ঘুরে এলাম মুম্বাই ॥ রানা সুলতানা

ছোটবেলা থেকেই বিদেশে বেড়াবার শখ ছিল। আর এই শখটা পেয়েছিলাম বাবার কাছে থেকে। বাবা আমাকে নানান জায়গায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিয়ের পরে দেখলাম আমার স্বামীরও একই রকম শখ রয়েছে। তার সাথে বেড়ানো হয়েছে নানান জায়গায়। ক’বছর আগে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা করলাম আমরা।


সঙ্গে ছিল আমার বড় ছেলে। ওর তখন স্কুল বন্ধ কাজেই আমরা মোটামুটি আট দশ দিনের একটা প্ল্যান করে ইন্ডিয়ার ভিসার জন্য আবেদন করলাম। আজকাল এই ভিসা পেতে বেশ সময় লাগে। যাইহোক শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল ভিসা। আমি,আমার স্বামী আর আমার ছেলে , এই তিনজন বেরিয়ে পড়লাম ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে।আমরা বেনাপোল বর্ডার পেরিয়ে প্রবেশ করলাম ইন্ডিয়ায়। সেখান থেকে মাত্র তিনঘন্টায় পৌঁছে গেলাম কলকাতায়। একটা হোটেলে উঠে চিন্তা করতে শুরু করলাম কোথায় যাওয়া যায়। হোটেলের পাশেই ছিল একটা ট্রাভেল এজেন্সী। সেখানে গিয়ে আমরা বললাম যে ৮-১০ দিন বেড়াতে চাই, ইন্ডিয়ার কোন দিকে ঘুরতে গেলে ভাল হয়। ওরা অনেকগুলো জায়গার কথা বললো। দিল্লী, মুম্বাই অথবা দক্ষিণ ভারতের কোন শহর। আমাদের মুম্বাই যাবার প্রস্তাবটি সবচেয়ে পছন্দ হলো। কারণ ছোটবেলা থেকে মুম্বাইয়ের সিনেমা দেখে বড় হয়েছি, শুনেছি মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বাই নাকি বেড়াবার জন্য খুবই ভাল। তাই আর দেরী না করে মুম্বাই যাবার টিকেট কাটতে বলে দিলাম। কিন্তু মুশকিল হলো ট্রেন টিকিট পাওয়া নিয়ে। ওই দেশে এতো মানুষ ট্রেনে যাতায়াত করে যে ট্রেনে টিকিট পেতে হলে অন্তত কয়েক দিন আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। যাইহোক বিদেশী কোটায় ট্রেন টিকিটের ব্যবস্থা হলো। টিকিট পাওয়া গেলো পুনের। পুনেতে নেমে মুম্বাই যেতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় না থাকায় আমরা তাতেই রাজী হয়ে গেলাম। তবে কোনমতেই ভাল সিট পাওয়া গেলো না। খুব সাধারণ বা সুলভ শ্রেণীতে তিনটি স্লিপারের টিকিট পাওয়া গেল। প্রথমে ভেবেছিলাম গরমের মৌসুমে ভীষণ গরমে বোধ হয় কষ্ট পাবো কিন্তু ট্রেনে ততটা গরম লাগেনি। হাওড়া ষ্টেশন থেকে গীতাজ্ঞলী এক্সপ্রেসে রাতের ট্রেনে রওনা দিলাম আমরা। প্রথমে ট্রেনে উঠে একটু মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কারণ যতটা পরিচ্ছন্ন ট্রেন আশা করেছিলাম ট্রেনটা ততটা পরিস্কার না। আমাদের আশেপাশে সবাই ছিল বাঙালী। আমাদের পুনেতে পৌঁছাতে সময় লাগবে ৩৬ ঘন্টা। এত দীর্ঘ সময় শুনে প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলাম। যাইহোক প্রথম রাতটা স্লিপারে ঘুমিয়ে ভালই কাটল। দিনের বেলা ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে সময় কাটালাম। একেকটা প্রদেশ ট্রেন পাড় করছে আর সেই সাথে বদলে যাচ্ছে বাইরের দৃশ্য, প্রকৃতি, কালচার সবকিছু। আমার ছেলে প্রথমে একটু খুশিতে থাকলেও শেষের দিকে সে বেশ অস্থির হয়ে পড়ে। ওকে আর দোষ দিয়ে কি লাভ। আমি নিজেই দুই রাত একদিনের ট্রেন জার্নিতে বেশ বিরক্ত হয়ে পড়ি।
