হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ফ্যাসিবাদী হামলারই এক নগ্ন রূপ by বদরুদ্দীন উমর
অন্য
যে কোনো ব্যবস্থার মতো কোনো দেশে যখন ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তা শুধু
বিভিন্ন রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমেই কাজ করে না। সমগ্র সমাজের ওপর তা এক
ধরনের প্রভাব বিস্তার করে, যাতে রাষ্ট্রযন্ত্রবহির্ভূত নানা ধরনের
অপরাধীকরণকৃত (criminalised) গ্র“প ও লোকজন রাষ্ট্রের সহায়তায় এবং
রাষ্ট্রের নাকের ডগায় ফ্যাসিবাদী কাণ্ডকারখানা চালিয়ে যায়। বাংলাদেশে এখন
ঠিক এই পরিস্থিতিই বিরাজ করছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা তো বটেই, এ ছাড়া
রাষ্ট্রবহির্ভূত নানা শক্তির দ্বারা বাংলাদেশে এখন এমন কোনো ক্রাইম নেই, যা
ব্যাপকভাবে করা হচ্ছে না। দেশের সমগ্র জনগণই আজ এই ফ্যাসিবাদের দ্বারা
আক্রান্ত। এই ফ্যাসিবাদ কতভাবে যে জনগণের স্বাভাবিক ও সাধারণ জীবনকে
ছিন্নভিন্ন করছে তার কোনো হিসাব নেই। এটাই স্বাভাবিক যে, সমগ্র জনগণের
মধ্যে যে অংশগুলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল, তার ওপরই এই ফ্যাসিবাদী নির্যাতন ও
হামলা বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত ইত্যাদি নানা ধরনের
সংখ্যালঘুর বসবাস। এদের ওপরই ফ্যাসিবাদী হামলা স্বাভাবিক কারণেই বেশি
হচ্ছে। বাংলাদেশ আমলের গোড়া থেকে বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘুরা ফ্যাসিস্ট
শাসক শ্রেণীর দ্বারা সব থেকে বেশি আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাদের
স্বার্থের পক্ষে কোনো রাজনৈতিক শক্তিই দাঁড়ায়নি। ১৯৫০ সালের পর থেকে
কমিউনিস্ট পার্টিগুলোও তাদের ধারে কাছে যায়নি। কাজেই তাদের বিরুদ্ধে
নির্যাতন বেশ অবাধে ও মসৃণভাবেই হয়ে এসেছে। বিহারি নামে কথিত উর্দু ভাষীদের
বড় অংশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের সঙ্গে ছিল। এ কারণে ১৯৭১ সালের পর সব রকম
সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা এক ধরনের রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী হিসেবেই
চরম দুর্গতির মধ্যে জীবনযাপন করছেন। জাতিগতভাবে বাঙালি হওয়ার জন্য এবং
পার্শ্ববর্তী বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কারণে
সংখ্যালঘু হিসেবে হিন্দু ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তুলনায় কম ক্ষতিগ্রস্ত হলেও
ফ্যাসিবাদী নির্যাতনের শিকার তাদেরও অনেক ক্ষেত্রে হতে হয়েছে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে এই নির্যাতনের এক বড় উদাহরণ হলো পাকিস্তানি আমলে প্রণীত
‘শত্র“সম্পত্তি আইন’। ১৯৭১ সালের পর বাতিল না করে তার নাম পরিবর্তন করে
‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ রেখে তার মাধ্যমে হিন্দু সম্পত্তি লুটপাট করা হয়। এ
কাজ আওয়ামী লীগের লোকেরা ব্যাপকভাবে করলেও শুধু তারাই এ কাজ করেনি। আওয়ামী
লীগবহির্ভূত শাসক শ্রেণীর অন্যান্য অংশ এবং অন্য দলের লোকেরাও এই লুটপাটে
অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে ভূমিদস্যুতা ধনসম্পদ অর্জনের অন্যতম প্রধান
উপায়ে পরিণত হওয়ায় সাধারণভাবে ভূমি দখলের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু সম্পত্তির ওপর
হামলাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিকে শুধু সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিলেই এর
