উচ্চ আদালতে বাংলা
বিশ্বে একমাত্র বাংলাদেশেরই মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে নিজের ভাষা। বাহান্ন সালে রক্ত দিয়ে সেই লড়াইয়ের সূচনা, যার চূড়ান্ত পর্যায় আসে ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে। সংগত কারণেই এখানকার রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলা সুমহান মর্যাদা পায়।
সংবিধান ও আইনে স্পষ্ট করা হয়, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহৃত হবে। যৌক্তিক কারণেই বহির্বিশ্বে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে আমাদের সংবিধান। স্বাভাবিকভাবেই মনে করা যায়, আদালতসহ সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কিছু বিশেষ কারণে উচ্চ আদালতে এখন পর্যন্ত ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শুনানি থেকে শুরু করে রায় লেখা পর্যন্ত ইংরেজির ব্যবহার অনেক সময় বাদী ও বিবাদী উভয়ের জন্যই অসুবিধার সৃষ্টি করে। কিন্তু আদালতের প্রচলিত ভাষা ইংরেজি হওয়ায় এ অসুবিধাকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে উভয়পক্ষ। অন্যদিকে আদালত থেকেও কখনো বলা হয়নি, বাংলা ব্যবহার করা হবে না কিংবা বাংলা ব্যবহার অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে তাদের দাবি হচ্ছে, পুরনো সূত্র উল্লেখ করতে হলে কিংবা সূত্র অনুসন্ধান করতে হলে ইংরেজির কোনো বিকল্প নেই। যে কারণে নিম্ন আদালতে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলার ব্যবহার চোখে পড়লেও উচ্চ আদালতে এখনো তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। নজির হিসেবে ইংরেজির ব্যবহার হয়তো আগামীতেও চলতে থাকবে। কিন্তু শুনানি কিংবা রায়ের মূল অংশ বাংলায় রচনা কষ্টসাধ্য হলেও আস্তে আস্তে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। আর 'বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭' এবং সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আদালতের বিষয়টিও স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং এখন উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার ব্যাপারটি অবশ্যই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। ২৪ বছর আগে প্রণীত আইনের কারণে আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে আর কোনো আইনানুগ অসুবিধা থাকছে না। সরকার দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ (২) ধারায় ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ব্যবহারের সব দুয়ার খুলে দিতে পারে বলে জানা গেছে। যদি সরকারের ঘোষণার কারণেই বাংলা ভাষা ব্যবহৃত না হয়ে থাকে তাহলে এটা হবে আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। যেহেতু এ মুহূর্তে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাই আমাদের বিশ্বাস সরকার এ ভাষার মাসেই ঘোষণা দেবে। পাশাপাশি রায় ঘোষণার ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহারের যে অসুবিধাগুলো আছে সেদিকেও নজর দিতে হবে। ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত প্রাচীন জটিল বাংলার পরিবর্তে সহজ, সাবলীল বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে। আমাদের দেশে আইনের বইগুলোর বেশির ভাগই ইংরেজিতে লেখা। সংগত কারণেই ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন আদালত সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক ও কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। সংবিধান ও আইনের বাস্তবায়ন করতে সরকারিভাবে আইনের বই সহজ, স্বচ্ছন্দ বাংলায় অনুবাদের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। প্রয়োজনে অনুবাদের জন্য সরকার বিশেষ কোনো কমিশনও গঠন করতে পারে। তবে পুরনো মামলার নজির দেখার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন পর্যন্ত যে ইংরেজির ব্যবহার থাকবে, তাও মেনে নিতে হবে। কিন্তু রায় ও শুনানির ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে বাংলার ব্যবহার বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। আবেগের ক্ষেত্রটা ব্যাপক হলেও বাস্তবতাকে আমাদের মেনে নিতে হবে। সেই বাস্তবতা বাংলাকে পরিহার করা নয়, ইংরেজির বিকল্প হিসেবে বাংলার সুচারু ব্যবহার কিভাবে নিশ্চিত হয় সেই লক্ষ্যেই আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত। সুপ্রিম কোর্টের রুলসে আদালতের ভাষা হিসেবে ইংরেজির উল্লেখ থাকার বিষয়টিও নজরে আনতে হবে। সরকারের ঘোষণার পাশাপাশি আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্থলাভিষিক্ত করার ব্যবস্থাও করতে হবে।
No comments