মুম্বাইয়ে মুসলমানরা বাড়ি কিনতে বা ভাড়া চাইতে গেলে শুনতে হয় এ মন্তব্য-বিক্রি করব না, ভাড়াও দেব না

মুম্বাইয়ের এক রেডিও জকি ইউনুস খান। সাধ আর সাধ্য মিলিয়ে একবার ঠিক করলেন, শহরতলীর গোরাই এলাকায় ফ্ল্যাট কিনবেন। ফ্ল্যাট কেনাবেচায় জড়িত এক দালালের সঙ্গে যোগাযোগও শুরু করলেন। কিন্তু এক সময় তাঁকে জানানো হলো, 'গোরাইয়ে তাঁর পক্ষে ফ্ল্যাট পাওয়া সম্ভব নয়।' গেরুয়াধারী শিবসেনা নিয়ন্ত্রিত এলাকা গোরাইয়ে


মুসলমানদের প্রবেশ নিষেধ। শুধু গোরাই নয়, মুম্বাইয়ের বহু এলাকাতেই মুসলমানদের বাস নিষিদ্ধ। বাড়ি বা ফ্ল্যাট তাদের কাছে বেচা হয় না। ভাড়াও দেওয়া হয় না।
ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দুকে ইউনুস এ প্রসঙ্গে বললেন, 'ওই এলাকা মুসলমানদের জন্য নয়। আমার স্ত্রী হিন্দু। আমাকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল স্ত্রীর নামে ফ্ল্যাট কিনতে। কিন্তু এভাবে নিজেকে গোপন করে বাস করাও তো সম্ভব নয়। কারণ আমার নামে চিঠি আসবে, ব্যাংকের বিবৃতি আসবে।' ইউনুসের ভাইয়ের অভিজ্ঞতাও একই।
মুম্বাই সম্পর্কে বলা হয়, এ নগরী কখনো ঘুমায় না। মুম্বাইবাসীও শহরের বিশ্বজনীনতা নিয়ে গর্বিত। অথচ ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস আর ভাষা নিয়ে শহরজুড়ে ছড়িয়ে আছে গভীর বিভক্তি। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন সাউথ মেট্রোসিটি এসোসিয়েশন অব রিয়েলটরসের সদস্য এইস রিয়েলটরসের মেহুল বেদ বলেন, 'দক্ষিণ মুম্বাইয়ের ওয়াকেশ্বর, মালাবার হিল, পেদ্দার রোড, ব্রিচ ক্যান্ডি; পশ্চিম মুম্বাইয়ের ভিলে পারলে, বান্দ্রা, বোরিভালি, কান্দিভালি এবং পূর্বের ঘাটকোপার, সিওন ও মুলুন্দসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।' একই সংগঠনের সদস্য প্রিমিয়াম হাউসিংয়ের সঞ্জয় মুন্দ্রা বলেন, 'ওয়াকেশ্বরের মাত্র কয়েকটি ভবন ছাড়া ওই এলাকার আর কোথাও মুসলমান নেই।' আরেক এজেন্ট বললেন, 'প্রায় পুরো শহরেই মুসলমানদের কাছে বাড়ি ভাড়া বা বিক্রি করতে রাজি নয় মালিকরা। আমি জুহু, বান্দ্রা, পেদ্দার রোড ও কোলাবায় কাজ করেছি। ফ্ল্যাট খালি নেই বা আত্মীয় আসবে_এ ধরনের অজুহাতে ৯৫ শতাংশ বাড়িওয়ালা মুসলমানদের সরাসরি না করে দেয়।'
মুন্দ্রা মুসলমানদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, 'ওদের কাপড় পরার ধরন আলাদা। তিন-চারজন বোরখাপরা নারী একসঙ্গে লিফটে উঠলে বাকিদের জন্য তা বিব্রতকর হয়ে দাঁড়ায়। আমি কোনো গোষ্ঠীরই বিরুদ্ধে নই। তবে সবাই এক রকম নয়। ওদের আদবকায়দা বা পরিচ্ছন্নতা বোধ নিয়ে প্রশ্ন আছে। অস্বস্তিটা মানসিক। তাদের তিন-চারটে করে বউ থাকতে পারে, সঙ্গে অনেক ছেলে-মেয়ে। ফলে ওদের লোকজনও বেশি, শব্দও বেশি।'
হিন্দু-মুসলমান মিশ্র বিয়ের বিষয়টিও সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। হিন্দু স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে তাদের মুসলমান সঙ্গীরা থাকবে_বিষয়টিতে হাউসিং সোসাইটিগুলোর আপত্তি রয়েছে। নানা কারণেই মুম্বাইয়ের হিন্দুদের মুসলমান বিষয়ে অস্বস্তি যায় না। ২০০৯ সালে চলচ্চিত্র অভিনেতা ইমরান হাশমি পালি হিল এলাকায় বাড়ি কিনতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। বিষয়টি নিয়ে মহারাষ্ট্র রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনে নালিশ করেন তিনি। তবে তাতে কোনো কাজ হয়নি। মেহুল বেদ জানান, বহু সোসাইটিতে আইন করে মুসলমানদের কাছে বাড়ি ভাড়া বা বেচার আগে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়েছে। যা প্রকারান্তে নিষেধ করার শামিল।
তবে শুধু ধর্ম নয়; সংকট রয়েছে খাদ্যাভ্যাস নিয়েও। বহু পাড়াতে আমিষভোজিরা নিষিদ্ধ। ফ্ল্যাটের দালালরা জানান, 'আমিষ-নিরামিষ ইস্যুও মুম্বাইয়ে বাড়ি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় অন্তরায়। আপনি চাইলেই দোকান ভাড়া দিতে বা পিৎজার দোকান খুলে বসতে পারবেন না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পাশের দোকানিই সাইনবোর্ড উঁচিয়ে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছে, ওই দোকানে যাবেন না, ওদের বর্জন করুন। ফলে টিকে থাকাই মুশকিল।' গুজরাট ও মাড়ওয়ারি বাড়িওয়ালাদের মধ্যেও খাদ্যাভ্যাসের কারণে মুসলমানদের ভাড়া না দেওয়ার প্রবণতা প্রবল।

No comments

Powered by Blogger.