বাঙালীর ব্যবসা বইয়ের অগ্রযাত্রা ও প্রকাশনা শিল্প by মিলু শামস
ন্যাথানিয়েল ব্রাসিহ্যালহেডের অভারতীয়দের
বাংলা শেখানোর ‘মহৎ’ উদ্দেশ্যের সঙ্গে আজকের বিশ্ব অধিপতি ইংরেজী ভাষীদের
ম্যান্ডারিন শেখার তেমন পার্থক্য বোধ হয় নেই।
ভারতবর্ষে
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তেরো বছর পর হ্যালহেড
ব্যাকরণনির্ভর বাংলা শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন নিশ্চয় বাংলা ভাষার প্রতি
অপরিসীম মমতা থেকে নয়। এ দেশে বাণিজ্য করতে এসে স্থানীয় ভাষায় অভ্যস্ত হতে
না পারলে অসুবিধা অনেক। এটুকু বোঝার দূরদর্শিতা তাদের ছিল।
হ্যালহেডের পটভূমি ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতবর্ষ। আর আজকের প্রেক্ষাপট প্রত্যক্ষ উপনিবেশমুক্ত দুনিয়া হলেও মূল উদ্দেশ্য একই। যে ছাপা মেশিনের কারণে বাঙালীদের কাছে হ্যালহেড স্মরণীয় হয়ে আছেন, সেই ছাপা মেশিনের বিবর্তনের সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রকাশনা জগতও আজ অনেক বিকশিত। অনেক বেশি প্রফেশনাল। অবশ্য এ বিষয়ে হ্যালহেডের অবদান নেই। ব্রিটিশ বণিক এবং শাসকেরা বাঙালীদের ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার সুযোগ গলাটিপে হত্যা করেছে। ভারতের বোম্বাই, মাদ্রাজ ইত্যাদি শহর যখন বাণিজ্য তরীর পালে হাওয়া লাগিয়ে তরতরিয়ে এগুচ্ছে বাংলা তখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূমিতে শেকড় গেড়ে অনড় বসে আছে। জমিদার শ্রেণীরু হাতে যে পুঁজি জমেছিল তা তারা ভূসম্পত্তি বাড়াতেই ব্যয় করেছে, ব্যবসা বা শিল্প বিনিয়োগে নয়। সে সুযোগ যে পরিকল্পিতভাবেই সঙ্কুচিত করে রেখেছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তক লর্ড কর্নওয়ালিস ও তার সহযোগীরা তা বোঝা যায় কর্নওয়ালিসের বক্তব্য থেকেই ‘আমাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই এ দেশের ভূস্বামীদের আমাদের সহযোগী করে নিতে হবে। যে ভূস্বামী একটি লাভজনক ভূসম্পত্তি নিশ্চিন্ত মনে ও সুখে শান্তিতে ভোগ করতে পারে তার মনে এর কোনরকম পরিবর্তনের ইচ্ছা জাগতেই পারে না। বিনয় ঘোষের ‘সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র’ থেকে জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাছে এক চিঠিতে তিনি লিখছেন ‘ভূমিস্বত্বকে নিরাপদ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই এদেশীয়দের হাতে যে বিরাট পুঁজি আছে সেটাকে তারা অন্য কোনভাবে নিয়োগ করার উপায় না দেখে ভূসম্পত্তি ক্রয়ের উদ্দেশ্যেই ব্যয় করবে।’ এ কাজ সহজ করতে এবং ব্যবসা ও শিল্প খাতে পুঁজি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে ইংরেজ সরকার আইন প্রণয়নসহ গোটা পরিবেশই প্রতিকূল করে রেখেছিল। পাশাপাশি উন্মুক্ত রেখেছিল ভূমিস্বত্ব কেনার সহজ ব্যবস্থা। বাঙালী স্বভাবত তাই মাটির দিকেই ঝুঁকেছে। ইংরেজের সঙ্গে শিল্প ব্যবসা বিনিময়ে নিজ দেশে ইংরেজ হয়েছে শিল্প পুঁজিপতি আর বাঙালী দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রিন্স উপাধি নিয়ে শেষ পর্যন্ত জমিদারীর গ-িতেই আটকে থাকেন, দেশীয় শিল্প বিকাশে অবদান রাখতে পারেন না। আজও ব্যবসায়ী হিসেবে বাঙালী তেমন সুনাম কুড়াতে পারেনি।
