পদ্মা সেতুর অংশীদার হতে চাই by ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

এ মুহূর্তে পদ্মা সেতু নিয়ে দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে। অফিস-আদালত, পাড়া-মহল্লায় সর্বত্র একই আলোচনা-বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির দায়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত করেছে। অন্যদিকে সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোন দুর্নীতি হয়নি।


এ প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়ভাবে বলেছেন, বিশ্বব্যাংক যেখানে কোন অর্থায়ন করেনি, সেখানে দুর্নীতি হলো কি করে? তাছাড়া প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর ভাষ্য ও সমকালের (২ জুলাই ২০১২) লেখাটি মানুষকে বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করেছে। জামিলুর রেজা চৌধুরীর ভাষ্যে জানা যাচ্ছে যে, বিশ্বব্যাংক একটা চীনা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিল, কিন্তু তাদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকায় তারা কাজটি পায়নি। জামিলুর রেজা চৌধুরীর পুরো লেখাটি পড়লে মনে হয়, বিশ্বব্যাংক বরং ঐ কাজটি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দিতে না পারার জন্য ক্ষুব্ধ হয়ে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে তার বক্তৃতায় বলেছেন যে, বিশ্বব্যাংক আমাদের ঋণ দেয়, তার বিনিময়ে আমরা তাদেরকে সুদ দেই। আমরা কারও কাছ থেকে ভিক্ষা নেই না (৮ জুলাই, নফহবংি২৪.পড়স)।
কথাটি যে কত সত্য তা বাংলাদেশের মতো গরিব দেশ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করে। প্রধানমন্ত্রীর আরও দু’একটা কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি ঐ দিন আরও বলেছেন যে, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শের কারণে আমাদের রেল আজ মৃতপ্রায়। আদমজী বন্ধ করে পাট শিল্প ধ্বংসপ্রায়। ১৯৭২-৭৩ সালের পর এ সত্যটি এমনভাবে আর কেউ উপলব্ধি করেননি। ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন দুই প্রধান কর্মকর্তা মি. ম্যাকনামারা ও মি. কারগিল এসেছিলেন বাংলাদেশে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে তাঁরা সাক্ষাৎ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের সাথে সাক্ষাৎকালে তারা জানতে চান যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য কি ধরনের সহায়তা দরকার। তখন তাজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য প্রথমে দরকার গরু; তারপর দরকার গরু বাঁধার রশি। কথাটা এই দুই কর্মকর্তার মনঃপূত হয়নি। তখন তাজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী দেশে এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, কৃষক কোন ফসল উৎপাদন করতে পারেনি। পাট চাষ হয়নি বলে রশি নেই। আর কৃষকের ঘর-বাড়ি, গরু-বাছুর সবই ধ্বংস করেছে পাকিস্তানীরা। ফলে গরু ও গরুর রশি দুটোই দরকার। কথাগুলো ভাল লাগার কথা নয় তাদের। তাছাড়া বিশ্বব্যাংক তখন থেকেই যে মার্কিন তাঁবেদারি করে তা প্রায় সবারই জানা।
বাংলাদেশ তখন কেবল সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তদুপরি সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সহায়তা দেবার কারণে তার সাথেও বাংলাদেশের সম্পর্ক ভাল। তাই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চেষ্টা করে। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধে মার্কিনীদের পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন, দ্বিতীয়ত, বিশ্বব্যাংকের সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ মার্কিনী খপ্পরে পড়বেÑএই আশঙ্কায় তাজউদ্দীন আহমদ তাদের সাহায্য নিতে অনাগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তারা বঙ্গবন্ধুর ওপর নিরন্তর চাপ সৃষ্টি করে; এমনকি সরকারেরও একটা অংশ মার্কিনীদের পক্ষ নেয়। ফলে ১৯৭৪ সালে তাজউদ্দীনকেই অর্থমন্ত্রী তথা মন্ত্রিত্ব থেকে সরে যেতে হয়; যার মাসুল দিতে হয় সমগ্র বাংলাদেশকে। তাজউদ্দীনবিহীন মন্ত্রিসভায় খন্দকার মোশতাকের প্রভাব বিস্তৃত হয়, ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়, যে বেদনার ভারে এখনও বাঙালী ন্যুব্জ। তাই প্রধানমন্ত্রীর এমন সাহসী উচ্চারণে একদিকে যেমন উদ্দীপ্ত হই; তেমনি এক অজানা আশঙ্কা পেয়ে বসে। কারণ বিরোধী দল গতানুগতিকভাবে বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যকেই সমর্থন করছে। তারা দেশের মর্যাদার বিষয়ে ভাবছে না একটিবারও। তাই সবার সতর্ক থাকার প্রয়োজন ঐ ধরনের কোন ষড়যন্ত্র যেন না সফল হয়।
পদ্মা সেতু নিয়ে মানুষের স্বপ্ন এখন তুঙ্গে। বর্তমান সরকার মানুষকে সেই স্বপ্নের জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করায় এবং সর্বশেষ নিজেদেরকে অর্থায়ন থেকে সরিয়ে নেয়ায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি হতাশাও যেন আঁচ করা যাচ্ছিল। ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা এল যে, দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হবে। এই খবর প্রচারিত হবার পর পরই চারদিকে আবার অলোচনা শুরু হয়েছে যে, এই অর্থের যোগান হবে কিভাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে তারা ৫ হাজার কোটি টাকা এখানে সরবরাহ করতে পারবে। এতে বাজেটের ওপর কোন প্রভাব পড়বে না। ইন্স্যুরেন্স এ্যাসোসিয়েশন ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চেয়েছে। সবচেয়ে সাড়া জাগানো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তাদের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আতাউর রহমানের আহ্বানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পকেটে যা ছিল তাই তারা নিবেদন করেছে পদ্মা সেতুর জন্য। শিক্ষক ও ছাত্র সমাজের এ ধরনের উদ্দীপনা জাগানিয়া কাজ সাম্প্রতিককালে খুব বেশি চোখে পড়েনি।
পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বাজারে বন্ড ছাড়া ও সারচার্জ আরোপের বিষয়টি নিয়েও কথা উঠেছে। কিন্তু কোন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। দেশের সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী একদিনের বেতন দিয়ে পদ্মা সেতুতে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে পারে। তবে দেশবাসীর যে বিপুল আগ্রহ রয়েছে পদ্মা সেতুতে তা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়েছে গত কয়েক দিনে। প্রসঙ্গত দু’টো ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। প্রথমটি মিসরের, দ্বিতীয়টি ইরানের ঘটনা। মিসরে সুয়েজখালের মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিন ব্রিটিশ সরকারের সাথে মিসরীয় সরকারের টানাপোড়েন চলছিল। খালটি খননে ব্রিটিশরা সহায়তা দিয়েছিল সত্য, কিন্তু ১৮৮২ সালে ব্রিটিশ কর্তৃক মিসর দখলের পর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে এ খালের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশরা নিয়ে নেয়। এমনকি ১৯৩৬ সালের ইঙ্গ-মিসরীয় চুক্তির পরও মিসরীয়রা এর মালিকানা পায়নি। শেষাবধি ১৯৫৬ সালে প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসের সুয়েজখালকে জাতীয়করণ করেন। এ ঘটনা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে সাড়া জাগায়। ইরানের ঘটনাটি তেল নিয়ে। ১৯০৬ সালে ইরানে তেল আবিষ্কৃত হবার পর তাদের প্রযুক্তির অভাবের কারণে তারা উন্নত দেশগুলোর ওপর এ বিষয়ে নির্ভরশীল হয়। কিন্তু পরে দেখা যায় উৎপাদিত তেলের সিংহভাগ নিয়ে যায় উৎপাদনকারী উন্নত দেশগুলো। এসব বিষয় নিয়ে ইরানের রাজনীতি উত্তপ্ত হয় এবং দ্রুত ক্ষমতার পালা বদল হতে থাকে। এমনকি একাধিক প্রধানমন্ত্রী ইরানের তৈল রাজনীতির কারণে হত্যার শিকার হন। শেষাবধি ড. মুসাদ্দেক ইরানের তেল সম্পদকে জাতীয়করণ করেন। উপর্যুক্ত দু’টো ঘটনার পর দু’দেশের মানুষ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। তাদের শক্তি ও সাহস সম্পর্কে দেশের মানুষের নতুন আস্থা