খাদ্য বহুমুখীকরণ কেন প্রয়োজন by ইকতেদার আহমেদ
মানুষের
জীবন ধারণের জন্য খাদ্য অপরিহার্য। একজন মানুষের যখন এ পৃথিবীতে আগমন ঘটে,
তখন সর্বপ্রথম কান্নার অভিব্যক্তিতে সে তার ক্ষুধার ভাব প্রকাশ করে। যে
মুহূর্তে শিশুটিকে তার জন্য উপযোগী মাতৃদুগ্ধ দেয়া হয়, তৎক্ষণাৎ তার কান্না
থেমে যায় এবং সে অনাবিল প্রশান্তিতে দুগ্ধ পান করতে থাকে। একটি শিশু কথা
বলা শেখার পর থেকে ধীরে ধীরে তার ভাব প্রকাশ করতে শেখে এবং এভাবে বুদ্ধি ও
জ্ঞান বিকাশের সঙ্গে সে তার রুচিবোধ অথবা কোন ধরনের খাবারের প্রতি তার
আগ্রহ সে বিষয়ে ধারণা দেয়। সাধারণত শিশুর পিতা-মাতা বা অভিভাবক একটি শিশুর
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং রুচি ও আগ্রহ এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তাকে সুষম
খাবার দেয়ার চেষ্টা করে। উন্নত রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের জীবন ধারণের
জন্য ন্যূনতম যে খাদ্যের প্রয়োজন, তার নিশ্চয়তা বিধান করা রাষ্ট্রের
দায়িত্ব। এসব রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য খাদ্যের নিশ্চয়তা মৌলিক
অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তবে যেসব দেশ সম্পদশালী নয়, সেসব দেশের পক্ষে
প্রত্যেক নাগরিকের জন্য খাদ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
আমাদের দেশে অদ্যাবধি প্রত্যেক নাগরিকের জন্য খাদ্যের নিশ্চয়তা মৌলিক
অধিকার হিসেবে স্বীকৃত নয়।
পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলে ওই অঞ্চলের আবহাওয়া উপযোগী খাদ্যশস্য ও ফলমূল উৎপাদিত হয়। হাঁস-মুরগি গবাদিপশু ও মাছ এলাকাভেদে বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে। অঞ্চলভিত্তিক খাদ্যশস্য, ফলমূল, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু, মাছ প্রভৃতির সহজপ্রাপ্যতার ওপর মানুষের খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে। এরই প্রভাবে দেখা গেছে প্রাচীনকাল থেকে আমাদের দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য তালিকায় মাছ ও ভাত স্থান পেয়ে আসছে। বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য আদিকাল থেকেই ছিল মাছ ও ভাত। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোয় গম ও গবাদিপশুর সহজলভ্যতার কারণে সে অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল রুটি ও মাংস। অনুরূপভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আলুর সহজলভ্যতার কারণে আলু হয়ে উঠেছিল তাদের প্রধান খাদ্য এবং এর পাশাপাশি তারা তাদের খাদ্য তালিকায় মাছ ও মাংসকে স্থান দিত। আফ্রিকা মহাদেশে এমন অনেক দেশ আছে যেখানে মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল কলা। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের পাহাড়ে আদিবাসী হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে যারা বসবাস করে আসছিল, তাদের খাদ্য তালিকায় ছিল পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ফলমূল এবং সহজে শিকার করা বা ধরা যায় এমন বণ্যপ্রাণী ও প্রাপ্যতা সাপেক্ষে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
যেসব অঞ্চলে জীবন ধারণ সহজতর ছিল, সেসব অঞ্চলে উৎপাদিত খাদ্যশস্য জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতির সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হলে বাধ্য হয়েই জীবিকার সন্ধানে অনেককে এক অঞ্চল ত্যাগ করে অন্য অঞ্চলে চলে যেতে হয়। এভাবে এক অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ সৃষ্টি হলে একে অপরের খাদ্যাভ্যাস দ্বারা প্রভাবিত হয়। অতঃপর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এক অঞ্চলের মানুষ জীবিকার সন্ধানে অপর অঞ্চলে গিয়ে ব্যাপক হারে বসবাস শুরু করলে অঞ্চলভিত্তিক খাদ্যশস্য ও ফলমূল সহজলভ্য না হওয়ায় পরিবেশগত কারণেই মানুষ খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
