৭৬,০০০ কোটি টাকা পাচার ‘নেপথ্যে তিন কারণ’

প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচার হচ্ছে বিভিন্ন পথে। এসব অর্থ পাচারের পেছনে দুর্নীতি, অনিরাপদ বিনিয়োগ পরিবেশ ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাই দায়ী বলে মনে করেন দেশের অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। তাদের মতে অর্থ সুরক্ষা, আস্থার সংকট ও নিরাপদবোধ মনে করছেন না বিনিয়োগকারীরা। ফলে বেশি লাভের আশায় অনেকেই আমদানি-রপ্তানির আড়ালে দেশের অর্থ বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আগের পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় প্রতি বছরই অর্থ পাচারের পরিমাণ বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তারা। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, বাংলাদেশ থেকে শুধু ২০১৩ সালেই ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে। টাকার অঙ্কে যা ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। পাচার হওয়া এ অর্থ আগের বছরের তুলনায় ৩৩.৭৯ শতাংশ বেশি। ‘ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোস ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিজ : ২০০৪-১৩’ শীর্ষক সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জিএফআই। ওই প্রতিবেদনেই অর্থ পাচারের এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন জিএফআইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ডেভ কার ও অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্পেনজারস। অস্বচ্ছ ব্যবসায়িক লেনদেন বা মিসইনভয়েসিং, দুর্নীতি ও কর ফাঁকির মাধ্যমে এ অর্থ পাচার হয়েছে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মীর্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্থবির অবস্থায়। এটা একটা অর্থ পাচারের বড় কারণ হতে পারে। তিনি সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে অনুসন্ধানের পরামর্শ দিয়ে বলেন, আমদানির পাশাপাশি রপ্তানির মাধ্যমেও অর্থ পাচার হতে পারে।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ পাচার হলেও ২০১৩ সালে এর পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। এতে বেশি অর্থ পাচার হওয়া দেশের তালিকায় খারাপ অবস্থানে গেছে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ ছিল ১৪৫টি দেশের মধ্যে ৫১তম। আর এবার বাংলাদেশ ১৪৯টি দেশের মধ্যে হয়েছে ২৬তম।
জিএফআইয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে ২০০৪ সাল থেকে অর্থ পাচারের হিসাব দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে ২০১২ ও ২০১৩ সালে। যেমন ২০১২ সালে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এ ছাড়া ২০০৪ সালে পাচার হয়েছিল ৩৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০০৯ সালে ৬১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং ২০১১ সালে পাচার হয় ৫৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গড়ে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫৫৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় কেউ দেশে বিনিয়োগের বিষয়টি ভাবছে না। অনিরাপদবোধ করছেন বিনিয়োগকারীরা। তাদের চিন্তা কখন কী হয়ে যায়। সে কারণে আস্থার সংকটে রয়েছেন তারা। এ ছাড়া অর্থসুরক্ষা ও বেশি লাভের আশায় কেউ কেউ টাকা বিদেশে পাঠাচ্ছেন। আমদানি-রপ্তানির আড়ালেও অর্থ পাচার হচ্ছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি আর্থিক খাতে কেলেঙ্কারিও বেড়েছে। আর নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নির্বাচনের আগে এসব অর্থ বিদেশে পাচার করে; যার চিত্র জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে বিদেশে অর্থ পাচার অনেক পুরনো। আগের পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় প্রতি বছরই অর্থ পাচারের পরিমাণ বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন এ অর্থনীতিবিদ। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আবদুল মজিদ বলেন, পাচার করা অর্থের যে হিসাব করা হয়েছে, তা ধারণামাত্র। বাস্তবে এর চেয়েও বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে। তার মতে, দেশে বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিবেশ না থাকায় অর্থ পাচার হচ্ছে। পাশাপাশি সুশাসনের অভাবে সহজে দুর্নীতি হচ্ছে। অবৈধ এ অর্থ দেশে নির্বিঘ্নে ব্যবহার করতে না পেরে তা পাচার করা হয়। পর্যাপ্ত নজরদারি ও আইনের শাসনে দুর্বলতা রয়েছে; যা সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, সবকিছুর আগে গোড়ায় হাত দিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তাদের। ভাসা ভাসা বলে লাভ নেই। ঢালাওভাবে কাউকে দোষারোপ না করে সুনির্দিষ্টভাবে যারা অবৈধ পথে অর্থ পাচার কাজে লিপ্ত তাদের খুঁজে বের করতে হবে। অর্থ পাচারকারীরা বাংলাদেশেই আছেন। তারা এ দেশকে ভালোবাসেন না। দেশে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ আছে দাবি করে মাতলুব বলেন, এ দেশের মতো এত লাভজনক বিনিয়োগ পরিবেশ পৃথিবীর কোথাও নেই। অর্থ পাচার থামাতে হবে। আর বাড়তে দেয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে গতকাল এনবিআর সম্মেলন কক্ষে ‘জনকল্যাণে রাজস্ব : রাজস্ব আদায়ে চাই অব্যাহত সহযোগিতা’ শীর্ষক এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান বলেন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এখন থেকে নিয়মিতভাবে মুদ্রা পাচার বা মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্তদের শনাক্ত করতে অভিযান পরিচালনা করবে প্রতিষ্ঠানটি। এ ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, আগে মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে অপরাধের তদন্ত ও মামলা করার এখতিয়ার কেবল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ছিল। এখন এর আওতা বাড়ানো হচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য সংস্থার পাশাপাশি এনবিআরও এ বিষয়ে জোরালো ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সরকার এখন চোরাচালানের বিরুদ্ধে অনেক বেশি সোচ্চার।

No comments

Powered by Blogger.