অলৌকিক আঙুল by বাদল সৈয়দ
তাঁর আঙুলগুলো প্রজাপতির মতো নাচছে। ওগুলো বাজাতে চায়। কিন্তু পারছে না। বয়স আঙুলের শক্তি শুষে ফেলেছে। তারপরও তাঁর আঙুল নাচে, প্রজাপতির মতো। বেটোফেনের মুনলাইট সোনাটার সঙ্গে। তিনি আরাম চেয়ারে বসে কাঁপছেন, পারকিনসন্স না সোনাটার মূর্ছনায় বোঝা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে ঝুঁকে এসে মনোযোগের কান দিচ্ছেন সোনাটায়। আমার মাথা রিনঝিন করে, নেশা নেশা ভাব। পুরো রুমটা মনে হচ্ছে হালকা তুলোর মতো ভেসে আছে। পিয়ানোয় বেটোফেন সৃষ্টি করেছেন পরাবাস্তবতা। আমি তাঁর দিকে তাকাই। তিনি এখনো ঝুঁকে আছেন।
হঠাৎ আমার নিজের কাছেই প্রশ্ন জাগে, কে বেশি শক্তিশালী?
বেটোফেন না তিনি, যিনি সামনে কান বাড়িয়ে সুর শুনছেন?
ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় অবিশ্বাস্য। কোনো রকমেই আমার তাঁর কাছে যাওয়ার কথা না। বলা হয়, ওয়াশিংটনের সাদা বাড়ির ভদ্রলোক এবং তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে ছয় মাস আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়! আমার তাঁর সঙ্গে শুধু দেখা হওয়ার কথা স্বপ্নে। কিন্তু তিনি বসে আছেন আমার সামনে। কান পেতে শুনছেন মুনলাইট সোনাটা। তাঁর নিজের বাজানো। বাজছে রেকর্ডে! একটু বোধ হয় ঠান্ডা লাগছে। আমি গরম গাউনের ওপর চাপিয়ে দিলাম পাতলা কম্বল। তিনি চোখের ভাষায় ধন্যবাদ দিয়ে আবার মনোযোগ দিলেন বেটোফেনে, আসলে বলা যায় নিজের সৃষ্টিতে। এখনো হালকা কাঁপছেন। কয়েক মাস হলো, নিউইয়র্ক এসেছি। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পাঠিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভের সঙ্গে মুদ্রাবিষয়ক একটা কাজে। কয়েক দিন হলো ছুটি শুরু হয়েছে। লম্বা ছুটি। আমি ফ্রিজভর্তি খাবার নিয়ে আশ্রয়ে ঢুকেছি। ইচ্ছে ছুটির সময়ে কাজ এগিয়ে রাখব। বেরটের হব না। এই জম্পেশ ঠান্ডায় আমার ক্রিসমাস পালনের কোনো ইচ্ছে নেই।
প্রথম দিন আরামসে ঘুমালাম। দুপুরে খাবার বাদ গেল। সন্ধ্যায় স্যান্ডউইচ আর কড়া টার্কিশ কফি নিয়ে বসেছি, এমন সময় ফোন। বিরক্তিতে ফোন ধরতেই রিনঝিন ভেসে এল, ‘লং আইল্যান্ডস হ্যাভেন হাসপাতাল। আমি কি সায়েদের সাথে কথা বলছি?’
একটু ভড়কে গেলাম। হাসপাতাল?
‘হ্যাঁ, সায়েদ বলছি।’
‘হ্যাপি ক্রিসমাস সায়েদ, আমি বারবারা বলছি, হ্যাভেন হাসপাতাল। তুমি তো আমাদের “আই অ্যাম উইথ ইউ” প্রোগ্রামের ভলান্টিয়ার, তাই না?’
প্রথম বুঝতে পারলাম না, রিনঝিন কণ্ঠ কী বলছে? তারপর বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ল, এখানকার হাসপাতালগুলোতে নিঃসঙ্গ রোগীদের সময় দেওয়ার জন্য কিছু প্রোগ্রাম থাকে। ‘আই অ্যাম উইথ ইউ’ সে রকম একটি প্রোগ্রাম। অনেক আগে এখানে যখন ছাত্র ছিলাম, তখন আমিও নাম লিখিয়েছিলাম। তারপর ভুলেই গিয়েছি। কিন্তু ওরা ভোলেনি।
বললাম, ‘হ্যাঁ, করেছি। দশ বছর আগে। কিন্তু এর আগে আমার সাথে কখনো যোগাযোগ করা হয়নি।’
রিনঝিন কণ্ঠ বলল, ‘তা ঠিক, হয়তো দরকার পড়েনি। তবে আমার কম্পিউটার বলছে, আমাকে তুমি এখন সাহায্য করতে পারো। কারণ, তুমি লিখেছ, ভলান্টিয়ার করার জন্য তোমার পছন্দের সময় হচ্ছে ক্রিসমাসের ছুটি।’
আমি আসলে ফরমে তা-ই লিখেছিলাম। কারণ ছাত্রাবস্থায় আমার ছিল হতদরিদ্র অবস্থা। স্কলারশিপ আর টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টের টাকায় খাবারই ঠিকমতো জোটে না, তার আবার ক্রিসমাস।
ওপারের মেয়েটি অপেক্ষা করছে। আমি লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, বলেছিলাম। কী করতে হবে বলো।’
টেলিফোনে স্বস্তি ভেসে এল।
‘আমাদের একজন রোগী, কিছুদিন থেকে এখানে আছেন, আরও থাকতে হবে, সমস্যা হচ্ছে ছুটির সময় তাঁর সঙ্গ দরকার, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি কি পারবে?’
‘আমাকে কি রোগীর ব্যাপারে ধারণা দিতে পারো?’
‘না, সরি, ওটা বলা যাবে না। এই রোগীর সব তথ্য ক্লাসিফায়েড। আমিও জানি না। তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে তোমাকে জানানো হবে, তবে একটি বন্ড সই করার পর। যেটাতে তুমি বলবে, কখনোই তুমি তার কোনো তথ্য প্রকাশ করবে না। এটাতে সই না করলে কাজটা তোমাকে দেওয়া হবে না।’
বেশ বিরক্তই লাগছে। ছাত্রজীবনের মমতাভরা হৃদয় এখন বাস্তবতার কাঠিন্যে কঠিন হয়ে গেছে। তখন যেটা করতে মন চাইত, তা এখন সম্ভব না। তারপরও ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করল না। বয়স্ক একজন নিঃসঙ্গ মানুষ সঙ্গ চাইছেন।
বললাম, ‘ঠিক আছে কখন আসব?’
