আবদুল হক চৌধুরীর কর্মকৃতি by ড. শিরীণ আখতার
আমাদের ইতিহাস রচনার ধারা সম্পর্কে
রবীন্দ্রনাথ তাঁর “ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রবন্ধে” বলেছেন “ভারতবর্ষের ইতিহাস
নিশীথ কালের দুঃস্বপ্নমাত্র।” ১
কেননা এতে শুধু রাজা-রাজড়ার রক্তাক্ত অধ্যায়ই নয়, রাজায়-প্রজায় যুদ্ধ,
ভ্রাতৃদ্রোহ, রণঝংকার এসবই ধ্বনিত হয়। কিন্তু আবদুল হক চৌধুরী ইতিহাস রচনা
করতে গিয়ে এই রক্ত-রঞ্জিত পথে অগ্রসর না হয়ে মাটি ও মানুষ, স্থান ও তার
জনমানুষের লোকায়িত শিল্প সংস্কৃতির একটি বর্ণনামূলক ধারাকেই সৃষ্টি করেছেন।
অধ্যাপক নীহার রঞ্জন রায়ের “বাঙালির ইতিহাস” গ্রন্থের পরিচয় পত্রে যদুনাথ
সরকার এই গ্রন্থটিকে একটি অমূল্যগ্রন্থ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন
“বহু বৎসর ধরিয়া ইহা আমাদের অবশ্য-পঠিতব্য প্রামাণিক পুস্তক বলিয়া গণ্য
হইবে এবং ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকদের পথ নির্দেশ করিবে। ২
তবে উক্ত গ্রন্থ সম্পর্কে নীহার রঞ্জন রায়ের বিনীত উক্তি হল “আমি কোন নূতন
শিলালিপি বা তাম্রপাট্টের সন্ধান পাই নাই, কোনও নূতন উপাদান আবিষ্কার করি
নাই।..... যে সমস্ত তথ্য ও উপাদান পণ্ডিতমহলে অল্প বিস্তর পরিচিত ও আলোচিত,
প্রায় তাহা হইতেই আমি সমস্ত তথ্য ও উপকরণ আহরণ করিয়াছি।....আমি শুধু,
প্রাচীন বাঙলার ও প্রাচীন বাঙালির ইতিহাস একটি নূতন কার্যকরণ সম্বন্ধগত
যুক্তি পরম্পরায়, একটি নূতন দৃষ্টিভঙ্গির ভিতর দিয়া বাঙালি পাঠকের কাছে
উপস্থিত করিতেছি মাত্র। .... এই যুক্তি ও দৃষ্টি অনুসরণ করিলে প্রাচীন
বাঙালির ইতিহাসের সামগ্রিক সর্বতোভদ্র রূপ দৃষ্টিগোচর হয়....। নূতন নূতন
উপাদান প্রায়শ আবিস্কৃত হইতেছে।....আমি শুধু কাঠামো রচনার প্রয়াস করিয়াছি,
ভবিষ্যৎ বাঙালি ঐতিহাসিকরা ইহাতে রক্তমাংস যোজনা করিবেন এই আশা ও
বিশ্বাসে।”৩ জ্ঞান প্রবীণ ড. রায়ের এই প্রণিধানযোগ্য উক্তি ইতিহাস সাধক
আবদুল হক চৌধুরীকে প্রাচীন ভূখ চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রণয়নে প্রেরণা হিসেবে
কাজ করেছে এবং এভাবেই চট্টল ইতিহাস রচনায় তিনি অগ্রসর হতে চেয়েছেন বলে আমার
ধারণা।
আবদুল হক চৌধুরী কীর্তিমান পুরুষ। পরিণত বয়সে তিনি লেখালেখির অঙ্গনে আবির্র্র্র্ভূত হয়ে চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য শিল্প সংস্কৃতি, লোককৃতি বিষয়ে মূল্যবান গ্রন্থাবলী রচনা করে একদিকে বাঙালির ইতিহাসকে সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত করেছেন অন্যদিকে বিশ্বলোকলোচনে তুলে ধরেছেন বঙ্গভূমির প্রান্তিক ভূ-খণ্ড-চট্টগ্রামের স্বকীয় পরিচয়। এভাবে তিনি দেশ-বিদেশের বিদ্ধজ্জনের কাছে হয়েছেন সমাদৃত।
ইতিহাস রচনায় প্রচলিত ধারাকে এবং গবেষণার প্রথাগত কর্মপদ্ধতি তিনি অনুসরণ করেননি। কিন্তু তাঁর অগ্রজ চট্টল ইতিহাস প্রণেতাদেরও তিনি অস্বীকার করেননি। বলা যায়, আমাদের ইতিহাস রচনার একটি নিজস্ব ধারা প্রবর্তন করেছেন তিনি।
চট্টগ্রাম, সিলেট, ত্রিপুরা ও আরাকান সম্পর্কে ইতিহাস রচনাকালেও তিনি শুধুমাত্র রাজা-রাজড়ার শৌর্যবীর্য, জয় পরাজয় ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য না রেখে সাধারণ মানুষের বা জনগণের জীবন চর্চার প্রতিও সমদৃষ্টি সমুন্নত রেখেছেন। তাই তাঁর ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্বন্ধীয় গ্রন্থগুলো হয়েছে মানুষের ইতিহাস।
তাঁর প্রথম গ্রন্থ “চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ” (১৯৭৩) যখন প্রকাশিত হয় তাঁর বয়স তখন ৫৪ বছর। এর কয়েক বছর পূর্বে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধগুলো প্রকাশিত হতে থাকে (যেমন দৈনিক আজাদী)। পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি এদেশের পণ্ডিতবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, মনীষী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের সঙ্গে এই সূত্রেই পরিচয় ঘটে।
তাঁর তৃতীয় গ্রন্থ “চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি” প্রকাশের পর তাঁর খ্যাতি উভয়বঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা সাহিত্যের কীর্তিমান কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ দেশ পত্রিকায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে এই গ্রন্থের একটি বিস্তৃতি সমালোচনা লেখেন। শুধু ঐতিহাসিক হিসেবেই নয়, একজন অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন সমাজতাত্ত্বিক হিসেবেও উভয় বাংলার আনাচে কানাচে তিনি খ্যাতিমান হন।