চরিত্র সঠিকভাবে বোঝা যাবে না। বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে প্রশাসনের চরিত্র
যদি ফ্যাসিবাদী না হতো তাহলে হিন্দু সম্পত্তিসহ সাধারণভাবে অন্য সম্পত্তির
ওপর হামলা এত ব্যাপকভাবে বিস্তৃত এবং শাস্তিবহির্ভূত হতো না।
গত কিছুদিন থেকে প্রথমে বৌদ্ধ ও পরে হিন্দু মন্দিরের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। চট্টগ্রামে বৌদ্ধ মন্দিরের ওপর আক্রমণের কারণ মিয়ানমারে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কারণে কিছুটা ভিন্ন হলেও দেশের বহু জায়গায় হিন্দু মন্দিরের ওপর যেভাবে আক্রমণ হচ্ছে, যেভাবে বিগ্রহ থেকে নিয়ে সবকিছু ভাংচুর হচ্ছেÑ এটা দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুনভাবে এক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের আক্রমণের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে কিছুসংখ্যক হিন্দু ইতিমধ্যেই ভারতে চলে গেছেন। বাস্তবত এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন নিরাপত্তার অভাব সৃষ্টি হচ্ছে যা তাদের অনেককে দেশত্যাগের প্রণোদনা জোগাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে এই পরিস্থিতি তাদের জন্য আরও বিপজ্জনক মনে হচ্ছে এ কারণে যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মুখে অসাম্প্রদায়িকতার ঢেঁড়ি পেটালেও আজ পর্যন্ত একটিও হিন্দু মন্দির আক্রমণ, বিগ্রহ ধ্বংস ইত্যাদির ব্যাপারে কোনো তদন্তই তারা করেনি। এ ব্যাপারে তদন্তের কোনো কথা পর্যন্ত তারা বলে না। লক্ষ্য করার বিষয় যে, হিন্দু মন্দিরের ওপর বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ হচ্ছে রাতের অন্ধকারে। হিন্দু ঘরবাড়িতে আগুন দেয়ার কাজও হচ্ছে রাতে। কাজেই সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার সময় যেভাবে সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ হয় তার সঙ্গে এ ধরনের আক্রমণের পার্থক্য আছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে হিন্দুদের দুর্বল বিবেচনা করে এখন এই আক্রমণ পরিচালনা করা হলেও সাধারণভাবে বাংলাদেশে এখন ভূমিদস্যুতা যেভাবে ব্যাপকভাবে হচ্ছে, তার সঙ্গেই এর সম্পর্ক বেশি। হিন্দুদের মন্দির, বাড়িঘর আক্রমণ করে তাদের ঘরছাড়া, দেশছাড়া করে তাদের জমি-জায়গা-ভিটেবাড়ি দখল করাই হলো এর মূল উদ্দেশ্য।
তবে এখানে অবশ্যই বলা দরকার যে, এভাবে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ শুধু অর্থনৈতিক কারণ ও সম্পত্তি লুটপাটের জন্যই হচ্ছে না, এর একটা রাজনৈতিক দিকও আছে। কাজেই হিন্দুদের ওপর এই আক্রমণের দ্বারা রাজনৈতিকভাবে কারা লাভবান হচ্ছে সেটা দেখা দরকার। এটা দেখার ক্ষেত্রে কোনো পূর্ব ধারণা বা রাজনৈতিক সংস্কারের বশবর্তী না হয়ে যদি বিষয়টি বিবেচনা করা যায়, তাহলে এটা বোঝার অসুবিধে নেই যে, এই মুহূর্তে হিন্দুদের ওপর এ ধরনের আক্রমণের দ্বারা কোনো প্রকাশ্য ধর্মীয় বা আধা-ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের বিশেষ কোনো লাভ নেই। উপরন্তু এ কাজ করলে তাদের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। কারণ অসাম্প্রদায়িক নামের পরিচয় দানকারী বিদ্যমান সরকার এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগ এই আক্রমণকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক প্রচারণা চালিয়ে তার মাধ্যমে লাভবান হতে পারে। এদিক দিয়ে দেখলে হিন্দুদের ওপর এখন যে