‘কাল সকাল নয়টায়, ইফ ইউ প্লিজ।’
রিনিঝিনি কণ্ঠ ফোন রেখে দিল।
সেদিন সকালে নিউইয়র্কের চৌদ্দ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা পড়েছে। মাইনাস তের।
ভোরে উঠে রাজ্যের কাপড় পরে, গাড়িতে স্নো টায়ার লাগিয়ে রওনা দিলাম। চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছি, নিজের আর হাসপাতালের।
ঘণ্টা খানেক পর জিব পুড়ে যাওয়া কফির সঙ্গে রোগীর ফাইল এল। তার আগে আমার বন্ড নেওয়া হয়েছে, কাজ করি না করি, যা দেখব তা প্রকাশ করা যাবে না। বিরক্তিতে গা গরম হয়ে যাচ্ছে, ঘোড়ার ডিমের এক রোগী আর ব্যাটারা এমন ভাব করছে যেন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে আমার হাতে তুলে দিচ্ছে।
ঘোড়ার ডিম নয়, যেন আস্ত হিমালয় ভেঙে পড়ল আমার মাথায়। ফাইল নয়, এ তো ঘন লাল আগুন! হাত পুড়ে যাচ্ছে।
এ লোক হাসপাতালে, কেউ জানে না! এটা তো বিশ্ব সংবাদ হতে পারত!
বলা হয় আলোর গতিতে তাঁর আঙুল নাচে। আসলে কি তাঁর আঙুল, না ঈশ্বরের? অনেকের সন্দেহ আছে।
তবে সে আঙুল পিয়ানোতে যে সুর তোলে তা যে দেবতাদের সুর, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি সুরের দেবতা।
তাঁর হাতে সুরের রং ফোটে।
একেক সময় একেক রং। বিটোফেনের পঞ্চম সিম্ফনি হলে সোনালি আর মুন লাইট সোনাটা হলে তরল রুপালি!
সভ্যতা এমনভাবে আর কারও হাতে সুরকে নাচতে দেখেনি।
তিনি হাসপাতালে! আর আমাকে দেওয়া হয়েছে তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার দায়িত্ব!
এক শ বছর গল্প করলেও তো এ গল্প ফুরাবে না! জিব পোড়ানো কফি অনেক আগেই বাইরে রাস্তায় জমে থাকা তুষারের চেয়ে ঠান্ডা হয়ে গেছে।
জন্মেছিলেন পোল্যান্ডে। হিটলারের ভয়ে বাবা যখন তাঁর আমেরিকায় পালিয়ে আসেন, তখন তাঁর বয়স দশ। হার্ভার্ডে সংগীত নিয়ে পড়তে যান ১৯৫৫ সালে। ত্রিশ বছর বয়সে বিটোফেনের ৩২টি সনেট গুচ্ছ সুরে বাঁধেন। শুধু এ কাজটির জন্যই তিনি ইতিহাস হয়ে থাকতে পারতেন। কারণ বিটোফেনকে নিয়ে এ সাহস করার মতো কেউ এর আগে জন্মাননি।
তারপর থেকে যা-ই করেছেন, মনে হয়েছে তিনি নন, ‘ওপরের উনি’ তাঁর আঙুলে ভর করেছেন। তিনিই ফোটাচ্ছেন সুর। পিয়ানোতে।
১৯৬২ সালের শেষের দিকে নিউইয়র্কে মেরিলিন মনরো তাঁর বাজনা শুনতে এসেছিলেন। কথা ছিল অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চে এসে তিনি শিল্পীকে ধন্যবাদ দেবেন। কিন্তু মাঝ অনুষ্ঠানে কোনো কথা না বলে মেরিলিন উঠে যান, তারপর বাড়ি ফিরে ত্রিশটি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে যান।
হাসপাতালে তিনি নাকি প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে বলেছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল, এ সুরের রেশ হারিয়ে যাওয়ার আগে মরে যাওয়া ভালো।
আমার হাতে হালকা গরম কফি, বাড়িয়ে দিলে তিনি চুমুক দিচ্ছেন, বাচ্চাদের মতো চুক চুক আওয়াজ করে। তারপর মৃদু হাসছেন ধন্যবাদের হাসি। আবার ঝুঁকে পড়ে নিজেকে শুনছেন। হালকা সুরে মিউজিক সিস্টেমে বাজছে তাঁর রেকর্ড।
সিম্ফনি সাত তারপর আট। চলতে থাকবে বত্রিশ পর্যন্ত। তারপর প্রথম আলো ফোটা লালচে ভোরে ঘুমাতে যাবেন। এরপর সন্ধ্যা অবধি আমার ছুটি।
কথা বলেন খুব কম। যখন বলেন সেখানে থাকে বিনয়ের আভা।
আবার মাঝেমধ্যে দেখি চেহারা টকটকে লাল হয়েছে। বোঝা যায়, খুব রেগে আছেন, কার ওপর তা বোঝা যায় না। সে সময় আমি চুপ থাকি।
আবার কখনো ঘোরের মধ্যে চলে যান, শুধু হাত কাঁপতে থাকে, মনে হয় পিয়ানো খোঁজে, কিন্তু পায় না। কিছু বললেও বোঝেন না। সম্ভবত তখন তিনি চলে যান অতীতে, যখন মানুষ এক মাস আগে থেকে মাঝরাতেও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকত তাঁর কনসার্টের টিকিট কেনার জন্য, যখন ঈশ্বর কথা বলতেন তাঁর আঙুলে ভর করে।
মাঝেমধ্যে দুষ্টামিও করেন। একদিন রহস্য করে বললেন, ‘হার্ভার্ডকে দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ বিশ্ববিদ্যালয় কেন বলা হয় জানো?’
‘কী! হার্ভার্ড খারাপ?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই খারাপ। তুমি জানো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র পঞ্চাশ শতাংশ সফল হয়। বাকিরা হারিয়ে যায়। অথচ এরা সারা দুনিয়া ওলটপালট করে সেরা মেধাবীদের জড়ো করে, কিন্তু ফিরিয়ে দেয় তার অর্ধেক। তাহলে কী দাঁড়াল? হার্ভার্ড কি অত ভালো, যা তোমরা ভাবো?’
