কাদের মোল্লার মামলার রায়- প্রতিবেদনগুলো তৈরি করেছেন দৈনিক জনকণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার by বিকাশ দত্ত
একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল
আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ
ট্রাইব্যুনাল-২।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি
ওবায়দুল হাসান ৫ ফেব্রুয়ারি এই রায় ঘোষণা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম এক
দিনে হয়নি। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬
ডিসেম্বর বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশ হিসেবে স্থান
করে নেয়। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে ৩০ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা, সোয়া
চার লাখ নারীর উপর পাশবিক নির্যাতন করা হয়, এক কোটি মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশ
ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কয়েক কোটি মানুষের অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত
স্মরণকালের ইতিহাসে এমনটি আর ঘটেনি।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে জামায়াতে ইসলামী, মুসলীম লীগ, নেজামে ইসলাম পাটি, পিডিপি ইত্যাদি ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ও শান্তি কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং তাদের সহযোগী ঘাতক বাহিনী আল-বদর, আল-শামস, সিভিল পাইওনিয়ার ফোর্সের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় চালানো হয় হত্যাযজ্ঞ। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কামান্ডের কাছে তাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালীর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
গণতদন্ত কমিশন ॥ জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয় ১৯৯২ সালে। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণআদালতে গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার অনুষ্ঠিত হয়। ওই বিচারে প্রায় ৫ লাখ লোকের সমাগত ঘটেছিল। ১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোলাম আযমের বিচারের যৌক্তিকতা তুলে ধরে এবং ২৪ বরেণ্য নাগরিকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদোহের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তখন জাতীয় সংসদে এক অসাধরণ ভাষণ দিয়েছিলেন।
তখন সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিরোধী দলের চাপে এবং জাহানারা ইমামের তুঙ্গস্পর্শী আন্দোলনে সরকার ২৯ জুন ’৯২ তারিখে বিরোধী দলের সঙ্গে চার দফা চুক্তিতে বাধ্য হয় যে চুক্তির প্রথম দুই দফা ছিল সরকার যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার করবে এবং গণআদালতের উদ্যোক্তা ২৪ জন বরেণ্য নাগরিকের বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করবে। বিরোধী দলকে সংসদের আনার জন্য খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার এ ধরনের চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করে গোলাম আযমের বিচার করার বদলে খালেদা জিয়া তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করেন। শত হয়রানি ও নির্যাতন সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নির্মূল কমিটি ১০ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিল।
একটি শূন্যতা ॥ ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর জাতীয় সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সূচিত একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের এই আন্দোলনের গুরুত্বের কথা বিবেচনায় রেখে রাজপথে এই আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য ১৯৯৫ সালে নির্মূল কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
একমাত্র শাস্তি ॥ শাহরিয়ার কবিরের সম্পাদনায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার গ্রন্থে বলা হয়েছে, প্রাচীন গ্রীসে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য বিবরণ পাওয়া যাবে গ্রীক পুরাণে। তখনও যুদ্ধাপরাধীদের একমাত্র শাস্তি ছিল মৃত্যুদ-। ১৪৭৪ সালে হাগেনবাখের স্যার পিটারকে যুদ্ধাপরাধের জন্য মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছিল। বযুরের যুদ্ধের পর গ্রেট ব্রিটেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ভিয়েনা কংগ্রেস পরাজিত ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়নকে অপরাধী ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকারের নিকট অর্পণ করে। নেপোলিয়ানকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হয়।
যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা ॥ ১৮৬৪ সালে জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা নির্ণয় করা হয়। এর পর ১৮৯৯, ১৯০০ও ১৯০৭ সালে ইউরোপে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন কনভেনশনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি পরাজিত জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯২০ সালে যুদ্ধাপরাধের ৪৫টি মামলার দায়িত্ব গ্রহণ করে জার্মানি। এর মধ্যে ১২ জনের বিচার করে ৬ জনকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়।
নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল ॥ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যুগান্তকারী আদালত বসেছিল জার্মানির নুরেমবার্গে। এর পাশাপাশি জাপানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত হয় টোকিও ট্রাইব্যুনাল। এই দুই ট্রাইব্যুনালে বিচার্য অপরাধসমূহকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। (১) যুদ্ধাপরাধ (২) শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ (৩) মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
কখন বিপর্যয় ঘটে ॥ মানব জাতির ইতিহাসে নৃশংসতম গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) সময়। জার্মানিতে হিটলারের নাৎসী বাহিনী, ইটালিতে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট বাহিনী এবং প্রাচ্যে জেনারেল তোজোর জাপানী বাহিনীর যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে বর্বরতম অপরাধের কথা বিশ্ববাসী কখনও ভুলবে না। হিটলারের নাৎসী বাহিনী এবং তাদের সহযোগী গেস্টাপো ও অন্যান্য বাহিনী যেভাবে ইহুদী, কমিউনিস্ট ও অজার্মানদের হত্যা করেছে সভ্যতার ইতিহাসে তার কোন নজির নেই।
মানবতাবিরোধী অপরাধ ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় রাজাকার আলবদর আলশামস মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। দীর্ঘদিন পরে হলেও তাদের বিচার শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করেছে। ট্রাইব্যুনালের এটিই প্রথম রায়। ১৯৭৩ সালে নবেম্বর মাসে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য করার অবকাশ থাকে, তা হলো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সময়টি। যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধী ও গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্য জুলাই মাসে সংবিধান সংশোধনের ও আইন প্রণয়ন করে আরেকটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলেও মাত্র চার মাসের মাথায় এই ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। যদিও ঘোষণার মুখবন্ধে বলা হয়েছিল দেশদ্রোহিতা, হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি, অগ্নিসংযোগ অপরাধীরা ক্ষমা পাবে না।
সর্বপ্রথম সংশোধনী পর ॥ সংবিধানে প্রথম সংশোধনীর পর ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩ পাস হয়। এর খসড়া রচনা করেছেন বাংলাদেশ, ভারত এবং ইউরোপের বিশিষ্ট আইনজ্ঞগণ। এই আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেই সময় জেনেভায় বাংলাদেশ মিশনের প্রধান, পরবর্তীকালে সচিব কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান। এই আইন প্রণয়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ১৯৭২ সালেই একটি সেল গঠন করেন। তাঁকে সহায়তা করেন, বিচারপতি এফকেএমএ মুনিম, প্রবীণ আইনজীবী সবিতা রঞ্জন পাল, সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল ফকির শাহাবুদ্দিন আহম্মেদ, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেমদ, তৎকালীন আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব নাসিম উদ্দিন আহম্মেদ, ব্যারিস্টার হারুনুর রশিদ, সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম ও ওয়ালিউর রহমান। এ ছাড়া এই আইন প্রণয়নে সহায়তা করে ভারতের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার দিপঙ্কর ঘোষ, ইউরোপের প্রফেসর ইয়েশেক ও অটোভন ট্রিফটাপরার। শেষের দুজন নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন ॥ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) গঠন করেন। এতে করে সারাদেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। দালাল আইন জারির পর ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ থেকে ৩৭ হাজার ৪১৭ জন দালালকে গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের বিচার। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ২ হাজার ৮৪৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। তার মধ্যে ৭৫২ জন দ-িত হয়। খালাস পায় ২ হাজার ৯৬ জন। সাধারণ ক্ষমায় ৩৭ হাজারের মধ্যে ২৬ হাজার ছাড়া পেয়েছিলেন। ১১ হাজারের বেশি ব্যক্তি আটক ছিল। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এর পর ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিচারপতি সায়েম ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার দালাল আইন বাতিল করে। ফলে এই ১১ হাজার ব্যক্তির পক্ষে আপীল করে জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ॥ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের সর্ববৃহৎ দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইস্তেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা উল্লেখ করে। নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয়। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহ (ট্রাইবুনালস) আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী। সেই অনুযায়ীই ২০১০ সালের ২৫ মার্চ পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে স্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মামলার কথা বিবেচনা করে ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এর মধ্যে বাচ্চু রাজাকারের মামরায় রায় ঘোষিত হয়েছে। এখন যাদের মামলা রয়েছে তাঁরা হলেন, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আরেক নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সুবহান, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, হাজী মোবারক ও পটুয়াখালীর রুস্তম আলী। এদের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ বিচার চলছে, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, ও সাবেক মন্ত্রী বিএনপি নেতা এমএ আলীমের।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে জামায়াতে ইসলামী, মুসলীম লীগ, নেজামে ইসলাম পাটি, পিডিপি ইত্যাদি ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ও শান্তি কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং তাদের সহযোগী ঘাতক বাহিনী আল-বদর, আল-শামস, সিভিল পাইওনিয়ার ফোর্সের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় চালানো হয় হত্যাযজ্ঞ। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কামান্ডের কাছে তাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালীর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
গণতদন্ত কমিশন ॥ জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয় ১৯৯২ সালে। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণআদালতে গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার অনুষ্ঠিত হয়। ওই বিচারে প্রায় ৫ লাখ লোকের সমাগত ঘটেছিল। ১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোলাম আযমের বিচারের যৌক্তিকতা তুলে ধরে এবং ২৪ বরেণ্য নাগরিকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদোহের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তখন জাতীয় সংসদে এক অসাধরণ ভাষণ দিয়েছিলেন।
তখন সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিরোধী দলের চাপে এবং জাহানারা ইমামের তুঙ্গস্পর্শী আন্দোলনে সরকার ২৯ জুন ’৯২ তারিখে বিরোধী দলের সঙ্গে চার দফা চুক্তিতে বাধ্য হয় যে চুক্তির প্রথম দুই দফা ছিল সরকার যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার করবে এবং গণআদালতের উদ্যোক্তা ২৪ জন বরেণ্য নাগরিকের বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করবে। বিরোধী দলকে সংসদের আনার জন্য খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার এ ধরনের চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করে গোলাম আযমের বিচার করার বদলে খালেদা জিয়া তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করেন। শত হয়রানি ও নির্যাতন সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নির্মূল কমিটি ১০ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিল।
একটি শূন্যতা ॥ ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর জাতীয় সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সূচিত একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের এই আন্দোলনের গুরুত্বের কথা বিবেচনায় রেখে রাজপথে এই আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য ১৯৯৫ সালে নির্মূল কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
একমাত্র শাস্তি ॥ শাহরিয়ার কবিরের সম্পাদনায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার গ্রন্থে বলা হয়েছে, প্রাচীন গ্রীসে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য বিবরণ পাওয়া যাবে গ্রীক পুরাণে। তখনও যুদ্ধাপরাধীদের একমাত্র শাস্তি ছিল মৃত্যুদ-। ১৪৭৪ সালে হাগেনবাখের স্যার পিটারকে যুদ্ধাপরাধের জন্য মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছিল। বযুরের যুদ্ধের পর গ্রেট ব্রিটেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ভিয়েনা কংগ্রেস পরাজিত ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়নকে অপরাধী ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকারের নিকট অর্পণ করে। নেপোলিয়ানকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হয়।
যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা ॥ ১৮৬৪ সালে জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা নির্ণয় করা হয়। এর পর ১৮৯৯, ১৯০০ও ১৯০৭ সালে ইউরোপে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন কনভেনশনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি পরাজিত জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯২০ সালে যুদ্ধাপরাধের ৪৫টি মামলার দায়িত্ব গ্রহণ করে জার্মানি। এর মধ্যে ১২ জনের বিচার করে ৬ জনকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়।
নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল ॥ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যুগান্তকারী আদালত বসেছিল জার্মানির নুরেমবার্গে। এর পাশাপাশি জাপানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত হয় টোকিও ট্রাইব্যুনাল। এই দুই ট্রাইব্যুনালে বিচার্য অপরাধসমূহকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। (১) যুদ্ধাপরাধ (২) শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ (৩) মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