আক্রমণ হচ্ছে তার থেকে রাজনৈতিক ফায়দা উঠানো আওয়ামী লীগের পক্ষেই খুব সহজ। কারণ তারা সহজেই বলতে পারে, যেহেতু এটা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, কাজেই এ কাজ ধর্মীয় দল, বিশেষত সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় মৌলবাদী নামে পরিচিত দলগুলোর দ্বারাই হচ্ছে। এটা কোনো কল্পিত ব্যাপার নয়। বাস্তবত এখন ঠিক এটাই করা হচ্ছে। দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে আক্রমণ বিভিন্ন স্থানে হচ্ছে তার দায়িত্ব সরকার, সরকারি দল ও তাদের জোটভুক্ত দলগুলো ধর্মীয় এবং আধা-ধর্মীয় দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এটা ঠিক যে, এই নতুন পরিস্থিতিতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী ইত্যাদি দল ও সংগঠনের লোকরা যে নির্লিপ্তভাবে বসে আছে এমন নয়। তারাও এই আক্রমণ ও লুটপাটে অংশগ্রহণ করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা ঠিক যে, এ কাজের মাধ্যমে তাদের লুটপাটের সুবিধা হলেও কোনো রাজনৈতিক সুবিধা নেই। সে সুবিধা আছে আওয়ামী লীগের, যা তারা এক্ষেত্রে ষোল আনা ব্যবহার করছে।
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ব্যাপকভাবে যে ভুল ধারণা বজায় আছে তা হল এই যে, এই দলটি আগের মতো এখনও অসাম্প্রদায়িক। তা যদি হতো তাহলে খেলাফত মজলিসের মতো একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে ২০০৬ সালে তারা এই মর্মে নির্বাচনী চুক্তি করত না যে, জয়লাভ করলে তারা ইসলাম ধর্ম রক্ষার জন্য ব্লাসফেমি আইন করবে। তারা যদি প্রকৃতপক্ষে অসাম্প্রদায়িক হতো, তাহলে সংবিধানে জিয়াউর রহমান যেভাবে বিসমিল্লাহ সংযোজন করেছিলেন সেটা তারা বাদ দিত, ১৯৭২ সালে ঘোষিত সংবিধানের অন্যতম খুঁটি ধর্মনিরপেক্ষতা নাকচ করে এরশাদের সময় ইসলামকে যেভাবে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল, সে স্বীকৃতি বাতিল করত। এসব তারা কিছুই করেনি। উপরন্তু সংবিধানকে ইসলামী করার জন্য পঞ্চদশ সংশোধনীতে সব রকম ব্যবস্থাই তারা রেখেছে। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর বাস্তব চরিত্র। এসবের মধ্যেই আছে ফ্যাসিবাদের বহিঃপ্রকাশ। এর মধ্যেই আছে ফ্যাসিবাদসহ সব রকম প্রতিক্রিয়াশীলতা রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদন ও অনুসরণের উদাহরণ। বাংলাদেশে আজ সব ধরনের জাতিগত, ভাষাগত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যে আক্রমণ হচ্ছে এবং বৃহত্তর ও ব্যাপকতর আক্রমণের শর্ত তৈরি হচ্ছে, একে ফ্যাসিবাদের থেকে বিযুক্ত করে দেখা যায় না। সামগ্রিকভাবে এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের সংগঠিত সংগ্রাম পরিচালনার শর্ত ও ক্ষেত্র তৈরি করাই বর্তমানে সাধারণভাবে জনগণের এক গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি রাজনৈতিক কর্তব্য। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এখন বিভিন্ন জায়গায় মন্দির ভাংচুর, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির যেসব ঘটনা ঘটছে, তা প্রতিরোধের সংগ্রামের সঙ্গে সাধারণভাবে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রাম এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই সংগ্রামে ব্যাপকভাবে এগিয়ে না এলে বাংলাদেশে অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীলতাসহ সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ ও তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম সংগঠিত করা সম্ভব নয়।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