ঘোরের মধ্যে ছুটি শেষ হয়ে এল, আমার ডিউটির সময়ও। এরপর আবার হাসপাতাল তাঁর দায়িত্ব নেবে। অবশ্য তিনি এখন প্রায় সুস্থ। কিন্তু তারপরও হাসপাতাল তাঁকে ছাড়ছে না কিংবা তিনিই যাচ্ছেন না। নিঃসঙ্গ বাড়ির চেয়ে হয়তো হাসপাতালের সঙ্গই বেশি ভালো!
শেষ সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে বসে আছি। তাঁর মেজাজ বেশি ভালো না। বিকেলে রাগ করে গ্লাস ভেঙেছেন। একটু পরপর গরগর করছেন। হাসপাতাল থেকে বলে দেওয়া হয়েছে, দরকার ছাড়া কথা না বলতে। চুপচাপ বসে আছি। আজ মিউজিকও বাজছে না। নিষেধ করে দিয়েছেন। কম্বল গায়ে শুয়ে আছেন, ছাদের দিকে চোখ। সে চোখে কোনো ভাব নেই, ভাষা নেই।
বাইরে তীব্র ঠান্ডা। মাইনাস ছয়। পুরো শহর যেন মৃত্যুশয্যায়। স্ট্রিট লাইটগুলো ঢাকা পড়ে গেছে বরফের চাদরে।
তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি পড়ছি। হাতে এরিক সেগালের থ্রিলার। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘুম ভাঙল চাপা গর্জন শুনে, চমকে দেখি আধা ঘুমে তিনি উঠে বসেছেন। চাপা গলায় কাকে যেন ধমকাচ্ছেন, ‘গেট লস্ট, লিভ মি অ্যালোন, ম্যান।’ তাঁর ঠোট বেয়ে নামছে লালা। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম, তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। কম্বলের নিচে ছোট্ট শরীর থরথর কাঁপছে।
কিছুক্ষণ পর কাঁপুনি থামল। বললাম, নার্স ডাকব? তিনি হাত নেড়ে না করলেন। তারপর মৃদু গলায় বললেন, ‘লাইট নিভাও, পানি দাও।’
হয়তো আলোতে তাঁর চোখ টাটাচ্ছে। আমি লাফ দিয়ে উঠে পানি নিয়ে এলাম, তিনি লম্বা ঢোঁকে খেলেন। মনে হলো খুব তৃষ্ণার্ত। পানি খাওয়ার পর আবার বললেন, ‘লাইট নিভাও।’
আলো নেভানোর পর নেমে এল কোমল অন্ধকার। শুধু বারান্দার হালকা বাতির ছটায় তাঁকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বললেন, ‘১৯৭৭।’
আমার দম বন্ধ হয়ে এল। ১৯৭৭!
প্রথম দিনেই বন্ডে লেখা ছিল, তাঁর সামনে এই শব্দটি উচ্চারণও করা যাবে না, প্রসঙ্গ তোলা তো দূরের কথা। এদিন তিনি বাজানো থামিয়ে দিয়েছিলেন!
ভরা মজলিসে পিয়ানোয় ঘুষি মেরে বলেছিলেন, ‘আমি আর কখনোই বাজাব না, কখনোই না।’ থরথর করে কাঁপছিলেন। তারপর আবার পিয়ানোতে ঘুষি। এরপরই জ্ঞান হারান। দর্শকদের সামনের সারিতে ছিলেন মোনাকোর প্রিন্স, তিনি লাফ দিয়ে উঠে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন, হাসপাতালে নিয়ে যান।
ভিয়েনা অপেরা হাউসে সেদিন আসলে কী ঘটেছিল তা যদি হয় মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন, তাহলে সংগীতের প্রায় ঈশ্বর কেন সেদিন বাজনা ছেড়ে দিয়েছিলেন তা হচ্ছে বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। অনেক জল্পনা হয়েছে, কিন্তু উত্তর পাওয়া যায়নি।
তিনি ব্যাপারটি নিয়ে শুধু চুপই থাকেননি, ব্যাপারটা উঠলেই প্রায় মারতে যান। তাই এ ব্যাপারে কথা বলা নিষেধ।
সম্ভবত এটাই শতাব্দীর সবচেয়ে রহস্যময় নীরবতা।
আর সেই নীরবতা তিনি ভাঙছেন, আমার সামনে!
‘১৯৭৭!’
তিনি আবার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, ‘ভিয়েনা অপেরা হাউস, ১৯৭৭, তুমি কি জানো ব্যাপারটা?’
আমি দম বন্ধ করে বলি, ‘হ্যাঁ।’
তিনি মুখ বাঁকা করে রহস্যময় হাসি হাসেন, ‘কিন্তু কেন তা জানো না, তাই না?’
আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘সেটা তো বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।’তিনি প্রায় ঝুঁকে এসেছেন আমার মুখের কাছে, তাঁর নিশ্বাস পড়ছে আমার ঠোঁটের ওপর। ‘চল্লিশ সালে যখন বাবা নিউইয়র্ক পালিয়ে এলেন তখন আমার বয়স দশ বছর। মা নেই, আমি, আমার দু-বছরের বড় ভাই গিবসন—এ নিয়ে আমাদের পরিবার। কিন্তু আমাদের দু-ভাইয়ের মধ্যে কোনো মিল ছিল না। আমি ছোটখাটো আর গিবসন ছয় ফুট দুই। আমি ক্লাসে শেষের দিকে থাকি, গিবসন জীবনে দ্বিতীয় হয়নি। আমি খেলার মাঠে সুযোগই পাই না, আর সে টেনিসে লোকাল হিরো। পরে অল আমেরিকান ইয়ুথ র্যা ঙ্কিংয়ে সাত নম্বর ছিল। এসব আমার কাছে কোনো ব্যাপার ছিল না, যেটা আমার মাথাব্যথা ছিল, তা হচ্ছে বাবা যখন তাঁর সাথে আমার তুলনা করতেন। নিষ্ঠুর তুলনা। সে ছিল বাবার ব্লু আইডল বয়। আর আমি ছিলাম গুড ফর নাথিং। আমি পরীক্ষায় খারাপ করলে আমাকে গিবসনের সাথে তুলনা করা হতো। সে টেনিসে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এলে বাবা ক্রূর হেসে আমার দিকে তাকাতেন। মমতাহীন সে দৃষ্টিতে একজন কিশোরের মরে যেতে ইচ্ছে করত। ‘আমি গিবসনকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। বলার অতীত ঘৃণা। সে সময় আমি আশ্রয় নিলাম পিয়ানোয়। ‘রাত-দিন পিয়ানো নিয়ে পড়ে থাকি। কিন্তু তেমন সুর ওঠে না। বাবা বাঁকা হাসি হাসেন, বলেন, “ভালো, নাইট ক্লাবের মিউজিক কন্ডাক্টর হতে পারবি। তোর বাজনা শুনে মাতালেরা নাচবে।” আমার গা রি রি করে। জেদ আমাকে পেয়ে বসে। পিয়ানোকে বশ মানাতেই হবে। ‘সিদ্ধান্ত নিই, মিউজিক নিয়ে আমি হার্ভার্ডে পড়ব। বাবাকে কিছুই বললাম না। তিনি আবার হাসবেন। হো হো নিষ্ঠুর হাসি। নিজে নিজেই আবেদন করলাম। তারপর রাত-দিন বেজমেন্টে পিয়ানো নিয়ে পড়ে রইলাম।
‘আমাকে চান্স পেতেই হবে। হার্ভার্ডে। বাবাকে দেওয়া সেটাই হবে আমার উপহার। কিন্তু আমি হলাম বঞ্চিতদের দলে। যাদের প্রকৃতি নির্মমভাবে বঞ্চিত করে। তাই আমার আঙুলে সুর ওঠে না। আমার ভর্তি পরীক্ষার এক মাস আগে গিবসন মারা গেল। সারা জীবন এই কাসানোভা বেপরোয়া ছিল। মারাও গেল বেপরোয়া ঘোড়া চালাতে গিয়ে। হর্স রাইডিং শিখছিল। বাবার বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেল। রাতারাতি তিনি বুড়ো হয়ে গেলেন। তবে আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, গিবসনের মৃত্যু আমাকে তেমন কষ্ট দিল না, বরং মনে মনে কেন যেন খুশিই হলাম। মনে হলো, আপদ বিদায় হয়েছে। আমি খুশিমনেই পিয়ানোতে মন দিলাম। তবে সেই পুরোনো সমস্যা, কিছুতেই সুর ওঠে না। আমার মন খারাপ। হার্ভার্ড পরীক্ষার তারিখ দিয়েছে, সারা দুনিয়ার ভবিষ্যৎ মিউজিক লিজেন্ডরা সেখানে পরীক্ষা দেবে। আর আমি, এ সুর নিয়ে যাব সেখানে? তীব্র আতঙ্কে সারাক্ষণ ঘামতে থাকি। আমার ঘুম হয় না, খাওয়া হয় না। আমি হার্ভার্ডে পড়তে চাই, নয়তো বাবাকে জবাব দেওয়া হবে না। আমাকে একদিনের জন্য হলেও সেখানে পড়তে হবে। যে করেই হোক। কিন্তু সুর আমার কাছে অধরাই থেকে যায়। প্রায় নার্ভাস ব্রেকডাউন নিয়ে পরীক্ষায় বসলাম। আমার সামনে পিয়ানো। আমার হাত ঘামছে, পিছলে যাচ্ছে কি-বোর্ড। আমার খুব কান্না পাচ্ছে, ছুটে গিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করছে। যাঁরা পরীক্ষা নেবেন তাঁরা অবাক হয়ে ভাবছেন, এ গাধা এখানে কী করছে। এমন সময় সুর উঠল। পিয়ানোতে, আমার আঙুলে! মনে হচ্ছিল স্বয়ং বিটোফেন নেমে এসেছেন। ছড়িয়ে দিচ্ছেন রং, সুরের রং।
একজন পরীক্ষক শুধু বলতে লাগলেন, ‘ও মাই গড, ও মাই গড।’ আরেকজন কাঁদতে লাগলেন ভেউ ভেউ করে।
তারপর থেকেই সুর রং নিয়ে ফুটেছে আমার আঙুলে। বলা হতো, আলোর গতির চেয়ে দুরন্ত আমার পিয়ানো।
টাইম ১৯৬৮ সালের পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র হিসেবে আমার আঙুলের ছবি নিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল। ক্যাপশন ছিল, “ঈশ্বরের আঙুল”।
তারপর ১৯৭৭ সাল।’
আমি দমবন্ধ উত্তেজনায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেদিন কী হয়েছিল, কেন বাজানো ছেড়ে দিলেন?’
‘কারণ সেদিন আমার ধৈর্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমার পক্ষে আর অভিনয় করা সম্ভব ছিল না।’
‘অভিনয়?’—আমার গলা প্রায় চিৎকারের মতো শোনায়।
‘হ্যাঁ, হার্ভার্ডে পরীক্ষার সময় যখন আমার হাত থেকে কি-বোর্ড ছুটে যাচ্ছিল ঘামে, ঝুঁকে থেকে যখন আমি অসহায় কান্না লুকোচ্ছিলাম, যখন বোঝা যাচ্ছিল এইমাত্র আমার স্বপ্ন নিহত হতে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ আমাকে কে যেন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। আমি পড়ে গেলাম। তারপর বেজে উঠল সুর।
অবাক হয়ে দেখলাম, আমি নই, পিয়ানো বাজাচ্ছে গিবসন। আমার ভাই গিবসন, যে মারা গেছে এক মাস আগে! যে কোনো দিন পিয়ানো ধরেও দেখেনি। সে বাজাচ্ছে আর হাসছে, দুষ্টু হাসি, আমার দিকে তাকিয়ে। তাঁর হাত নেচে যাচ্ছে পিয়ানোতে—অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায়। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি, গিবসন কোত্থেকে? সে কখন পিয়ানো শিখল? সে তো মারা গেছে এক মাস আগে। আমি ছাড়া আর কেউ তাঁকে দেখছে না কেন?’
বৃদ্ধ হাঁপাচ্ছেন, কেমন লালচে তাঁর চোখের জল।
‘আমি আসলে কোনো দিন বাজাইনি। আমি বাজাতে পারি না। বাজিয়েছে মৃত গিবসন, সারা জীবন।’
তিনি আমার হাত ধরলেন, তারপর হাউমাউ কাঁদতে লাগলেন, আসলেই তাঁর চোখের জল লাল।
কেন লাল আমি জানি না।
হঠাৎ দূরের পিয়ানো নিজে নিজে বেজে উঠল।
সিম্ফনি নাইন, বিটোফেন।
কে যেন তা বাজাচ্ছে!