যা হোক বেশ সকালে আমরা পৌঁছালাম পুনেতে। স্টেশনে নেমেই স্টেশনের খুব কাছে থেকেই মুম্বাই যাবার একটা ভাল বাস পেয়ে উঠে পড়লাম আমরা। বাসটা সত্যি খুব ভাল ছিল। পথে একটা রেস্তোরায় বাসটা থামানো হলো খাবারের জন্য। মুম্বাই থেকে পুনে যাবার রাস্তাটা ভারী সুন্দর। দুইপাশে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলেছে আমাদের বাসটি। ঠিক মনে নেই, সম্ভবত ৪-৫ ঘন্টার মধ্যেই বাসটি মুম্বাই পৌঁছাল। আমরা বাস থেকে নেমে একটা ট্যাক্সিতে উঠলাম। ট্যাক্সিচালককে বললাম আমরা সাধারণ দামের মধ্যে একটা হোটেলে যেতে চাই। ড্রাইভার আমাদের পৌঁছে দিল একটা সাধারণ মানের হোটেলে। ওই এলাকাটিকে বলে পুরানো মুম্বাই। ওখানে আদালত, অফিস সবকিছু রয়েছে। শুনলাম প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসে এখানে কাজের সন্ধানে। রাস্তায় রয়েছে মানুষের ভীড় আর রয়েছে বেশ যানজট। যেদিন পৌঁছালাম সেইদিন আমরা বেশ ক্লান্ত ছিলাম। তবুও লোভ সামলাতে পারলাম না মুম্বাইয়ের বিখ্যাত মেরিন ড্রাইভ দেখার। একটা ট্যাক্সিকে বলতেই আমাদের নিয়ে গেলো মেরিন ড্রাইভে। ওখানে পৌঁছেই মনে হলো কত বোম্বের সিনেমায় এই জায়গাটা দেখছি। আরব সাগরে তীরের এই মুম্বাই শহরটিতে রয়েছে অসংখ্য সমুদ্র সৈকত। তারই একটিকে বানানো হয়েছে মেরিন ড্রাইভ । আরব সাগরের তীরকে বাঁিধয়ে তার পাশ দিয়ে লম্বা ড্রাইভের ব্যবস্থা। বাঁধানো তীরের উপর শত শত মানুষ বসে সময় কাটাচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে অনেক ধরণের খাবার। তাকালেই দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের বিশালতা।সমুদ্রে ঘোরার জন্য বোটিংয়ের ব্যবস্থাও আছে। আমরাও কিছুক্ষণ বসলাম বাঁধানো পাড়ে। বেশ রাত হয়ে যাচ্ছিল বলে আমরা সেইদিনকার মতন হোটেলে ফিরে এলাম। পুরানো মুম্বাই এলাকাটি বেশ ঘিঞ্জি। রাস্তার দুইপাশে প্রচুর দোকানপাট। এখানে রয়েছে ছোট বড় অনেক খাবারের রেস্তোরা। আমরা প্রতিদিন রাতে হোটেলের পাশের একটি রেস্তোরায় খেতে যেতাম। খাবার ছিল ট্রাডিশনাল ইন্ডিয়ান ফুড। দ্বিতীয় দিন সকালে আমরা একটি টুরিস্ট বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারা বললো সকাল ১০টার মধ্যে তৈরি হয়ে থাকতে। ঠিক সময় মতো বাস হোটলের নিচে এসে উপস্থিত। আমরা উঠে পড়লাম বাসে। বাসে উঠে দেখি দক্ষিণ ভারত থেকে বেড়াতে আসা একদল ভ্রমণকারীও আমাদের দলের সঙ্গে রয়েছে। তারাও গভীর বিস্ময়ে নিজের দেশের আরেক প্রান্ত দেখছে। বাস চলা শুরু করলো। কিছু দূর যেতেই বাসের গাইড বেশ রসিয়ে বললেন সামনেই পড়বে অভিনেতা সঞ্জয় দত্তের শ্বশুড়বাড়ী অর্থাৎ আদালত। আদালত ভবনটি বেশ রাজকীয় ধাঁচে নির্মিত। প্রথমেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো মেরিন ড্রাইভের নিরমলা পয়েন্টে। যা কিনা আমরা গত রাতেই দেখেছি। এর কাছেই ছিল গেট অফ ইন্ডিয়া। আরব সাগরের পাড়ে দরজার মতন নির্মিত এই গেটটি আকারে বিশাল। গেটের সামনে যেন দেশি বিদেশী পর্যটকের মেলা বসেছে। বৃটিশ রাজা জর্জ দি ফিফথ ১৯১১ সালে নাকি এই দরজা বা সমুদ্র বন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। আরো শুনলাম মহাত্মা গান্ধী যখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরেছিলেন তখন তিনিও নাকি এই পথেই এসেছিলেন।