আর দশটা পণ্য নিয়ে বাঙালী ব্যবসায়ী যেখানে পুরোপুরি পেশাদার হতে পারে না সেখানে বইয়ের মতো পণ্য নিয়ে এগুনো কি সম্ভব? এ প্রশ্ন পিছনে ফেলে দেশের প্রকাশনা জগত আজ অনেক দূর এগিয়েছে। ‘প্রকাশনা শিল্প’ কথাটা অনায়াসে উচ্চারণ করা যাচ্ছে আমাদের দেশেও। সবাই জানেন এর পেছনে অমর একুশে বইমেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এ শিল্পের গতি দ্রুত বাড়িয়েছে। প্রকাশনার পেছনের কাজ ও ঝামেলা অনেক কমেছে। খুব অল্প সময়ে বাজারজাত করা যায় বলে প্রচুর বই বাজারে আসছে। ভেতরে বিষয় যাই থাক প্রকাশনার মান বেড়েছে। প্রকাশকের সংখ্যা বেড়েছে। শিক্ষিত তরুণেরা এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এতে আধুনিকতার ছোঁয়া আছে পুরো মাত্রায়, স্বাধীনতার পর নানা সঙ্কট পেরিয়ে প্রকাশনা শিল্প এগিয়ে চললেও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এক লাফে তাকে এগিয়ে দিয়েছে অনেক দূর। টেলিভিশনের ঝড়ো হাওয়ার ঝাপ্টায় চেনা পরিবেশ অচেনা হয়ে ওঠা ও তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশে বার বার সেই চেনা প্রশ্নটি উঠেছেÑ বই কি হারিয়ে যাবে? ভেঙ্গে পড়বে কি প্রকাশনা শিল্পের ভিত? সব আশঙ্কা পাশকাটিয়ে প্রকাশনা শিল্পের অগ্রগামী যাত্রা নিশ্চিত করেছে যে, বই হারাবে না। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে বই সাংঘর্ষিক নয়। বরং এর ব্যবহার বইয়ের উৎকর্ষ বাড়িয়েছে। বই উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের পেশাদার হওয়ার সুযোগ হাতের মুঠোয় পৌঁছে দিয়েছে। লেখার এবং কেনার প্রবণতাও এতে বেড়েছে। যে কেউ যে কোন বিষয় নিয়ে লিখছে। রান্না, রূপচর্চা, ফ্যাশন, লাইফ স্টাইলÑ সব কিছু নিয়ে বই হচ্ছে আজকাল। দশম শ্রেণীতে পড়ুয়ারও দুটো কবিতা কিংবা গল্পের বই, গৃহবধূর দু’খানা লাইফ স্টাইল বা রান্নাবিষয়ক বই, চাকরিজীবীর গদ্যপদ্য মিলিয়ে হাফ ডজন বই থাকা আজকাল প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা। কিছু লিখলেই তা নিখুঁত বই হয়ে আসছে সহজেই। এই বিপুলসংখ্যক বই চিন্তা বা মননশীলতার জগতে কি অবদান রাখছেÑতা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলেও প্রকাশনা শিল্প বিকাশে অবদান রাখছে। যার অর্থ বই এক লাভজনক পণ্যে পরিণত হচ্ছে।
বাংলা একাডেমীর পরিসংখ্যান মতে, গত বছর একুশের বইমেলায় নতুন বই এসেছিল তিন হাজার ছয় শ’ ঊনসত্তরটি আর বিক্রি হয়েছিল ছাবিবশ কোটি টাকার। ক্রেতা-পাঠকের উপস্থিতিও নাকি ছিল আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। মাসজুড়ে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষের আগমন হয়েছিল মেলা প্রাঙ্গণে। একাডেমির জরিপে বেরিয়ে এসেছেÑআটাশ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুধু বাংলা একাডেমীরই বিক্রি হয়েছে বিরাশি লাখ তেপ্পান্ন হাজার টাকার বই। আগের বছর এ হার ছিল বাহাত্তর লাখ তিরাশি হাজার টাকা। সে বছর বই এসেছিল তিন হাজার তেরোটি। এবারের মেলায় চার হাজারের বেশি বই আসার সম্ভবনা রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে বইয়ের সংখ্যা ও বিক্রি দুই-ই বাড়ছে।
বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক জানিয়েছেন, একুশের বইমেলার ইতিহাসে এবারই প্রথম মেলা হবে ‘প্রকাশকদের মেলা।’ প্রকাশকদের বাইরে এবার কোন স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র নীতিমালা মেনেই এবার মেলা পরিচালিত হচ্ছে। উটকো প্রকাশক, সংগঠনের নামে স্টল বরাদ্দ নিয়ে বই বিক্রির যে হিড়িক অন্যান্য বার থাকে এবার তা থাকছে না। এগুলো ঠিকঠাকভাবে মানা গেলে প্রকাশনার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বইমেলা হিসেবে পরিচিত ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা ও প্রকাশকদের মেলা। প্রায় পাঁচ শ’ বছরের পুরনো এ আন্তর্জাতিক বইমেলার প্রথম তিনদিন বরাদ্দ প্রকাশক এবং প্রকাশনার সঙ্গে জড়িতদের জন্য। এ তিনদিন অন্য কারও মেলায় প্রবেশ নিষেধ। চার বছর আগের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দু’হাজার নয় সালে এ মেলায় চার লাখের মতো বই এসেছিল। অংশ নেয়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল তিন শ’ চৌদ্দটি। এ সব পরিসংখ্যান বইয়ের অগ্রগামী অভিযাত্রার চিত্রই তুলে ধরে।
তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলা যায়, প্রকাশনা শিল্প যত দৃঢ় হচ্ছে ভাল লেখকের ঘাটতি ততই প্রকট হচ্ছে। এ দেশের প্রকাশনা শিল্প নিজ পায়ে দাঁড়ানোর দৃঢ়তা অর্জনে হুমায়ূন আহমেদের অবদান অনেক। তাঁর প্রায় প্রতিটি বইয়ের লাখের বেশি পাঠক ছিল। তাঁর আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা এ দেশে পাঠকের অস্তিত্বের কথাও মনে করিয়ে দেয়। সে পাঠকের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে পাঠকের মান বাড়ানোর দায় কিন্তু খানিকটা লেখকের ওপরও বর্তায়। দায়িত্বের প্রশ্নে হমায়ুন আহমেদকে সাহিত্রের কারিগড়ায় দাঁড়াতেই হবে।
প্রকাশকদের দায়ও কিছু কম নয়। দায়িত্বশীল প্রকাশকদের সহযোগিতায় অনেক প্রতিশ্রুতিশীল কবি-সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছেনÑএমন দৃষ্টান্ত পশ্চিম বাংলায় অনেক আছে। ব্যবসার ক্ষতি না করেও এটা করা যায়। ঘটনাক্রমে একজন লেখক বাজার পেয়ে গেলেনÑব্যস, তাকে নিয়ে কর্পোরেট বাণিজ্য পাপড়ি মেলতে থাকে। প্রতিশ্রুতিশীল বা ক্ষমতাবান অন্য লেখকরা পাত্তাই পান না। পেশাদারিত্বের নামে এ ধরনের মানসিকতা ভাষা-সাহিত্যের বিকাশে তেমন কোন অবদান রাখতে তো পারেই না বরং ক্ষতি করে। কলকাতার দায়িত্বশীর প্রকাশনী ‘প্রতিক্ষণ’-এর কর্ণধার প্রিয়ব্রত দেব এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেনÑ ‘প্রকাশকদের কাজ শুধু বই প্রকাশ আর বেচা নয়। পাঠক তৈরি করাও তাদের দায়িত্ব। নতুন লেখক তৈরিতে মন দেয়া প্রয়োজন। প্রকাশনা একটি সম্ভ্রান্ত ব্যবসা। প্রকাশনার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের সমাজের প্রতি একটা দায়িত্ব আছে। বই মানব সভ্যতার অগ্রগতির ঐতিহাসিক দলিল। তাই পাঠককে উন্নততর রুচির সন্ধান দেয়া প্রয়োজন।’ বাণিজ্যিকে উপেক্ষা না করেও এ কমিটমেন্ট পালন করা যায়। কমিটমেন্ট পেশাদায়িত্বের অংশ।
পৃথিবীর সাত হাজারের বেশি জীবিত ভাষার মধ্যে বাংলার অবস্থান ষষ্ঠ। একই ভাষা গোষ্ঠীর ফরাসী বা জার্মান ভাষীরা সংখ্যায় অল্প হয়েও নিজেদের ভাষায় জাতীয় জীবন নিয়ন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিকভাবে উল্লেখযোগ্য জায়গা দখল করে আছে। পৃথিবীতে এখন ফরাসী ভাষায় কথা বলছে ছয় কোটি আশি লাখ মানুষ। জার্মান ভাষায় নয় কোটি আর বাংলায় কথা বলছে আঠার কোটি দশ লাখের বেশি মানুষ। পরিসংখ্যানেই কেবল বাংলা, ফারাসী ও জার্মানের দ্বিগুণ বা তার বেশি এগিয়ে আছে। কাজেকর্মে পিছিয়ে আছে যোজন যোজন দূর।
আমাদের ঔপনিবেশিক পূর্বসূরিতা এর অন্যতম কারণ। আমাদের পুঁজির শক্তি নেই। ভাষার কণ্ঠও তাই ক্ষীণ। ইংরেজরা ভারতে আসার আগে ভারত ও চীনের আর্থ-সামাজিক অবস্থা প্রায় একই ধরনের ছিল। কিন্তু চীনে ঔপনিবেশিক আধিপত্য ঢুকতে না পারায় আজ তারা বিশ্বে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হতে যাচ্ছে। তাদের ভাষাকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলোও। আর আমরা আজও রাজনীতি অর্থনীতির সবকিছুতে ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার নিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি। যার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই ভাষা-সাহিত্যেও পড়েছে। এ অবস্থা কি চলতেই থাকবে? রাষ্ট্রের বয়স একচল্লিশ। সেই যে আঠারো শতকে কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফাঁদে আটকে ভূ-স্বামীদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেনÑএদের মনে পরিবর্তনের কোন রকম ইচ্ছা জাগতেই পারে না। আমাদের শাসক শ্রেণীর জমিদাররা এই দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বেরোতে পারেননি আজও। এই এ হীনম্মন্যতা থেকে বেরোতে শিক্ষা-দীক্ষা আত্মমর্যাদার বোধ বাড়াতে হবে। আর এর সঙ্গে ভাষা-সাহিত্য বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং সাহিত্যকে যারা ছাপার অক্ষরে মানুষের হাতে পৌঁছে দেন তারা ব্যবসায়ে অবদান রাখার পাশাপাশি নিজেদের দায়িত্বের গুরুত্বও বুঝবেন এমন সঙ্গত আশা করাই যায়।
হ্যালহেডের পটভূমি ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতবর্ষ। আর আজকের প্রেক্ষাপট প্রত্যক্ষ উপনিবেশমুক্ত দুনিয়া হলেও মূল উদ্দেশ্য একই। যে ছাপা মেশিনের কারণে বাঙালীদের কাছে হ্যালহেড স্মরণীয় হয়ে আছেন, সেই ছাপা মেশিনের বিবর্তনের সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রকাশনা জগতও আজ অনেক বিকশিত। অনেক বেশি প্রফেশনাল। অবশ্য এ বিষয়ে হ্যালহেডের অবদান নেই। ব্রিটিশ বণিক এবং শাসকেরা বাঙালীদের ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার সুযোগ গলাটিপে হত্যা করেছে। ভারতের বোম্বাই, মাদ্রাজ ইত্যাদি শহর যখন বাণিজ্য তরীর পালে হাওয়া লাগিয়ে তরতরিয়ে এগুচ্ছে বাংলা তখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূমিতে শেকড় গেড়ে অনড় বসে আছে। জমিদার শ্রেণীরু হাতে যে পুঁজি জমেছিল তা তারা ভূসম্পত্তি বাড়াতেই ব্যয় করেছে, ব্যবসা বা শিল্প বিনিয়োগে নয়। সে সুযোগ যে পরিকল্পিতভাবেই সঙ্কুচিত করে রেখেছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তক লর্ড কর্নওয়ালিস ও তার সহযোগীরা তা বোঝা যায় কর্নওয়ালিসের বক্তব্য থেকেই ‘আমাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই এ দেশের ভূস্বামীদের আমাদের সহযোগী করে নিতে হবে। যে ভূস্বামী একটি লাভজনক ভূসম্পত্তি নিশ্চিন্ত মনে ও সুখে শান্তিতে ভোগ করতে পারে তার মনে এর কোনরকম পরিবর্তনের ইচ্ছা জাগতেই পারে না। বিনয় ঘোষের ‘সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র’ থেকে জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাছে এক চিঠিতে তিনি লিখছেন ‘ভূমিস্বত্বকে নিরাপদ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই এদেশীয়দের হাতে যে বিরাট পুঁজি আছে সেটাকে তারা অন্য কোনভাবে নিয়োগ করার উপায় না দেখে ভূসম্পত্তি ক্রয়ের উদ্দেশ্যেই ব্যয় করবে।’ এ কাজ সহজ করতে এবং ব্যবসা ও শিল্প খাতে পুঁজি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে ইংরেজ সরকার আইন প্রণয়নসহ গোটা পরিবেশই প্রতিকূল করে রেখেছিল। পাশাপাশি উন্মুক্ত রেখেছিল ভূমিস্বত্ব কেনার সহজ ব্যবস্থা। বাঙালী স্বভাবত তাই মাটির দিকেই ঝুঁকেছে। ইংরেজের সঙ্গে শিল্প ব্যবসা বিনিময়ে নিজ দেশে ইংরেজ হয়েছে শিল্প পুঁজিপতি আর বাঙালী দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রিন্স উপাধি নিয়ে শেষ পর্যন্ত জমিদারীর গ-িতেই আটকে থাকেন, দেশীয় শিল্প বিকাশে অবদান রাখতে পারেন না। আজও ব্যবসায়ী হিসেবে বাঙালী তেমন সুনাম কুড়াতে পারেনি।
আর দশটা পণ্য নিয়ে বাঙালী ব্যবসায়ী যেখানে পুরোপুরি পেশাদার হতে পারে না সেখানে বইয়ের মতো পণ্য নিয়ে এগুনো কি সম্ভব? এ প্রশ্ন পিছনে ফেলে দেশের প্রকাশনা জগত আজ অনেক দূর এগিয়েছে। ‘প্রকাশনা শিল্প’ কথাটা অনায়াসে উচ্চারণ করা যাচ্ছে আমাদের দেশেও। সবাই জানেন এর পেছনে অমর একুশে বইমেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এ শিল্পের গতি দ্রুত বাড়িয়েছে। প্রকাশনার পেছনের কাজ ও ঝামেলা অনেক কমেছে। খুব অল্প সময়ে বাজারজাত করা যায় বলে প্রচুর বই বাজারে আসছে। ভেতরে বিষয় যাই থাক প্রকাশনার মান বেড়েছে। প্রকাশকের সংখ্যা বেড়েছে। শিক্ষিত তরুণেরা এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এতে আধুনিকতার ছোঁয়া আছে পুরো মাত্রায়, স্বাধীনতার পর নানা সঙ্কট পেরিয়ে প্রকাশনা শিল্প এগিয়ে চললেও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এক লাফে তাকে এগিয়ে দিয়েছে অনেক দূর। টেলিভিশনের ঝড়ো হাওয়ার ঝাপ্টায় চেনা পরিবেশ অচেনা হয়ে ওঠা ও তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশে বার বার সেই চেনা প্রশ্নটি উঠেছেÑ বই কি হারিয়ে যাবে? ভেঙ্গে পড়বে কি প্রকাশনা শিল্পের ভিত? সব আশঙ্কা পাশকাটিয়ে প্রকাশনা শিল্পের অগ্রগামী যাত্রা নিশ্চিত করেছে যে, বই হারাবে না। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে বই সাংঘর্ষিক নয়। বরং এর ব্যবহার বইয়ের উৎকর্ষ বাড়িয়েছে। বই উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের পেশাদার হওয়ার সুযোগ হাতের মুঠোয় পৌঁছে দিয়েছে। লেখার এবং কেনার প্রবণতাও এতে বেড়েছে। যে কেউ যে কোন বিষয় নিয়ে লিখছে। রান্না, রূপচর্চা, ফ্যাশন, লাইফ স্টাইলÑ সব কিছু নিয়ে বই হচ্ছে আজকাল। দশম শ্রেণীতে পড়ুয়ারও দুটো কবিতা কিংবা গল্পের বই, গৃহবধূর দু’খানা লাইফ স্টাইল বা রান্নাবিষয়ক বই, চাকরিজীবীর গদ্যপদ্য মিলিয়ে হাফ ডজন বই থাকা আজকাল প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা। কিছু লিখলেই তা নিখুঁত বই হয়ে আসছে সহজেই। এই বিপুলসংখ্যক বই চিন্তা বা মননশীলতার জগতে কি অবদান রাখছেÑতা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলেও প্রকাশনা শিল্প বিকাশে অবদান রাখছে। যার অর্থ বই এক লাভজনক পণ্যে পরিণত হচ্ছে।
বাংলা একাডেমীর পরিসংখ্যান মতে, গত বছর একুশের বইমেলায় নতুন বই এসেছিল তিন হাজার ছয় শ’ ঊনসত্তরটি আর বিক্রি হয়েছিল ছাবিবশ কোটি টাকার। ক্রেতা-পাঠকের উপস্থিতিও নাকি ছিল আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। মাসজুড়ে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষের আগমন হয়েছিল মেলা প্রাঙ্গণে। একাডেমির জরিপে বেরিয়ে এসেছেÑআটাশ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুধু বাংলা একাডেমীরই বিক্রি হয়েছে বিরাশি লাখ তেপ্পান্ন হাজার টাকার বই। আগের বছর এ হার ছিল বাহাত্তর লাখ তিরাশি হাজার টাকা। সে বছর বই এসেছিল তিন হাজার তেরোটি। এবারের মেলায় চার হাজারের বেশি বই আসার সম্ভবনা রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে বইয়ের সংখ্যা ও বিক্রি দুই-ই বাড়ছে।
বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক জানিয়েছেন, একুশের বইমেলার ইতিহাসে এবারই প্রথম মেলা হবে ‘প্রকাশকদের মেলা।’ প্রকাশকদের বাইরে এবার কোন স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র নীতিমালা মেনেই এবার মেলা পরিচালিত হচ্ছে। উটকো প্রকাশক, সংগঠনের নামে স্টল বরাদ্দ নিয়ে বই বিক্রির যে হিড়িক অন্যান্য বার থাকে এবার তা থাকছে না। এগুলো ঠিকঠাকভাবে মানা গেলে প্রকাশনার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বইমেলা হিসেবে পরিচিত ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা ও প্রকাশকদের মেলা। প্রায় পাঁচ শ’ বছরের পুরনো এ আন্তর্জাতিক বইমেলার প্রথম তিনদিন বরাদ্দ প্রকাশক এবং প্রকাশনার সঙ্গে জড়িতদের জন্য। এ তিনদিন অন্য কারও মেলায় প্রবেশ নিষেধ। চার বছর আগের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দু’হাজার নয় সালে এ মেলায় চার লাখের মতো বই এসেছিল। অংশ নেয়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল তিন শ’ চৌদ্দটি। এ সব পরিসংখ্যান বইয়ের অগ্রগামী অভিযাত্রার চিত্রই তুলে ধরে।
তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলা যায়, প্রকাশনা শিল্প যত দৃঢ় হচ্ছে ভাল লেখকের ঘাটতি ততই প্রকট হচ্ছে। এ দেশের প্রকাশনা শিল্প নিজ পায়ে দাঁড়ানোর দৃঢ়তা অর্জনে হুমায়ূন আহমেদের অবদান অনেক। তাঁর প্রায় প্রতিটি বইয়ের লাখের বেশি পাঠক ছিল। তাঁর আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা এ দেশে পাঠকের অস্তিত্বের কথাও মনে করিয়ে দেয়। সে পাঠকের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে পাঠকের মান বাড়ানোর দায় কিন্তু খানিকটা লেখকের ওপরও বর্তায়। দায়িত্বের প্রশ্নে হমায়ুন আহমেদকে সাহিত্রের কারিগড়ায় দাঁড়াতেই হবে।
প্রকাশকদের দায়ও কিছু কম নয়। দায়িত্বশীল প্রকাশকদের সহযোগিতায় অনেক প্রতিশ্রুতিশীল কবি-সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছেনÑএমন দৃষ্টান্ত পশ্চিম বাংলায় অনেক আছে। ব্যবসার ক্ষতি না করেও এটা করা যায়। ঘটনাক্রমে একজন লেখক বাজার পেয়ে গেলেনÑব্যস, তাকে নিয়ে কর্পোরেট বাণিজ্য পাপড়ি মেলতে থাকে। প্রতিশ্রুতিশীল বা ক্ষমতাবান অন্য লেখকরা পাত্তাই পান না। পেশাদারিত্বের নামে এ ধরনের মানসিকতা ভাষা-সাহিত্যের বিকাশে তেমন কোন অবদান রাখতে তো পারেই না বরং ক্ষতি করে। কলকাতার দায়িত্বশীর প্রকাশনী ‘প্রতিক্ষণ’-এর কর্ণধার প্রিয়ব্রত দেব এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেনÑ ‘প্রকাশকদের কাজ শুধু বই প্রকাশ আর বেচা নয়। পাঠক তৈরি করাও তাদের দায়িত্ব। নতুন লেখক তৈরিতে মন দেয়া প্রয়োজন। প্রকাশনা একটি সম্ভ্রান্ত ব্যবসা। প্রকাশনার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের সমাজের প্রতি একটা দায়িত্ব আছে। বই মানব সভ্যতার অগ্রগতির ঐতিহাসিক দলিল। তাই পাঠককে উন্নততর রুচির সন্ধান দেয়া প্রয়োজন।’ বাণিজ্যিকে উপেক্ষা না করেও এ কমিটমেন্ট পালন করা যায়। কমিটমেন্ট পেশাদায়িত্বের অংশ।
পৃথিবীর সাত হাজারের বেশি জীবিত ভাষার মধ্যে বাংলার অবস্থান ষষ্ঠ। একই ভাষা গোষ্ঠীর ফরাসী বা জার্মান ভাষীরা সংখ্যায় অল্প হয়েও নিজেদের ভাষায় জাতীয় জীবন নিয়ন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিকভাবে উল্লেখযোগ্য জায়গা দখল করে আছে। পৃথিবীতে এখন ফরাসী ভাষায় কথা বলছে ছয় কোটি আশি লাখ মানুষ। জার্মান ভাষায় নয় কোটি আর বাংলায় কথা বলছে আঠার কোটি দশ লাখের বেশি মানুষ। পরিসংখ্যানেই কেবল বাংলা, ফারাসী ও জার্মানের দ্বিগুণ বা তার বেশি এগিয়ে আছে। কাজেকর্মে পিছিয়ে আছে যোজন যোজন দূর।
আমাদের ঔপনিবেশিক পূর্বসূরিতা এর অন্যতম কারণ। আমাদের পুঁজির শক্তি নেই। ভাষার কণ্ঠও তাই ক্ষীণ। ইংরেজরা ভারতে আসার আগে ভারত ও চীনের আর্থ-সামাজিক অবস্থা প্রায় একই ধরনের ছিল। কিন্তু চীনে ঔপনিবেশিক আধিপত্য ঢুকতে না পারায় আজ তারা বিশ্বে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হতে যাচ্ছে। তাদের ভাষাকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলোও। আর আমরা আজও রাজনীতি অর্থনীতির সবকিছুতে ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার নিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি। যার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই ভাষা-সাহিত্যেও পড়েছে। এ অবস্থা কি চলতেই থাকবে? রাষ্ট্রের বয়স একচল্লিশ। সেই যে আঠারো শতকে কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফাঁদে আটকে ভূ-স্বামীদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেনÑএদের মনে পরিবর্তনের কোন রকম ইচ্ছা জাগতেই পারে না। আমাদের শাসক শ্রেণীর জমিদাররা এই দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বেরোতে পারেননি আজও। এই এ হীনম্মন্যতা থেকে বেরোতে শিক্ষা-দীক্ষা আত্মমর্যাদার বোধ বাড়াতে হবে। আর এর সঙ্গে ভাষা-সাহিত্য বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং সাহিত্যকে যারা ছাপার অক্ষরে মানুষের হাতে পৌঁছে দেন তারা ব্যবসায়ে অবদান রাখার পাশাপাশি নিজেদের দায়িত্বের গুরুত্বও বুঝবেন এমন সঙ্গত আশা করাই যায়।
No comments