কেমন যেন বেগুনি আলোয় ধোঁয়া ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, কি-বোর্ডে নেচে যাচ্ছে অশরীরী আঙুল।
ঈশ্বরের আঙুল?
হঠাৎ আমার নিজের কাছেই প্রশ্ন জাগে, কে বেশি শক্তিশালী?
বেটোফেন না তিনি, যিনি সামনে কান বাড়িয়ে সুর শুনছেন?
ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় অবিশ্বাস্য। কোনো রকমেই আমার তাঁর কাছে যাওয়ার কথা না। বলা হয়, ওয়াশিংটনের সাদা বাড়ির ভদ্রলোক এবং তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে ছয় মাস আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়! আমার তাঁর সঙ্গে শুধু দেখা হওয়ার কথা স্বপ্নে। কিন্তু তিনি বসে আছেন আমার সামনে। কান পেতে শুনছেন মুনলাইট সোনাটা। তাঁর নিজের বাজানো। বাজছে রেকর্ডে! একটু বোধ হয় ঠান্ডা লাগছে। আমি গরম গাউনের ওপর চাপিয়ে দিলাম পাতলা কম্বল। তিনি চোখের ভাষায় ধন্যবাদ দিয়ে আবার মনোযোগ দিলেন বেটোফেনে, আসলে বলা যায় নিজের সৃষ্টিতে। এখনো হালকা কাঁপছেন। কয়েক মাস হলো, নিউইয়র্ক এসেছি। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পাঠিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভের সঙ্গে মুদ্রাবিষয়ক একটা কাজে। কয়েক দিন হলো ছুটি শুরু হয়েছে। লম্বা ছুটি। আমি ফ্রিজভর্তি খাবার নিয়ে আশ্রয়ে ঢুকেছি। ইচ্ছে ছুটির সময়ে কাজ এগিয়ে রাখব। বেরটের হব না। এই জম্পেশ ঠান্ডায় আমার ক্রিসমাস পালনের কোনো ইচ্ছে নেই।
প্রথম দিন আরামসে ঘুমালাম। দুপুরে খাবার বাদ গেল। সন্ধ্যায় স্যান্ডউইচ আর কড়া টার্কিশ কফি নিয়ে বসেছি, এমন সময় ফোন। বিরক্তিতে ফোন ধরতেই রিনঝিন ভেসে এল, ‘লং আইল্যান্ডস হ্যাভেন হাসপাতাল। আমি কি সায়েদের সাথে কথা বলছি?’
একটু ভড়কে গেলাম। হাসপাতাল?
‘হ্যাঁ, সায়েদ বলছি।’
‘হ্যাপি ক্রিসমাস সায়েদ, আমি বারবারা বলছি, হ্যাভেন হাসপাতাল। তুমি তো আমাদের “আই অ্যাম উইথ ইউ” প্রোগ্রামের ভলান্টিয়ার, তাই না?’
প্রথম বুঝতে পারলাম না, রিনঝিন কণ্ঠ কী বলছে? তারপর বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ল, এখানকার হাসপাতালগুলোতে নিঃসঙ্গ রোগীদের সময় দেওয়ার জন্য কিছু প্রোগ্রাম থাকে। ‘আই অ্যাম উইথ ইউ’ সে রকম একটি প্রোগ্রাম। অনেক আগে এখানে যখন ছাত্র ছিলাম, তখন আমিও নাম লিখিয়েছিলাম। তারপর ভুলেই গিয়েছি। কিন্তু ওরা ভোলেনি।
বললাম, ‘হ্যাঁ, করেছি। দশ বছর আগে। কিন্তু এর আগে আমার সাথে কখনো যোগাযোগ করা হয়নি।’
রিনঝিন কণ্ঠ বলল, ‘তা ঠিক, হয়তো দরকার পড়েনি। তবে আমার কম্পিউটার বলছে, আমাকে তুমি এখন সাহায্য করতে পারো। কারণ, তুমি লিখেছ, ভলান্টিয়ার করার জন্য তোমার পছন্দের সময় হচ্ছে ক্রিসমাসের ছুটি।’
আমি আসলে ফরমে তা-ই লিখেছিলাম। কারণ ছাত্রাবস্থায় আমার ছিল হতদরিদ্র অবস্থা। স্কলারশিপ আর টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টের টাকায় খাবারই ঠিকমতো জোটে না, তার আবার ক্রিসমাস।
ওপারের মেয়েটি অপেক্ষা করছে। আমি লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, বলেছিলাম। কী করতে হবে বলো।’
টেলিফোনে স্বস্তি ভেসে এল।
‘আমাদের একজন রোগী, কিছুদিন থেকে এখানে আছেন, আরও থাকতে হবে, সমস্যা হচ্ছে ছুটির সময় তাঁর সঙ্গ দরকার, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি কি পারবে?’
‘আমাকে কি রোগীর ব্যাপারে ধারণা দিতে পারো?’
‘না, সরি, ওটা বলা যাবে না। এই রোগীর সব তথ্য ক্লাসিফায়েড। আমিও জানি না। তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে তোমাকে জানানো হবে, তবে একটি বন্ড সই করার পর। যেটাতে তুমি বলবে, কখনোই তুমি তার কোনো তথ্য প্রকাশ করবে না। এটাতে সই না করলে কাজটা তোমাকে দেওয়া হবে না।’
বেশ বিরক্তই লাগছে। ছাত্রজীবনের মমতাভরা হৃদয় এখন বাস্তবতার কাঠিন্যে কঠিন হয়ে গেছে। তখন যেটা করতে মন চাইত, তা এখন সম্ভব না। তারপরও ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করল না। বয়স্ক একজন নিঃসঙ্গ মানুষ সঙ্গ চাইছেন।
বললাম, ‘ঠিক আছে কখন আসব?’