এই দরজার উল্টো দিকেই বিখ্যাত তাজ হোটেল। এই হোটেলটিই ২০০৮ সালে জঙ্গী হামলার শিকার হয়েছিল। বর্তমানে এটিকে পুনর্নিমার্ণের কাজ চলছে। দর্শণীয় স্থানগুলো দেখছিলাম আর প্রতি মুহূর্তেই আমার মনে হচ্ছিল নানা হিন্দী সিনেমায় দেখা নানা দৃশ্যের কথা। যেন হুবহু মিলে যাচ্ছিল ছবির দৃশ্যের সাথে। আমাদের গাইড জানালেন এই গেটের সামনে প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন সিনেমার শুটিং হয়ে থাকে। এইখানে আমাদের গাইড ঘোষণা করলেন খাবারের বিরতি। আমরা একটু এগুতেই খাবারের দোকান পেয়ে গেলাম। হঠাৎই আমার ছেলে চেঁচিয়ে উঠল। সে তো আনন্দে আত্মহারা। কারণ সে দেখতে পেয়েছে তার প্রিয় খেলোয়ার শচীন টেন্ডুলকারের বিখ্যাত ক্যাফে। সময়ের অভাবে ক্যাফেতে ঢোকার সুযোগ হলো না। এই ফাঁকে বলে রাখা ভাল যে মুম্বাইয়ে আসার আগে আমরা ভেবেছিলাম এই জায়গাটা বোধ হয় ভীষণ দামী হবে। কিন্তু এখানে সাধারণ মানুষের সামর্থ্যরে মধ্যেও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমরা যে টুরিস্ট বাসে করে সারাদিন শহরের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ঘুরে দেখলাম তা ছিল নিতান্তই সস্তা। তবে এ কথা সত্য যে শহরটি মূলত ধনীদের। বড় বড় হোটেল আর শপিং সেন্টারে ভরা একটি শহর। আবার এই শহরের একটি ভিন্ন চিত্রও আমরা দেখেছি ট্রেনে শহরটি পেরিয়ে পুনে যাবার পথে। ট্রেন থেকে স্পষ্ট দেখা যায় মাইল কে মাইল ধরে বস্তি। সেই বস্তি অবশ্য সুগঠিত। তাতে বসবাসের সুযোগ সুবিধাও রয়েছে। এই ধনীদের শহরটি আসলে চলে এই বস্তিবাসীর মেহনতে। শহরের ভুলাভাই দেশাই রোডে অবস্থিত মহালক্ষীর মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হল আমাদের। আমাদের সঙ্গী হিন্দুধর্মাবলম্বীরা পরম শ্রদ্ধায় মন্দিরে প্রবেশ করে পূজা করলেন। পথ চলতে চলতে একটি টিলার সামনে এসে বাস থামানো হলো। এই টিলার খুব কাছে যাওয়া নিষেধ। এই টিলার নাম টাওয়ার অফ সাইলেন্ট সিমেট্রি। আমাদের গাইড বললেন এই উঁচু টাওয়ারটিতে পার্সি ধর্মাবলম্বীদের দেহবাশেষ ফেলে দেয়া হয় । পরে চিল ও অন্যান্য পশু পাখিরা তা খায়। আর দেহের বাকি অংশ ওষুধ দিয়ে গলিয়ে তরল করে বের করে দেয়া হয়। এইটাই হচ্ছে পার্সিদের ধর্মীয় আচার। আমরা আগে এই বিষয়টি কখনও শুনিনি বলে বেশ বিস্মিত হয়েছিলাম। এর কাছেই ছিল বিখ্যাত ঝুলন্ত বাগান। মালাবার হিলে অবস্থিত এই বাগানটিকে না হলেও আমি একশ সিনেমায় দেখেছি । তাছাড়া এই বাগানটি বেশ উঁচু পাহাড়ে বলে ওখান থেকে শহরের একাংশের একটি ভিউ দেখা যায়। এই ঝুলন্ত বাগানটির আসল নাম হলো ফিরোজ শাহ মেহতা গার্ডেন । এর বিপরীতে রয়েছে কমলা নেহেরু পার্ক । এই পার্কটিতে গাছকে কেটে ছেঁটে বিভিন্ন প্রাণীর আকৃতি