তাঁর রচনাবলী সম্পর্কে উন্নত ধারণা পোষণ করে মন্তব্য করেছেন অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র সিংহ, ড. আহমদ শরীফ, ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায়, ড. আনিসুজ্জামান, ড. এ.কে. এম নাজমুল করিম, ড. সুবোধ রঞ্জন রায়, দেবী প্রসাদ বন্দোপাধ্যায়, মনসুর মুসা, অনুপম সেনের মত সামাজিক সৃষ্টিশীল লেখক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সমাজ বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতবর্গ।
আবদুল হক চৌধুরী তাঁর কর্মকৃতীকে নিজেই বর্ণনাত্মক পরিচিতিমূলক গ্রন্থ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নিজের পুস্তক “চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি” সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “নতুন কিছুই নয়, আবহমানকালের চট্টগ্রামের লোক সমাজের কথা ও তাদের আচার আচরণের বিবরণ যা কোনদিন লিখিত হয়নি। ...তা যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করেছি।” ৪ আবদুল হক চৌধুরী সত্যনিষ্ঠভাবে কাল ও সমাজের দাবি মিটিয়েছেন। প্রতিবর্গ তাঁর এই সরল উচ্চারণকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন।
আবদুল হক চৌধুরী কীর্তিমান পুরুষ। পরিণত বয়সে তিনি লেখালেখির অঙ্গনে আবির্র্র্র্ভূত হয়ে চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য শিল্প সংস্কৃতি, লোককৃতি বিষয়ে মূল্যবান গ্রন্থাবলী রচনা করে একদিকে বাঙালির ইতিহাসকে সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত করেছেন অন্যদিকে বিশ্বলোকলোচনে তুলে ধরেছেন বঙ্গভূমির প্রান্তিক ভূ-খণ্ড-চট্টগ্রামের স্বকীয় পরিচয়। এভাবে তিনি দেশ-বিদেশের বিদ্ধজ্জনের কাছে হয়েছেন সমাদৃত।
ইতিহাস রচনায় প্রচলিত ধারাকে এবং গবেষণার প্রথাগত কর্মপদ্ধতি তিনি অনুসরণ করেননি। কিন্তু তাঁর অগ্রজ চট্টল ইতিহাস প্রণেতাদেরও তিনি অস্বীকার করেননি। বলা যায়, আমাদের ইতিহাস রচনার একটি নিজস্ব ধারা প্রবর্তন করেছেন তিনি।
চট্টগ্রাম, সিলেট, ত্রিপুরা ও আরাকান সম্পর্কে ইতিহাস রচনাকালেও তিনি শুধুমাত্র রাজা-রাজড়ার শৌর্যবীর্য, জয় পরাজয় ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য না রেখে সাধারণ মানুষের বা জনগণের জীবন চর্চার প্রতিও সমদৃষ্টি সমুন্নত রেখেছেন। তাই তাঁর ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্বন্ধীয় গ্রন্থগুলো হয়েছে মানুষের ইতিহাস।
তাঁর প্রথম গ্রন্থ “চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ” (১৯৭৩) যখন প্রকাশিত হয় তাঁর বয়স তখন ৫৪ বছর। এর কয়েক বছর পূর্বে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধগুলো প্রকাশিত হতে থাকে (যেমন দৈনিক আজাদী)। পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি এদেশের পণ্ডিতবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, মনীষী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের সঙ্গে এই সূত্রেই পরিচয় ঘটে।
তাঁর তৃতীয় গ্রন্থ “চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি” প্রকাশের পর তাঁর খ্যাতি উভয়বঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা সাহিত্যের কীর্তিমান কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ দেশ পত্রিকায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে এই গ্রন্থের একটি বিস্তৃতি সমালোচনা লেখেন। শুধু ঐতিহাসিক হিসেবেই নয়, একজন অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন সমাজতাত্ত্বিক হিসেবেও উভয় বাংলার আনাচে কানাচে তিনি খ্যাতিমান হন।
তাঁর রচনাবলী সম্পর্কে উন্নত ধারণা পোষণ করে মন্তব্য করেছেন অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র সিংহ, ড. আহমদ শরীফ, ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায়, ড. আনিসুজ্জামান, ড. এ.কে. এম নাজমুল করিম, ড. সুবোধ রঞ্জন রায়, দেবী প্রসাদ বন্দোপাধ্যায়, মনসুর মুসা, অনুপম সেনের মত সামাজিক সৃষ্টিশীল লেখক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সমাজ বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতবর্গ।
