ব্যাংকের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফায় 'ব্রেক' কষা দরকার by ড. আর এম দেবনাথ

ছোটবেলায় শুনতাম সুদের ব্যবসায় কোন মার নেই বরং এই ব্যবসায় সুদ ব্যবসায়ী আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়। তার অর্থবিত্ত বাড়ে শনৈঃশনৈ, আর মরে ঋণগ্রহীতা সাধারণ কৃষক ও মানুষ। এই নিয়ে কত কথা শুনেছি। একটু বড় হয়ে শুনেছি সুদখোর এই মহাজনেরা দেশের শত্রু, কৃষকের শত্রু।


কারণ তারা মাত্রাতিরিক্ত হারে সুদ চার্জ করে, লাভ করে মাত্রাতিরিক্ত, মরে কৃষক। আজকাল সুদের ব্যবসার অনেকটাই দখল করেছে বড় বড় বাণিজ্যিক ব্যাংক। সুদের ব্যবসা আগে করত ব্যক্তি-ব্যবসায়ীরা যারা ছিলেন ধনাঢ্য ব্যক্তি, বড় বড় ব্যবসায়ী অথবা জমিদার। এদের অনেককেই বলা হতো ‘মহাজন’। আজকাল সুদের ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশে এরা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি, ব্যাংক নামে পরিচিত। এদের ব্যবসা চলে আমানতকারীদের আমানতের টাকা দিয়ে। ব্যাংক মালিকদের নিজস্ব পুঁজির পরিমাণ খুবই কম। অথচ বাজারে চালু যে, ব্যাংক মালিকরা নিজেদের টাকাতেই সুদের ব্যবসা করেন। বর্তমানের সুদের ব্যবসাকে অবশ্য সুদের ব্যবসা বলা হয় না। একে বলা হয়, ‘ব্যাংকিং ব্যবসা’, আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবসা। চালায় শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা। মালিকরা পেছন থেকে খবরদারি করেন। আনো আমানত যাতে বেশি বেশি টাকা ধার দিতে পারি। দুই ধরনের ব্যবসা অর্থাৎ ব্যক্তির সুদ ব্যবসা এবং প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক ব্যবসার মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কী?
লাভ, মুনাফার ভিত্তিতে বলা যায় দুইয়ের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। অন্তত এই সোনার বাংলাদেশে! আমার কথা বিশ্বাস করবেন পাঠক যদি কিছু তথ্য দিই। আমরা সবাই জানি সারা বিশ্বে দ্বিতীয় দফার মন্দা চলছে। দেশেও বাজার মন্দা। ফ্ল্যাটের বাজারে মন্দা, জমি বাজারে মন্দা, আমানতের বাজারে মন্দা, শেয়ারবাজারে মন্দা, কেনা-বেচার ব্যবসায় দেখা যাচ্ছে সাধারণভাবে একটা মন্দা মন্দা ভাব। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের মুনাফা কমছে। সাত শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল, তা শেষ পর্যন্ত হবে না। প্রাথমিক হিসাবে হয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। বছর শেষের চূড়ান্ত হিসাবে তা হতে পারে সাতের কম। বেসরকারী খাতের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা বলছেন, তারা পর্যাপ্ত ঋণ পাচ্ছেন না। সরকার তার ব্যাংক থেকে কম দামে ঋণ নিয়ে নিচ্ছে। গ্যাস সংযোগ নেই, বিদ্যুত সংযোগ নেই। এতসবের পরেও বেসরকারী ব্যাংকগুলোর মুনাফার কোন ঘাটতি নেই। তাদের মুনাফা বাড়ছে তো বাড়ছেই। পত্রিকান্তরে ২৭টি বেসরকারী ব্যাংকের একটা হিসাবে দেখলাম। এতে দুটোর তথ্য নেই। বাকি ২৫টি ব্যাংকের মধ্যে ২০টির মুনাফাই জানুয়ারি-জুনে বেড়েছে এই দুর্দিনেও। গেল বছর বলা হয়েছিল তাদের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা হয়েছে শেয়ারবাজার থেকে। এবার শেয়ারের ব্যবসার টাকা নেই, থাকলেও তা যৎসামান্য। এতদসত্ত্বেও তাদেও লাভে কোন ঘাটতি নেই। কিভাবে তা সম্ভব হচ্ছে? কিভাবে এসব ব্যাংক দিনের পর দিন সুদের ব্যবসায় ভাল মুনাফা দেখিয়ে যাচ্ছে?
যে সমস্ত ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ব্যাংকের মালিক নন তারা প্রতিদিন অভিযোগ করছেন ব্যাংকগুলোর সুদের হার মাত্রার বেশি। অর্থাৎ ঋণের ওপর সুদের হার বেশি। তারা এও বলছেন, এই সুদের হারে প্রতিযোগিতা করে কোন ব্যবসা করা যায় না। তারা বার বার সুদের হার কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। এই তাগিদের বিপক্ষেও কিছু যুক্তি আছে। আমি সেদিকে যাচ্ছি না। সাধারণভাবে ব্যবসায়ী যারা বলছেন ব্যাংকের সুদের হার বেশি তাদের কথা ঠিক। ঠিক যে তা সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকের সুদের হারের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করলেই ধরা