গত কিছুদিন থেকে প্রথমে বৌদ্ধ ও পরে হিন্দু মন্দিরের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। চট্টগ্রামে বৌদ্ধ মন্দিরের ওপর আক্রমণের কারণ মিয়ানমারে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কারণে কিছুটা ভিন্ন হলেও দেশের বহু জায়গায় হিন্দু মন্দিরের ওপর যেভাবে আক্রমণ হচ্ছে, যেভাবে বিগ্রহ থেকে নিয়ে সবকিছু ভাংচুর হচ্ছেÑ এটা দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুনভাবে এক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের আক্রমণের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে কিছুসংখ্যক হিন্দু ইতিমধ্যেই ভারতে চলে গেছেন। বাস্তবত এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন নিরাপত্তার অভাব সৃষ্টি হচ্ছে যা তাদের অনেককে দেশত্যাগের প্রণোদনা জোগাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে এই পরিস্থিতি তাদের জন্য আরও বিপজ্জনক মনে হচ্ছে এ কারণে যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মুখে অসাম্প্রদায়িকতার ঢেঁড়ি পেটালেও আজ পর্যন্ত একটিও হিন্দু মন্দির আক্রমণ, বিগ্রহ ধ্বংস ইত্যাদির ব্যাপারে কোনো তদন্তই তারা করেনি। এ ব্যাপারে তদন্তের কোনো কথা পর্যন্ত তারা বলে না। লক্ষ্য করার বিষয় যে, হিন্দু মন্দিরের ওপর বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ হচ্ছে রাতের অন্ধকারে। হিন্দু ঘরবাড়িতে আগুন দেয়ার কাজও হচ্ছে রাতে। কাজেই সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার সময় যেভাবে সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ হয় তার সঙ্গে এ ধরনের আক্রমণের পার্থক্য আছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে হিন্দুদের দুর্বল বিবেচনা করে এখন এই আক্রমণ পরিচালনা করা হলেও সাধারণভাবে বাংলাদেশে এখন ভূমিদস্যুতা যেভাবে ব্যাপকভাবে হচ্ছে, তার সঙ্গেই এর সম্পর্ক বেশি। হিন্দুদের মন্দির, বাড়িঘর আক্রমণ করে তাদের ঘরছাড়া, দেশছাড়া করে তাদের জমি-জায়গা-ভিটেবাড়ি দখল করাই হলো এর মূল উদ্দেশ্য।
তবে এখানে অবশ্যই বলা দরকার যে, এভাবে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ শুধু অর্থনৈতিক কারণ ও সম্পত্তি লুটপাটের জন্যই হচ্ছে না, এর একটা রাজনৈতিক দিকও আছে। কাজেই হিন্দুদের ওপর এই আক্রমণের দ্বারা রাজনৈতিকভাবে কারা লাভবান হচ্ছে সেটা দেখা দরকার। এটা দেখার ক্ষেত্রে কোনো পূর্ব ধারণা বা রাজনৈতিক সংস্কারের বশবর্তী না হয়ে যদি বিষয়টি বিবেচনা করা যায়, তাহলে এটা বোঝার অসুবিধে নেই যে, এই মুহূর্তে হিন্দুদের ওপর এ ধরনের আক্রমণের দ্বারা কোনো প্রকাশ্য ধর্মীয় বা আধা-ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের বিশেষ কোনো লাভ নেই। উপরন্তু এ কাজ করলে তাদের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। কারণ অসাম্প্রদায়িক নামের পরিচয় দানকারী বিদ্যমান সরকার এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগ এই আক্রমণকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক প্রচারণা চালিয়ে তার মাধ্যমে লাভবান হতে পারে। এদিক দিয়ে দেখলে হিন্দুদের ওপর এখন যে আক্রমণ হচ্ছে তার থেকে রাজনৈতিক ফায়দা উঠানো আওয়ামী লীগের পক্ষেই খুব সহজ। কারণ তারা সহজেই বলতে পারে, যেহেতু