দাওয়াতের অন্যতম পথ ওয়াজ মাহফিল

কোরআন কারিমের ৭৭টি নামের এক নাম হলো ‘ওয়াজ’ বা উপদেশ। মহান আল্লাহ হলেন প্রথম ওয়ায়েজ বা ওয়াজকারী। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন দ্বিতীয় ওয়ায়েজ—এই সূত্রে নবী করিম (সা.)-এর উত্তরাধিকারীরা ওয়ায়েজিন। এই উম্মতের দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করবেন ওয়ারেসাতুল আম্বিয়া তথা নবীদের উত্তরাধিকারী উলামায়ে কিরাম। আর উলামায়ে কিরামের দায়িত্ব হলো এই দাওয়াতি কাজ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত রাখা। ওয়াজ, নসিহত, বয়ান, খুতবা, তাফসির ইত্যাদি দাওয়াতের প্রচলিত মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’ (আল কোরআন, পারা-১৪, সূরা: নাহল, আয়াত: ১২৫)। দাওয়াতি আলোচনার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। যেমন: ওয়াজ, নসিহত, বয়ান, খুতবা, তাফসির ইত্যাদি। ‘ওয়াজ’ হলো সুন্দর, আকর্ষণীয়, যুক্তিপূর্ণ ও হৃদয়স্পর্শী আবেদনময় আলোচনা। সাধারণত ওয়াজ সুরেলা কণ্ঠে উপমার মাধ্যমে আকর্ষণীয় উপায়ে গল্প–কাহিনির সমন্বয়ে পরিবেশন করা হয়। যিনি ওয়াজ করেন, তাকে ওয়ায়েজ বলে। ওয়ায়েজিন হলো এর বহুবচন। ‘নসিহত’ হলো কল্যাণ কামনায় আন্তরিক আদেশ বা অনুজ্ঞাসূচক চূড়ান্ত নিবেদন। এর জন্য ব্যক্তিত্ব, অধিকার ও কল্যাণকামী হওয়া প্রয়োজন। যিনি নসিহত করেন, তাঁকে নাসিহ বলা হয়। নাসিহিন এর বহুবচন। হাদিস শরিফে আছে, ‘নসিহত অর্থাৎ সদুপদেশ বা কল্যাণ কামনাই দ্বীন বা ধর্মের মূল কথা।’ (বুখারি)।
‘বয়ান’ হলো বক্তৃতা বা জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, যাতে নির্ধারিত বিষয়ের বিবরণভিত্তিক সুস্পষ্ট বর্ণনা থাকে। এর জন্য পর্যাপ্ত বিষয়জ্ঞান, দালিলিক প্রমাণ প্রয়োজন। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহ, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনি তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে “বয়ান”।’ (আল কোরআন, পারা: ২৭, সূরা: আর রহমান, আয়াত: ১-৪)। ‘খুতবা’ হলো ভাষণ, যাতে দায়িত্বশীল ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত বিশেষ কোনো বিষয়ে কর্মসূচির উল্লেখ করে থাকেন। যিনি খুতবা প্রদান করেন, তাঁকে খতিব বলা হয়। এর বহুবচন খুতাবা। এর মূল হলো খিতাব অর্থাৎ সম্বোধন বা উপস্থাপন। ‘তাফসির’ হলো কোরআনের নির্ধারিত অংশ বা বিষয়ে যোগ্য মুফাসসির কর্তৃক মূলনীতির ভিত্তিতে সুন্নাহ, ফিকাহ ও প্রয়োজনীয় ইসলামি শাস্ত্রসমূহের আলোকে ব্যাখ্যা করা। যিনি তাফসির করেন, তাঁকে ‘মুফাসসির’ বলা হয়। ‘মুফাসসিরিন’ হলো এর বহুবচন। এ জন্য অগাধ ইসলামি জ্ঞানের প্রয়োজন, বিভিন্ন গ্রন্থে মুফাসসিরের জন্য ১০ থেকে ৪০টি বিষয়ের জ্ঞান থাকার শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু সব তাফসিরকারক আলেম তাফসিরের শর্তে মুফাসসিরের মানোত্তীর্ণ নন; তাই যাঁরা নিজে মুফাসসির না হলেও অন্য মুফাসসিরদের তাফসির পড়ে মানুষের কাছে তা পেশ করেন, তাঁদের জন্য অন্তত দুটি শর্ত প্রযোজ্য। যথা: ব্যক্তির বিশ্বস্ততা ও সূত্রের গ্রহণযোগ্যতা। অর্থাৎ ব্যক্তিকে দ্বীনদার, পরহেজগার, ন্যায়নিষ্ঠ হতে হবে, বর্ণনায় সততা থাকতে হবে এবং তিনি যেসব তাফসিরগ্রন্থ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন, সেগুলো বিশুদ্ধ ও অবিসংবাদী হতে হবে।