খাদ্যাভ্যাস একটি জাতির বা অঞ্চলের মানুষের কৃষ্টি, সভ্যতা ও ঐতিহ্যের অংশ। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের মানুষ তাদের কৃষ্টি, সভ্যতা ও ঐতিহ্যের লালনে নিজ নিজ খাদ্যাভ্যাস ধরে রাখতে পারেনি। এরই ফলে মানুষের চাহিদার আলোকে এবং সবার জন্য সুষম খাদ্য নিশ্চিতকরণের প্রয়োজনে খাদ্য বহুমুখীকরণ ধারণার জন্ম ও ক্রমবিকাশ। বর্তমান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের মানুষ নিজ নিজ কৃষ্টি, সভ্যতা ও ঐতিহ্য অনুযায়ী সামাজিক ও ধর্মীয় বিশেষ দিনে ঐতিহ্যগত খাবার গ্রহণ করলেও বছরব্যাপী সে খাবারের আর আবেদন থাকে না। খাদ্য বহুমুখীকরণের ধারণার বিকাশের ফলে এখন আর পৃথিবীর কোনো অঞ্চলের মানুষের বছরব্যাপী খাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট একটি বা দুটি খাদ্য থাকে না। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ যেসব দেশের শতভাগ লোক শিক্ষিত ও সচ্ছল, তাদের অধিকাংশই কর্মজীবী হওয়ায় দেখা যায়, তারা মধ্যাহ্নের খাবার কর্মস্থলের ক্যান্টিন বা আশপাশের কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে নিচ্ছে এবং রাতের খাবারের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, ঘরের বাইরে কোথাও আহার সেরে নিচ্ছে অথবা বাইরে থেকে কিনে এনে ঘরে বসে খাচ্ছে। তারা প্রতিদিন একই ধরনের খাবার গ্রহণ করে না। তারা মূলত কী ধরনের খাবার খাবে, এটি তাদের রুচির ওপর নির্ভর করে। খাদ্য বহুমুখীকরণের কারণে কোনো একটি বিশেষ ধরনের খাবার যেমন- ভাত, রুটি, আলু, শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মাংস, দুগ্ধজাত খাদ্য প্রভৃতির ওপর একক চাপ না থাকায় অনেক দেশ বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উৎপাদন করে একদিকে নিজ দেশের জনগণের খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছে, অপরদিকে উদ্বৃত্ত বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বিদেশে রফতানি করে নিজের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করছে।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ এখনও গ্রামে বসবাস করে। আধুনিকতার ছোঁয়া এখনও তাদের তেমনভাবে প্রভাবিত না করতে পারায় তাদের মূল খাদ্য তালিকা থেকে একবেলার জন্যও ভাতকে বাদ পড়তে দেখা যায় না। একজন সুস্থ সবল লোকের বেঁচে থাকার জন্য সুষম খাবারের প্রয়োজন। এ সুষম খাবারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে ভাত, মাছ, মাংস, ডাল, সবজি, দুধ, দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ফল, রুটি, আলু প্রভৃতি। আমাদের দেশে ধনী-গরিব নির্বিশেষে দেখা যায়, সুষম খাদ্য বিষয়ে জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে যার যতটুকু ও যে ধরনের খাদ্য গ্রহণ প্রয়োজন তা গ্রহণ না করে একই ধরনের বা বিভিন্ন ধরনের অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করছে। খাদ্য গ্রহণ বিষয়ে অসচেতনতার কারণে অনেকেই নিজের অজান্তে বা অবহেলায় বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে বর্তমানে ধানের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ শাকসবজি, গম, আলু ও ভুট্টা উৎপাদিত হয়। দেশের প্রত্যেক নাগরিক যদি তার খাদ্য তালিকায় ভাতের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে এর পরিবর্তে শাকসবজি, আলু, গম ও ভুট্টা সংমিশ্রিত আটার রুটি খাওয়ার অভ্যাস করে, তাহলে বর্তমানে স্বল্প ভূমিতে আমরা যে পরিমাণ ধান উৎপাদন করছি, তা দিয়ে দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণ চাল বিদেশে রফতানি করে সে আয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ অবকাঠামো খাতে ব্যয় করতে পারি।