কখন বিপর্যয় ঘটে ॥ মানব জাতির ইতিহাসে নৃশংসতম গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) সময়। জার্মানিতে হিটলারের নাৎসী বাহিনী, ইটালিতে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট বাহিনী এবং প্রাচ্যে জেনারেল তোজোর জাপানী বাহিনীর যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে বর্বরতম অপরাধের কথা বিশ্ববাসী কখনও ভুলবে না। হিটলারের নাৎসী বাহিনী এবং তাদের সহযোগী গেস্টাপো ও অন্যান্য বাহিনী যেভাবে ইহুদী, কমিউনিস্ট ও অজার্মানদের হত্যা করেছে সভ্যতার ইতিহাসে তার কোন নজির নেই।
মানবতাবিরোধী অপরাধ ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় রাজাকার আলবদর আলশামস মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। দীর্ঘদিন পরে হলেও তাদের বিচার শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করেছে। ট্রাইব্যুনালের এটিই প্রথম রায়। ১৯৭৩ সালে নবেম্বর মাসে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য করার অবকাশ থাকে, তা হলো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সময়টি। যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধী ও গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্য জুলাই মাসে সংবিধান সংশোধনের ও আইন প্রণয়ন করে আরেকটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলেও মাত্র চার মাসের মাথায় এই ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। যদিও ঘোষণার মুখবন্ধে বলা হয়েছিল দেশদ্রোহিতা, হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি, অগ্নিসংযোগ অপরাধীরা ক্ষমা পাবে না।
সর্বপ্রথম সংশোধনী পর ॥ সংবিধানে প্রথম সংশোধনীর পর ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩ পাস হয়। এর খসড়া রচনা করেছেন বাংলাদেশ, ভারত এবং ইউরোপের বিশিষ্ট আইনজ্ঞগণ। এই আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেই সময় জেনেভায় বাংলাদেশ মিশনের প্রধান, পরবর্তীকালে সচিব কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান। এই আইন প্রণয়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ১৯৭২ সালেই একটি সেল গঠন করেন। তাঁকে সহায়তা করেন, বিচারপতি এফকেএমএ মুনিম, প্রবীণ আইনজীবী সবিতা রঞ্জন পাল, সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল ফকির শাহাবুদ্দিন আহম্মেদ, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেমদ, তৎকালীন আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব নাসিম উদ্দিন আহম্মেদ, ব্যারিস্টার হারুনুর রশিদ, সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম ও ওয়ালিউর রহমান। এ ছাড়া এই আইন প্রণয়নে সহায়তা করে ভারতের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার দিপঙ্কর ঘোষ, ইউরোপের প্রফেসর ইয়েশেক ও অটোভন ট্রিফটাপরার। শেষের দুজন নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন ॥ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) গঠন করেন। এতে করে সারাদেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। দালাল আইন জারির পর ১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ থেকে ৩৭ হাজার ৪১৭ জন দালালকে গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের বিচার। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ২ হাজার ৮৪৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। তার মধ্যে ৭৫২ জন দ-িত হয়। খালাস পায় ২ হাজার ৯৬ জন। সাধারণ ক্ষমায় ৩৭ হাজারের মধ্যে ২৬ হাজার ছাড়া পেয়েছিলেন। ১১ হাজারের বেশি ব্যক্তি আটক ছিল। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এর পর ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিচারপতি সায়েম ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার দালাল আইন বাতিল করে। ফলে এই ১১ হাজার ব্যক্তির পক্ষে আপীল করে জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ॥ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের সর্ববৃহৎ দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইস্তেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা উল্লেখ করে। নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয়। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহ (ট্রাইবুনালস) আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী। সেই অনুযায়ীই ২০১০ সালের ২৫ মার্চ পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে স্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মামলার কথা বিবেচনা করে ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এর মধ্যে বাচ্চু রাজাকারের মামরায় রায় ঘোষিত হয়েছে। এখন যাদের মামলা রয়েছে তাঁরা হলেন, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আরেক নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সুবহান, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, হাজী মোবারক ও পটুয়াখালীর রুস্তম আলী। এদের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ বিচার চলছে, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, ও সাবেক মন্ত্রী বিএনপি নেতা এমএ আলীমের।
No comments