এ ধরনের তাফসির উপস্থাপনকারীদেরও বর্তমানে মুফাসসির নামে আখ্যায়িত করা হয়। এঁরা মুফাসসিরে হাকিকি বা প্রকৃত মুফাসসির নন, বরং তাঁরা মুফাসসিরে মাজাজি বা রূপকার্থে মুফাসসির। ওয়াজে সাধারণত কোরআনের আয়াত, নবীজি (সা.)-এর হাদিস, ফিকহি মাসায়িল ও উপদেশমূলক কাহিনি মূল প্রতিপাদ্য হওয়া উচিত। যে ওয়াজে কোরআনের বয়ান সবচেয়ে বেশি, তারপর হাদিসের বয়ান এবং গল্প-কাহিনি সবচেয়ে কম, সেই ওয়াজ বেশি উপকারী। যে ওয়াজ এর যত বিপরীত, তার উপকারিতাও তত কম। ওয়াজে সাধারণত তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত, ইমান ও আমল, হক্কুল্লাহ তথা আল্লাহর হক ও হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক; হারাম ও হালাল, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদি থাকা উচিত। তবে ওয়াজে বিতর্কিত মাসআলা–মাসায়িল, অপ্রয়োজনীয় অভিনব বিষয়, মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ, ভুল-বোঝাবুঝি ও সংশয় সৃষ্টি হতে পারে—এমন কোনো বিষয় থাকা অনুচিত। দ্বীনি ইলম শিক্ষা ও দাওয়াতি কাজের জন্য সনদ বা সূত্রপরম্পরা থাকা জরুরি। সনদ ছাড়া ইসলামি প্রচারকার্য অনধিকারচর্চার শামিল। সনদ দুই প্রকার—একটি হলো সংক্ষিপ্ত, অন্যটি বিস্তারিত। প্রথমটি নিজের আমলের জন্য যথেষ্ট, দ্বিতীয়টি শিক্ষাদান ও প্রচারের জন্য অপরিহার্য। আজকাল অনেকেই তাফসির মাহফিল করেন, কিন্তু তাতে শুধু ওয়াজই করে থাকেন। ওয়াজ-নসিহত করারও কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। পর্যাপ্ত শিক্ষাগত ইলমি যোগ্যতা, অবয়ব সুরত সুন্নাত মুতাবিক হওয়া, আখলাক সিরাত নবী (সা.)-এর আদর্শে আদর্শিত হওয়া, তাকওয়ার অধিকারী মুত্তাকি হওয়া, ইখলাসওয়ালা মুখলিস হওয়া, তাওয়াক্কুল আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা থাকা, ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু হওয়া, কপটতামুক্ত সরলমনা হওয়া, বিনয়ী হওয়া, সুমিষ্টভাষী হওয়া, ভদ্র ও মার্জিত রুচিসম্মত হওয়া, দূরদর্শী হওয়া, সব বিষয়ে মতামত না দেওয়া বা কোনো বিষয়ে তাৎক্ষণিক মন্তব্য না করা,
নিজের বিদ্যা ও পাণ্ডিত্য জাহির না করা, হিকমতের সঙ্গে কথা বলা, প্রয়োজনমতো কোরআনের আয়াত ও হাদিস উল্লেখ করা, সহিহ কাহিনি বলা, উদ্ধৃতি যেন নির্ভুল হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা, শব্দ–বাক্য ও উচ্চারণ শুদ্ধ হওয়া, তাজবিদসহ বিশুদ্ধ তিলাওয়াত করা, গ্রামারসহ আরবি পাঠ করা, কথায় ও কাজে মিল থাকা, উম্মতের ইসলাহ তথা সংশোধন ও কল্যাণকামিতার মনোভাব থাকা, ইতিবাচক কথা ও আশার বাণী শোনানো এবং নিয়ত সহিহ থাকা। হাদিয়া দেওয়া ও নেওয়া সুন্নত। তবে ওয়াজ করে তার বিনিময় গ্রহণ না করাই উত্তম। এতে এর সুফল বা প্রভাব কমে যায়। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অনুসরণ করো তাদের, যারা তোমাদের নিকট কোনো প্রতিদান চায় না এবং যারা সৎপথপ্রাপ্ত।’ (আল কোরআন, পারা: ২৩, সূরা: ইয়াসিন, আয়াত: ২১)। ধর্মীয় সেবা দিয়ে পারিশ্রমিক নেওয়া বৈধ হলেও তা উত্তম নয়। তাই সামর্থ্যবানদের জন্য তা পরিহার করাই শ্রেয়। এটাই ইখলাস ও তাকওয়ার উচ্চ স্তর। নবী-রসুলগণ দাওয়াতি কাজের শেষে সাধারণত এভাবেই বলতেন, ‘আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোনো প্রতিদান চাই না; আমার পুরস্কার তো জগৎসমূহের প্রতিপালকের নিকটই আছে।’ (আল কোরআন, পারা: ১৯, সূরা: শোআরা, আয়াত: ১০৯, ১২৭, ১৪৫, ১৬৪ ও ১৮০)। যুক্তিসংগত কারণ ও শরয়ি ওজর ছাড়া মাহফিলের তারিখ প্রত্যাহার করা মোটেই উচিত নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং প্রতিশ্রুতি পালন করিয়ো; নিশ্চয় প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (আল কোরআন, পারা: ১৫, সূরা: বনি ইসরাইল/ইসরা, আয়াত-৩৪)। হাদিস শরিফে আছে, ‘যার আমানতদারি নেই, তার ইমান নেই, যার প্রতিশ্রুতি রক্ষা নেই, তার কোনো ধর্মই নেই।’ (তিরমিজি)। আল্লাহ সব ওয়ায়েজিনকে যথার্থভাবে কবুল করুন। মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক: আহছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.