আবদুল হক চৌধুরী তাঁর কর্মকৃতীকে নিজেই বর্ণনাত্মক পরিচিতিমূলক গ্রন্থ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নিজের পুস্তক “চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি” সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “নতুন কিছুই নয়, আবহমানকালের চট্টগ্রামের লোক সমাজের কথা ও তাদের আচার আচরণের বিবরণ যা কোনদিন লিখিত হয়নি। ...তা যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করেছি।” ৪ আবদুল হক চৌধুরী সত্যনিষ্ঠভাবে কাল ও সমাজের দাবি মিটিয়েছেন। প্রতিবর্গ তাঁর এই সরল উচ্চারণকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
১৯২২ সালে রাউজান থানার নোয়াজিশপুর গ্রামের মধ্যযুগের “চন্দ্রাবতী” কাব্যখ্যাত কোরেশী মাগনের বংশে আবদুল হক চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবন সংগ্রামমুখর নানা ঘাত-প্রতিঘাতে পরিপূর্ণ। রাউজানের “নতুন হাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে” তার শিক্ষাজীবনের শুরু। এরপর রাউজানের মধ্যসর্তা মধ্য ইংরেজী স্কুল এবং “আর আর আবদুল বারী চৌধুরী ইনস্টিটিউশনে” অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৩৪ সালে যখন তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে। পিতার রেখে যাওয়া বিপুল ভূ-সম্পত্তি আত্মীয় পরিজনের চক্রান্তে হাতছাড়া হওয়ার মুখে তিনি পড়াশোনা ত্যাগ করে একমাত্র পুত্র হিসেবে সংসারের হাল ধরেন।
১৯৪২ সালে তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত নোয়াজিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাসিক পনের টাকা বেতনে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। ১৯৪২ সালেই চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ড. এনামুল হকের বংশের মেয়ে জুবাইদা বানুর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। এ সময়ই তিনি আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের সঙ্গে পরিচিত হন।
১৯৪৮ সাল পর্যন্ত উক্ত স্কুলে শিক্ষকতা করার পর তাঁকে অন্যত্র বদলী করা হলে স্বাস্থ্যের অজুহাত দেখিয়ে তিনি স্বেচ্ছা-অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি বেশ কয়েকবার ব্যবসা করার চেষ্টা করেন কিন্তু এতে তিনি সাফল্য লাভে ব্যর্থ হন।
তাঁর একটি ভ্রমণেচ্ছু হৃদয় স্কুল জীবন থেকেই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করত। তিনি যখন ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র তখনই তিনি পিতার সঙ্গে তার কর্মস্থল রেঙ্গুনে বেড়াতে যান। এরপর যখন তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন তিনি তার সহপাঠীদের নিয়ে কলকাতায় যান। পরিণত বয়সে পুত্রের কর্মস্থল সিলেটে গিয়েও সেখানকার ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার সম্পর্কে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও তিনি দেশের নানা স্থান ঘুরে বেড়িয়েছেন। চট্টগ্রামকে যথার্থ অর্থে চেনার জন্য তিনি এ ভূখণ্ডে বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে পরিভ্রমণ করেছেন এবং প্রাচীন নিদর্শনসমূহের অনুসন্ধান করেছেন এবং গণমানুষের ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা কিংবদন্তি পূর্বকথা ও কাহিনী সংগ্রহ করেছেন। জানা যায়, লেখক জীবনে প্রবেশের পূর্বে তিনি প্রায় ত্রিশ বছর যাবৎ এই সংগ্রহ ও অনুসন্ধান কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। পরিণত বয়সে এসে তিনি ইতিহাস রচনায় ব্রতী হন। তার এই ভ্রমণেচ্ছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পঠন পাঠন এবং গবেষণার আগ্রহের ফলে তিনি উল্লেখযোগ্য পুস্তকসমূহ রচনা করে বাঙালি জাতিকে চিরঋণে আবদ্ধ করেছেন।
কর্মকৃতী
প্রায় বারটির মত পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ এবং অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেন আবদুল হক চৌধুরী। তাঁর গ্রন্থগুলো হলঃ
১। চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ প্রথম খণ্ড -প্রথম প্রকাশ ১৯৭৬ ইং
২। চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ দ্বিতীয় খণ্ড-প্রথম প্রকাশ ১৯৭৯ ইং
৩। চট্টগ্রামের চরিতাভিধান-১৯৭৯ ইং
৪। চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি-ডিসেম্বর ১৯৮০ ইং
৫। সিলেটের ইতিহাস প্রসঙ্গ-১ম স: ১৯৮১, ২য় স: ১৯৯০ ইং
৬। শহর চট্টগ্রামের ইতিকথা-১৯৮৬ ইং
৭। চট্টগ্রাম সমাজ সংস্কৃতির রূপরেখা-১৯৮৮ ইং।
৮। চট্টগ্রাম আরাকান-১৯৮৯ ইং
৯। চট্টগ্রামের ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধ-১৯৯২ ইং