দেয়া হয়েছে । এটাই হচ্ছে এই পার্কের বৈশিষ্ট্য। বাগানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হচ্ছে বুট জুতার সাদৃশ্য একটি বিরাট জুতা। এই জুতা বেয়ে উঠা যায়। এরপরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো নেহরু সাইন্স মিউজিয়ামে। বিজ্ঞান জাদুঘরটি যে কোন শিশু দারুণ উপভোগ করবে। পুরানো মুম্বাই থেকে নতুন মুম্বাইয়ে যাওয়ার পথে আমাদের রাস্তা থেকে দেখানো হলো সাধক হাজী আলীর বিখ্যাত মসজিদটি। আরব সাগরের বেশ কিছুটা ভেতরে অবস্থিত এই মসজিদটি । শোনা যায় হাজী আলীর দরগায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশিষে সবাই যায় নিজেদের মনের ইচ্ছা পূরণ হবার জন্যে। আমাদের অবশ্য দরগার ভেতরে প্রবেশ করার মতন সময় ছিল না। সবশেষে আমরা মুম্বাইয়ে প্রাচীন একটি জাদুঘর দেখলাম। বাউ ডাজি লাড মিউজিয়াম। বহু প্রাচীন শিল্পকর্মের সমাহার রয়েছে এই জাদুঘরটিতে। ওই দিন এই পর্যন্তই ছিল আমাদের টুরিস্ট বাসে ভ্রমণ। পরের দিন সকালে আমরা সিনেমা দেখতে গেলাম বেশ নামকরা এটি হলে । হলের এক দর্শকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো যে এই শহরের সবাই ভীষণ সিনেমাপ্রেমী। প্রতি মাসেই নিয়ম করে সবাই হলে গিয়ে সিনেমা দেখে। দুপুরে আমরা টুকিটাকি কেনাকাটা করলাম । বিকালে আমরা ঘুরতে গেলাম জুহু বিচে। এই বিচ কেবল ভারত খ্যাত নয় বরং বলা যায় বিশ্বখ্যাত। বিচটিতে শত শত মানুষ প্রতিদিন ঘুরতে আসে। বিচের পাশে গড়ে উঠেছে অনেক খাবারের দোকান। বিচে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা একটি ট্যাক্সি নিলাম নতুন মুম্বাই শহরটি ঘুরে দেখার জন্য। ট্যাক্সি ড্রাইভার বেশ আগ্রহের সঙ্গে আমাদের ঘুরানো শুরু করলেন। জুহু বিচ থেকে বেরিয়ে দেখলাম বিশ্ববিখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের বাড়ি । জুহু এলাকায় আরো অনেক অভিনেতা অভিনেত্রীর বাড়ি ট্যাক্সি ড্রাইভার দেখাতে লাগল। বাইরে থেকে বাড়িগুলোকে খুব অসাধারণ কিছু বলে মনে হলো না তবে ধারণা করতে পারলাম যে এই বাড়ীগুলোর ভেতর নিশ্চয় খুবই জমকালো। তারপরে আমরা বান্দ্রা এলাকার ঘুরতে গেলাম। নতুন মুম্বাই অবশ্যই পুরানো মুম্বাই থেকে অনেক জমকালো আর গতিশীল। বান্দ্রা সমুদ্রের পাড় ঘেষে রয়েছে অনেক ক্লাব, পাব, আর ডিসকো। এগুলো সবই পাশ্চাত্য ধাঁচের। এই সমুদ্র তীরেই নায়ক শাহরুখ খানের বাড়ি । সেই বাড়ি দেখতে অনেক দর্শনার্থী ভীড় জমায়। সত্যি বলতে কি শাহরুখের বাড়ির সামনে কালো পাথরের সমুদ্রের তীরÑ এক কথায় অপূর্ব। বলা যায় যে, মুম্বাইয়ের নতুন প্রজন্মের তরুণ তরুণীরা জীবনযাপন করে অনেকটা পাশ্চাত্য ডং-য়ে।