আমরা নিত্যনৈমিত্তিক সবজি হিসেবে যেসব খাদ্য গ্রহণ করি, এর মধ্যে অন্যতম হল লাউ, মিষ্টি কুমড়া, পটোল, কাঁচাকলা প্রভৃতি। উপরোক্ত সবজি দিয়ে আমরা খাদ্য প্রস্তুতকালীন এসব সবজির খোসা আবর্জনা হিসেবে ফেলে দিই। আবার অনেকে খোসা দিয়ে উপাদেয় খাবার প্রস্তুত করে। এভাবে খোসা ফেলে না দিয়ে উপাদেয় খাবার প্রস্তুত করা হলে, তা কিছুটা হলেও অন্য খাদ্যের চাহিদা কমাবে।
দেশে শীতকালীন সবজি হিসেবে প্রচুর পরিমাণ ফুলকপি উৎপাদিত হয়। ফুলকপি রান্না বা ভাজি করার সময় আমরা সাধারণত এর ডাঁটা ফেলে দিই। অথচ ফুলকপির ডাঁটা ছোট মাছ, ডাল বা শুঁটকি দিয়ে রান্না করলে উপাদেয় খাদ্যে পরিণত হয়। সুতরাং ফুলকপির ডাঁটা ফেলে না দিয়ে প্রচুর খাদ্যগুণ সমৃদ্ধ এ ডাঁটা যদি আমরা তরকারি হিসেবে খাই, তা নিুবিত্তের সবজির চাহিদা লাঘবে কিছুটা হলেও সহায়ক হবে।
আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এক বিপুল অংশ বর্ষাকালে সবজির অভাবে বিকল্প হিসেবে শাপলা ভাজি বা শাপলা দিয়ে রান্না করা তরকারি খেয়ে জীবন ধারণ করত। সে সময়ে গ্রামের বিত্তবান ও শহুরে জনগোষ্ঠীর কাছে এ শাপলা ফেলনা ছিল। কিন্তু আজ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় শাপলা আর ফেলনা নয়। বিত্তবানদের খাবার টেবিলে রুচিকর খাদ্য হিসেবে এখন শাপলা ভাজি ও শাপলা দিয়ে রান্না করা তরকারি শোভা পায়।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা ছাড়া অবশিষ্ট সব জেলার মানুষ সিদ্ধ চালের ভাত খেয়ে অভ্যস্ত। সিদ্ধ চাল দিয়ে ভাত রান্নার পর এর ফেন বা মাড় ফেলে দিয়ে খাওয়ার জন্য পরিবেশন করা হয়। অপরদিকে আতপ চাল দিয়ে ভাত ও পোলাও রান্না করা হলে মাড়সহ পানি শুকিয়ে খাওয়ার উপযোগী করা হয়। বাংলাদেশ ছাড়া অল্পসংখ্যক দেশের মানুষ সিদ্ধ চালের রান্না করা ভাত খায়। দেশে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের সময় এবং স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বন্যা, খরা, সাইক্লোন প্রভৃতিতে ফসলহানির পর গ্রামাঞ্চলে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিল। তখন গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এক বিপুল অংশ অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের ফেলে দেয়া ভাতের মাড় খেয়ে জীবন ধারণ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ভাতের মাড় ফেলে দেয়ার ফলে ভাতের খাদ্যগুণ অনেকাংশে হ্রাস পায়। আমাদের বিত্তবানদের মধ্যে শখের বসে যারা লবণ, গোলমরিচের গুঁড়া, ডিমের সাদা অংশ, টেস্টিং সল্ট ও সস দিয়ে ভাতের মাড় স্যুপের মতো করে খেয়েছেন, তাদের অভিমত এ স্যুপের স্বাদ কোনো অংশে পাঁচ তারকা হোটেলের ক্রিম স্যুপের চেয়ে কম নয়। তবে কেন আমরা খাদ্যগুণ সমৃদ্ধ মাড় ফেলে দিয়ে অযথা খাদ্য বিনষ্ট করছি? উল্লেখ্য, অন্যান্য উপাদানের পাশাপাশি দুধের ননি মিশিয়ে ক্রিম স্যুপ সুস্বাদু করা হয়। ভাতের মাড় না ফেলে ভাত খেলে অথবা মাড় দিয়ে সুস্বাদু স্যুপ বানিয়ে খেলে যে পরিমাণ খাদ্য সাশ্রয় হবে, তার অবদান জাতীয় অর্থনীতিতে অসীম। এ বিষয়ে দেশবাসীকে সজাগ করে তুলতে পারলে আশা করা যায় ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।
