চিরকুট-একাকী মানুষ by শাহাদুজ্জামান
পৃথিবীতে একাকী মানুষের সংখ্যা বেড়ে এখন স্মরণাতীতকালের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে, এমনটাই জানাচ্ছে ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকার সাম্প্রতিক একটি সংখ্যা। ‘একাকী’ বলতে একাকী বসবাসকারী মানুষ। একটি বাড়িতে একজন মাত্র মানুষ—এই পরিস্থিতি, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের অধিকাংশ দেশেরই এখন স্বাভাবিক চিত্র।
জানা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়ে আছে সুইডেন। সেখানে জনসংখ্যার ৪৭ ভাগই থাকে একা। পরিসংখ্যানে আরও জানা গেল, নরওয়ে, জার্মানি, ব্রিটেন, হল্যান্ড—এসব দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগ একাকী বসবাস করে। সে হিসাবে বলা যেতে পারে, পাশ্চাত্যের অধিকাংশ দেশের প্রায় অর্ধেক অধিবাসী এখন থাকে একা। এ এক অভূতপূর্ব অবস্থা। আদিম মানুষেরা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে গা মাখামাখি করে থাকত। এরপর মানুষ থাকতে শুরু করে যৌথ পরিবারে, যৌথ পরিবার ভেঙে হয় একক পরিবার। এখন দেখা যাচ্ছে, একক পরিবার হয়ে দাঁড়াচ্ছে একক মানুষে। পরিবার এখন অনেক দেশেই আর অনিবার্য কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। প্রেম, বাৎসল্য, যৌনতা—এগুলোর জন্য বিয়ে বা পরিবার গঠন অনেক দেশেই এখন আর অবধারিত কোনো ব্যাপার নয়। বিয়ের বদলে একসময় পাশ্চাত্যের নারী-পুরুষ চর্চা করেছে লিভিং টুগেদারের, এখন সেটি হয়ে দাঁড়িয়েছে লিভিং অ্যাপার্ট টুগেদার। অর্থাৎ দম্পতি তারা ঠিকই, কিন্তু থাকে পৃথক বাড়িতে।
তবে পত্রিকাটি বলছে, একাকী মানুষ মাত্রই নিঃসঙ্গ, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। একজন মানুষ এখন শুধু একটা ল্যাপটপের সামনে বসে ই-মেইল, ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে পৃথিবীর নানা প্রান্তে গড়ে তুলতে পারে বন্ধুত্ব। একটা সময় ছিল যখন একজন মানুষের পক্ষে কোনো গোষ্ঠী বা পরিবারভুক্ত না হয়ে বেঁচে থাকাটাই ছিল অসম্ভব। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতি আর প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে একা বেঁচে থাকা এখন আর কষ্টসাধ্য কোনো ব্যাপার নয়। বস্তুগত প্রয়োজনের বাইরে আত্মিক বা জৈবিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যও এখন আর পরস্পরের একত্রে বসবাসের প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তির অধিকার—এসবের গুরুত্ব পাশ্চাত্যে সর্বাধিক। ফলে একসময় যেখানে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আইনের কাছে কৈফিয়ত দিতে হতো, এখন কোনো দম্পতি যদি নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষুণ্ন করেও একটি অসুখী বিয়েকে টিকিয়ে রাখে তাহলে তাকে উল্টো আইনের কাছে জবাবদিহি করতে হয় অনেক দেশে। ফলে পাশ্চাত্যে একা থাকাকেই অনেকে নানা দিক থেকে সুবিধাজনক মনে করছে। প্রাচ্যের অনেক দেশেও ক্রমেই এ প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষ করে জাপানে দেখা যাচ্ছে দ্রুত