রঙ্গব্যঙ্গ-ফার্মগেট পুলিশ-ফাঁদ! by মোস্তফা কামাল

প্রিয় পাঠক, আপনাদের কাছে একটি কাল্পনিক গল্প তুলে ধরছি। পুলিশকে নিয়ে কাহিনী। কাহিনীটি শুনে আপনারা হয়তো নতুন করে ভাববেন। এবার গল্পটা শুনুন। মোহাম্মদ শাকিল, পেশায় সাংবাদিক। তিনি একটি বেসরকারি টিভিতে কাজ করেন। কয়েক দিন আগে তিনি নিজের গাড়িতে বাসা থেকে অফিসে যাচ্ছিলেন।


হঠাৎ তিনি ফার্মগেটে যানজটে আটকে পড়েছেন। তিনি উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছেন। কিছুই বুঝতে পারছেন না। সামনে সারি সারি গাড়ি। রাস্তাটা হঠাৎ অচল হয়ে যাওয়ার কারণ খুঁজছেন তিনি। একপর্যায়ে তিনি গাড়ি থেকে নেমে সামনের দিকে এগোলেন। এসে দেখলেন, পুলিশ একটা পাবলিক বাস রাস্তায় আটকে রেখেছে। কারণটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে ড্রাইভার ও হেলপারের কথাকাটাকাটি হচ্ছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন যাত্রীরা। তাঁরাও কথাবার্তা বলছেন। কিন্তু পুলিশ কিছুতেই গাড়িটা ছাড়ছে না। তাদের এক কথা, মিটমাট না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি আটক রাখা হবে। যাত্রীরা কী বলল, না বলল তাতে তাদের কিছু আসে-যায় না।
হেলপার ড্রাইভারকে বোঝাচ্ছে, 'ওস্তাদ, পাঁচ শ টাকা দিয়া দেন। তা না হইলে সার্জেন্ট ব্যাটা ঝামেলা করব।'
ড্রাইভার উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, 'করে করুক। আমি কোনো অন্যায় করি নাই। খামাখা টাকা দিব কেন?'
'এই দেশে ন্যায়-অন্যায়ের কথা বইলা লাভ নাই। টাকা না দিলে গাড়ি ছাড়ব না। পাঁচ শ টাকা না দিলে চার হাজার টাকা হারাব। কোনটা করবেন দেখেন।'
'এই ব্যাটা! পাঁচ শ টাকা যে দিব, এই টাকা কি মালিক পরিশোধ করব? করব না। তাইলে কি আমার পকেট থেকে দিব? আমার ইনকাম কত?'
'ওস্তাদ, মালিকরে বুঝাইয়া বলব। আপনি টাকাটা দিয়া দেন তো!'
ড্রাইভার ও হেলপারের কথাগুলো শুনছিলেন মোহাম্মদ শাকিল। তিনি তাঁর কাছে ঘটনা জানতে চাইলেন। 'দেখেন ভাই, আমি কোনো অন্যায় করি নাই। তার পরও পুলিশ আমার কাছে টাকা চায়। অন্যায় করলে দিতাম। খামাখা দিব কেন?'
মোহাম্মদ শাকিল কী করবেন বুঝতে পারছেন না। কিন্তু রাস্তায় যেভাবে জটলা লেগেছে, তাতে পাবলিক বাসটি না সরালে শত শত মানুষ রাস্তায় কষ্ট পাবে। যানজটে কত সময় বসে থাকা যায়! অনেক চিন্তাভাবনার পর তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে বললেন, 'ভাই, সমস্যা কী?'
পুলিশ উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, 'সমস্যা কী মানে?'
'না মানে, আপনারা যে গাড়িটি আটকে রেখেছেন সেটার কারণে পুরো রাস্তায় যানজট লেগে গেছে।'
'লাগে লাগুক। আগে সমস্যার সমাধান হোক, তারপর যানজটের ব্যাপারটা দেখব।'
'ভাই, আমাকে অফিসে যেতে হবে। ফার্মগেটে এসে এক ঘণ্টা আটকে আছি। গাড়িটা রাস্তার পাশে রেখে সমস্যার সমাধান করেন।'
'এই মিয়া! আমরা কী করব না করব সেটা বলার আপনি কেডা?'
'আমি ধরেন একজন সাধারণ মানুষ।'
'না না, আপনাকে বলতে হবে, আপনি এত বড় বড় কথা বলার কে? ফাজলামি পেয়েছেন!'
