প্রাকৃতিক গ্যাস উষ্ণায়ন কমাতে পারে না

বিশ্বে কয়লাচালিত যত বিদ্যুতকেন্দ্র আছে সবগুলো তুলে দিয়ে সেগুলোর জায়গায় যদি প্রাকৃতিক গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানিচালিত বিদ্যুতকেন্দ্র চালু করা যায় তাহলেও পৃথিবীর উষ্ণায়নের উপর ইতিবাচক কোন প্রভাব পড়বে না। জ্বালানি হিসাবে প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লার চেয়েও বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন হলেও পৃথিবীর উত্তাপ যেভাবে বেড়ে চলেছে তার


রাস টেনে ধরতে প্রাকৃতিক গ্যাসের তেমন কোন ভূমিকা নেই। নতুন এক সমীক্ষায় এই তথ্যটি জানা গেছে।
গবেষক দলের প্রধান পদার্থবিজ্ঞানী নাথান মাইহর ভোল্ড বলেছেন যে, প্রাকৃতিক গ্যাসকে পছন্দ করার নানান কারণ আছে। তবে আবহাওয়ার পরিবর্তনে এর ইতিবাচক ভূমিকা সেই কারণগুলোর একটি নয়। বরং বলা যায় যে, আবহাওয়ার পরিবর্তন রোধে এর কোন গুরুত্বই নেই।
প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পর্কে এমন নিরানন্দ মূল্যায়নের কারণ হলো পৃথিবীর উপর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বোঝা ইতোমধ্যে এত বিশাল আকারে চেপে বসেছে এবং বায়ুম-লে এই গ্যাসের স্থায়িত্বকাল এত দীর্ঘ যে কয়লাচালিত বিদ্যুত তুলে দিয়ে সম্পূর্ণরূপে কার্বনমুক্ত বিদ্যুত চালু করা হলেও আগামী এক শ’ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার মাত্র ২০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে কয়লার জায়গায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা পরমাণু বিদ্যুত চালু করা গেলে উষ্ণায়নের মাত্রা প্রায় দুই- তৃতীয়াংশ থেকে তিন-চতুর্থাংশ কমিয়ে আনা যাবে।
মাইহর ভোল্ড নতুন এই গবেষণার মধ্য দিয়ে বিশ্বে জ্বালানির ব্যবহারের এক নতুন পথ নির্দেশনা দিয়েছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মাইহর ভোল্ড মাইক্রোসফটের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা এবং মাইক্রোসফট রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে তিনি সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়েও গবেষণা করেছেন। ডাইনোসরদের উপর তার বেশ কিছু গবেষণামূলক লেখা রয়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ব্যাপার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তার যথেষ্ট আগ্রহের পরিচয় পাওয়া গেছে। আবহাওয়া গবেষক কেন ক্যালডেইরার সঙ্গে একত্রে তিনি কয়লাচালিত বিদ্যুতকেন্দ্রের বেশ কিছু বিকল্পও তুলে ধরেছেন। বিশ্বে কয়লার ব্যবহার বাদ দিয়ে যদি অন্য যে কোন বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার করা সম্ভব হয় তাহলে আবহাওয়ার উপর তার কি প্রভাব এসে পড়বে এই দুই বিজ্ঞানী তা নিয়ে যথেষ্ট মাথা ঘামিয়েছেন।
বিশ্বে ৭শ’ কোটি মানুষের প্রত্যেকে যদি একই সময় ২টি ৭৫ ওয়াটের বাল্ব ব্যবহার করে তাহলে মোট যে পরিমাণ বিদ্যুত দরকার তার সমপরিমাণ প্রায় এক টেরাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের মতো যথেষ্টসংখ্যক কয়লাচালিত বিদ্যুতকেন্দ্র বর্তমান বিশ্বে রয়েছে। মাইহর ভোল্ড ও ক্যালডেইরা এই এক টেরাওয়াট কয়লাচালিত বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোকে প্রাকৃতিক গ্যাস বা সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তি বা পরমাণুশক্তি কিংবা অন্য যেকোন বিকল্প জ্বালানিচালিত বিদ্যুতকেন্দ্রে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখেছেন। সেই সঙ্গে তারা গোটা উত্তরণ প্রক্রিয়াটি এক বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার সম্ভাব্য