মুম্বাইয়ের এই প্রজন্মকে ভারতীয় সংস্কৃতিতে লালিত পালিত বলে মনে করা কঠিন। গাড়ী থেকে দেখলাম বিখ্যাত লীলাবতী হাসপাতাল । এই হাসপাতালে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বহু রোগী চিকিৎসার জন্য আসে। ওই দিনের মতন ভ্রমণ বিরতি দিয়ে আমরা হোটেলে ফিরলাম। এর পরের দিন সকালে দেখতে গেলাম এলিফেন্টা কেভ। আগেই হোটেল থেকে ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছিল। আমরা প্রথমে পৌঁছালাম গেট অফ ইন্ডিয়াতে। সেখান থেকে একটা ছোট লঞ্চে করে আরও অনেক পর্যটকদের সঙ্গে আমরা রওনা দিলাম এলিফেন্টা কেভের পথে। এই বিখ্যাত কেভটি তীর থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে আরব সাগরের মাঝে একটি দ্বীপে অবস্থিত। দ্বীপের মুখে একটি হাতির র্মূতি আছে বলে এই দ্বীপের নাম এলিফেন্টা কেভ। এই নামটি অবশ্য পর্তুগাল শাসনামলে দেওয়া হয় । তার আগে এই দ্বীপের আদি নাম ছিল ঘারাপুরি। এখানে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা আসত উপাসনার জন্যে। এখনও নাকি এখানে পূজা আর্চনা হয়ে থাকে । এই দ্বীপে পৌঁছে দেখলাম উঁচু পাহাড়ের উপরে উঠে দেখতে হবে কেভ বা গুহার ভেতরটা। পাহাড়ে উঠার ট্রেন সেইদিন না থাকায় দুই পায়ের উপর নির্ভর করেই প্রায় ৩০-৪০ তলা সিড়ি ভেঙ্গে উঠতে হলো। উঠার পথে দেখলাম অসংখ্য বানর আর ময়ূর খেলা করে বেড়াচ্ছে। শেষে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পৌঁছলাম সেই গুহায়। পাহাড়ের মধ্যে গুহার ভেতরে যে অসাধারণ ভাস্কর্য থাকতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না । শোনা যায় ৫ম থেকে ৮ম শতকে এই ভাস্কর্যগুলো তৈরি করা হয়। তবে এই শিল্পকর্মের নির্মাতা কে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ইউনেস্কো এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করেছে। এই গুহায় পাথরে খোদাই করে বিশাল আকৃতির শিবের ভাস্কর্য রয়েছে। কয়েকশ বছরের পুরানো এই ভাস্কর্যকে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না যে শত বছরের পুরানো শিল্পকর্ম কতটা অসাধারণ হতে পারে। এই শিল্পকর্মকে না দেখলে আমার জীবনটা অনেকটাই অপূর্ণ থেকে যেতো। ঢাকায় ফিরে অনেককে আমি অনুরোধ করেছি এই এলিফেন্টা কেভকে দেখতে যেতে। ওখান থেকে ফিরতে ফিরতে দুুপুর গড়িয়ে বিকেলে পড়ল। আমরা বেশ ক্লান্ত ছিলাম । তাই হোটেলে গিয়ে আমরা একটু বিশ্রাম নেই । সন্ধ্যায় আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম । কারণ বেড়াতে গিয়ে ঘরে বসে থাকলে চলে না। এবার আমাদের গন্তব্য মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ফিল্মসিটি। এই ফিল্মসিটিতে মুম্বাইয়ের সিনেমার শূটিং হয়ে থাকে। এটি শহর থেকে একটু দূরে। পাহাড়ে ঘেরা বিশাল এলাকা। এখানে প্রবেশ করা বেশ কঠিন। তারপরেও আমরা প্রবেশপথের প্রহরীকে অনেক অনুরোধ করে ফিল্মসিটির ভেতরে ঢোকার অনুমতি পাই। পুরো সিটিটি আমরা গাড়িতে করে ঘুরে দেখলাম । অনেক ছবির সেট দেখা গেলো। আহাত নামের একটি ভৌতিক ছবির শুটিংয়ের কাজ চলছিল। যেখান থেকে হোটেলে ফিরতে আমাদের বেশ রাত হয়ে গেলো। এবার বাড়ি ফেরার পালা। কোনমতেই ট্রেন টিকিট না পাওয়ায় আমরা মুম্বাই থেকে প্লেনে করে কলকাতা ফিরলাম। একদিন কলকাতায় থেকেই আমরা ফিরে এলাম ঢাকায় । মুম্বাই ভ্রমণের এই স্মৃতি আমার জীবনের একটি ভাল লাগার স্মৃতি হিসাবে মনের কোণে সব সময়ই থেকে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.