সাফারি ওয়ার্ল্ডে কয়েকঘণ্টা এস.এম. মনিরুজ্জামান

আগেও অনেকবার অফিসের কাজে থাইল্যান্ডে গিয়েছি। কাজের চাপে দেশটি ঘুরে দেখার তেমন সুযোগ হয়নি। কিন্তু এবারের থাইল্যান্ড যাওয়াটা কিছুটা ব্যতিক্রম। এবার যাচ্ছি ¯্রফে বেড়াতে। আমার সঙ্গে যাচ্ছে আমার স্ত্রী ও সন্তানেরা। এবার কোন কাজের তাড়া নেই,শুধুই ঘুরে বেড়াবো। সময়টা ফেব্রুয়ারী মাস।


প্রথমে ভেবেছিলাম ঠান্ডা থাকবে বোধ হয়। কিন্তু যাবার আগে ওয়েবসাইটে দেখলাম শীত মোটেই নেই। আমার স্ত্রী সব গোছগাছ শেষ করেছে। আমিও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ট্রাভেল এজেন্সী থেকে টিকিট নিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে বাড়ী ফিরেছি। রাতে আমাদের ফ্লাইট। গত সপ্তাহে আমরা ভিসার জন্য পাসর্পোট জমা দিতে যাই দূতাবাসে। মাত্র তিন কর্মদিবসের মধ্যেই আমরা থাই ভিসা পেয়ে যাই। যেহেতু আমরা আগেও অন্যান্য দেশে বেড়াতে গেছি তাই ভিসা পেতে কোন অসুবিধা হয়নি। যাবার দিন আমার ছেলেরা সন্ধ্যা থেকেই তৈরি ছিল। তাদের উত্তেজনা দেখে আমার মনে হয়েছে বিদেশে যাবার জন্য এতগুলো টাকার ব্যয় যেন সার্থক। বেশ রাতে আমরা প্লেনে করে রওনা দিলাম থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের উদ্দেশ্যে। প্লেনে আমার ছোট ছেলে খুবই দৌড় ঝাঁপ করলো। তাকে সিটে আটকে রাখাই মুশকিল। প্রায় ৩ ঘন্টায় জার্নি শেষে আমরা নামলাম ব্যাংকক আর্ন্তজাতিক এয়ারপোর্টে। যে বেল্টে মালামাল আসে আমার ছোট ছেলে লাফিয়ে উঠে পড়ল সেই বেল্টে। তাকে সামলাতে আমার স্ত্রী পড়ে মহা বিপাকে। যাইহোক ভালোয় ভালোয় আমরা আমাদের ব্যাগ আর সুটকেস নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি এয়ারপোর্ট থেকে। বেরিয়ে দেখি দুই ধরনের ট্যাক্সির ব্যবস্থা রয়েছে। একটার দাম একটু বেশি আর আরেকটি সাধারণ দামের। আমরা সাধারণ দামের ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম। বিখ্যাত বমরুদগ্রাদ হাসপাতালের আশেপাশে অনেক হোটেল আছে। বাংলাদেশ থেকে ব্যাংককে বেড়াতে আসা বাঙালীরা সাধারণত এই সব হোটেলেই থাকে। আমরাও একটি মধ্যম মানের একটি হোটেলে উঠলাম। হোটেলে পৌঁছে দেখি আমাদের আশেপাশে অনেক বাঙালী, দেখে ভালই লাগল। খুব ক্লান্ত ছিলাম বলে রুমে গিয়ে হোটেল থেকে অর্ডার দিয়ে খাবার এনে খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে নাস্তা খাবার জন্য হোটেল থেকে বেরিয়ে দেখি ছোট বড় অসংখ্য খাবারের রেস্টুরেন্ট। বাংলাদেশি সবধরনের খাবারের ব্যবস্থা আছে এই সব রেস্টুরেন্টগুলোতে। আমরা খাবার পর্ব শেষ করে হোটেলে থাকা টুরিস্ট বাসের সঙ্গে কথা বললাম। তারা জানালো পরের দিন সকালে তাদের পাতোয়া ট্রিপ আছে। আমরা চারটি সিট বুকিং দিয়ে দিলাম। একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সাফারি ওর্য়াল্ডের উদ্দেশ্যে নিয়ে। আমার ছেলেরা সাফারি ওয়ার্ল্ডে পৌঁছে আনন্দে দিশেহারা। যেন তারা এসে পড়েছে তাদের স্বপ্নের ভুবনে। ব্যাংকক শহরে অদূরে এই সাফারি ওয়ার্ল্ডটি অবস্থিত। আমরা প্রবেশ পথ থেকে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ঢুকতেই