১০। প্রাচীন আরাকান, রোহিঙ্গা, হিন্দু ও বড়ুয়া বৌদ্ধ অধিবাসী-১৯৯৪ ইং
১১। বন্দর শহর চট্টগ্রাম-১৯৯৪ ইং
১২। প্রবন্ধ বিচিত্রা : ইতিহাস ও সাহিত্য-১৯৯৫ ইং
এছাড়াও তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রচুর প্রবন্ধাদি লিখেন- বিভিন্ন বক্তৃতামালায়ও অংশ নেন। যদিও তিনি তাঁর রচনাকে বর্ণনামূলক রচনা বলেছেন তারপরও তাঁর রচনাসমূহ বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্বে বিভিন্ন উপমা উদাহরণে পরিপূর্ণ। তাঁর এই বিশাল ব্যাপক কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে আলোচনা এই সংক্ষিপ্ত সময়ে সমাপ্ত করা অসম্ভব ব্যাপার। তাই তাঁর মাত্র কয়েকটি গ্রন্থ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি।
চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ
আবদুল হক চৌধুরীর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ “চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ” ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত। এই গ্রন্থটি দুই খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে লেখক মধ্যযুগের রাজপুরুষ এবং কবিদের জীবন ও কর্মের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। এ খণ্ডের “ঈশা খার চট্টগ্রামে অজ্ঞাতবাসা প্রবন্ধে তিনি প্রাচীন মতবাদের ক্ষেত্রে নতুন তথ্য সংযোজন করেছেন। তাঁর নিজস্ব গবেষণা ও কর্মপদ্ধতি প্রয়োগ করে এ সম্পর্কে তিনি পূর্বতন পণ্ডিতদের মতবাদের উপর তাঁর নিজস্ব মতামতকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পেয়েছেন। এভাবেই তিনি নশরত শাহ এবং রাস্তি খাঁ সম্পর্কেও আলোকপাত করেন। এ গ্রন্থে তিনি মধ্যযুগের কবি কোরেশী মাগন, মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ মুকিম ও আজগর আলী পন্ডিত সম্পর্কেও উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া এ খন্ড চট্টগ্রামের প্রত্নতাত্ত্বিক বিবরণকে সমৃদ্ধ করে আরো তিনটি প্রবন্ধ লিখেন। সেগুলো হলো-উত্তরপূর্ব রাজপাটসমূহ, চট্টগ্রামের প্রাচীন স্মারক নিদর্শন ও ঐতিহাসিক তথ্য। এ গ্রন্থে লেখক চট্টগ্রাম তথা বাংলার হারানো ইতিহাসকেও সতর্কভাবে পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছেন।
এ গ্রন্থে কবি মোহাম্মদ আলী ও আজগর আলী পন্ডিত সম্পর্কেও প্রবন্ধ লিখেছেন এবং কবি মোহাম্মদ আলী সম্পর্কে নতুন তথ্যের উল্লেখ করেন। এ ছাড়া “রেঙ্গুনের সাপ্তাহিক বাংলা গেজেটিয়ার পত্রিকা” ও তার প্রকাশ এবং ভূমিকা ও অবলুপ্তি বিষয়েও বিশদ বর্ণনা করেছেন।
কবি আহমদ আলী মিঞার “বড় তুফানের কবিতা’টি ও অন্তর্ভুক্ত করেন।
“চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ-২য় খণ্ডে” চট্টগ্রামের অতীত সমাজ ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তথ্য সমৃদ্ধ আলোচনা করেছেন। চট্টগ্রামের বহু হারিয়ে যাওয়া খেলাধুলা, খাবার-দাবার, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিষয়েও আলোকপাত করেন।
চট্টগ্রামের ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধ
বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত আবদুল হক চৌধুরীর দশটি প্রবন্ধ সংকলন করে এই গ্রন্থটি ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থের বিষয়গুলো বিবেচনা করে প্রবন্ধগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় ১। স্থান ও নামের আলোচনা ২। তিনজন কবির সময়কাল বিচার এবং ৩। ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধ।
এ গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধে তিনি চট্টগ্রামের নামকরণের আদি উৎসের সন্ধান করেছেন। তিনি চইট্রেগ্রাম, সামন্দর, চৈত্যগ্রাম, চতু:গ্রাম, শ্যাৎগঙ্গ, চিৎ তৌৎগোৎ চাটিগ্রাম ইত্যাদি থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ এবং আধুনিকযুগে নানা পরিবর্তন সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তিনি চেরাগী পাহাড় নামের নতুন উৎস সম্পর্কেও তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন।