হারে বেড়ে যাচ্ছে একাকী মানুষ। তবে পরিবার, যৌথতা এগুলোর একটা গুরুত্ব সেখানে আছে। ফলে জাপানে একাকী বসবাসকারী মানুষের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পাশ্চাত্যের মতো এতটা সহজলভ্য নয়। বিবিসির আলোচিত ডকুমেন্টারি মেগাসিটিতে এন্ড্রু মার দেখাচ্ছেন টোকিওতে এখন বন্ধু ভাড়া পাওয়া যায়। আপনি চাইলে সেখানে ঘণ্টা খানেকের জন্য একজন বন্ধু ভাড়া করতে পারেন, যে আপনাকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সঙ্গ দেবেন। অভিনয় করবেন যে তিনি আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এতে করে আপনি যে বন্ধুহীন, একাকী মানুষ এই দুর্নাম ঘুচবে। টোকিওর বড় বড় কোম্পানির এক্সিকিউটিভদের মধ্যে এই চর্চা বেশ জনপ্রিয়।
এই যে পৃথিবীর বহু মানুষ একাকী বসবাসে আগ্রহী হচ্ছে এবং সক্ষমও হচ্ছে, একে কি মানুষের সাফল্য বলা যাবে, না ব্যর্থতা? ভাববার বিষয়। চূড়ান্ত বিচারে মানুষের অর্জন, বিকাশ একে অন্যের সান্নিধ্যেই, একে অন্যের দায়িত্ব নেওয়ার ভেতরেই। পরিবার বা যৌথভাবে জীবনযাপন না করেও মানুষে মানুষে সেই সান্নিধ্য পাশ্চাত্য সম্ভব করে তুলছে। তবে এ ধরনের একাকী বসবাসে ব্যক্তিসর্বস্বতার একটা ঝুঁকিও থেকে যায়। পাশ্চাত্যে এর নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে প্রচুর। আমাদের মতো দেশগুলোতে যেখানে এককভাবে জীবন যাপন করা অর্থনৈতিকভাবে, প্রযুক্তিগতভাবে, মূল্যবোধগতভাবে কঠিন; সেখানে অবশ্য সমস্যাটির ধরন ভিন্ন। এখানে অধিকাংশ মানুষ পারিবারিক যৌথতায় থাকতে বাধ্য হলেও এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না তাঁরা সব সময় পরস্পরের খুব নিকট সান্নিধ্যে থাকেন। এক ছাদের নিচে থাকলেও এমন প্রায়ই দেখা যায় তাঁরা পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ, সন্দেহ, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি নিয়েই বসবাস করছেন। বহু মানুষ আত্মীয়-পরিজন দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকলেও ভেতরে ভেতরে থাকেন একা।
সুতরাং মেনে নেওয়া ভালো যে একাকিত্ব বোধের সঙ্গে এককভাবে জীবনযাপন আর যৌথভাবে জীবনযাপনের কোনো সম্পর্ক নেই। একটা মৌলিক একাকিত্ব মানুষ মাত্রেরই থাকে। কবি আবুল হাসান যেমন লিখেছিলেন, ‘মানুষ তার চিবুকের কাছেও একা।’ সৃজনশীল মানুষের কাছে এই একাকিত্ব অবশ্য আশীর্বাদই। কিন্তু অধিকাংশ মানুষেরই থাকে অন্যের সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষা। সেই সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষা যদি অবিরাম প্রতারিত হয়, বাধাপ্রাপ্ত হয়, তবে মানুষ ক্রমেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়, হয়ে যায় একাকীতর। লেখক কমলকুমার মজুমদার যেমন বলেছিলেন, ‘আমরা এখন সব আল দেয়া জমির মত একা।’ একাকিত্ব ঘোচানোর মন্ত্র তাই হতে পারে নিজেদের চারপাশে ঘিরে রাখা সেই আলগুলো ভেঙে ফেলা। অন্যের কথা শোনার, অন্যের কথা জানার একটা কান তৈরি করা, মন তৈরি করা। মোক্ষম কথাটা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ:
—জানো কি একেলা কাহারে বলে?
