দেশের অর্থে পদ্মা সেতু ॥ সাহসী পদক্ষেপ by অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। গল্পটির উৎপত্তিস্থল গফরগাঁও বাজার। এক তরুণ উর্ধশ্বাসে দৌড়ে বাজার ছেড়ে বাড়ি মুখে যাচ্ছে আর উচ্চস্বরে বলছে, ‘মানির মান আল্লাহই রাখে।’ তার এই কথার অর্থ জানার জন্য তাকে থামাতে চেষ্টা করে অনেকেই ব্যর্থ হয়, কিন্তু একজন সাহসী যুবক তাকে ঠিকই ধরে ফেলেন।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানির মান আল্লাহ্ রাখে’ কথাটার মানে কি? দৌড় থামিয়ে এবার তরুণটি বলল যে, ‘কিছু সংখ্যক লোক বাজারে বাজানকে (আব্বুকে) জুতা দিয়ে পিটাচ্ছে। সে কা- দেখে আমি ভোঁ দৌড় দিয়েছি, ‘মানির মান আল্লাহই রাখে’। পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে বহু দিন আগে শোনা গল্পটির কথা মনে পড়ে গেল। গল্পটি বলেছিলেন একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও বিদগ্ধ শিক্ষক ড. মনোয়ার উদ্দিন আহমদ।
পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের যখন বিবিধ বিতর্ক, মান-অভিমান লুকোচুরি, অভিযোগ, অনুযোগ চলছে তখন গফরগাঁওয়ের সেই কিশোরটিকে আবছা দেখা যাচ্ছিল। আর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যখন একতরফা ও অন্যায়ভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দিল তখন আবারও ‘মানি’ ব্যক্তিদের আবির্ভাব দেখলাম। মনে হলো কেউ কেউ মুচকি হাসি কিংবা অট্টহাসি হাসছে। তাদের নিবাস এ দেশেই, তারা এ মাটির অন্নজলে মানুষ এবং জাতির অর্থবিত্তে তারা প্রাইমারী থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছে, এ দেশের চাষাভূষা খেটে খাওয়া মানুষের রক্ত চুষে আর বিদেশীদের উলঙ্গ দালালী করে বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হয়ে সুশীল সেজেছেন। তারা বিশ্বব্যাংকের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে সরকারকে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করছেন, সরকার ও আওয়ামী লীগকে এক করে দেখেছেন, শেখ হাসিনা ও দেশের ষোলো কোটি মানুষকে একাকার করে দেখছেন। তাতে খারাপ কি? খারাপটা হচ্ছে তারা বাথটব ছুড়ে ফেলতে গিয়ে হায়েনার হাসি হাসছেন আর ইংরেজী প্রবাদের সেই ঞযৎড়রিহম ঃযব নধনু রিঃয ঃযব নধঃয ঃঁন কথাটির সম্যক প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন।
বিশ্বব্যাংকের অর্থে কোন দুর্নীতি যে ঘটেনি তা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে তারা বলছেন শেখ হাসিনার সরকার ঞধপঃষবংং আচরণ করেই বিশ্বব্যাংককে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে; তার আরও একটু আপোস ও নমনীয় আচরণ বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা শেখ হাসিনার আচরণকে ঞধপঃষবংং বললেও আমরা কিন্তু উচ্চ কণ্ঠে শেখ হাসিনার প্রশংসা করছি। শেখ হাসিনার এই আচরণ আবারও বঙ্গবন্ধুকে আমাদের চোখের সামনে নিয়ে এসেছে।
সেই ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখের কথা। সেদিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড স্বহস্তে গাড়ি চালিয়ে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউর অতি সরু রাস্তা ধরে ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সাথে একান্ত সাক্ষাত করেন। উত্তাল সে সময়ে আলোচনার বিষয়বস্তু তেমন কেউ জানতে পারেননি। তবে আমি পরম সৌভাগ্যবান। সেদিন দুপুরের পর শেখ ফজলুল হক মণি আমাকে নিয়ে পুরানা পল্টনের আওয়ামী লীগ অফিসে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যান। আমরা দু’জন বঙ্গবন্ধুর সাথে একান্তে দেখা করি। বঙ্গবন্ধু তার আলোচনার সারমর্ম আমাদেরকে জানান এবং একটি গুলি খরচ না করেই যুদ্ধ জয়ের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। এরই মাঝে তিনি একটি টেলিফোন কল পান। এই কলটি ছিল ফারল্যান্ডের। ফারল্যান্ড যে কথা সকালে বলেননি তা-ই তখন বঙ্গবন্ধুকে জানালেন। বঙ্গবন্ধু অতি উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন; রাগে উষ্মায় তিনি কাঁপছিলেন। ফারল্যান্ডের প্রস্তাবটি ছিল সিংঙ্গাপুর কায়দায় পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নকরণ, বিনিময়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ। মুহূর্তে তিনি ফারল্যান্ডের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন অর্থাৎ, আমাদের সুশীল ও বিরুদ্ধবাদীদের ভাষায় ঞধপঃষবংং কাজটা করলেন। সেই ঞধপঃষবংং কাজটা না করলে গোলামীর জিঞ্জিরটা আমরা আজও হয়ত পরে বসে থাকতাম। এ জাতীয় ঞধপঃষবংং কাজটা আমরা শেখ হাসিনার মধ্যেও দেখলাম। বঙ্গবন্ধুকে সে জন্য সপরিবারে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। শেখ হাসিনার বরাতে কি আছে জানি না, তবে স্রষ্টা অফুরন্ত মহিমা ও করুণা দিয়ে তাকে যেভাবে বাঁচিয়ে রাখছেন তাতে মনে হয় মহান স্রষ্টা শেখ হাসিনাকে কোন না কোন মহৎ কাজের জন্য রেখেছেন। বিরুদ্ধবাদীদের ঞধপঃষবংং কাজের সংজ্ঞাটা স্পষ্ট নয়। অনেকের মতে, শেখ হাসিনার পক্ষে অতীতে ঞধপঃভঁষ কাজ ছিল বিশ্বব্যাংকের ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, মনগড়া সব কিছু মাথা পেতে নেয়া কিংবা ড. ইউনূসকে আজীবন গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তাব্যক্তি রাখা। বিশ্বব্যাংকের পর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বক্তব্য আরও স্পষ্ট করেছে যে, যুদ্ধাপরাধী ও বিডিআর বিদ্রোহীদের বিচারসহ সকল প্রকার ন্যক্কার ও ঘৃণ্য কাজকে প্রশ্রয় দেয়া হবে ঞধপঃভঁষ বা কৌশলী পদক্ষেপ। এই কৌশলী পদক্ষেপ অন্তত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নিতে পারেন না; তাকে বাবার মতোই তথাকথিত ঞধপঃষবংং হতে হবে এবং তিনি পদ্মা সেতুর ব্যাপারে অনমনীয় অবস্থান নিয়ে এমনটিই করেছেন। আমরা আর কিছু না পারি তাকে প্রাণ খুলে দোয়া করছি আর তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয়ার পর দুর্নীতির সংজ্ঞার হাত-পা গজাতে শুরু করেছে আর বিদগ্ধ সুশীল অর্থনীতিবিদগণ এই পদক্ষেপের মধ্যেও জাতীয় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা থাকতেও পারবেন না, যেতে চাইলে যেতেও পারবেন না, আর ‘কি’ করবেন তা জিজ্ঞাসিত হলে ‘কি’ করতেও নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হচ্ছেন। আমার ধারণা, তাদের কথা অনেক শোনা হয়েছে, আর শোনার প্রয়োজন নেই। তারা সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করবেন, ভালো কাজের পরামর্শ দেবেন, কিন্তু ভালো কাজ হাতে নিতে গেলেও বাধা সৃষ্টি করবেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিহত করে তারা এখন কচুগাছ কাটতে কাটতে ডাকাতে পরিণত হয়েছে। এই ডাকাতদের ঠেকাতে হবে।
নির্দ্বিধায় বলছি দেশের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা অতিশয় সাহসী পদক্ষেপ। আমরা এই পদক্ষেপের সাথে আছি। জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে রাজি আছি, তবুও মাথা নোয়াতে আমরা প্রস্তুত নই। তা আমরা বহুবার প্রমাণ করেছি। আবারও করব।
এ সেতু বানাতে কয়েক পর্বে প্রায় ২২৫৫৪ কোটি টাকা প্রয়োজন। আমার ধারণা, পদ্মা সেতু নিজ অর্থেই নির্মাণ সম্ভব ও সঙ্গত। তাতে হয়ত বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গট হতে পারে। আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের প্রায় এক কোটি শ্রমজীবী মানুষ বিদেশে চাকরি করছেন। পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীও কম নন। তাদের দেশপ্রেম সুশীলদের চেয়ে কিংবা অনেক স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকের চেয়ে অনেক বেশি। আমার ধারণা, জননেত্রী যদি বিদেশে কর্মরতদের কাছে একটি আহ্বান জানান তাহলে তারা বারো হাজার কোটি টাকা বিদেশ থেকে এ বছরই তুলে দেবেন। মাথাপিছু মাত্র ১৫০ ডলার আমাদের বিদেশে কর্মরত বন্ধুরা পাঠলেই তার সংস্থান হয়ে যাবে। এই মানুষগুলোসহ গার্মেন্টস শিল্প আমাদের দেশটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আর তারা আমাদের ‘জাতীয় বীর’ কৃষকদের সন্তান ও সজ্জন। তারা নিশ্চয়ই জাতির এই ক্লান্তিলগ্নে এগিয়ে আসবেন।
ব্যবসায়ীদের দেশপ্রেম বিবর্জিত ভাবা একটি স্টাইলে পরিণত হয়ে গেছে। তাদের সঠিকভাবে প্রণোদিত করতে পারলে ও আস্থায় নিতে পারলে দেশীয় মুদ্রার বিশালাংশ তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যে শেখ কবিরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইনসিওরেন্স অ্যাসোসিয়েশন ১৬ হাজার কোটি টাকা পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। আমার মতে, দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় আর একটু নিশ্চয়তা পেলে পিপিপি’র অধীনে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগের ক্ষেত্রটা আরেকটু সম্প্রসারিত করলে সুফল বৈ কুফল আসবে না। তবে বিনিয়োগকারীদের এনবিআরসহ অন্য কোন সংস্থা বা এজেন্সির অনল থেকে রক্ষা করলে এক সেতু নয়, বহু সেতুর টাকা আপনি আপনি চলে আসবে; হুন্ডি ব্যবসা বিলুপ্ত হবে। দেশী অর্থের বিদেশ গমন প্রয়াস প্রতিহত হবে। আমি ড. মশিউর রহমান সাহেবের কাছে পরামর্শ রেখেছিলাম যে পদ্মা সেতুর বিনিয়োগে এনবিআর বা অন্যান্য সংস্থার প্রতিবন্ধকতা সম্পূর্ণ তুলে দিতে। তার আগ্রহে আমি এই পরামর্শ দিতে আবারও আগ্রহী হচ্ছি। আয়কর আইনে ১৯বি ধারাটা আরও একটু সম্পাদিত করেও কিন্তু পদ্মা সেতুর অর্থায়নের পথ সুগম করা সম্ভব। বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের বন্ড ছেড়ে এই অর্থ-সংগ্রহের পদক্ষেপ প্রশংসাযোগ্য। ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগের ন্যায় অনুরূপ সুবিধা এখানে রাখলে ভাল হয়।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ
পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের যখন বিবিধ বিতর্ক, মান-অভিমান লুকোচুরি, অভিযোগ, অনুযোগ চলছে তখন গফরগাঁওয়ের সেই কিশোরটিকে আবছা দেখা যাচ্ছিল। আর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যখন একতরফা ও অন্যায়ভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দিল তখন আবারও ‘মানি’ ব্যক্তিদের আবির্ভাব দেখলাম। মনে হলো কেউ কেউ মুচকি হাসি কিংবা অট্টহাসি হাসছে। তাদের নিবাস এ দেশেই, তারা এ মাটির অন্নজলে মানুষ এবং জাতির অর্থবিত্তে তারা প্রাইমারী থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছে, এ দেশের চাষাভূষা খেটে খাওয়া মানুষের রক্ত চুষে আর বিদেশীদের উলঙ্গ দালালী করে বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হয়ে সুশীল সেজেছেন। তারা বিশ্বব্যাংকের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে সরকারকে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করছেন, সরকার ও আওয়ামী লীগকে এক করে দেখেছেন, শেখ হাসিনা ও দেশের ষোলো কোটি মানুষকে একাকার করে দেখছেন। তাতে খারাপ কি? খারাপটা হচ্ছে তারা বাথটব ছুড়ে ফেলতে গিয়ে হায়েনার হাসি হাসছেন আর ইংরেজী প্রবাদের সেই ঞযৎড়রিহম ঃযব নধনু রিঃয ঃযব নধঃয ঃঁন কথাটির সম্যক প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন।
বিশ্বব্যাংকের অর্থে কোন দুর্নীতি যে ঘটেনি তা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে তারা বলছেন শেখ হাসিনার সরকার ঞধপঃষবংং আচরণ করেই বিশ্বব্যাংককে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে; তার আরও একটু আপোস ও নমনীয় আচরণ বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা শেখ হাসিনার আচরণকে ঞধপঃষবংং বললেও আমরা কিন্তু উচ্চ কণ্ঠে শেখ হাসিনার প্রশংসা করছি। শেখ হাসিনার এই আচরণ আবারও বঙ্গবন্ধুকে আমাদের চোখের সামনে নিয়ে এসেছে।
সেই ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখের কথা। সেদিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড স্বহস্তে গাড়ি চালিয়ে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউর অতি সরু রাস্তা ধরে ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সাথে একান্ত সাক্ষাত করেন। উত্তাল সে সময়ে আলোচনার বিষয়বস্তু তেমন কেউ জানতে পারেননি। তবে আমি পরম সৌভাগ্যবান। সেদিন দুপুরের পর শেখ ফজলুল হক মণি আমাকে নিয়ে পুরানা পল্টনের আওয়ামী লীগ অফিসে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যান। আমরা দু’জন বঙ্গবন্ধুর সাথে একান্তে দেখা করি। বঙ্গবন্ধু তার আলোচনার সারমর্ম আমাদেরকে জানান এবং একটি গুলি খরচ না করেই যুদ্ধ জয়ের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। এরই মাঝে তিনি একটি টেলিফোন কল পান। এই কলটি ছিল ফারল্যান্ডের। ফারল্যান্ড যে কথা সকালে বলেননি তা-ই তখন বঙ্গবন্ধুকে জানালেন। বঙ্গবন্ধু অতি উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন; রাগে উষ্মায় তিনি কাঁপছিলেন। ফারল্যান্ডের প্রস্তাবটি ছিল সিংঙ্গাপুর কায়দায় পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নকরণ, বিনিময়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ। মুহূর্তে তিনি ফারল্যান্ডের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন অর্থাৎ, আমাদের সুশীল ও বিরুদ্ধবাদীদের ভাষায় ঞধপঃষবংং কাজটা করলেন। সেই ঞধপঃষবংং কাজটা না করলে গোলামীর জিঞ্জিরটা আমরা আজও হয়ত পরে বসে থাকতাম। এ জাতীয় ঞধপঃষবংং কাজটা আমরা শেখ হাসিনার মধ্যেও দেখলাম। বঙ্গবন্ধুকে সে জন্য সপরিবারে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। শেখ হাসিনার বরাতে কি আছে জানি না, তবে স্রষ্টা অফুরন্ত মহিমা ও করুণা দিয়ে তাকে যেভাবে বাঁচিয়ে রাখছেন তাতে মনে হয় মহান স্রষ্টা শেখ হাসিনাকে কোন না কোন মহৎ কাজের জন্য রেখেছেন। বিরুদ্ধবাদীদের ঞধপঃষবংং কাজের সংজ্ঞাটা স্পষ্ট নয়। অনেকের মতে, শেখ হাসিনার পক্ষে অতীতে ঞধপঃভঁষ কাজ ছিল বিশ্বব্যাংকের ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, মনগড়া সব কিছু মাথা পেতে নেয়া কিংবা ড. ইউনূসকে আজীবন গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তাব্যক্তি রাখা। বিশ্বব্যাংকের পর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বক্তব্য আরও স্পষ্ট করেছে যে, যুদ্ধাপরাধী ও বিডিআর বিদ্রোহীদের বিচারসহ সকল প্রকার ন্যক্কার ও ঘৃণ্য কাজকে প্রশ্রয় দেয়া হবে ঞধপঃভঁষ বা কৌশলী পদক্ষেপ। এই কৌশলী পদক্ষেপ অন্তত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নিতে পারেন না; তাকে বাবার মতোই তথাকথিত ঞধপঃষবংং হতে হবে এবং তিনি পদ্মা সেতুর ব্যাপারে অনমনীয় অবস্থান নিয়ে এমনটিই করেছেন। আমরা আর কিছু না পারি তাকে প্রাণ খুলে দোয়া করছি আর তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয়ার পর দুর্নীতির সংজ্ঞার হাত-পা গজাতে শুরু করেছে আর বিদগ্ধ সুশীল অর্থনীতিবিদগণ এই পদক্ষেপের মধ্যেও জাতীয় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা থাকতেও পারবেন না, যেতে চাইলে যেতেও পারবেন না, আর ‘কি’ করবেন তা জিজ্ঞাসিত হলে ‘কি’ করতেও নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হচ্ছেন। আমার ধারণা, তাদের কথা অনেক শোনা হয়েছে, আর শোনার প্রয়োজন নেই। তারা সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করবেন, ভালো কাজের পরামর্শ দেবেন, কিন্তু ভালো কাজ হাতে নিতে গেলেও বাধা সৃষ্টি করবেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রতিহত করে তারা এখন কচুগাছ কাটতে কাটতে ডাকাতে পরিণত হয়েছে। এই ডাকাতদের ঠেকাতে হবে।
নির্দ্বিধায় বলছি দেশের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা অতিশয় সাহসী পদক্ষেপ। আমরা এই পদক্ষেপের সাথে আছি। জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে রাজি আছি, তবুও মাথা নোয়াতে আমরা প্রস্তুত নই। তা আমরা বহুবার প্রমাণ করেছি। আবারও করব।
এ সেতু বানাতে কয়েক পর্বে প্রায় ২২৫৫৪ কোটি টাকা প্রয়োজন। আমার ধারণা, পদ্মা সেতু নিজ অর্থেই নির্মাণ সম্ভব ও সঙ্গত। তাতে হয়ত বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গট হতে পারে। আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের প্রায় এক কোটি শ্রমজীবী মানুষ বিদেশে চাকরি করছেন। পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীও কম নন। তাদের দেশপ্রেম সুশীলদের চেয়ে কিংবা অনেক স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকের চেয়ে অনেক বেশি। আমার ধারণা, জননেত্রী যদি বিদেশে কর্মরতদের কাছে একটি আহ্বান জানান তাহলে তারা বারো হাজার কোটি টাকা বিদেশ থেকে এ বছরই তুলে দেবেন। মাথাপিছু মাত্র ১৫০ ডলার আমাদের বিদেশে কর্মরত বন্ধুরা পাঠলেই তার সংস্থান হয়ে যাবে। এই মানুষগুলোসহ গার্মেন্টস শিল্প আমাদের দেশটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আর তারা আমাদের ‘জাতীয় বীর’ কৃষকদের সন্তান ও সজ্জন। তারা নিশ্চয়ই জাতির এই ক্লান্তিলগ্নে এগিয়ে আসবেন।
ব্যবসায়ীদের দেশপ্রেম বিবর্জিত ভাবা একটি স্টাইলে পরিণত হয়ে গেছে। তাদের সঠিকভাবে প্রণোদিত করতে পারলে ও আস্থায় নিতে পারলে দেশীয় মুদ্রার বিশালাংশ তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যে শেখ কবিরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইনসিওরেন্স অ্যাসোসিয়েশন ১৬ হাজার কোটি টাকা পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। আমার মতে, দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় আর একটু নিশ্চয়তা পেলে পিপিপি’র অধীনে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগের ক্ষেত্রটা আরেকটু সম্প্রসারিত করলে সুফল বৈ কুফল আসবে না। তবে বিনিয়োগকারীদের এনবিআরসহ অন্য কোন সংস্থা বা এজেন্সির অনল থেকে রক্ষা করলে এক সেতু নয়, বহু সেতুর টাকা আপনি আপনি চলে আসবে; হুন্ডি ব্যবসা বিলুপ্ত হবে। দেশী অর্থের বিদেশ গমন প্রয়াস প্রতিহত হবে। আমি ড. মশিউর রহমান সাহেবের কাছে পরামর্শ রেখেছিলাম যে পদ্মা সেতুর বিনিয়োগে এনবিআর বা অন্যান্য সংস্থার প্রতিবন্ধকতা সম্পূর্ণ তুলে দিতে। তার আগ্রহে আমি এই পরামর্শ দিতে আবারও আগ্রহী হচ্ছি। আয়কর আইনে ১৯বি ধারাটা আরও একটু সম্পাদিত করেও কিন্তু পদ্মা সেতুর অর্থায়নের পথ সুগম করা সম্ভব। বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের বন্ড ছেড়ে এই অর্থ-সংগ্রহের পদক্ষেপ প্রশংসাযোগ্য। ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগের ন্যায় অনুরূপ সুবিধা এখানে রাখলে ভাল হয়।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ
No comments