বুয়েট এখনো অচল-আলোচনা চালিয়ে যেতে উপাচার্যকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাস এখনো উত্তাল। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক আন্দোলনের মুখে গতকাল বৃহস্পতিবার উপাচার্য এস এম নজরুল ইসলাম আবারও বলেছেন, অনৈতিক কোনো দাবির কারণে তিনি পদত্যাগ করবেন না। অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা বলেছেন, উপাচার্যকে পদত্যাগ করতেই হবে। সিন্ডিকেট সভায়


বিচার বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশের বিরোধিতা করে তাঁরা বলেছেন, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য পদত্যাগের পরই এ ধরনের তদন্ত গ্রহণযোগ্য হবে। গতকাল ছিল বুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন। এদিন বিকেলে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনসহ বুয়েটের সাবেকরা এসে আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন। তবে দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে বুয়েটের সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
এ পরিস্থিতিতে গতকাল সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুয়েটের উপাচার্যসহ সিন্ডিকেট সদস্যদের গণভবনে ডেকে নেন। জানা গেছে, উপাচার্য ড. এস এম নজরুল ইসলামকে আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে উপাচার্যের নেতৃত্বে বুয়েটের প্রতিনিধিদলে ছিলেন সিন্ডিকেটের আট সদস্য। তাঁরা আধা ঘণ্টা গণভবনে ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর উপাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, 'আমি ও সিন্ডিকেট সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীকে বুয়েটের সার্বিক অবস্থা জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী সব শুনে শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা চালাতে বলেছেন।' প্রধানমন্ত্রী কোনো সিদ্ধান্ত দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী সব শুনেছেন। পরে হয়তো সিদ্ধান্ত দেবেন।' প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী বুয়েটের সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন বলে উপাচার্য জানিয়েছেন। তবে এর প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল রাতে বুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. আশরাফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেছেন, 'এ পরিস্থিতিতে উপাচার্যের সঙ্গে নতুন করে আলোচনার কোনো সুযোগ বা প্রয়োজন কোনোটাই নেই। সবার আগে আমরা চাই উপাচার্যের পদত্যাগ।' প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উপাচার্যের বৈঠক সম্পর্কে তিনি বলেন, 'উপাচার্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে কি না কি বলেছেন তার কিছুই আমরা জানি না। উপাচার্যের সদিচ্ছা থাকলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতেন।'
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী দুপুরে বুয়েটের পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বুয়েটের সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করেন। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ইউজিসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার পরই প্রধানমন্ত্রী বুয়েট কর্তৃপক্ষকে তাঁর সঙ্গে বৈঠকের জন্য ডেকে পাঠান।
গতকাল দুপুরে নিজ বাসভবনে বুয়েটের উপাচার্য এস এম নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, 'আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, অনৈতিকভাবে আমি পদত্যাগ করব না। নৈতিকভাবে আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ এলেই কেবল আমি পদত্যাগ করতে পারি।'
অন্যদিকে বুয়েটের চলমান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার রাতের বৈঠকে সিন্ডিকেট বিচার বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
'লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের' দ্বিতীয় দিনে বুয়েটের প্রশাসনিক ভবনের সামনে আয়োজিত সমাবেশে বুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও যোগ দিয়েছেন। এ অবস্থায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। আর তদন্ত যদি হয়ও, তা হতে হবে তাঁরা পদ থেকে সরে যাওয়ার পর। কারণ উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিজেরা তদন্তের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা সিন্ডিকেটকে জানিয়েছেন। এ সিদ্ধান্ত উপাচার্যের একক সিদ্ধান্ত। এটা মেনে নেওয়া যায় না।'
এ বিষয়ে উপাচার্য কালের কণ্ঠকে বলেছেন, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের সুপারিশ গত রবিবার আচার্যের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। আর বুধবার রাতে সিন্ডিকেট সভায় তা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
গতকাল ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকেই প্রশাসনিক ভবনের সামনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবস্থান ধর্মঘট চলছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে শামিয়ানা টানিয়ে এর নিচে চলতে থাকে বক্তৃতা, প্রতিবাদী গান ও আবৃত্তি। এ সময় চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অভি, নাভিদ ও আরিক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অনেকে অভিযোগ করেছেন, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের প্ররোচনায় আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। কিন্তু আমরা বুয়েটকে বাঁচানোর জন্য এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছি।' বুয়েটের ভেতরের মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে তাঁরা বলেন, 'এখানে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে, তা আমরা কিছুটা টের পেয়েছি। বাইরে থেকে তা চোখে পড়বে না।' তাঁদের মতে, বুয়েটে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা কেবল উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের মধ্য দিয়েই শেষ হবে।
উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে বুয়েটের শিক্ষক সমিতি এর আগে গত ৭ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করে। এরপর প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের দাবি বিবেচনার আশ্বাস দিলে সমিতি এক মাসের জন্য আন্দোলন স্থগিত করে।
তবে দাবি পূরণ না হওয়ায় গত ৭ জুলাই থেকে প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করছিলেন শিক্ষকরা।
গণপদত্যাগ অবৈধ : বুয়েটের ডিন, পরিচালক, বিভাগীয় প্রধানসহ ২৪ জনের পদত্যাগের বিষয়ে উপাচার্য গতকাল বলেন, তাঁরা প্রতীকী পদত্যাগ করেছেন। এ পদত্যাগ অবৈধ। একটি কাগজে ২৪ জন স্বাক্ষর দিয়ে পদত্যাগ করলেই হলো না। এটা কোনো নিয়ম নয়। পদত্যাগ করতে হলে প্রত্যেককে আলাদাভাবে নিয়মানুযায়ী পদত্যাগপত্র দিতে হবে। ২৪ জনের এ পদত্যাগকে উপাচার্য আন্দোলনের কৌশল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি আরো বলেন, 'বুয়েটের কিছু শিক্ষক আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। আর এই শিক্ষকরাই আন্দোলন করছেন। তাঁদের আন্দোলন করার নৈতিক ভিত্তি নেই। সব মিলিয়ে গুটিকয়েক শিক্ষক ছাত্রদের নিয়ে এ আন্দোলন করছেন।'
উপাচার্য পদত্যাগ করলেই সংকটের সমাধান হবে কি না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বুয়েটের উপাচার্য বলেন, 'আমি পদত্যাগ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। তাহলে এটি অন্যায় হবে।'

No comments

Powered by Blogger.