বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৫৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। সাজ্জাদ আলী জহির, বীর প্রতীক দক্ষ গোলন্দাজ যোদ্ধা সাজ্জাদ আলী জহির ১৯৬৯ সালের শেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন।


১৯৭১ সালে পাকিস্তানের (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) কাকুল সামরিক একাডেমিতে সিনিয়র ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আগস্ট মাসের শেষে তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে এসে যুদ্ধে যোগ দেন। কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন তা তাঁর বয়ান থেকে শোনা যাক।
‘কাকুল সামরিক একাডেমিতে বাঙালি আমরা কয়েকজন প্রশিক্ষণরত ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল অথবা মে মাসে একাডেমি থেকে বাঙালি তিন-চারজন পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন এস এম ইমদাদুল হক (বীর উত্তম, শহীদ)।
‘তাঁর ও আমার একই সঙ্গে পালানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু একসঙ্গে একই কোম্পানি থেকে পালিয়ে গেলে দুজনেরই ধরা পড়ার সম্ভাবনা। তাই ঠিক হয়, তিনি এবং অন্য কোম্পানি থেকে মাহবুব ও মোদাসসের (মোদাসসের হোসেন খান বীর প্রতীক) একসঙ্গে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করবেন।
যাওয়ার আগে ইমদাদুল আমাকে বলে যান সিনিয়র ক্যাডেট হিসেবে আমি যেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে দেরি করে রিপোর্ট করি। যাতে তিনি পিন্ডি (রাওয়ালপিন্ডি) পার হওয়ার সময় পান। তাঁর পালিয়ে যাওয়ার খবর আমি চেপে রাখি। তিন-চার দিন পর খবরটা প্রকাশ পায়। তখন আমার কোম্পানি কমান্ডার এ ব্যাপারে আমাকে অভিযুক্ত করে কোর্ট মার্শাল করার হুমকি দেন। শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি।
আগস্ট মাসে আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোরে কমিশন লাভ করি। আমার পোস্টিং হয় ৭৮ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট শিয়ালকোটে। একাডেমি থেকে শিয়ালকোটে যাওয়ার পথে আমি দুই দিন পিন্ডি অবস্থান করি। সেখানে দুই আত্মীয়সহ কয়েকজনের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আলাপ করি। তাঁরা আমাকে যথাসম্ভব উপদেশ দেন। তা পরবর্তী সময়ে আমার কাজে লেগেছিল। এরপর শিয়ালকোট যাই। কয়েক দিন পর সেখান থেকে পালিয়ে ভারতে যাই।’
সাজ্জাদ আলী জহির মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন সেপ্টেম্বর মাসে। এই সময় ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীকে কয়েকটি ১০৫ এমএম গান (হাউইটজার) দেয়। তা দিয়ে মুক্তিবাহিনীর জন্য একটি ফিল্ড আর্টিলারি ব্যাটারি (গোলন্দাজ দল) গঠন করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় রওশন আরা (বা ২ ফিল্ড) ব্যাটারি।
এই ব্যাটারিতে অন্তর্ভুক্ত হন সাজ্জাদ আলী জহির। তিনি সহঅধিনায়ক ছিলেন। রওশন আরা ব্যাটারিতে ছিল ছয়টি গান। অক্টোবর মাস থেকে এই ব্যাটারি ১০৫ এমএম কামান দিয়ে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সকে বিভিন্ন যুদ্ধে আর্টিলারি ফায়ার সাপোর্ট দিয়ে সহায়তা করে।
সাজ্জাদ আলী জহিরের পরিচালনায় রওশন আরা ব্যাটারি কয়েকবার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে গোলাবর্ষণ করে। সঠিক নিশানায় গোলাবর্ষণ করার ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্ব ও দক্ষতা প্রদর্শন করেন। এর ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
মুক্তিযুদ্ধে আর্টিলারি ব্যাটারি পরিচালনায় দক্ষতার জন্য সাজ্জাদ আলী জহিরকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৪। গেজেটে নাম কাজী সাজ্জাদ আলী জহির।
সাজ্জাদ আলী জহির স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার (ডাক ইলিয়টগঞ্জ) চৌসই গ্রামে। বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম কাজী আবদুল মুত্তালিব, মা নূরুন্নাহার বেগম। স্ত্রী খালেদা মরিয়ম সাজ্জাদ। তাঁদের এক মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস এবং আমাদের সংগ্রাম চলবেই, অপরাজেয় সংঘ, ঢাকা।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.