—জানি যবে দিতে চাই নিতে নাহি কেহ।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
তবে পত্রিকাটি বলছে, একাকী মানুষ মাত্রই নিঃসঙ্গ, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। একজন মানুষ এখন শুধু একটা ল্যাপটপের সামনে বসে ই-মেইল, ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে পৃথিবীর নানা প্রান্তে গড়ে তুলতে পারে বন্ধুত্ব। একটা সময় ছিল যখন একজন মানুষের পক্ষে কোনো গোষ্ঠী বা পরিবারভুক্ত না হয়ে বেঁচে থাকাটাই ছিল অসম্ভব। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতি আর প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে একা বেঁচে থাকা এখন আর কষ্টসাধ্য কোনো ব্যাপার নয়। বস্তুগত প্রয়োজনের বাইরে আত্মিক বা জৈবিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যও এখন আর পরস্পরের একত্রে বসবাসের প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তির অধিকার—এসবের গুরুত্ব পাশ্চাত্যে সর্বাধিক। ফলে একসময় যেখানে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আইনের কাছে কৈফিয়ত দিতে হতো, এখন কোনো দম্পতি যদি নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষুণ্ন করেও একটি অসুখী বিয়েকে টিকিয়ে রাখে তাহলে তাকে উল্টো আইনের কাছে জবাবদিহি করতে হয় অনেক দেশে। ফলে পাশ্চাত্যে একা থাকাকেই অনেকে নানা দিক থেকে সুবিধাজনক মনে করছে। প্রাচ্যের অনেক দেশেও ক্রমেই এ প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষ করে জাপানে দেখা যাচ্ছে দ্রুত হারে বেড়ে যাচ্ছে একাকী মানুষ। তবে পরিবার, যৌথতা এগুলোর একটা গুরুত্ব সেখানে আছে। ফলে জাপানে একাকী বসবাসকারী মানুষের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পাশ্চাত্যের মতো এতটা সহজলভ্য নয়। বিবিসির আলোচিত ডকুমেন্টারি মেগাসিটিতে এন্ড্রু মার দেখাচ্ছেন টোকিওতে এখন বন্ধু ভাড়া পাওয়া যায়। আপনি চাইলে সেখানে ঘণ্টা খানেকের জন্য একজন বন্ধু ভাড়া করতে পারেন, যে আপনাকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সঙ্গ দেবেন। অভিনয় করবেন যে তিনি আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এতে করে আপনি যে বন্ধুহীন, একাকী মানুষ এই দুর্নাম ঘুচবে। টোকিওর বড় বড় কোম্পানির এক্সিকিউটিভদের মধ্যে এই চর্চা বেশ জনপ্রিয়।
এই যে পৃথিবীর বহু মানুষ একাকী বসবাসে আগ্রহী হচ্ছে এবং সক্ষমও হচ্ছে, একে কি মানুষের সাফল্য বলা যাবে, না ব্যর্থতা? ভাববার বিষয়। চূড়ান্ত বিচারে মানুষের অর্জন, বিকাশ একে অন্যের সান্নিধ্যেই, একে অন্যের দায়িত্ব নেওয়ার ভেতরেই। পরিবার বা যৌথভাবে জীবনযাপন না করেও মানুষে মানুষে সেই সান্নিধ্য পাশ্চাত্য সম্ভব করে তুলছে। তবে এ ধরনের একাকী বসবাসে ব্যক্তিসর্বস্বতার একটা ঝুঁকিও থেকে যায়। পাশ্চাত্যে এর নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে প্রচুর। আমাদের মতো দেশগুলোতে যেখানে এককভাবে জীবন যাপন করা অর্থনৈতিকভাবে, প্রযুক্তিগতভাবে, মূল্যবোধগতভাবে কঠিন; সেখানে অবশ্য সমস্যাটির ধরন ভিন্ন। এখানে অধিকাংশ মানুষ পারিবারিক যৌথতায় থাকতে বাধ্য হলেও এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না তাঁরা সব সময় পরস্পরের খুব নিকট সান্নিধ্যে থাকেন। এক ছাদের নিচে থাকলেও এমন প্রায়ই দেখা যায় তাঁরা পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ, সন্দেহ, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি নিয়েই বসবাস করছেন। বহু মানুষ আত্মীয়-পরিজন দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকলেও ভেতরে ভেতরে থাকেন একা।
সুতরাং মেনে নেওয়া ভালো যে একাকিত্ব বোধের সঙ্গে এককভাবে জীবনযাপন আর যৌথভাবে জীবনযাপনের কোনো সম্পর্ক নেই। একটা মৌলিক একাকিত্ব মানুষ মাত্রেরই থাকে। কবি আবুল হাসান যেমন লিখেছিলেন, ‘মানুষ তার চিবুকের কাছেও একা।’ সৃজনশীল মানুষের কাছে এই একাকিত্ব অবশ্য আশীর্বাদই। কিন্তু অধিকাংশ মানুষেরই থাকে অন্যের সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষা। সেই সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষা যদি অবিরাম প্রতারিত হয়, বাধাপ্রাপ্ত হয়, তবে মানুষ ক্রমেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়, হয়ে যায় একাকীতর। লেখক কমলকুমার মজুমদার যেমন বলেছিলেন, ‘আমরা এখন সব আল দেয়া জমির মত একা।’ একাকিত্ব ঘোচানোর মন্ত্র তাই হতে পারে নিজেদের চারপাশে ঘিরে রাখা সেই আলগুলো ভেঙে ফেলা। অন্যের কথা শোনার, অন্যের কথা জানার একটা কান তৈরি করা, মন তৈরি করা। মোক্ষম কথাটা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ:
—জানো কি একেলা কাহারে বলে?
—জানি যবে দিতে চাই নিতে নাহি কেহ।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
No comments