‘কাল সকাল নয়টায়, ইফ ইউ প্লিজ।’
রিনিঝিনি কণ্ঠ ফোন রেখে দিল।
সেদিন সকালে নিউইয়র্কের চৌদ্দ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা পড়েছে। মাইনাস তের।
ভোরে উঠে রাজ্যের কাপড় পরে, গাড়িতে স্নো টায়ার লাগিয়ে রওনা দিলাম। চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছি, নিজের আর হাসপাতালের।
ঘণ্টা খানেক পর জিব পুড়ে যাওয়া কফির সঙ্গে রোগীর ফাইল এল। তার আগে আমার বন্ড নেওয়া হয়েছে, কাজ করি না করি, যা দেখব তা প্রকাশ করা যাবে না। বিরক্তিতে গা গরম হয়ে যাচ্ছে, ঘোড়ার ডিমের এক রোগী আর ব্যাটারা এমন ভাব করছে যেন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে আমার হাতে তুলে দিচ্ছে।
ঘোড়ার ডিম নয়, যেন আস্ত হিমালয় ভেঙে পড়ল আমার মাথায়। ফাইল নয়, এ তো ঘন লাল আগুন! হাত পুড়ে যাচ্ছে।
এ লোক হাসপাতালে, কেউ জানে না! এটা তো বিশ্ব সংবাদ হতে পারত!
বলা হয় আলোর গতিতে তাঁর আঙুল নাচে। আসলে কি তাঁর আঙুল, না ঈশ্বরের? অনেকের সন্দেহ আছে।
তবে সে আঙুল পিয়ানোতে যে সুর তোলে তা যে দেবতাদের সুর, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি সুরের দেবতা।
তাঁর হাতে সুরের রং ফোটে।
একেক সময় একেক রং। বিটোফেনের পঞ্চম সিম্ফনি হলে সোনালি আর মুন লাইট সোনাটা হলে তরল রুপালি!
সভ্যতা এমনভাবে আর কারও হাতে সুরকে নাচতে দেখেনি।
তিনি হাসপাতালে! আর আমাকে দেওয়া হয়েছে তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার দায়িত্ব!
এক শ বছর গল্প করলেও তো এ গল্প ফুরাবে না! জিব পোড়ানো কফি অনেক আগেই বাইরে রাস্তায় জমে থাকা তুষারের চেয়ে ঠান্ডা হয়ে গেছে।
জন্মেছিলেন পোল্যান্ডে। হিটলারের ভয়ে বাবা যখন তাঁর আমেরিকায় পালিয়ে আসেন, তখন তাঁর বয়স দশ। হার্ভার্ডে সংগীত নিয়ে পড়তে যান ১৯৫৫ সালে। ত্রিশ বছর বয়সে বিটোফেনের ৩২টি সনেট গুচ্ছ সুরে বাঁধেন। শুধু এ কাজটির জন্যই তিনি ইতিহাস হয়ে থাকতে পারতেন। কারণ বিটোফেনকে নিয়ে এ সাহস করার মতো কেউ এর আগে জন্মাননি।
তারপর থেকে যা-ই করেছেন, মনে হয়েছে তিনি নন, ‘ওপরের উনি’ তাঁর আঙুলে ভর করেছেন। তিনিই ফোটাচ্ছেন সুর। পিয়ানোতে।
১৯৬২ সালের শেষের দিকে নিউইয়র্কে মেরিলিন মনরো তাঁর বাজনা শুনতে এসেছিলেন। কথা ছিল অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চে এসে তিনি শিল্পীকে ধন্যবাদ দেবেন। কিন্তু মাঝ অনুষ্ঠানে কোনো কথা না বলে মেরিলিন উঠে যান, তারপর বাড়ি ফিরে ত্রিশটি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে যান।
হাসপাতালে তিনি নাকি প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে বলেছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল, এ সুরের রেশ হারিয়ে যাওয়ার আগে মরে যাওয়া ভালো।
আমার হাতে হালকা গরম কফি, বাড়িয়ে দিলে তিনি চুমুক দিচ্ছেন, বাচ্চাদের মতো চুক চুক আওয়াজ করে। তারপর মৃদু হাসছেন ধন্যবাদের হাসি। আবার ঝুঁকে পড়ে নিজেকে শুনছেন। হালকা সুরে মিউজিক সিস্টেমে বাজছে তাঁর রেকর্ড।
সিম্ফনি সাত তারপর আট। চলতে থাকবে বত্রিশ পর্যন্ত। তারপর প্রথম আলো ফোটা লালচে ভোরে ঘুমাতে যাবেন। এরপর সন্ধ্যা অবধি আমার ছুটি।
কথা বলেন খুব কম। যখন বলেন সেখানে থাকে বিনয়ের আভা।
আবার মাঝেমধ্যে দেখি চেহারা টকটকে লাল হয়েছে। বোঝা যায়, খুব রেগে আছেন, কার ওপর তা বোঝা যায় না। সে সময় আমি চুপ থাকি।
আবার কখনো ঘোরের মধ্যে চলে যান, শুধু হাত কাঁপতে থাকে, মনে হয় পিয়ানো খোঁজে, কিন্তু পায় না। কিছু বললেও বোঝেন না। সম্ভবত তখন তিনি চলে যান অতীতে, যখন মানুষ এক মাস আগে থেকে মাঝরাতেও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকত তাঁর কনসার্টের টিকিট কেনার জন্য, যখন ঈশ্বর কথা বলতেন তাঁর আঙুলে ভর করে।
মাঝেমধ্যে দুষ্টামিও করেন। একদিন রহস্য করে বললেন, ‘হার্ভার্ডকে দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ বিশ্ববিদ্যালয় কেন বলা হয় জানো?’
‘কী! হার্ভার্ড খারাপ?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই খারাপ। তুমি জানো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র পঞ্চাশ শতাংশ সফল হয়। বাকিরা হারিয়ে যায়। অথচ এরা সারা দুনিয়া ওলটপালট করে সেরা মেধাবীদের জড়ো করে, কিন্তু ফিরিয়ে দেয় তার অর্ধেক। তাহলে কী দাঁড়াল? হার্ভার্ড কি অত ভালো, যা তোমরা ভাবো?’
ঘোরের মধ্যে ছুটি শেষ হয়ে এল, আমার ডিউটির সময়ও। এরপর আবার হাসপাতাল তাঁর দায়িত্ব নেবে। অবশ্য তিনি এখন প্রায় সুস্থ। কিন্তু তারপরও হাসপাতাল তাঁকে ছাড়ছে না কিংবা তিনিই যাচ্ছেন না। নিঃসঙ্গ বাড়ির চেয়ে হয়তো হাসপাতালের সঙ্গই বেশি ভালো!