অতীতে যারা নিজেদের সম্ভ্রান্ত হিসেবে দাবি করত, তারা এবং অনেক মধ্যবিত্ত গরু বা ছাগলের ভুঁড়ি, শোল বা গজার মাছ এবং মুরগির পা ভক্ষণকে হীন দৃষ্টিতে দেখত। কিন্তু আজ সে ধারণা পাল্টে গেছে। এখন এ খাবারগুলো অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি সম্ভ্রান্ত ও মধ্যবিত্তের খাবার টেবিলে বেশি শোভা পায়। আর ফাস্টফুডের দোকান থেকে আমরা যে সমুচা, পিৎজা, হটডগ প্রভৃতি খাবার খাই সেসব খাবারে যে ভুঁড়ির অস্তিত্ব নেই, সে নিশ্চয়তা কেউ কি দিতে পারবে? আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল। এ ফলের কোনো কিছুই ফেলনা নয়। কাঁঠালের বাকলসহ কোষ যে অংশ দ্বারা আবৃত থাকে, তা আমাদের পরিত্যাজ্য হলেও গরুর আদর্শ খাবার। গ্রামাঞ্চলে এখনও দেখা যায় গৃহিণীরা বর্ষাকালের জন্য আদর্শ খাবার বিবেচনায় কাঁঠালের বিচি সংরক্ষণ করে রাখেন।
উপরোক্ত সব খাবার আমাদের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্তির উপযোগী। আর অন্তর্ভুক্ত করা গেলে এসব খাদ্য সার্বিকভাবে আমাদের দেহ উপযোগী সব ধরনের খাদ্যের জোগান দেবে, যা খাদ্য বহুমুখীকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। দেশের বিভিন্ন পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসাবিদের অভিমত, পৌঢ়ত্ব পদার্পণ পরবর্তী কায়িক পরিশ্রম করে না এমন মানুষ তার সুস্থতা ধরে রাখতে চাইলে তাকে অবশ্যই তেল ও চর্বিযুক্ত খাবার সম্পূর্ণ পরিহার করে একবেলা স্বল্প পরিমাণ ভাত এবং আরেক বেলা রুটি, শাকসবজি, আলু প্রভৃতি খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকদের অভিমত অনুযায়ী আমরা আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে পারলে এক সময় দেখা যাবে তা কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধদেরও প্রভাবিত করছে। আর এভাবে দেশের জনসাধারণের এক বিরাট অংশকে খাদ্য বহুমুখীকরণ ধারণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ করে আমরা যদি আমাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে পারি, তাহলে খাদ্য বহুমুখীকরণ আমাদের দেশে একটি বিপ্লবের সূচনা করবে। দেশ ও জাতি হিসেবে আমাদের সমৃদ্ধির সোপানে পেঁৗঁছাতে হলে সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতি আনা প্রয়োজন। সে অগ্রগতি খাদ্য বহুমুখীকরণকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ ও কলামিস্ট
পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলে ওই অঞ্চলের আবহাওয়া উপযোগী খাদ্যশস্য ও ফলমূল উৎপাদিত হয়। হাঁস-মুরগি গবাদিপশু ও মাছ এলাকাভেদে বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে। অঞ্চলভিত্তিক খাদ্যশস্য, ফলমূল, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু, মাছ প্রভৃতির সহজপ্রাপ্যতার ওপর মানুষের খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে। এরই প্রভাবে দেখা গেছে প্রাচীনকাল থেকে আমাদের দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য তালিকায় মাছ ও ভাত স্থান পেয়ে আসছে। বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য আদিকাল থেকেই ছিল মাছ ও ভাত। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোয় গম ও গবাদিপশুর সহজলভ্যতার কারণে সে অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল রুটি ও মাংস। অনুরূপভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আলুর সহজলভ্যতার কারণে আলু হয়ে উঠেছিল তাদের প্রধান খাদ্য এবং এর পাশাপাশি তারা তাদের খাদ্য তালিকায় মাছ ও মাংসকে স্থান দিত। আফ্রিকা মহাদেশে এমন অনেক দেশ আছে যেখানে মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল কলা। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের পাহাড়ে আদিবাসী হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে যারা বসবাস করে আসছিল, তাদের খাদ্য তালিকায় ছিল পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ফলমূল এবং সহজে শিকার করা বা ধরা যায় এমন বণ্যপ্রাণী ও প্রাপ্যতা সাপেক্ষে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
যেসব অঞ্চলে জীবন ধারণ সহজতর ছিল, সেসব অঞ্চলে উৎপাদিত খাদ্যশস্য জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতির সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হলে বাধ্য হয়েই জীবিকার সন্ধানে অনেককে এক অঞ্চল ত্যাগ করে অন্য অঞ্চলে চলে যেতে হয়। এভাবে এক অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ সৃষ্টি হলে একে অপরের খাদ্যাভ্যাস দ্বারা প্রভাবিত হয়। অতঃপর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এক অঞ্চলের মানুষ জীবিকার সন্ধানে অপর অঞ্চলে গিয়ে ব্যাপক হারে বসবাস শুরু করলে অঞ্চলভিত্তিক খাদ্যশস্য ও ফলমূল সহজলভ্য না হওয়ায় পরিবেশগত কারণেই মানুষ খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
খাদ্যাভ্যাস একটি জাতির বা অঞ্চলের মানুষের কৃষ্টি, সভ্যতা ও ঐতিহ্যের অংশ। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের মানুষ তাদের কৃষ্টি, সভ্যতা ও ঐতিহ্যের লালনে নিজ নিজ খাদ্যাভ্যাস ধরে রাখতে পারেনি। এরই ফলে মানুষের চাহিদার আলোকে এবং সবার জন্য সুষম খাদ্য নিশ্চিতকরণের প্রয়োজনে খাদ্য বহুমুখীকরণ ধারণার জন্ম ও ক্রমবিকাশ। বর্তমান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের মানুষ নিজ নিজ কৃষ্টি, সভ্যতা ও ঐতিহ্য অনুযায়ী সামাজিক ও ধর্মীয় বিশেষ দিনে ঐতিহ্যগত খাবার গ্রহণ করলেও বছরব্যাপী সে খাবারের আর আবেদন থাকে না। খাদ্য বহুমুখীকরণের ধারণার বিকাশের ফলে এখন আর পৃথিবীর কোনো অঞ্চলের মানুষের বছরব্যাপী খাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট একটি বা দুটি খাদ্য থাকে না। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ যেসব দেশের শতভাগ লোক শিক্ষিত ও সচ্ছল, তাদের অধিকাংশই কর্মজীবী হওয়ায় দেখা যায়, তারা মধ্যাহ্নের খাবার কর্মস্থলের ক্যান্টিন বা আশপাশের কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে নিচ্ছে এবং রাতের খাবারের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, ঘরের বাইরে কোথাও আহার সেরে নিচ্ছে অথবা বাইরে থেকে কিনে এনে ঘরে বসে খাচ্ছে। তারা প্রতিদিন একই ধরনের খাবার গ্রহণ করে না। তারা মূলত কী ধরনের খাবার খাবে, এটি তাদের রুচির ওপর নির্ভর করে। খাদ্য বহুমুখীকরণের কারণে কোনো একটি বিশেষ ধরনের খাবার যেমন- ভাত, রুটি, আলু, শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মাংস, দুগ্ধজাত খাদ্য প্রভৃতির ওপর একক চাপ না থাকায় অনেক দেশ বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উৎপাদন করে একদিকে নিজ দেশের জনগণের খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছে, অপরদিকে উদ্বৃত্ত বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বিদেশে রফতানি করে নিজের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করছে।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ এখনও গ্রামে বসবাস করে। আধুনিকতার ছোঁয়া এখনও তাদের তেমনভাবে প্রভাবিত না করতে পারায় তাদের মূল খাদ্য তালিকা থেকে একবেলার জন্যও ভাতকে বাদ পড়তে দেখা যায় না। একজন সুস্থ সবল লোকের বেঁচে থাকার জন্য সুষম খাবারের প্রয়োজন। এ সুষম খাবারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে ভাত, মাছ, মাংস, ডাল, সবজি, দুধ, দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ফল, রুটি, আলু প্রভৃতি। আমাদের দেশে ধনী-গরিব নির্বিশেষে দেখা যায়, সুষম খাদ্য বিষয়ে জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে যার যতটুকু ও যে ধরনের খাদ্য গ্রহণ প্রয়োজন তা গ্রহণ না করে একই ধরনের বা বিভিন্ন ধরনের অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করছে। খাদ্য গ্রহণ বিষয়ে অসচেতনতার কারণে অনেকেই নিজের অজান্তে বা অবহেলায় বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে বর্তমানে ধানের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ শাকসবজি, গম, আলু ও ভুট্টা উৎপাদিত হয়। দেশের প্রত্যেক নাগরিক যদি তার খাদ্য তালিকায় ভাতের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে এর পরিবর্তে শাকসবজি, আলু, গম ও ভুট্টা সংমিশ্রিত আটার রুটি খাওয়ার অভ্যাস করে, তাহলে বর্তমানে স্বল্প ভূমিতে আমরা যে পরিমাণ ধান উৎপাদন করছি, তা দিয়ে দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণ চাল বিদেশে রফতানি করে সে আয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ অবকাঠামো খাতে ব্যয় করতে পারি।
আমরা নিত্যনৈমিত্তিক সবজি হিসেবে যেসব খাদ্য গ্রহণ করি, এর মধ্যে অন্যতম হল লাউ, মিষ্টি কুমড়া, পটোল, কাঁচাকলা প্রভৃতি। উপরোক্ত সবজি দিয়ে আমরা খাদ্য প্রস্তুতকালীন এসব সবজির খোসা আবর্জনা হিসেবে ফেলে দিই। আবার অনেকে খোসা দিয়ে উপাদেয় খাবার প্রস্তুত করে। এভাবে খোসা ফেলে না দিয়ে উপাদেয় খাবার প্রস্তুত করা হলে, তা কিছুটা হলেও অন্য খাদ্যের চাহিদা কমাবে।
দেশে শীতকালীন সবজি হিসেবে প্রচুর পরিমাণ ফুলকপি উৎপাদিত হয়। ফুলকপি রান্না বা ভাজি করার সময় আমরা সাধারণত এর ডাঁটা ফেলে দিই। অথচ ফুলকপির ডাঁটা ছোট মাছ, ডাল বা শুঁটকি দিয়ে রান্না করলে উপাদেয় খাদ্যে পরিণত হয়। সুতরাং ফুলকপির ডাঁটা ফেলে না দিয়ে প্রচুর খাদ্যগুণ সমৃদ্ধ এ ডাঁটা যদি আমরা তরকারি হিসেবে খাই, তা নিুবিত্তের সবজির চাহিদা লাঘবে কিছুটা হলেও সহায়ক হবে।
আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এক বিপুল অংশ বর্ষাকালে সবজির অভাবে বিকল্প হিসেবে শাপলা ভাজি বা শাপলা দিয়ে রান্না করা তরকারি খেয়ে জীবন ধারণ করত। সে সময়ে গ্রামের বিত্তবান ও শহুরে জনগোষ্ঠীর কাছে এ শাপলা ফেলনা ছিল। কিন্তু আজ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় শাপলা আর ফেলনা নয়। বিত্তবানদের খাবার টেবিলে রুচিকর খাদ্য হিসেবে এখন শাপলা ভাজি ও শাপলা দিয়ে রান্না করা তরকারি শোভা পায়।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা ছাড়া অবশিষ্ট সব জেলার মানুষ সিদ্ধ চালের ভাত খেয়ে অভ্যস্ত। সিদ্ধ চাল দিয়ে ভাত রান্নার পর এর ফেন বা মাড় ফেলে দিয়ে খাওয়ার জন্য পরিবেশন করা হয়। অপরদিকে আতপ চাল দিয়ে ভাত ও পোলাও রান্না করা হলে মাড়সহ পানি শুকিয়ে খাওয়ার উপযোগী করা হয়। বাংলাদেশ ছাড়া অল্পসংখ্যক দেশের মানুষ সিদ্ধ চালের রান্না করা ভাত খায়। দেশে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের সময় এবং স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বন্যা, খরা, সাইক্লোন প্রভৃতিতে ফসলহানির পর