এটা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, কাজেই এ কাজ ধর্মীয় দল, বিশেষত সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় মৌলবাদী নামে পরিচিত দলগুলোর দ্বারাই হচ্ছে। এটা কোনো কল্পিত ব্যাপার নয়। বাস্তবত এখন ঠিক এটাই করা হচ্ছে। দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে আক্রমণ বিভিন্ন স্থানে হচ্ছে তার দায়িত্ব সরকার, সরকারি দল ও তাদের জোটভুক্ত দলগুলো ধর্মীয় এবং আধা-ধর্মীয় দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এটা ঠিক যে, এই নতুন পরিস্থিতিতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী ইত্যাদি দল ও সংগঠনের লোকরা যে নির্লিপ্তভাবে বসে আছে এমন নয়। তারাও এই আক্রমণ ও লুটপাটে অংশগ্রহণ করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা ঠিক যে, এ কাজের মাধ্যমে তাদের লুটপাটের সুবিধা হলেও কোনো রাজনৈতিক সুবিধা নেই। সে সুবিধা আছে আওয়ামী লীগের, যা তারা এক্ষেত্রে ষোল আনা ব্যবহার করছে।
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ব্যাপকভাবে যে ভুল ধারণা বজায় আছে তা হল এই যে, এই দলটি আগের মতো এখনও অসাম্প্রদায়িক। তা যদি হতো তাহলে খেলাফত মজলিসের মতো একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে ২০০৬ সালে তারা এই মর্মে নির্বাচনী চুক্তি করত না যে, জয়লাভ করলে তারা ইসলাম ধর্ম রক্ষার জন্য ব্লাসফেমি আইন করবে। তারা যদি প্রকৃতপক্ষে অসাম্প্রদায়িক হতো, তাহলে সংবিধানে জিয়াউর রহমান যেভাবে বিসমিল্লাহ সংযোজন করেছিলেন সেটা তারা বাদ দিত, ১৯৭২ সালে ঘোষিত সংবিধানের অন্যতম খুঁটি ধর্মনিরপেক্ষতা নাকচ করে এরশাদের সময় ইসলামকে যেভাবে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল, সে স্বীকৃতি বাতিল করত। এসব তারা কিছুই করেনি। উপরন্তু সংবিধানকে ইসলামী করার জন্য পঞ্চদশ সংশোধনীতে সব রকম ব্যবস্থাই তারা রেখেছে। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর বাস্তব চরিত্র। এসবের মধ্যেই আছে ফ্যাসিবাদের বহিঃপ্রকাশ। এর মধ্যেই আছে ফ্যাসিবাদসহ সব রকম প্রতিক্রিয়াশীলতা রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদন ও অনুসরণের উদাহরণ। বাংলাদেশে আজ সব ধরনের জাতিগত, ভাষাগত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যে আক্রমণ হচ্ছে এবং বৃহত্তর ও ব্যাপকতর আক্রমণের শর্ত তৈরি হচ্ছে, একে ফ্যাসিবাদের থেকে বিযুক্ত করে দেখা যায় না। সামগ্রিকভাবে এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের সংগঠিত সংগ্রাম পরিচালনার শর্ত ও ক্ষেত্র তৈরি করাই বর্তমানে সাধারণভাবে জনগণের এক গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি রাজনৈতিক কর্তব্য। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এখন বিভিন্ন জায়গায় মন্দির ভাংচুর, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির যেসব ঘটনা ঘটছে, তা প্রতিরোধের সংগ্রামের সঙ্গে সাধারণভাবে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রাম এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই সংগ্রামে ব্যাপকভাবে এগিয়ে না এলে বাংলাদেশে অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীলতাসহ সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ ও তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম সংগঠিত করা সম্ভব নয়।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments