শাসন কাঠামো-মানসিকতা ও ধরনে এখনও ঔপনিবেশিকতা! by শেখ হাফিজুর রহমান

এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের ব্যর্থতাগুলো দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও এর বাইরে নয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নানা সময়ের নানা ব্যর্থতা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে।
কিন্তু সমালোচনার স্তূপের নিচে চাপা পড়েছে তাদের দক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও রাজনৈতিক ব্যবহারের প্রসঙ্গটি

বাংলাদেশের সমস্যা হচ্ছে, এখানে রাষ্ট্র আছে, সুশাসন নেই। আইন আছে, আইনের শাসন নেই। গণতন্ত্রের বাগাড়ম্বর আছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নেই। বাংলাদেশে কেন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না? আমরা কি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব বুঝি না, নাকি নীতিনির্ধারকরা চাননি যে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক? গণতন্ত্রকে গণতন্ত্র হয়ে উঠতে হলে কার্যকর সংসদ দরকার, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার দরকার, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ দরকার, শিক্ষা ও গবেষণায় সমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় দরকার, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন দরকার, বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যম দরকার, দায়বদ্ধ ও জনবান্ধব প্রশাসন দরকার। এর কোনোটা কি আমরা গড়ে তুলতে পেরেছি? ফলে চার দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরও আমাদের গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য আর্তচিৎকার করতে হচ্ছে। এক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা না মানা নিয়ে সেই ১৯৮৮ সাল থেকে কত হরতাল, ভাংচুর, প্রাণপাত ও রক্তক্ষয় হলো দেশে! আমাদের যদি ভারতের মতো শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন এবং গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক দল থাকত, তাহলে কি আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার হতো?
এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের ব্যর্থতাগুলো দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও এর বাইরে নয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নানা সময়ের নানা ব্যর্থতা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু সমালোচনার স্তূপের নিচে চাপা পড়েছে তাদের দক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও রাজনৈতিক ব্যবহারের প্রসঙ্গটি। প্রশ্নটি হচ্ছে, তারা অদক্ষ ও অপেশাদার বলেই কি তারা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে? নাকি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর যেটুকু দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব আছে, রাজনৈতিক সরকারগুলো তা রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে ব্যবহার না করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে? ফলে ব্যর্থতার দায় এসে পড়ছে সংস্থাগুলোর ওপর।
পুরো সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের চৌকস অফিসারদের দ্বারা গঠিত গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কতটা শক্তিশালী, দক্ষ ও পেশাদার, তা নির্ণয় করতে গিয়ে প্রথমে যে জায়গাটিতে ধাক্কা খেলাম তা হচ্ছে, গত ৪০ বছরে আমরা বাংলাদেশের জন্য কোনো পূর্ণকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী দেখিনি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ, টেকনিক্যাল ও স্ট্র্যাটেজিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে চার দশক ধরে কোনো পূর্ণকালীন মন্ত্রী নেই! আর্মড ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার্সের ওপরে এখন দুটি সমান্তরাল অফিস রয়েছে। একটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অধীন আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন এবং অন্যটি হচ্ছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একই সঙ্গে এ ধরনের দুটি অফিস রাখা হয় না। একই সঙ্গে সমান্তরাল দুটি অফিস রাখার উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা কী, তাও স্পষ্ট নয়। (ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর কবির, বাংলাদেশ টুডে, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ২৩ জানুয়ারি, ২০১০)।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, গত ৪০ বছর ধরে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী (প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতি) প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। একজন দক্ষ, যোগ্য ও সক্ষম ব্যক্তিকে পূর্ণকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী করতে সমস্যা কোথায়? সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অনেক। সংসদের নেতা হিসেবে তাকে সংসদের সকল কর্মকাণ্ড তদারক করতে হয়। উপরন্তু তিনি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধান। একই সঙ্গে তিনি প্রধান নির্বাহী। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী প্রশাসন, সংসদ ও দল সামলানোর পর প্রতিরক্ষা বিষয়ে কতটা সময় দিতে পারেন? নীতিনির্ধারণের জায়গা থেকে প্রতিরক্ষা বিষয়ে পর্যাপ্ত সময় না দেওয়ায় আমরা প্রত্যাশিত মাত্রার দক্ষ ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে পারিনি, আমাদের আকাশ ও নৌবাহিনী রয়ে গেছে দুর্বল, আমাদের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রয়ে গেছে ঔপনিবেশিক ধাঁচের। নীতিনির্ধারকরা প্রতিরক্ষা ও সশস্ত্র বাহিনীর বিষয়ে পর্যাপ্ত মনোযোগ না দেওয়ার ফলে কী হয়েছে, সে বিষয়ে দু'একটি দৃষ্টান্ত দিতে চাই।
প্রথমত, সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক ও শক্তিশালী করার জন্য যে বাজেট বরাদ্দ রয়েছে তা খুবই অপর্যাপ্ত। ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে ৪ বছরে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনার জন্য সামরিক বাহিনী ৪০৩ কোটি টাকা চেয়েছিল। কিন্তু ৪ অর্থবছরে মাত্র ১৯২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৮ মে সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে পেশ করা এক রিপোর্টে এ কথা বলা হয়। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, ভারতের প্রতিরক্ষা বা সামরিক বাজেট ওই দেশের জিডিপির ২.৩৮ শতাংশ, পাকিস্তানের ৩.২ শতাংশ, শ্রীলংকার ৬ শতাংশ ও মিয়ানমারের ৩.৩ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেট জিডিপির মাত্র ১.১ শতাংশ (দি ডেইলি স্টার, ১৪ জুন, ২০০৯)।
এরপর যে বিষয়টি আমি উত্থাপন করতে চাই সেটি হচ্ছে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ঔপনিবেশিক মানসিকতা ও ঔপনিবেশিক ধরন। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন ছিল, তারপর চলেছে পাকিস্তানি সামরিক শাসন। ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৪ বছরের মাথায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, তারপর আবার সেনাশাসন। ঔপনিবেশিক আমল, পাকিস্তান আমল ও সামরিক শাসকদের আমলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা ছিল নির্যাতকের। ওই সময় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান কাজ ছিল ঔপনিবেশিক ও সামরিক শাসকদের গণবিরোধী শাসন টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করা ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের কঠোর হাতে দমন করা। ঔপনিবেশিক ও সামরিক শাসনের আমলে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ও পুলিশের দ্বারা স্বাধীনতা সংগ্রামী ও গণতন্ত্রকামীদের নির্যাতন করে পঙ্গু করে দেওয়া এবং নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার নানা ঘটনা আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে নতুন করে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হওয়ার পর এ সংস্থাগুলোকে ঢেলে সাজাবার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মানসিকতায় এখনও ভয়ানক রকম ঔপনিবেশিক রয়ে গেছে। ২০০৮ সালে রাতের অন্ধকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন সম্মানিত শিক্ষককে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করেছিল, যাতে রয়েছে হুবহু ঔপনিবেশিক মানসিকতার ছাপ।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাঠামো ও কাজ করার ধরন একেবারে ঔপনিবেশিক। ব্রিটিশরাজ যে কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের যে ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান করত, এখনও বাংলাদেশে সেটাই চলছে। অথচ একবিংশ শতাব্দীর গোয়েন্দা কার্যক্রম অনেক বেশি আধুনিক, চৌকস ও গতিশীল। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য বিশেল্গষণ ও গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, গবেষক, ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট ও বিজ্ঞানী প্রয়োজন হয়। অথচ আমাদের দেশে এখনও আমরা শুধু সামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা পরিচালনা করছি।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অহেতুক সমালোচনা করার পক্ষে আমি নই। তাদের যেমন অনেক ব্যর্থতা রয়েছে, তেমনি এর উপযোগিতাকে খাটো করে দেখাও উচিত নয়। তবে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকাণ্ড অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে পরিচালিত হয় বলে অনেক সময় আমরা জানতেও পারি না যে, কোনো একটি ঘটনায় আসলেই গোয়েন্দা ব্যর্থতা আছে কিনা। আমরা জানতে পারি না, মারাত্মক কোনো ঘটনার আগাম তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে গোয়েন্দা ব্যর্থতা রয়েছে, নাকি গোয়েন্দা তথ্য দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো পর্যায়ে তা আটকে গেছে। তবে যে কথাটা আমরা জোর গলায় বলতে চাই তা হলো, বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ঔপনিবেশিক মানসিকতা ও ধরন থেকে মুক্ত করে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ক্যাবিনেট ও সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহি করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই এটা করা হয়।

শেখ হাফিজুর রহমান :সহযোগী অধ্যাপক আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.