পরিণতিও যাচাই করেছেন। তারা যে ফল পেয়েছেন তা মাইহর ভোল্ডের ভাষায় ধারণার বিপরীত। তিনি বলেন, কয়লা থেকে কার্বন নির্গমনের সঙ্গে তুলনা করে দেখলে দুই বা তিনগুণ কার্বণ নির্গমন কমালে মোটেই তেমন কিছু আসবে যাবে না। চলতি শতাব্দীতে পৃথিবীর উষ্ণতাবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পরিহার করতে হলে কার্বন নির্গমন নাটকীয় মাত্রায় কমাতে হবে। সেই মাত্রাটা হলো দশগুণ কি বিশ গুণ। চল্লিশ বছরের মধ্যে বিশ্বের তাবত কয়লাচালিত বিদ্যুতকেন্দ্র যদি প্রাকৃতিক গ্যাসচালিত বিদ্যুতকেন্দ্রে রূপান্তরিত করা এবং এর মাধ্যমে প্রতি ওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুতের অর্ধেক পরিমাণ গ্রীনহাউজ গ্যাস তৈরি করা যায় তাহলে উষ্ণতা বৃদ্ধি মন্থরগতিতে হবে। তবে সেই মন্থরতার মাত্রা হবে খুবই সামান্য। দুই বিজ্ঞানীর সমীক্ষায় আগামী এক শ’ বছর শুধুমাত্র প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের ফলে উষ্ণতাব ৃদ্ধি কতটা কমবে তা হিসাব করা হয়। তাতে দেখা যায় যে, বিশ্বব্যাপী কয়লার ব্যবহারের কারণে তাপমাত্রা যতটা বাড়ত শুধু প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের কারণে সেই বৃদ্ধির মাত্রা ১৭ থেকে ২৫ শতাংশ হ্রাস পাবে। এই বৃদ্ধির হার ঢেড় বেশি হ্রাস পাবে যদি এসব জ্বালানি বাদ দিয়ে পরমাণু, বায়ুশক্তি বা সৌরশক্তি ব্যবহার করা যায়। কারণ এ তিন ধরনের জ্বালানিতে কার্বন নির্গমনের মাত্রা প্রায় শূন্য শতাংশ। জ্বালানির এসব উৎসের ক্ষেত্রে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ৫৭ থেকে ৮১ শতাংশ হ্রাস পাবে।
গবেষণায় মানবজাতির সামনে এসব চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করা হয়েছে বাস্তবে সেই চ্যালেঞ্জগুলো অনেক বেশি কঠিন। যেমন, আবহাওয়া পরিবর্তন সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ ক্যালডেইরা গবেষণা করে দেখেছেন কিভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড অতি দীর্ঘকাল ধরে বায়ুম-লে থেকে যেতে পারে। তার মতে, এর প্রায় এক-চতুর্থাংশ এক হাজার বছরেরও বেশি বায়ুম-লে ভেসে বেড়াবে। এসব কথা ভাবলে মানবজাতির সামনে দুটি পথ খোলা। তার যেকোন একটিকে বেছে নিতে হবে। হয় হতাশায় হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে নয়ত ন্যূনতম মাত্রায় কার্বন নির্গমন যাতে হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। এতদসত্ত্বেও আমেরিকান ক্লিনস্কাইস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘চেসাপিক গ্যাস’ নামে সে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী অব্রে ম্যাকক্লনডন গবেষণার এই ফলাফলে আপত্তি করার কোন কারণ খুঁজে পাননি বরং তারপরও দাবি করেছেন যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রাকৃতিক গ্যাস সহায়ক হতে পারে। প্যাট্রিক বিন নামে আরেক নীতি বিশেষজ্ঞ বলেন, গবেষণায় যদিও পর্যায়ক্রমে কয়লার ব্যবহার তুলে নিয়ে অন্যান্য জ্বালানি ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে তথাপি আমাদের বিদ্যুতের নানামুখী উৎসের এক মিশ্রিত ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে হবে। তাঁর মতে সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তি এখনও অতি ব্যয়বহুল। অর্থ ও রাজনীতির সীমাবদ্ধতার বিচারে প্রাকৃতিক গ্যাস আজও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সৌর ও বায়ুশক্তিসহ বিশুদ্ধতর জ্বালানি উৎস ব্যবহারের পথে প্রাকৃতিক গ্যাস সেতুবন্ধনকারী জ্বালানি হিসাবে কাজ করতে পারে।
প্রকৃতি ও বিজ্ঞান ডেস্ক

No comments

Powered by Blogger.