শেষ সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে বসে আছি। তাঁর মেজাজ বেশি ভালো না। বিকেলে রাগ করে গ্লাস ভেঙেছেন। একটু পরপর গরগর করছেন। হাসপাতাল থেকে বলে দেওয়া হয়েছে, দরকার ছাড়া কথা না বলতে। চুপচাপ বসে আছি। আজ মিউজিকও বাজছে না। নিষেধ করে দিয়েছেন। কম্বল গায়ে শুয়ে আছেন, ছাদের দিকে চোখ। সে চোখে কোনো ভাব নেই, ভাষা নেই।
বাইরে তীব্র ঠান্ডা। মাইনাস ছয়। পুরো শহর যেন মৃত্যুশয্যায়। স্ট্রিট লাইটগুলো ঢাকা পড়ে গেছে বরফের চাদরে।
তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি পড়ছি। হাতে এরিক সেগালের থ্রিলার। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘুম ভাঙল চাপা গর্জন শুনে, চমকে দেখি আধা ঘুমে তিনি উঠে বসেছেন। চাপা গলায় কাকে যেন ধমকাচ্ছেন, ‘গেট লস্ট, লিভ মি অ্যালোন, ম্যান।’ তাঁর ঠোট বেয়ে নামছে লালা। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম, তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। কম্বলের নিচে ছোট্ট শরীর থরথর কাঁপছে।
কিছুক্ষণ পর কাঁপুনি থামল। বললাম, নার্স ডাকব? তিনি হাত নেড়ে না করলেন। তারপর মৃদু গলায় বললেন, ‘লাইট নিভাও, পানি দাও।’
হয়তো আলোতে তাঁর চোখ টাটাচ্ছে। আমি লাফ দিয়ে উঠে পানি নিয়ে এলাম, তিনি লম্বা ঢোঁকে খেলেন। মনে হলো খুব তৃষ্ণার্ত। পানি খাওয়ার পর আবার বললেন, ‘লাইট নিভাও।’
আলো নেভানোর পর নেমে এল কোমল অন্ধকার। শুধু বারান্দার হালকা বাতির ছটায় তাঁকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বললেন, ‘১৯৭৭।’
আমার দম বন্ধ হয়ে এল। ১৯৭৭!
প্রথম দিনেই বন্ডে লেখা ছিল, তাঁর সামনে এই শব্দটি উচ্চারণও করা যাবে না, প্রসঙ্গ তোলা তো দূরের কথা। এদিন তিনি বাজানো থামিয়ে দিয়েছিলেন!
ভরা মজলিসে পিয়ানোয় ঘুষি মেরে বলেছিলেন, ‘আমি আর কখনোই বাজাব না, কখনোই না।’ থরথর করে কাঁপছিলেন। তারপর আবার পিয়ানোতে ঘুষি। এরপরই জ্ঞান হারান। দর্শকদের সামনের সারিতে ছিলেন মোনাকোর প্রিন্স, তিনি লাফ দিয়ে উঠে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন, হাসপাতালে নিয়ে যান।
ভিয়েনা অপেরা হাউসে সেদিন আসলে কী ঘটেছিল তা যদি হয় মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন, তাহলে সংগীতের প্রায় ঈশ্বর কেন সেদিন বাজনা ছেড়ে দিয়েছিলেন তা হচ্ছে বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। অনেক জল্পনা হয়েছে, কিন্তু উত্তর পাওয়া যায়নি।
তিনি ব্যাপারটি নিয়ে শুধু চুপই থাকেননি, ব্যাপারটা উঠলেই প্রায় মারতে যান। তাই এ ব্যাপারে কথা বলা নিষেধ।
সম্ভবত এটাই শতাব্দীর সবচেয়ে রহস্যময় নীরবতা।
আর সেই নীরবতা তিনি ভাঙছেন, আমার সামনে!
‘১৯৭৭!’
তিনি আবার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, ‘ভিয়েনা অপেরা হাউস, ১৯৭৭, তুমি কি জানো ব্যাপারটা?’
আমি দম বন্ধ করে বলি, ‘হ্যাঁ।’
তিনি মুখ বাঁকা করে রহস্যময় হাসি হাসেন, ‘কিন্তু কেন তা জানো না, তাই না?’
আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘সেটা তো বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।’তিনি প্রায় ঝুঁকে এসেছেন আমার মুখের কাছে, তাঁর নিশ্বাস পড়ছে আমার ঠোঁটের ওপর। ‘চল্লিশ সালে যখন বাবা নিউইয়র্ক পালিয়ে এলেন তখন আমার বয়স দশ বছর। মা নেই, আমি, আমার দু-বছরের বড় ভাই গিবসন—এ নিয়ে আমাদের পরিবার। কিন্তু আমাদের দু-ভাইয়ের মধ্যে কোনো মিল ছিল না। আমি ছোটখাটো আর গিবসন ছয় ফুট দুই। আমি ক্লাসে শেষের দিকে থাকি, গিবসন জীবনে দ্বিতীয় হয়নি। আমি খেলার মাঠে সুযোগই পাই না, আর সে টেনিসে লোকাল হিরো। পরে অল আমেরিকান ইয়ুথ র্যা ঙ্কিংয়ে সাত নম্বর ছিল। এসব আমার কাছে কোনো ব্যাপার ছিল না, যেটা আমার মাথাব্যথা ছিল, তা হচ্ছে বাবা যখন তাঁর সাথে আমার তুলনা করতেন। নিষ্ঠুর তুলনা। সে ছিল বাবার ব্লু আইডল বয়। আর আমি ছিলাম গুড ফর নাথিং। আমি পরীক্ষায় খারাপ করলে আমাকে গিবসনের সাথে তুলনা করা হতো। সে টেনিসে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এলে বাবা ক্রূর হেসে আমার দিকে তাকাতেন। মমতাহীন সে দৃষ্টিতে একজন কিশোরের মরে যেতে ইচ্ছে করত। ‘আমি গিবসনকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। বলার অতীত ঘৃণা। সে সময় আমি আশ্রয় নিলাম পিয়ানোয়। ‘রাত-দিন পিয়ানো নিয়ে পড়ে থাকি। কিন্তু তেমন সুর ওঠে না। বাবা বাঁকা হাসি হাসেন, বলেন, “ভালো, নাইট ক্লাবের মিউজিক কন্ডাক্টর হতে পারবি। তোর বাজনা শুনে মাতালেরা নাচবে।” আমার গা রি রি করে। জেদ আমাকে পেয়ে বসে। পিয়ানোকে বশ মানাতেই হবে। ‘সিদ্ধান্ত নিই, মিউজিক নিয়ে আমি হার্ভার্ডে পড়ব। বাবাকে কিছুই বললাম না। তিনি আবার হাসবেন। হো হো নিষ্ঠুর হাসি। নিজে নিজেই আবেদন করলাম। তারপর রাত-দিন বেজমেন্টে পিয়ানো নিয়ে পড়ে রইলাম।