তৈরি হয়। বাংলাদেশের মানুষের সামনেও এখন সেই রকম একটি ক্ষণ সমুপস্থিত। বাংলাদেশের জনগণ যে পারে, তা তারা ’৫২ ও ’৭১সহ বিভিন্ন সময়ে যেমন প্রমাণ করেছে, ঠিক আরেকবার প্রমাণের সুযোগ এসেছে। প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের গুটিয়ে নেয়ার ২-১ দিন আগেই বলেছিলেন যে, আমাদের গরিব দেশে যতটুকু সম্পদ আছে তার ওপরও অনেকের লোভের দৃষ্টি। নিকট অতীতে কোন সরকারপ্রধান স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে এ ধরনের মন্তব্য করেছেন বলে জানা নেই। সে জন্যই তিনি বলতে পারেন, আর কোন অনুরোধ নয়, দেশীয় অর্থেই পদ্মা সেতু হবে। এখন প্রয়োজন এ ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত থাকা এবং এটি বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্স এ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য আমরা শুনেছি। আমি অর্থনীতির মানুষও নই, আবার ব্যবসা-বাণিজ্যেরই কোন জ্ঞান নেই। তবু পদ্মা সেতু নিয়ে জনগণের অংশগ্রহণ বিষয়ে একটা নিজস্ব ভাবনার কথা বিনীতভাবে উপস্থাপন করতে চাই। পদ্মা সেতু নির্মাণে ২২ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে বলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে দেখেছি। এখানে বছরওয়ারী একটা খরচের কথাও বলা হয়েছে, যাতে অর্থনীতির ওপর কোন প্রভাব না পড়ে। তবে উপর্যুক্ত বিভিন্ন প্রস্তাব বা চিন্তার সাথে একটি সরল প্রস্তাব হলো, পদ্মা সেতুর জন্য শেয়ার ছাড়া যেতে পারে। ধরে নিই একটা শেয়ারের দাম ১০ হাজার টাকা। তাহলে যার যতটুকু সামর্থ্য আছে তিনি ততগুলো শেয়ার কিনবেন। যেসব বিদেশী প্রতিষ্ঠান এখানে সহায়তা দেবে তাদের পাওনা যেমন সেতুর টোল থেকে পরিশোধ হবে, ঠিক তেমনি শেয়ার হোল্ডারদেরও একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এখান থেকে অর্থ শোধ করা হবে। ধরে নিই ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করা হলো। ঐ সময় থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত শেয়ার হোল্ডারগণ তার বিনিয়োগের পরিমাণের ওপর বছরে ১-২ বার অর্থ/মুনাফা পাবেন। শেয়ারগুলো হস্তান্তরযোগ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। এভাবে যদি জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া যায়। বিশ্বাস করি পদ্মা সেতু তৈরিতে টাকা কোন সমস্যা হবে না। তাছাড়া সেতুর ওপর জনগণের সার্বভৌমত্বও প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে সরকারের রাজস্বের ওপর কোন চাপ পড়বে না এবং উন্নয়ন কর্মকা-ও ব্যাহত হবে না। এ ক্ষেত্রে সেতু নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সর্বোচ্চ ত্যাগ ও দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়া দরকার। এ দেশের মানুষের মধ্যে বঙ্গবন্ধু তিলে তিলে যে প্রেরণা ও স্বপ্ন তৈরি করেছিলেন তা বাস্তবায়িত হয়েছিল একাত্তরে। এবার পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের আচরণে মানুষের মধ্যে এক নতুন জাগরণ তৈরি হয়েছে। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক তাঁর দেশকে যেভাবে সেবা দেয়, ভালবাসে, এতটুকু ভালবাসা ও সেবা সকল রাজনীতিবিদ ও আমলা, শিক্ষক-ছাত্র সবাই মিলে যদি দেশকে দেয়, তাহলে পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের তৈরি ঐ বন্ধুর পথ অতিক্রম করা মোটেই কষ্টসাধ্য নয়। এখন মফস্বলের রিকশাওয়ালা ও সাধারণ গ্রাম্য কৃষকও বলতে শুরু করেছে যে, যদি সরকারের কোন মন্ত্রী দুর্নীতি করে থাকে নিশ্চয়ই তার বিচার হবে; কিন্তু বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির বিচার করবে কে? কারণ তারা অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেবার জন্য তদ্বির করেছে। এজন্য আমরা, এ দেশের আপমর মানুষ পদ্মা সেতুর অংশীদার হতে চাই। সরকার যে কোন পন্থায় ব্যবস্থা নিন।

লেখক : উপ-উপাচার্য,খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
ভধুবশুুঁধসধহস@ুধযড়ড়.পড়স

No comments

Powered by Blogger.