পড়বে। এদিকে আমনতকারীদের অভিযোগও একই। ব্যাংকাররা আমানতকারীদের কোন সুদই দিতে চায় না। বিশেষ করে সঞ্চয় আমানতকারীদের। ব্যাংকিং খাতের কম করে হলে ২৫-৩০ শতাংশ আমানত সঞ্চয়ী আমানত। এই আমানতের পুরোটা এক সময় তলবি অমানত হিসেবে গণ্য হতো। এখন সঞ্চয়ী আমানতের ৮০-৮৫ শতাংশই মেয়াদি আমানত। কারণ সাধারণ সঞ্চয়কারীরা তাদের এ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলেন না বিপদে না পড়লে। এতদসত্ত্বেও ব্যাংকাররা এ ধরনের আমানতের ওপর কোন সুদই দিতে চান না। ৪-৫ শতাংশে সুদ দিয়েই তারা খালাস যেখানে মেয়াদি আমানতে ১২-১৩ শতাংশ সুদ বর্তমানে দেয়া হয়। কম সুদের পর আছে নানা ধরনের চার্জ। এই চার্জের কথা সত্য ঋণের ক্ষেত্রেও। কত রকমের চার্জ যে ব্যাংকগুলো আদায় করে তার কোন হিসাবে নেই। এসব অনাচার দেখে বাংলাদেশ ব্যাংক অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন রোধে একটা সীমারেখা করে দিয়েছে। বলা হয়েছে, ‘স্প্রেড’ ৫ শতাংশের বেশি হবে না। অর্থাৎ আমানতের ওপর প্রদত্ত সুদের হার এবং ঋণের ওপর ধার্যকৃত সুদের হারের মধ্যে সর্বোচ্চ তফাৎ হবে ৫ শতাংশ। বলা দরকার, ৫ শতাংশ ‘স্প্রেড’ আন্তর্জাতিক মানে অনেক বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকটা খাতির করেই একে ৫ শতাংশ করেছে। এতদসত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ ব্যাংক এ নিয়ম মানে না। তারা সামানে ৫ শতাংশের সীমারেখা লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারপরও হুঁশ হচ্ছে না। অথচ হওয়া উচিত ছিল। আমি যখন কলাম লিখছি তখন দেখলাম বার্কলেস ব্যাংকের জালিয়াতির জন্য ব্যাংককে জরিমানা করা হয়েছে। চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী পদত্যাগ করেছেন। কী অপরাধ? তারা সুদের হার গোপন করেছিলেন। ওখানে গোপন কাজ করে ধরা খেয়ে জারিমানা দিতে হলো। আর সোনার বাংলাদেশে প্রকাশ্যে আইন-নিয়ম ভেঙ্গে ব্যাংকিং করলেও কোন শাস্তি হচ্ছে না। বিপরীতে দেখলাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলছেন, এবার ব্যাংকগুলো মন্দার মধ্যেও ভাল করেছে। কী ভাল? সুদের হার উপরে রেখে, আমানতকারীদের ঠকিয়ে ‘স্প্রেড’ বেশি রেখে ব্যাংকগুলো অপারেশনাল প্রফিট করেছে গেল বছরের তুলনায় বেশি। এটা কী সমর্থনযোগ্য? ব্যাংকের মুনাফার কী কোন সীমারেখা থাকবে না? শত হোক সুদের ব্যবসা। মানুষের টাকা ব্যাংকে রাখতে হবে, ঋণগ্রহীতাদেরও ঋণ নিতে হবে। এ রকম একটা বাধ্যতামূলক অবস্থায় ব্যাংকের মুনাফায় কোন ‘ব্রেক’ থাকবে না?
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ব্যাংকের মুনাফার একটা সীমারেখা বেঁধে দেয়া উচিত। দেশের শিল্পায়নের স্বার্থে সুদের হার সহনীয় থাকা দরকার, আবার আমানতকারীদেরও ঠকানো চলবে না। অহেতুক ‘চার্জ’ বেশি আদায় করা চলবে না। সবচেয়ে বড় কথা, ‘লোন লসের’ বোঝা আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতার ওপর চাপানো ঠিক নয়। মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা লোন লস, অদক্ষতা, কম্পিউটারায়নের অভাব ইত্যাদি কারণে ব্যাংকগুলোর খরচা বেশি যার বোঝা চাপানো হচ্ছে আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাদের ওপরে। অতএব দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বেসরকারী ব্যাংকের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের পথে একটা ‘ব্রেক’ তৈরি করা দরকার। শত হোক, বেসরকারী ব্যাংক দেশের বাইরে নয়। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম মানবে না, কৃষি ঋণ করতে চাইবে না, গ্রামাঞ্চলে শাখা খুলবে না, শিল্পায়নের জন্য ঋণ দেবে না অথচ শুধু মুনাফা গুনবে আর কর্মচারীদের পিষে মারবে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের জন্য তা হওয়া উচিত নয়। আমার প্রস্তাব ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক। তাদের বলা হোক, ব্যাংকের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার বোঝা সমাজ বহন করতে অক্ষম। তাদের সমাজমুখী হতে হবে।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক, বিআইবিএম

No comments

Powered by Blogger.