সিরাজুল ইসলাম মুনির এক অনবদ্য কথাশিল্পী

সমুদ্র উপকূলবর্তী জনপদ নিয়ে একাধিক উপন্যাস এবং গল্প লিখেছেন কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম মুনির। লিখেছেন নগর জীবন নিয়েও। ভালোবাসা, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, জীবনযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে উপজীব্য করে গল্পের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।


আর এটাই সত্য যে, একজন লেখক তার দূরদৃষ্টির বাইনোকুলারে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়-আশয়কে ছেঁকে-ছেনে এনে লেখার কাঠামোর গভীরে প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে তাকে শিল্পবোধের ঘেরাটোপে মুড়ে দেবেন। করবেন মলাট গ্রন্থি। স্বভাববতই সিরাজুল ইসলাম মুনিরও তার লেখার গহীনে এমন অজস্র ঘটনাকে বরফকুচির মতো সাজিয়ে সাজিয়ে জমাটবরফে রূপায়িত করেছেন অত্যন্ত কুশলী এবং শৈল্পিক বয়ানে। তার এই বয়ানে যেমন বাহুল্যের মাত্রাটা একেবারেই নৈঃশব্দিক। উপরন্তু নান্দনিকতার ঝালরটা ঠিকই তিনি তার প্রতিটি রচনায় ছড়িয়েছেন জ্যোৎস্নার গুঁড়োর মতো নিবিড় মোহাবিষ্টতায়। এই সময়ের পাঠক নন্দিত ঔপন্যাসিক, গল্পকার সিই মুনির তার প্রায় দীর্ঘ সাড়ে তিন দশককালের রচনাসমূহে বরাবরই নির্মোহত প্লাটফর্মে ছিলেন অটল দাঁড়িয়ে। আর সে কারণেই তার গদ্যের বুননশৈলী যেমন হৃদয়গ্রাহী। একইভাবে পাঠস্পর্শী।
তার ভাষাভঙ্গী রচনার উৎকর্ষ, গল্প বলার নির্ভার আবহ তার রচিত প্রতিটি গল্প এবং উপন্যাসকেই দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি আলোচ্য তাহলো মুনির তার সৃষ্টি প্রতিটি চরিত্রকে খুব কাছ থেকে, একেবারে ছুঁয়ে দিয়ে উপলব্ধি করে তবেই তা রচনায় সন্নিবেশিত করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যের গদ্যের ধারাটি নানাভাবে, নানা বাঁকে বাঁকে বাঁক খেয়ে খেয়ে একটা সমৃদ্ধ বন্দর খুঁজে পেয়েছে। অসংখ্য ঘটনাবলীর পারস্পর্যতায় হৃদ্য হয়েছে বাংলা সাহিত্য। এই বাঁকে নতুন একটি সুনিপুণ, মোহনীয় বাঁকের কল্লোলে সিরাজুল ইসলাম মুনির জুড়ে দিয়েছেন উপদ্রুত জনপদের অদেখা অজানা এমন এক ছবি। যে ছবিটি মুনিরই এঁকে চলেছেন নিরন্তর, নিরবধি। জলরঙে আঁকা সেই ছবিগুলোকে আরও বিস্তৃত, বড় ফ্রেমের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার কাজটিও করছেন মুনির অনবদ্য শিল্পীর মতো।
ঝড়, ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙ্গা মানুষের অনর্গল আর্তনাদের ছবিটি যেমন মুনিরের মৌন লেখক সত্তাকে বারবার ছুঁয়ে যায়। একইভাবে রোমান্টিসিজমের নৈর্ব্যক্তিক রূপটাও গতানুগতিকতার মোড়ক খুলে বেরিয়ে এসে আবেগ মহিত এক গাঢ় সঞ্চারণে পুঞ্জীভূত হয়।
কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম মুনিরের গদ্যে যেমন রয়েছে মেঘ, কুয়াশা, শিশিরের নিরবচ্ছিন্ন আনাগোনা। তেমনি জ্যোৎস্নাঙ্কিত উপত্যকা, চাঁদের কিরণ ধারা নদী, উত্তাল সাগরের ফেনিল জলরাশির গহীনে স্বর্ণোজ্জ্বল গোধূলির আভাও। জেগে ওঠা চরে নদীর বুকে সবুজায়নের আত্মযাতনালব্ধ বোধের তিরতিরে সুরমূর্ছনা যেমন সিরাজুল ইসলাম মুনির তার সৃষ্ট চরিত্রের হৃৎস্পন্দনে জাগিয়ে তোলেন। একইভাবে গুঞ্জরাশীল উপকূলবর্তী মানুষের মর্তে সংগ্রামী চেতনাকেও একরেখায় এনে দাঁড় করিয়ে দেন।
নিকট সম্প্রতি প্রকাশিত তার দুটি গ্রন্থ : ‘রক্তে ভেজা অববাহিকা’ (উপন্যাস) এবং ‘ভালোবাসার ফুল’ (গল্প) রচনার ক্ষেত্রেও দেখিয়েছেন অসাধারণ দক্ষতা।
বিশেষ করে ‘রক্তে ভেজা অববাহিকা’ এক দীর্ঘ পরিসরের উপন্যাস হওয়ার দরুন লেখককে প্রচ- মনোযোগী হতে হয়েছে। আর এখানেই সিরাজুল ইসলাম মুনির এক সফল রচয়িতার অনস্বীকার্যের দোলনচাঁপাটি পেয়ে গেছেন হাতের নাগালে।
‘রক্তে ভেজা অববাহিকায়’ উপদ্রুত জনপদের যে চিত্রটি লেখক এঁকেছেন। কথার ভিতর দিয়ে যেতে যেতে চরিত্রের বিন্যাস, সংযমী ভাববোধ, বর্ণনার গভীরতা, বেদনাবোধ এবং আনন্দের জলধারাকে এক মোহনায় এনে মিশিয়ে দেয়ার ঐ শৈল্পিক অনন্য কৌশলকে দ্বন্দ্ব মুখরতা, ঘাত-প্রতিঘাত, কষ্ট, কান্নাকে নিঙড়ে এনে চোখের অপাহ্নে জমি...নিখুঁত শিল্পীর মতো সহজাত এবং সাবলীলভাবে। আলোচ্য উপন্যাসটি পাঠ করতে করতে পাঠক নিজেই ডুবে যাবেন ঘটনার অবগাহনে। তারপর তার গভীর থেকে নিজেই কুড়িয়ে নেবেন কাহিনীর মনিরতœরাজি। জীবন সংগ্রামের খ--বিখ- নানা উপাখ্যানে উদ্ভাসিত ‘রক্তে ভেজা অববাহিকা’ কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম মুনিরের এক উল্লেখযোগ্য রচনা। যা পাঠককে নিমিষে অবতীর্ণ করে দেবে পাঠযুদ্ধে।
‘ভালোবাসার ফুলে’র গল্পগুলোর সঙ্গে পাঠকের পরিচর্য পর্বের ক্ষণে একটু নড়েচড়ে বসে পড়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। কেননা, সিরাজুল ইসলাম মুনিরের গল্প বলার ভঙ্গিটি এমন যে, পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘটনার গহীন অরণ্যে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে যাবে। এবং এক অতল রহস্যপুরীর অজানা কল্পকথার প্রতিবেশে নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায় পেয়ে বসবে পাঠককে।
সিরাজুল ইসলাম মুনিরের ‘ভালোবাসার ফুল’ গল্পগ্রন্থে গল্পসংখ্যা ২৬টি। ধৈর্য নিয়ে পাঠক গল্পগুলো পড়লেও বুঝবেনÑপ্রতিটি গল্পের প্রেক্ষাপট, চরিত্র, বলার ধরন, বিন্যাসেই রয়েছে ভিন্নতা এবং নিদারুণ কারুকার্যময়তা। সর্বোপরি শব্দবুনন, শিল্পরোধের স্পর্শে গ্রন্থের গল্পগুলো হয়ে উঠেছে সময়ের নির্জন একেকটি আয়নার উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি।
রেজা ফারুক

No comments

Powered by Blogger.