‘আমাকে চান্স পেতেই হবে। হার্ভার্ডে। বাবাকে দেওয়া সেটাই হবে আমার উপহার। কিন্তু আমি হলাম বঞ্চিতদের দলে। যাদের প্রকৃতি নির্মমভাবে বঞ্চিত করে। তাই আমার আঙুলে সুর ওঠে না। আমার ভর্তি পরীক্ষার এক মাস আগে গিবসন মারা গেল। সারা জীবন এই কাসানোভা বেপরোয়া ছিল। মারাও গেল বেপরোয়া ঘোড়া চালাতে গিয়ে। হর্স রাইডিং শিখছিল। বাবার বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেল। রাতারাতি তিনি বুড়ো হয়ে গেলেন। তবে আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, গিবসনের মৃত্যু আমাকে তেমন কষ্ট দিল না, বরং মনে মনে কেন যেন খুশিই হলাম। মনে হলো, আপদ বিদায় হয়েছে। আমি খুশিমনেই পিয়ানোতে মন দিলাম। তবে সেই পুরোনো সমস্যা, কিছুতেই সুর ওঠে না। আমার মন খারাপ। হার্ভার্ড পরীক্ষার তারিখ দিয়েছে, সারা দুনিয়ার ভবিষ্যৎ মিউজিক লিজেন্ডরা সেখানে পরীক্ষা দেবে। আর আমি, এ সুর নিয়ে যাব সেখানে? তীব্র আতঙ্কে সারাক্ষণ ঘামতে থাকি। আমার ঘুম হয় না, খাওয়া হয় না। আমি হার্ভার্ডে পড়তে চাই, নয়তো বাবাকে জবাব দেওয়া হবে না। আমাকে একদিনের জন্য হলেও সেখানে পড়তে হবে। যে করেই হোক। কিন্তু সুর আমার কাছে অধরাই থেকে যায়। প্রায় নার্ভাস ব্রেকডাউন নিয়ে পরীক্ষায় বসলাম। আমার সামনে পিয়ানো। আমার হাত ঘামছে, পিছলে যাচ্ছে কি-বোর্ড। আমার খুব কান্না পাচ্ছে, ছুটে গিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করছে। যাঁরা পরীক্ষা নেবেন তাঁরা অবাক হয়ে ভাবছেন, এ গাধা এখানে কী করছে। এমন সময় সুর উঠল। পিয়ানোতে, আমার আঙুলে! মনে হচ্ছিল স্বয়ং বিটোফেন নেমে এসেছেন। ছড়িয়ে দিচ্ছেন রং, সুরের রং।
একজন পরীক্ষক শুধু বলতে লাগলেন, ‘ও মাই গড, ও মাই গড।’ আরেকজন কাঁদতে লাগলেন ভেউ ভেউ করে।
তারপর থেকেই সুর রং নিয়ে ফুটেছে আমার আঙুলে। বলা হতো, আলোর গতির চেয়ে দুরন্ত আমার পিয়ানো।
টাইম ১৯৬৮ সালের পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র হিসেবে আমার আঙুলের ছবি নিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল। ক্যাপশন ছিল, “ঈশ্বরের আঙুল”।
তারপর ১৯৭৭ সাল।’
আমি দমবন্ধ উত্তেজনায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেদিন কী হয়েছিল, কেন বাজানো ছেড়ে দিলেন?’
‘কারণ সেদিন আমার ধৈর্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমার পক্ষে আর অভিনয় করা সম্ভব ছিল না।’
‘অভিনয়?’—আমার গলা প্রায় চিৎকারের মতো শোনায়।
‘হ্যাঁ, হার্ভার্ডে পরীক্ষার সময় যখন আমার হাত থেকে কি-বোর্ড ছুটে যাচ্ছিল ঘামে, ঝুঁকে থেকে যখন আমি অসহায় কান্না লুকোচ্ছিলাম, যখন বোঝা যাচ্ছিল এইমাত্র আমার স্বপ্ন নিহত হতে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ আমাকে কে যেন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। আমি পড়ে গেলাম। তারপর বেজে উঠল সুর।
অবাক হয়ে দেখলাম, আমি নই, পিয়ানো বাজাচ্ছে গিবসন। আমার ভাই গিবসন, যে মারা গেছে এক মাস আগে! যে কোনো দিন পিয়ানো ধরেও দেখেনি। সে বাজাচ্ছে আর হাসছে, দুষ্টু হাসি, আমার দিকে তাকিয়ে। তাঁর হাত নেচে যাচ্ছে পিয়ানোতে—অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায়। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি, গিবসন কোত্থেকে? সে কখন পিয়ানো শিখল? সে তো মারা গেছে এক মাস আগে। আমি ছাড়া আর কেউ তাঁকে দেখছে না কেন?’
বৃদ্ধ হাঁপাচ্ছেন, কেমন লালচে তাঁর চোখের জল।
‘আমি আসলে কোনো দিন বাজাইনি। আমি বাজাতে পারি না। বাজিয়েছে মৃত গিবসন, সারা জীবন।’
তিনি আমার হাত ধরলেন, তারপর হাউমাউ কাঁদতে লাগলেন, আসলেই তাঁর চোখের জল লাল।
কেন লাল আমি জানি না।
হঠাৎ দূরের পিয়ানো নিজে নিজে বেজে উঠল।
সিম্ফনি নাইন, বিটোফেন।
কে যেন তা বাজাচ্ছে!
কেমন যেন বেগুনি আলোয় ধোঁয়া ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, কি-বোর্ডে নেচে যাচ্ছে অশরীরী আঙুল।
ঈশ্বরের আঙুল?
No comments