এই গ্রন্থের দ্বিতীয় প্রবন্ধে কবি শ্রীমতি রহিমন্নিসার সময়কাল বিচার আবদুল হক চৌধুরীর অন্যতম নিজস্ব আবিষ্কার হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তাঁর পূর্বে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. বদিউজ্জামান এবং আরো বহু গুণীজন রহিমন্নিসাকে মধ্যযুগের একমাত্র মুসলমান কবি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আবদুল হক চৌধুরী তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে অনুসন্ধান চালিয়ে ( সরেজমিনে অনুসন্ধান, বংশধরদের সাক্ষ্যগ্রহণ) আবিস্কার করেন যে কবি রহিমন্নিসার জন্মকাল ১৮৪৬ সালে এবং মৃত্যু ১৯১৫ সাল। অর্থাৎ তিনি মধ্যযুগের কবি নন, আধুনিক কালের কবি। এ আবিষ্কার তাঁর একটি মৌলিক কাজ। কেননা তিনি প্রমাণ করেছেন শুধুমাত্র ভাষা শৈলী দিয়ে বিচার করে তাকে মধ্যযুগের কবি হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে না বরং তার জন্ম ও মৃত্যু সন দিয়েই তাঁকে আধুনিক যুগের কবি প্রতিপন্ন করা যায়।
চট্টগ্রামের ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধে কবি শেখ মোহাম্মদ বাকর আলী ও “গুলেবকাউলী”র কবি মোহাম্মদ মুকিমের সময়কাল ও পরিচিতি নিয়েও আবদুল হক চৌধুরী প্রবন্ধ লিখেছেন এ গ্রন্থে।
চট্টগ্রামের চরিতাভিধান
এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা চরিতাভিধান কেউ রচনা করেননি। আবদুল হক চৌধুরীই এ কাজটি শুরু করেন। সুতরাং তাঁকে চট্টগ্রামের চরিতাভিধান রচনার প্রবক্তা হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে। অত্যন্ত দুরূহ এ কাজটি সম্পন্ন করার জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গায় ধর্ণা দিয়েছেন, এমনকি আজাদী পত্রিকায় ও আবেদন করেন। শেষ পর্যন্ত বিফল মনোরথ নিয়ে তিনি তাঁর পারিবারিক গ্রন্থাগারে রক্ষিত বিভিন্ন গ্রন্থাবলী, পত্রপত্রিকা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগৃহীত তথ্যের সহায়তায় চরিতাভিধানটি সংকলন করেন। এই রচিতাভিধানটি চট্টগ্রাম জেলার পাঁচশতাধিক কবি, সাহিত্যিক ও গবেষকদের পরিচিতমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। চট্টগ্রাম যুগে যুগে অনেক মনীষীর জন্ম দিয়েছে কিন্তু তাদের কোন পরিচিতিমূলক গ্রন্থ এদেশে ছিল না। এ কারণেই আবদুল হক চৌধুরী এ অভাব পূরণের উদ্দেশ্যে এ গ্রন্থ রচনায় ব্রতী হন। তথ্যাভাবে অনেকের নাম হয়তো বাদ পড়ে গেছে তার পরেও তাঁর এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। “চট্টগ্রামের চরিতাভিধান গ্রন্থের জন্য তাঁকে কেউ কেউ ব্রজেন্দ্রনাথের সার্থক উত্তরসূরি রূপে অভিহিত করেছেন।”৫ কিন্তু তসিকুল ইসলাম সাহেব এই মাত্র পুরোপুরি সমর্থন করেননি। তিনি জানান-একই পথের পথিক হলেও আবদুল হক চৌধুরী ভিন্নার্থে ব্যতিক্রম। তিনি কোন প্রতিষ্ঠানের সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই ব্যক্তিগতভাবে যে মহতী উদ্যোগ নিয়েছেন তার তুলনা বিরল।
চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি এবং চট্টগ্রামের সমাজ সংস্কৃতির রূপরেখা
আবদুল হক চৌধুরী প্রথম “চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ’র দ্বিতীয় খণ্ডে চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রবন্ধগুলো পুনরুক্তি বা খণ্ডিত আলোচনা হিসেবে সমালোচিত হওয়ায় তিনি ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত নানান তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে ১৯৮০ সালে “চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি” গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল উপরোক্ত দ্বিরুক্তি খণ্ড। এই গ্রন্থটি প্রায় সাড়ে চারশ পৃষ্ঠা সম্বলিত। এতে তিনি চট্টগ্রামের হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলমান আপামর জনগোষ্ঠীর লৌকিক আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিশদ বিবরণী প্রকাশ করেন।
এ গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর হাতে আরো যে তথ্য সামগ্রী অবশিষ্ট থাকে সেই তথ্য উপাদান সমম্বিত করে আরও পূর্ণাঙ্গ ও বৃহৎ কলেবরে অন্য একটি গ্রন্থ বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত করেন। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত এ গ্রন্থের নাম “চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা।”
এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর দেশে-বিদেশে তিনি সমাদৃত হন। এই গ্রন্থ সম্পর্কে পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ কলকাতার দেশ পত্রিকায় লিখেছেন:-
