাঠিসোটা নিয়ে ডাকাতদের ধাওয়া দেয়। গ্রামবাসীর ধাওয়া খেয়ে ডাকাতদলের সদস্য দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। প্রাণভয়ে তাদের কেউ বাঁশঝাড়ে, কেউ কচুরি পানার ডোবায়, কেউ পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উত্তেজিত গ্রামবাসী একপর্যায়ে পুরিন্দা বাজার থেকে ৩ জন, পুরিন্দা রোকন উদ্দিন মোল্লার মাঠ থেকে ৪ জন, পুরিন্দা আনোয়ার মেম্বারের পুকুর থেকে ৩ জন ও বাগবাড়ি থেকে ২ ডাকাতকে ধরে ফেলে। পৃথক পৃথক স্থানে তাদের গণপিটুনি দেয় শ’ শ’ গ্রামবাসী। এ সময় ডাকাতদের আর্তচিৎকার ও গ্রামবাসীর হৈ চৈয়ে ভীতিকর এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এলাকায়। সাম্প্রতিক কয়েকটি ডাকাতির ঘটনায় চরমভাবে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী হামলে পড়ে ডাকাতদের ওপর। যে যেভাবে পেরেছে আক্রমণ করতে থাকে ডাকাত সদস্যদের। এলোপাথাড়ি পিটুনিতে একে একে প্রাণ হারায় ৭ ডাকাত। তাদের নিথর দেহ চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে উৎসুক জনতার ভিড়। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা আনোয়ার মেম্বারের পুকুর থেকে ৩, পুরিন্দা বাজার থেকে ১ ও রোকনউদ্দিন মোল্লার মাঠ থেকে ৩ ডাকাতের মৃত দেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। এবং মারাত্মক আহত ৫ ডাকাতকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুরে এক ডাকাত মারা যায়।
পুরিন্দা বাজারের ভাই ভাই স্টোর চালের আড়তের মালিক হাজি গফুর ভুঁইয়া জানান, তার আড়তে ১৫০ বস্তা চাল ছিল। ডাকাতরা আড়ৎ থেকে ৪০ বস্তা চাল ট্রাকে তুলে ফেলে এবং আরও চাল ট্রাকে তোলার সময় নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিরা দেখে মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়েছে বলে প্রচার করলে আমরা শুনে বাজারে আসি। তিনি আরও জানান, গ্রামবাসী ডাকাতদের চাল ভর্তি ট্রাকটিও আটক করেছে।
সাতগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অদুদ মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, গ্রামবাসী ডাকাতদের ধাওয়া দিলে কেউ পুকুরে, কেউ বাঁশের ঝাড়ে ও কেউ ডোবায় কচুরি পানার তলে লুকিয়ে থাকলে সেখান থেকে জনতা তাদেরকে আটক করে গণপিটুনি দেয়। তিনি জানান, প্রায়ই পুরিন্দা বাজারে ও আশেপাশের বাড়িতে ডাকাতি সংঘটিত হলেও এ পর্যন্ত কোনো ডাকাতকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তাই ডাকাতদের প্রতি এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ ছিল।
বাজারের নৈশপ্রহরী নজরুল ইসলাম জামান ও মোতালেব মিয়া জানান, বুধবার রাত ৩টার পর একটি ট্রাক (ঢাকা মেট্রো-ট-১৮-৪৩১১) যোগে ১৮ থেকে ২০ জনের সংঘবদ্ধ ডাকাত দল আসে আড়াইহাজার উপজেলার সাতগ্রাম ইউনিয়নের পুরিন্দা বাজারে। এ বাজারটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত। ডাকাতরা রাতে বাজারে আসার পর নিজেদের চাল ক্রেতা পরিচয় দেয় জামান ও মোতালেবের কাছে। তাদের কাছে গফুর ভূঁইয়ার মালিকানাধীন চালের গুদামের খবর জানতে চায়। অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর ওই দুই নৈশপ্রহরীর হাত পা বেঁধে ফেলে ডাকাতরা। তাদের মধ্যে একজন কোনোমতে দড়ির বাঁধন খুলে দৌড়ে স্থানীয় মসজিদে গিয়ে মুয়াজ্জিনকে বিষয়টি জানালে দ্রুত মাইকিং করা হয়। আর সে কারণেই ধরা পড়ে ডাকাতরা।
গ্রামবাসী আলেক মিয়া (৫৭) জানান, গ্রামে চুরি ডাকাতি প্রায়ই হয়। কিন্তু থানা পুলিশ তা বন্ধ করতে পারছে না। এতে ভুক্তভোগী লোকজন ছাড়াও গ্রামবাসীর মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছিল। তাই ডাকাতদের হাতের নাগালে পেয়ে আগে-পিছে চিন্তা না করে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। সামনের দিকে ডাকাতি না কমলে এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে। কারণ পুলিশের উপর গ্রামবাসীর  আস্থা কমতে শুরু করেছে।
আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন ডাকাত সদস্য সজীব ও সাব্বির সাংবাদিকদের জানান, তাদের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলাতে। বুধবার রাতে তারা স্ব স্ব জেলা হতে ঢাকায় আসে। সেখানে তেজগাঁও হতে একটি ট্রাক ভাড়া করে। আর এর পুরো মনিটরিংটি ছল মানিকের কাছে। সে মূলত ডাকাত দলের টিম লিডার। সজীব ও সাব্বিরের দেয়া তথ্য মতে যদি ডাকাতির মিশনে ১৮ জন থাকে তাহলে তাদের মধ্যে ৮জনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে আরও ৪জন। সে হিসেবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে ৬ জন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মানিক এখনো চিকিৎসাধীন। সুস্থ হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও তথ্য নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (বি সার্কেল) জহিরুল ইসলাম।
স্বামীর লাশ দেখে সংজ্ঞাহীন স্ত্রী
এদিকে আড়াইহাজার থানায় গিয়ে নিহত ডাকাত সদস্য গাড়িচালক রাজিব ওরফে রনির লাশ শনাক্ত করেন স্ত্রী নাজমা বেগম। তিনি জানান, তার স্বামী রনি ঢাকায় একটি বাসে হেলপারের কাজ করতেন। ১০ দিন ধরে স্বামীর সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ হয়নি। সে ডাকাতি করত কি না তা আমার জানা নেই। লোক মারফত জানতে পেরে আড়াইহাজার থানায় এসেছি। এ সময় থানা প্রাঙ্গণে রাখা স্বামী রনির লাশ দেখে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। অপরদিকে ডাকাতদের পাকড়াও করতে আসা কয়েক শত মানুষ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে জড়ো হওয়ায় ভোর রাত থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ এসে মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক করে। আড়াইহাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আরিফুল হক জানান, সকালে স্থানীয় লোকজনদের মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৭ ডাকাতের লাশ ও আহত অবস্থায় ৫ ডাকাতকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও এক ডাকাতের মৃত্যু হয়। নিহত ডাকাতদের লাশ ময়নাতদন্ত করার জন্য নারায়ণগঞ্জ মর্গে পাঠানো হয়েছে।
এ ঘটনায় রাতেই অজ্ঞাত পরিচয় দিয়ে কয়েক হাজার এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.