'এই যে এভাবে কথা বলছেন কেন?'
'কিভাবে কথা বলব? এই মিয়া! আপনার পরিচয় জানতে চাইছি না?'
'মোহাম্মদ শাকিল বললেন, আমি একজন সাংবাদিক। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কাজ করি।'
'সাংবাদিক! আমি তো সাংবাদিকই খুঁজি। সাংবাদিক না মারলে বড় হওয়া যায় না।' তারপর পুলিশ শুরু করল কিল-ঘুষি! তার সঙ্গে দুজন পুলিশ ইন্সপেক্টরও যোগ দিলেন। তাঁরাও কিল-ঘুষি-লাথি শুরু করলেন। পুলিশ মোহাম্মদ শাকিলকে মারছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকজন তা দেখছে। কেউ মারার কারণও জিজ্ঞেস করছে না। অনেকক্ষণ পর মোহাম্মদ শাকিল মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তারপর পুলিশ তাঁকে গাড়িতে তোলে। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁও থানায়।
এদিকে রাস্তায় পড়ে থাকা মোহাম্মদ শাকিলের গাড়িটা পুলিশ জব্দ করে থানায় নিয়ে গেল। থানায় নিয়ে মোহাম্মদ শাকিলের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হলো। পুলিশ পেটানোর মামলা। বড়ই যুতসই মামলা হবে।
মোহাম্মদ শাকিল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তিনি মনে মনে ভাবেন, এ কী করছে পুলিশ! আমি পুলিশকে কখন মারলাম! আসলে কোনো কিছু না পেয়ে ওরা পুলিশ পেটানোর মামলা দিচ্ছে। এটাকে পুলিশ-ফাঁদ বলা যেতে পারে। তিনি মনে মনে ভাবেন, এর আগে আরেক সাংবাদিককে পেটানো হলো। তখনো পুলিশ বলেছিল, সাংবাদিক মারলে কিছু হয় না। বরং পদোন্নতি হয়! তারপর উল্টো সেই সাংবাদিকের বিরুদ্ধেই দিল পুলিশ পেটানোর মামলা। দিন দিন ফার্মগেট পুলিশ-ফাঁদে পরিণত হচ্ছে। এভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকলে ফার্মগেট এলাকা দিয়ে পুলিশের ভয়ে সাংবাদিকরা যাতায়াতই করবেন না!
এর মধ্যে থানায় অসংখ্য ফোন এল ওপর থেকে। থানায় সাংবাদিক নেতারাও ছুটে গেলেন। ঘটনা কী? থানায় সাংবাদিক আটকানোর মানে কী?
পুলিশ বলল, এ তো সন্ত্রাসী! কত্ত বড় সাহস, পুলিশ পেটায়! তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হবে, পুলিশ পেটানোর মামলা।
সাংবাদিক নেতারা কিছুতেই বোঝাতে পারছেন না, মোহাম্মদ শাকিল অত্যন্ত ভালো, ভদ্র একজন সাংবাদিক। তারা মামলা দেবেই, দেবে। কোনো মাফ নেই!
সাংবাদিক নেতারা উপায়ান্তর না পেয়ে আইজি এবং ঢাকার কমিশনারকে ফোন করলেন। কিন্তু তাঁরাও যেন অসহায়। তাঁরা টেলিফোনে বললেন, 'দেখি কী করা যায়।'
সাংবাদিক নেতারা আবার শুরু করলেন দেনদরবার। একপর্যায়ে শুরু হয় তর্কবিতর্ক। এসব বিতর্কের মধ্যেই একজন সাংবাদিক বললেন, 'আচ্ছা ভাই, শাকিল তো আপনাদের পিটিয়েছে তাই না?'
'জি জি।'
'কী দিয়ে পেটাল?'
'প্যান্টের বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে একেবারে জখম করে দিয়েছে।'
'যাকে পেটানো হয়েছে তিনি কোথায়?'
'তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।'
'তাই নাকি!'
'জি। কেন, বিশ্বাস হয় না?'
'আচ্ছা, শাকিল পিটিয়েছে পুলিশকে, তাই না? তাহলে শাকিল অসুস্থ হলো কেন?'
পুলিশ কর্মকর্তা বিব্রত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। আর কিছুই বলতে পারছেন না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.