“এটি একটি শ্রেণিবদ্ধ সাংস্কৃতিক মহাফেজখানা। চৌদ্দটি পরিচ্ছেদে চট্টগ্রামের মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাবৎ আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস, আদর্শ, জীবনযাপন পদ্ধতি এবং লৌকিক-অলৌকিক যা কিছু বেঁচে থাকার জন্য জরুরি-সবই সাজিয়ে দিয়েছেন। সংস্কৃতির অর্থ যে কত ব্যাপক এভাবেই তার সম্যক উপলদ্ধি হতে পারে। মানুষ যে মূলত: সাংস্কৃতিকভাবেই বাঁচে এবং তার অস্তিত্বগত অনন্যতা একান্তভাবে সাংস্কৃতিক এ কথা সত্যিকারভাবে বোঝাবার জন্য এ ধরণের বই অর্থাৎ এমন একটা সাংস্কৃতিক এনসাইক্লোপিডিয়া জরুরি।
এ গ্রন্থটি সম্পর্কে মরহুম মুস্তফা সিরাজের অভিমত নিয়ে দ্বিরুক্তির কোন উপায় নেই। আবদুল হক চৌধুরী তার গবেষণায় সমাজতত্ত্বের নতুন মডেল নির্মাণ করেছেন। লেখক নিজেই সবিনয়ে বলেছেন তাঁর গ্রন্থ পরিচিতি ও বর্ণনামূলক গ্রন্থ। কাজেই তার গ্রন্থ সম্পর্কে সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের মতই উদার নিরপেক্ষ ও গঠনমূলক মন্তব্য অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। এই গ্রন্থটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত।
সিলেটের ইতিহাস প্রসঙ্গ
ঐতিহাসিকগণ তাঁর নিজ ভূমির পার্শ্ববর্তী স্থানসমূহের প্রতি সতত: অপরিসীম কৌতূহল অনুভব করেন। একজন সচেতন গবেষক তার নিজস্ব বাসভূমের চতুষ্পার্শ্বের মানুষ, মাটি ও সংস্কৃতির প্রতি স্বত:প্রবৃত হয়েই অনুসন্ধানে ব্রতী হন। আবদুল হক চৌধুরী চট্টগ্রামের সন্তান হয়েও চট্টগ্রামের সঙ্গেই রাজনৈতিক ও সামাজিকতার সম্পর্কিত পার্বত্য চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা সিলেট এবং আরকান ভূমির প্রতি অনুসন্ধিৎসু হয়েছিলেন। এ এলাকাগুলো সম্পর্কিত নানান ধরনের গবেষণা চালিয়েছেন। এই আগ্রহ থেকেই তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন গ্রন্থ।
সিলেটের ইতিহাস প্রসঙ্গ ও তেমনি সিলেটের লোকজীবন, প্রাচীন কালের নানান বিষয় নিয়ে রচিত একটি গ্রন্থ।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, তিনি ১৯৫৫ সালে প্রথমে সিলেট গিয়ে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হন। দেড়যুগ পরে চাকুরিরত ছেলের কাছে বেশ কয়েকবার তিনি সিলেট যান। এ সময় তিনি সিলেটের গ্রামে-গঞ্জে পরিভ্রমণকালে সেখানকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির যে বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন এবং সে সম্পর্কে যে ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহ করেছেন তার ভিত্তিতেই “সিলেটের ইতিহাস প্রসঙ্গ” গ্রন্থটির বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তবে গ্রন্থটি সিলেটের ইতিহাস গ্রন্থ নয়। সিলেটের কয়েকটি বিষয় যা তাকে বিস্মিত করেছিল সে ধরণের বিষয় নিয়ে এ গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন-সিলেটের লাউড়ের সুফী সাধক শাহ আরেফিন।
শহর চট্টগ্রাম পীর আউলিয়া ও দরবেশে পরিপূর্ণ। এখানে বারতাকিয়ার মসজিদ, কদম মোবারক, আমানত শাহ, বদর শাহ, বায়েজিদ বোস্তামি ইত্যাদি আউলিয়ার কিংবদন্তী প্রচলিত। বিশেষত আমানত শাহ ও বদর শাহ সম্পর্কে পক্ষ-বিপক্ষ অবলম্বনেরও জনশ্রুতি রয়েছে। তাই আবদুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম থেকে সিলেটে গিয়ে সুফী সাধক শাহ আরেফিনের সম্পর্কে বিভিন্ন অনুসন্ধান করেছেন। সিলেটের প্রচলিত মত ছিল শাহ আরেফিন সাপের লৌকিক পীর বা দেবতা। কিন্তু যুক্তি দিয়ে তিনি এই মত খণ্ড করেন। এই গ্রন্থের অন্য আরেকটি প্রবন্ধ সুজা নগরের “আগর-আতর শিল্প”।
খ্রীষ্টিয় নবম থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরব পরিব্রাজকদের ভ্রমণ কাহিনীতে চট্টগ্রাম, আরাকান ও সিলেটের “আগর শিল্প” সম্পর্কে জানা যায়। আবদুল হক চৌধুরী অত্যন্ত সরল ও সহজ অথচ মনোজ্ঞভাবে এই শিল্পের বিবরণ দিয়েছেন। এ ছাড়া হাওড় বেষ্টিত সিলেটের জনসাধারণের প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে ফসল ফলানো, হিন্দু সমাজে পীরের প্রভাব, মুসলমান হলেও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হিন্দু প্রভাব এইসব উপাদান নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ঐতিহাসিক ও সমাজতত্ত্বের গবেষকদের জন্য এই উপাদান খুবই প্রয়োজনীয়।
বন্দর শহর চট্টগ্রাম
১৯৯৪ খ্রি: প্রকাশিত তাঁর দশম গ্রন্থ বন্দর শহর চট্টগ্রাম। আবদুল হক চৌধুরী চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, সমাজতত্ত্ব ও নৃবিজ্ঞান পুঁথি ও পুরাতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে আকর গ্রন্থ রচনা ছাড়াও বহু প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