গ্রামাঞ্চলে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিল। তখন গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এক বিপুল অংশ অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের ফেলে দেয়া ভাতের মাড় খেয়ে জীবন ধারণ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ভাতের মাড় ফেলে দেয়ার ফলে ভাতের খাদ্যগুণ অনেকাংশে হ্রাস পায়। আমাদের বিত্তবানদের মধ্যে শখের বসে যারা লবণ, গোলমরিচের গুঁড়া, ডিমের সাদা অংশ, টেস্টিং সল্ট ও সস দিয়ে ভাতের মাড় স্যুপের মতো করে খেয়েছেন, তাদের অভিমত এ স্যুপের স্বাদ কোনো অংশে পাঁচ তারকা হোটেলের ক্রিম স্যুপের চেয়ে কম নয়। তবে কেন আমরা খাদ্যগুণ সমৃদ্ধ মাড় ফেলে দিয়ে অযথা খাদ্য বিনষ্ট করছি? উল্লেখ্য, অন্যান্য উপাদানের পাশাপাশি দুধের ননি মিশিয়ে ক্রিম স্যুপ সুস্বাদু করা হয়। ভাতের মাড় না ফেলে ভাত খেলে অথবা মাড় দিয়ে সুস্বাদু স্যুপ বানিয়ে খেলে যে পরিমাণ খাদ্য সাশ্রয় হবে, তার অবদান জাতীয় অর্থনীতিতে অসীম। এ বিষয়ে দেশবাসীকে সজাগ করে তুলতে পারলে আশা করা যায় ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।
অতীতে যারা নিজেদের সম্ভ্রান্ত হিসেবে দাবি করত, তারা এবং অনেক মধ্যবিত্ত গরু বা ছাগলের ভুঁড়ি, শোল বা গজার মাছ এবং মুরগির পা ভক্ষণকে হীন দৃষ্টিতে দেখত। কিন্তু আজ সে ধারণা পাল্টে গেছে। এখন এ খাবারগুলো অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি সম্ভ্রান্ত ও মধ্যবিত্তের খাবার টেবিলে বেশি শোভা পায়। আর ফাস্টফুডের দোকান থেকে আমরা যে সমুচা, পিৎজা, হটডগ প্রভৃতি খাবার খাই সেসব খাবারে যে ভুঁড়ির অস্তিত্ব নেই, সে নিশ্চয়তা কেউ কি দিতে পারবে? আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল। এ ফলের কোনো কিছুই ফেলনা নয়। কাঁঠালের বাকলসহ কোষ যে অংশ দ্বারা আবৃত থাকে, তা আমাদের পরিত্যাজ্য হলেও গরুর আদর্শ খাবার। গ্রামাঞ্চলে এখনও দেখা যায় গৃহিণীরা বর্ষাকালের জন্য আদর্শ খাবার বিবেচনায় কাঁঠালের বিচি সংরক্ষণ করে রাখেন।
উপরোক্ত সব খাবার আমাদের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্তির উপযোগী। আর অন্তর্ভুক্ত করা গেলে এসব খাদ্য সার্বিকভাবে আমাদের দেহ উপযোগী সব ধরনের খাদ্যের জোগান দেবে, যা খাদ্য বহুমুখীকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। দেশের বিভিন্ন পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসাবিদের অভিমত, পৌঢ়ত্ব পদার্পণ পরবর্তী কায়িক পরিশ্রম করে না এমন মানুষ তার সুস্থতা ধরে রাখতে চাইলে তাকে অবশ্যই তেল ও চর্বিযুক্ত খাবার সম্পূর্ণ পরিহার করে একবেলা স্বল্প পরিমাণ ভাত এবং আরেক বেলা রুটি, শাকসবজি, আলু প্রভৃতি খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকদের অভিমত অনুযায়ী আমরা আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে পারলে এক সময় দেখা যাবে তা কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধদেরও প্রভাবিত করছে। আর এভাবে দেশের জনসাধারণের এক বিরাট অংশকে খাদ্য বহুমুখীকরণ ধারণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ করে আমরা যদি আমাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে পারি, তাহলে খাদ্য বহুমুখীকরণ আমাদের দেশে একটি বিপ্লবের সূচনা করবে। দেশ ও জাতি হিসেবে আমাদের সমৃদ্ধির সোপানে পেঁৗঁছাতে হলে সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতি আনা প্রয়োজন। সে অগ্রগতি খাদ্য বহুমুখীকরণকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ ও কলামিস্ট
No comments