দেখি বাঘের বাচ্চা কোলে নিয়ে কতগুলো মেয়ে ঘুরাফেরা করছে। আমার ছেলেরা সেই বাঘের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ছবি তুলল আর বোতলে করে তাদের দুধ পান করলো । এজন্য অবশ্য আমাকে বেশ কয়েক বাথ (থাই মুুদ্রা) দিতে হলো মেয়েগুলোকে। এটাই তাদের ব্যবসা। প্রবেশ পথে আরো দেখলাম কয়েকজন মানুষ বিভিন্ন পশুর পোশাক পরে নাচ দেখাচ্ছে। সকলকে আনন্দ দেওয়াই যেন তাদের কাজ। প্রথমেই চোখে পড়ল একটা বড় সুভেনিয়র শপ। নানাধরনের আর্কষণীয় সব জিনিস এখানে বিক্রি হচ্ছে। আমরা অবশ্য চলে গেলাম সাফারির বিশেষ গাড়ির দিকে। সাফারির বিশেষ গাড়িতে চড়ে আমরা ঢুকে পড়লাম এক বিশেষ এলাকায়। এই এলাকাটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব শক্ত। উচুঁ প্রাচীর চারিদিকে আর সেই প্রাচীরে জড়ানো বিদ্যুতের তার। এ যেন এক বিশাল খাঁচা। প্রাচীরে ঘেরা এই এলাকাটিতে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাঘ। তারা সম্পূর্ণ মুক্ত। আমরাই গাড়ীতে বন্দি হয়ে তাদের মাঝ দিয়ে চলছি। কেবল যদি গাড়িটির দরজা এক মিনিটের জন্য খোলা হয় তবেই ছিড়ে কেটে খাবে মানুষদের এই হিংস্র পশুরা। গাড়ীর জানালার খুব কাছে বাঘ দেখে আমি মনে মনে একটু ভয় পেলেও আমার ছেলেরা মোটেই ভয় পায় নি। তারা আনন্দ উত্তেজনায় চিৎকার করতে লাগল। যাই হোক, সেই এলাকা থেকে বেরিয়ে আমরা আরেকটি পশুরাজ্য প্রবেশ করলাম। এই জায়গাটি জিরাফ, জেব্রা, ময়ূর জাতীয় নিরীহ পশুদের অভয়ারন্য। গাড়ী থেকে আমরা প্রায় কয়েক শত জীবজন্তু দেখে আমরা আবার ফিরে আসলাম সাফারির প্রবেশ পথে। এবার আমরা সাফারির আরেকটি অংশে যেখানে বিভিন্ন পশুর খেলা দেখানো হয় সেখানে গেলাম। প্রথমে আমরা উপভোগ করলাম ওরাংওটাং শো। নারী ও পুরুষ দুই ওরাংওটাং অদ্ভুত নাটক করে হৃদয় জয় করল কয়েকশ দর্শকের। চারিদিকে চলল তুমুল করতালি। এরপরে দেখলাম বিখ্যাত ডলফিন শো। কয়েকটি ডলফিন পানিতে নেচে ও নানা রকম কসরত করে আমাদের মন মাতালো। দেখলাম স্কুল থেকে দলে দলে শিশুরা এসেছে এই শো দেখতে। কয়েকজন অত্যন্ত দক্ষ প্রশিক্ষক এই শো পরিচালনা করল। ডলফিনের শো দেখতে গিয়ে আমরা ভিজে গেলাম। তবুও আমাদের আনন্দের শেষ নেই। সবশেষে আমরা উপভোগ করলাম সীল মাছের শো। সীল মাছকেও যে ট্রেনিং দিয়ে খেলা করানো সম্ভব তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। দুপুরের খাবারের জন্য গেলাম রেস্টুরেন্টে। সেখানে খাওয়ার পাট চুকিয়ে হাতি ও পাখির আরও দুটি খেলা দেখলাম। সাফারির সব শেষ আকর্ষণ ছিল জেমস বন্ডের শো। জেমস বন্ডের সিনেমা যেন স্বচোখে দেখলাম। সাফারি ভ্রমণ শেষে আমরা প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরলাম। কিন্তু মন পড়ে রইল সাফারি পার্কের অদ্ভুত সুন্দর পশু পাখি ও এদের মনমুগ্ধকর খেলার দিকে। আমার ও আমার স্ত্রীর থেকেও আমাদের ছেলে মেয়েরা সাফারী পার্কে কাটানো সময়টা বেশি উপভোগ করেছে। এই সাফারি পার্ক এখনও আমার মনে দাগ কেটে আছে। এছাড়া থাইল্যান্ডের আর কোথায় কোথায় ঘুরলাম এবং কী কী দেখলাম সেটা আপনাদের কাছে অন্য কোন লেখায় তুলে ধরব।

No comments

Powered by Blogger.