দেশে বিদেশে পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত এই সব প্রবন্ধ থেকে ইতিহাস ও সাহিত্যিবিষয়ক ৩৬টি প্রবন্ধ নিয়ে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে। এই গ্রন্থে চট্টগ্রাম নামের উৎস, প্রাগৈতিহাসিক যুগের চট্টগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ঐতিহাসিক যুগে চট্টগ্রাম জেলা ও বার্মা দেশের আরাকান রাজ্যের সম্পর্ক ইত্যাদি প্রবন্ধসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। মোঘল ও নবাবি আমলে চট্টগ্রামের শাসনকর্তাদের পরিচিতি রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের আদিযুগ, গঙ্গাবাজার বা প্রাচীন চট্টগ্রাম বন্দর চট্টগ্রাম ও তার অবস্থান, বন্দর শহর চট্টগ্রামের প্রাচীন বন্দর শহর চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মাণ শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। এটি পাঠ করে আমরা জানতে পারি অতীতে চট্টগ্রামে এ শিল্পটি কতখানি প্রসিদ্ধ ছিল। এমন কি চট্টগ্রাম থেকে জাহাজ বিদেশে রফতানি হতো এবং সরের জাহাজ নির্মাণ কৌশলে চট্টগ্রামের নাবিক, খালাসি ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা কিভাবে তাদের অর্থ ও শ্রম ব্যয় করত সে সম্পর্কেও আমরা জ্ঞাত হই। অতীতের এই শিল্পটি বর্তমানকালে আবার ফিরে এসেছে এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশ আবার সক্রিয় হচ্ছে এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। এছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানের প্রাচীন নামগুলো আমাদের যথেষ্ট কৌতূহলের উদ্রেক করে। যেমন জয়নামা পাহাড় বা জাহানুমা পাহাড়, বাঘভেলুবা, টাইগার পাস, ভাঙ্গঘুটনা, ফিরিঙ্গিবাজার, গঙ্গাবাড়ি, আস্করখাঁর দীঘি, গুডসাহেবের পাহাড়, রুমঘাটা, দেওয়ান বাজার ইত্যাদি।
এছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে জালালাবাদ পাহাড় সম্পর্কেও আলোচনা রয়েছে এ গ্রন্থে। বন্দর শহর চট্টগ্রামের বিভিন্ন দীঘি, পরবর্তীকালে লুপ্ত প্রায় বাকলিয়া নদী, শিকল বাহা, ফৌজদারহাট ইত্যাদি ও লেখক তাঁর এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেন।
তাঁর সপ্তম গ্রন্থ চট্টগ্রাম আরাকান
দীর্ঘদিন আবদুল হক চৌধুরী তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রকে চট্টগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ১৯৮৯ সালে আরাকানের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেন। মধ্যযুগের ইতিহাস পাঠে আমরা জানতে পারি আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের লালন পালন ঘটেছে। এ গ্রন্থটি সম্পর্কে তসিকুল ইসলাম তাঁর সুদীর্ঘ প্রবন্ধে জানান, “এই গ্রন্থে ১২টি পরিচ্ছেদে চট্টগ্রাম ও আরাকানের রাজনৈতিক ইতিহাস, মুসলমানদের বিজয়, আরাকানীদের পতন ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে আরাকানী শাসন আরাকান রাজসভায় মুসলমান সভাসদ ও পদস্থ কর্মচারী এবং এক নজরে আরাকানের পরবর্তী ইতিহাস যেন গল্পের ঢংএ বিবৃত করেছেন। যা পাঠ করে জ্ঞান লাভের সঙ্গে সঙ্গে আনন্দময় প্রশান্তি ও পাঠক লাভ করতে পারেন। ৮
এছাড়া এ গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হলো “বাংলার করদ রাজ্য রূপে আরাকান: সময়কাল চার বছর মাত্র। উত্তর চট্টগ্রামে আরাকানী আমলে নির্মিত কাঠের দুর্গ কাঠগড়, রাউজান নামের নতুন উৎস, বৃহত্তর চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলাসমূহে মগ বা মারমা উপজাতি এবং চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কেও আলোচনা করেন।
বাংলার করদ রাজ্য হিসেবে আরাকান মাত্র চার বছর প্রবন্ধটিতে নানান যুক্তিতর্কের উপস্থাপন করেছেন তিনি। কেউ কেউ আরাকানকে বাংলার করদ রাজ্য হিসেবে এগার বছর, কেউ কেউ একশত বছর বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু আবদুল হক চৌধুরী যুক্তি দিয়ে সেই সব মতবাদ খন্ড করে রাজা নরমিখলার রাজত্বকাল ১৪৩০-১৮৩৩ খ্রী: পর্যন্ত সময়কালকেই অর্থাৎ চার বছর আরাকান বাংলার করদ রাজ্য ছিল এই মত প্রতিষ্ঠিত করেন। এ মতের পক্ষে যুক্তিও রয়েছে। কেননা নরমিখলা বাংলার সুলতানের সহায়তায় আরাকান পুনরুদ্ধার করার পর বাংলার সুলতানের কাছে কর প্রদানে অঙ্গীকার করেন। তার রাজত্ব কালের এই চার বছর বাংলার করদ রাজ্যে পরিণত হয়।
