চারদিক-মাছকুড়ানির দল by সাইফুদ্দিন রবিন

আমকুড়ানি, পাতাকুড়ানি আর ধানকুড়ানির কথা শুনেছেন অনেকেই। কিন্তু মাছকুড়ানি শব্দটা চেনা ঠেকছে কি? শহুরে মানুষের কাছে এ এক আজব কথা বলেই মনে হবে। মাছ কি গাছে ধরে যে তা কুড়িয়ে নেওয়া যায়? না, মাছ যেখানে থাকার কথা সেখানেই থাকে, শুধু একদল শিশু-কিশোর সেই মাছ কুড়িয়ে নেয়।


কুড়িয়ে নিয়ে যাওয়া মাছ নিয়ে ঘরে ফিরে মায়ের হাতে তুলে দেয় ‘মাছে ভাতে বাঙালি’—কথাটা টিকিয়ে রাখতে।
গ্রামগঞ্জে এই দৃশ্য চোখে পড়ে। যে দৃশ্যের দেখা মিলল নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপে। ওসখালীতে মূল সড়কের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে যাওয়া খালেই চোখ পড়ল একদল শিশুর দিকে। যারা হাতে ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে খালের কাদামাটিতে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে শিকার করছে মাছ। নিজেদের গায়েও লেপ্টে আছে মাটি। তবু মাছ পাওয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে মাটি খুঁড়ছে। কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। চেষ্টা চলছেই।
হাতিয়ার এই খালটি গিয়ে মিশেছে মেঘনার সঙ্গে। বর্ষায় তা টইটম্বুর থাকে। আর অন্য ঋতুতেও নদী থেকে জল এসে ভরিয়ে রাখে। ভরা খালে কেউ কেউ গাছের বড় বড় ডাল ফেলে রাখে। পচা পাতা, খালের জলের ভেতর ডালের ছায়ায় আশ্রয় নেয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। হয়ে ওঠে মৎস্য অভয়ারণ্য। কিছুদিন পর ডাল ফেলে রাখা অংশটি জাল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। কোথাও কোথাও সাময়িক বাঁধও দেওয়া হয়। তারপর ডাল তুলে পানি সেচে শিকার করা হয় মাছ। বড়দের মাছ ধরা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন ছোটরা মানে মাছকুড়ানির দলের দখলে সেই মৎস্য অভয়ারণ্য।
এমনই একদল মাছকুড়ানির দল হাসান, খায়ের, বেলাল, সাদ্দাম, হূদয়, রিয়াজ—এই ছয় বন্ধু। ভোরবেলা থেকে সবাই মাছ ধরা শুরু করে যখন বড় বড় মাছ নিয়ে ঘরে ফিরে গেছে তখন ভরদুপুরে তারা নেমেছে মাছ শিকারে। জানে, এখন আর বড় কোনো মাছ খুঁজে পাবে না তারা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে আকারে ছোট কিছু মাছ জুটতে পারে। অনিশ্চিত এই মাছ কুড়ানোর শিবিরে তারা হতাশ হয়নি, যখন ঘণ্টা খানেক খোঁজাখুঁজির পরও তারা একটা মাছও ভরতে পারেনি তাদের থলেতে। হতাশ হয়ে খালপাড়ে বসে বিশ্রাম নেয়। আবার হাঁটুভর্তি কাদামাটির জলে হাতড়ে বেড়ায়। ডালের গোড়ায়, মাটির তলে কচি কচি হাত ছুটে যায় মাছের সন্ধানে। ফিরে আসে হাত কখনো কখনো শূন্য হয়ে। যখন কেউ একজন একটি মাছ পায় অমনি উল্লাসে চিৎকার। একজন পেলে সবারই আনন্দ। জানে ছোট সেই মাছটি ছয়জনে মিলে ভাগ করে নিতে পারবে না। কিন্তু আনন্দ, উত্তেজনা আর ভালো লাগা এই কচিমুখগুলো সেটুকুই ভাগ করে নিতে চায়। কথা হলো ওদের একজনের সঙ্গে। হাসান ওর নাম। বয়স ১০ বছর। পড়াশোনা করা হয়নি তার। পড়তে ইচ্ছা হলেও দারিদ্র্যের কাছে হার মেনেছে। ভ্যানগাড়ির চালক বাবার ভ্যান ঠেলাই তার কাজ। বাড়িতে মাছ-মাংস জোটে বছরে দু-একবার। তাই এমন সুযোগ পেলে মাছের লোভে নিজেকে নাকি আটকে রাখতে পারে না। বলল, ‘ইয়ানে যদি মাছ হাই দুই-উইগ্গা, তাইলে ঘরে লই যামু। মারে কমু, হেব্বি করি রান্ধনের লাই। মেলাদিন মাছ খাই না। বাপও হেতো টিয়া ইনকাম কইরতো হারে না। বাপ যদি বড়লোক হইতো তাইলে আই হইত্তেক দিন মাছ খাইতাম।’
যদি মাছ না মেলে?
এমন প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘তাইলেতো লোদলই ঘরে যান যাইতো ন। হইতো গোসল করি গা হুয়াইতো অইব।’
অনেকের কাছেই গায়ে কাদা মেখে মাছ ধরাটা কেবলই বিলাসিতা। কিন্তু এই শিশুদের কাছে নিদারুণ বাস্তবতা। কথা বলতে বলতেই একজন পুরো হাতটা ঢুকিয়ে দিল মাটির ভেতরে। অনেক কসরত শেষে তুলে আনল বাইন মাছ। চিৎকার শুনে সবাই দৌড় দিল সেদিকে। সেই দৌড়ে মাছ-বিজয়ের আনন্দ।
দক্ষ শিকারির মতো পা ফেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় এই মাছ কুড়ানোর দল অগভীর কাদামাটির পানিতে। কোনো শব্দ না করেই লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগোয় তারা। কিছু একটা নড়াচড়া করে উঠলেই হলো। মাছ ভেবে কখনো কখনো হাতের ভেতর উঠে আসে নানা রকমের পোকামাকড়। তবু মাছের আশায় কাদামাখা গা নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটে চলা। কটি মাছ পেলেই তাদের সুখ। সার্থক পরিশ্রম।
কজন মাছকুড়ানিকে দেখে সামনে পা বাড়াই। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে যায় পেটঘড়ির কাঁটায়। ভূরিভোজে ভাতের সঙ্গে হয়তো সুস্বাদু কোনো সামুদ্রিক মাছই থাকবে। তৃপ্তির ঢেকুরও তুলব। পেছনে পড়ে থাকে একদল আশাবাদী খুদে মাছকুড়ানির দল।
সাইফুদ্দিন রবিন

No comments

Powered by Blogger.