এছাড়া আবদুল হক চৌধুরী আরাকানে বাংলার সার্বভৌমত্বের অবসান ও স্বাধীন আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্পর্কেও এ প্রবন্ধে আলোচনা করেন।
উত্তর চট্টগ্রামে আরাকানী দুর্গ কাঠগড় সম্পর্কেও স্বতন্ত্র প্রবন্ধ এ গ্রন্থে রচনা করেন। তিনি প্রায় ৭টি কাঠগড়ের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন।
এছাড়া মগ এবং মারমাদের এদেশে আগমন, বসতি স্থাপন সম্পর্কেও প্রবন্ধ লেখেন। প্রাচীনকাল থেকে এদেশে বৌদ্ধরা অবস্থান করছিল। তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়েও প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এ গ্রন্থে।
প্রাচীন আরাকান রোহিঙ্গা হিন্দু ও বড়ুয়া বৌদ্ধ অধিবাসী উক্ত গ্রন্থটি চট্টগ্রাম আরাকান গ্রন্থের বর্ধিত সংস্করণ রূপে বিবেচিত হচ্ছে। পূর্বোক্ত গ্রন্থে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করে রোহিঙ্গা সমস্যার উপরও আলোকপাত করা হয়েছে। আবার কিছু অধ্যায় নতুনভাবে সংযোজন করা হয়েছে।
বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের এক বিরাট সমস্যা। প্রায় তিন লক্ষের উপর বর্তমান মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গারা টেকনাফ, কক্সবাজার, পালংখালী, পার্বত্য চট্টগ্রাম শরণার্থী হিসেবে বাস করছে। নানা রকম সমস্যারও সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ অনেক পূর্বে আবদুল হক চৌধুরী দেখিয়েছেন রোহিঙ্গারা প্রাচীন আরাকানেরই অধিবাসী। বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত একটি বিষয়। এ দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা একদিন স্বদেশে ফিরে যাবে এ কথা অবান্তর হলেও এটাই সকলের কাম্য হওয়া উচিত।
প্রকৃতপক্ষে আবদুল হক চৌধুরীর কর্মকৃতির মৌলিকত্ব আমাদের বিস্ময় উৎপাদন করে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত না হয়েও তিনি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে যে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও জ্ঞান চর্চার পরিচয় দিয়েছেন তা তাঁর প্রখর ইতিহাস চেতনার ফলেই সম্ভব হয়েছে। ইতিহাস চেতনা তখনই প্রখর হয় যখন দেশপ্রেম হৃদয়টা পূর্ণ থাকে। দেশপ্রেম মানেই তো মাটি ও মানুষের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা। আজ তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে গিয়ে আমার অন্তর নিঃসরিত শ্রদ্ধা তাঁর স্মৃতির প্রতি নিবেদন করে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি।
আমার এ রচনাটি গবেষণামূলক নয়। কেবলমাত্র আবদুল হক চৌধুরীর শ্রমলব্ধ সৃজন কর্মের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরাই আমার উদ্দেশ্য। ভবিষ্যতে কোন পাঠক এ মহান গবেষকের কর্মকৃতি সম্পর্কে গবেষণায় সচেষ্ট হলেই এ নিবন্ধটি সার্থক হবে।
তথ্যসূত্র:
১। ভারতবর্ষের ইতিহাস-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র রচনাবলী-চতুর্থ খণ্ড -, বিশ্বভারতী প্রকাশনা-পৃষ্ঠা ৩৭৭
২। বাঙালির ইতিহাস-আদিপর্ব- নীহার রঞ্জন রায়, দেশ পাবলিকেশন, যদুনাথ সরকার-পৃষ্ঠা: ১০, ১১, ১২
৩। বাঙালির ইতিহাস-আদিপর্ব-নীহার রঞ্জন রায়, দেশ পাবলিকেশন, যদুনাথ সরকার-পৃষ্ঠা- ১৪, ১৫
৪। চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি, আবদুল হক চৌধুরী, বাকলিয়া চট্টগ্রাম-ভূমিকা।
৫। আবদুল হক চৌধুরীর স্থানীয় ইতিহাস গবেষণা পদ্ধতি-মো. মুহিবউল্ল্যাহ সিদ্দিকী, আবদুল হক চৌধুরী স্মারক গ্রন্থ, বাংলা একাডেমি ১৯৯৬, পৃষ্ঠা-১২৯।
৬। আবদুল হক চৌধুরী: জীবন ও সাধনা-তসিকুল ইসলাম, আবদুল হক চৌধুরী স্মারক গ্রন্থ, প্রবন্ধ পৃষ্ঠা-৫৮-৫৯
৭। চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে-সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, গবেষক আবদুল হক চৌধুরী কর্মকৃতি মূল্যায়ন, অমিত চৌধুরী সম্পাদিত, ১৯৯৫ চট্টগ্রাম, পৃষ্ঠা-২৫।
৮। তসিফুল ইসলাম “আবদুর হক চৌধুরী: জীবন ও সাধনা”, আবদুল হক চৌধুরী স্মারক গ্রন্থ, প্রবন্ধ পৃষ্ঠা:-৬৬।
সহায়ক গ্রন্থ
১। রবীন্দ্র রচনাবলী-বিশ্বভারতী প্রকাশনা, দ্বাদশ খণ্ড-।
২। বাঙালির ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়, আদি।
৩। আবদুল হক চৌধুরী স্মারক গ্রন্থ, মুহাম্মদ মজিবউদ্দীন মিয়া ও তসিকুল ইসলাম সম্পাদিত।
৪। গবেষক আবদুল হক চৌধুরী কর্মকৃতি মূল্যায়ন-অমিত চৌধুরী।
৫। আবদুল হক চৌধুরীর রচনাবলী, প্র. প্র. ২০১১ বাংলা একাডেমি।
৬। চট্টগ্রামের সমাজ সংস্কৃতি-আবদুল হক চৌধুরী।
২৫ এ অক্টোবর ২০১৩
No comments