রাষ্ট্রীয় স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের বিতর্ক by এ এম এম শওকত আলী

রাষ্ট্রীয় স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বাংলাদেশে প্রায়ই সমালোচনার সম্মুখীন হন। এ প্রবণতা ভালো এবং খারাপও হতে পারে। ভালোর দিকটা হলো যদি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্মকাণ্ড পরিচালনায় যদি কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি বা পক্ষপাতিত্ব করে, সেটা জনগণ জানতে পারে।


এ প্রবণতার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো বিচার বিভাগ, বিশেষ করে উচ্চতর আদালত। আদালত অবমাননা সংক্রান্ত আইন থাকা সত্ত্বেও বিচার বিভাগ এখন সমালোচনার সম্মুখীন। মিডিয়া থেকেই সাধারণত সমালোচনার সূত্রপাত হয়। দুর্নীতি সংক্রান্ত টিআইবির প্রতিবেদন এ সমালোচনাকে আরো গতিশীল করেছে। এ বছরের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিচার বিভাগকে দুর্নীতির জন্য অন্যতম শীর্ষ সংস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ ধরনের সমালোচনা অতীতে হয়নি, যদিও ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিগত আলোচনায় বিচার বিভাগের নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যেমন পেশকারের দুর্নীতির বিষয়টি স্থান পেয়েছে। বর্তমানে এ সমালোচনা প্রকাশ্যেই করা হচ্ছে।
মিডিয়ায় এ প্রতিবেদনটি ছিল বহুল আলোচিত। স্বাভাবিকভাবেই অধস্তন বিচারকরা এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অন্যদিকে টিআইবির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মানহানির মামলাও দায়ের করা হয়েছে। উচ্চতর আদালতেও এ বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়েছে, তবে আদালত অবমাননার আইনে নয়। উচ্চতর আদালত প্রাথমিকভাবে প্রতিবেদনের সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পরীক্ষার জন্য আদেশ দেন। পরবর্তী সময়ে উচ্চতর আদালত টিআইবির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয়টি আলাপ করেন। সর্বশেষ পদক্ষেপ ছিল বিচার বিভাগে কোন পর্যায়ে দুর্নীতি বিরাজমান সে বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য বিচারকের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতিসহ সার্বিকভাবে উচ্চতর আদালত যথেষ্ট সহনশীলতার সাক্ষ্য রেখেছেন, যা প্রশংসার দাবি রাখে। এ ধরনের সহনশীলতা উপযুক্ত ক্ষেত্রে অন্যদের জন্য করলে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে। রাষ্ট্রীয় যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা সমালোচনার জন্য উত্তেজিত হয়ে ক্ষমতা না দেখিয়ে সহনশীলতার পরিচয় দিলে সুশাসন সুসংহত হবে। বিশেষ করে বিচার বিভাগের জন্য এ বিষয়টি অধিকতর প্রযোজ্য। একই সঙ্গে যাঁরা সমালোচনা করেন তাঁদেরও নিছক সমালোচনার খাতিরে সমালোচনা করার বিষয়ে আরো অধিক সতর্ক হওয়াও সমীচীন হবে। বিচার বিভাগের সমালোচনা সাধারণত মিডিয়া, নীতি বিশ্লেষক এবং আইনজীবীরাই করেন। এ ক্ষেত্রেও অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
আইনজীবীরা নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ্যে বিচার বিভাগ তথা বিচারকভিত্তিক সমালোচনা করে থাকেন। বিশেষ করে উচ্চতর আদালতের ক্ষেত্রে। ব্যক্তি হিসেবে কোনো আইনজীবী এটা সাধারণত করেন না। অতীতে এটা কখনো দৃশ্যমান ছিল না। তবে এখন কম মাত্রায় হলেও হচ্ছে। ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে গোষ্ঠীগতভাবে আইনজীবীদের প্রধান দুই দল যে সময়ে সময়ে বিচারকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন তার কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন যে উচ্চ আদালতে বিচারকদের নিয়োগ রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। এর কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেওয়া সম্ভব না হলেও সেটাই প্রচলিত। এ নিয়ে প্রকাশ্যে বহু বিতর্কও হয়েছে, যা ইতিপূর্বে ছিল না।
আইনজীবীদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যে সমালোচনা করা হয়, সে বিষয়টিই অধিকতর দৃশ্যমান। তবে অব্যাহতভাবে এটা হয় না। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে এ ধরনের সমালোচনার অন্যতম কারণ কোন পন্থী আইনজীবীরা তাদের প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীসহ নিম্ন আদালতের আইনজীবীরাও কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন। এটাও সঠিক যে এ ধরনের সমালোচনা বিচারিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করে। অতীতেও যে এ ধরনের কর্মকাণ্ড হয়নি তা নয়। তবে কয়েক বছর ধরে এর মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সমালোচনার মাধ্যমে প্রতিবাদী হয়ে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা (সবাই নন) অনেকাংশে রাজনীতিবিদদের মতো প্রতিবাদ করেন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে নির্দিষ্ট বিচারপতির আদালত বর্জন, বিচারপতির চেম্বার বা এজলাসের সম্মুখে দল বেঁধে বসে থাকা, হাত উঁচিয়ে স্লোগান দেওয়া, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে চেম্বারের দরজায় লাথি মারা। এ ধরনের কর্মকাণ্ড ১৯৯১-পূর্ববর্তী সময়ে ছিল না। যা ছিল তা হলো স্বৈরশাসনের তথা সামারিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। ১৯৯১-পরবর্তী সময়ের কিছু কিছু ক্ষেত্রে দলভিত্তিক ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটেছে। এ মাসের ২৭ তারিখ আইনজীবীদের একটি দল প্রধান বিচারপতির এজলাসের বাইরে দল বেঁধে বসে থাকে এবং প্রধান বিচারপতিকে লক্ষ করে স্লোগানও দেয়। সূত্র মতে, প্রধান বিচারপতি এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলার পর নেতৃস্থানীয় আইনজীবী এর পরিণতির জন্য প্রধান বিচারপতিকেই দায়ী থাকতে হবে বলে হুঁশিয়ার-বাণী উচ্চারণ করেন। উচ্চতর আদালতের আইনজীবীদের মতো জেলা বার সমিতির সদস্যরাও রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুযায়ী বিভক্ত। এসব আদালত প্রাঙ্গণেও একই ধারা দৃশ্যমান। এরাও ক্ষেত্রবিশেষে আদালত বর্জন করে থাকে। এ ধরনের আচরণ বা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্য কত বিচারদিনের ক্ষতি হয়েছে যে হিসাব কখনো করা হয়নি। যদি করা হতো, তাহলে জানা সম্ভব ছিল।
গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড জনগণ তথা সংশ্লিষ্ট অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডও নিবিড়ভাবে পরিবীক্ষণ করবে_এটাই কাম্য। তবে এ ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা রয়েছে। অনেক অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই নিজস্ব পেশা অনুযায়ী গঠিত। এদের মধ্যে অনেক সংগঠনই রাজনৈতিক দল দ্বারা প্রভাবিত, যাদের মূল দলের অঙ্গসংগঠন বলা হয়। যেমন শ্রমিক সংগঠন বা সাংস্কৃতিক সংগঠন। ছাত্রসংগঠনের কথা তো সর্বজনবিদিত। কোনো নির্দিষ্ট দলের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করলে এ সংগঠন তাদের নিজস্ব পেশায় উৎকর্ষ অর্জনে ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বার্থভিত্তিক (ওহঃবৎবংঃ ৎেড়ঁঢ়) দল বা গ্রুপকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা হয়। বাংলাদেশের এ ধরনের সংগঠনকে একই দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব বা সমীচীন কি না, তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাই বলতে পারবেন।
বিচার বিভাগের মতো নির্বাচন কমিশনও সাংবিধানিক স্বীকৃতির বলে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। ১৯৯১-পরবর্তী সময় থেকেই এ প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব দায়িত্ব পালনে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। এ অভিযোগ যে একেবারেই ভিত্তিহীন নয়, তা প্রায় সবাই জানে। এ কারণেই ২০০০-পরবর্তী সময়ে কমিশনকে অধিকতর শক্তিশালী ও পক্ষপাতমুক্ত করার বিষয়ে নাগরিক সমাজসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও সোচ্চার হয়। ফলে ২০০৭-২০০৮ সালে কমিশন সংক্রান্ত আইনের কিছু ধারাও তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিবর্তন করে। কমিশনকেও পুনর্গঠন করা হয়। ২০০৮ সালের শেষ পর্যায়ে কমিশন জাতীয় পর্যায়ে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। সবাই তখন আশা প্রকাশ করে যে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে এসেছে।
পৌরসভাসহ দুটি উপনির্বাচনের পূর্ব এবং পরবর্তী সময় থেকেই এ আশা ম্লান হতে থাকে। অবশ্য সুশাসন সংক্রান্ত কিছু বিষয়ও এর অন্যতম কারণ। ২০০৮ সালে যে আস্থা জনগণ কমিশনের ওপর অর্পণ করে, তা এখন হুমকির মুখে। মূল কারণ সংঘাতপূর্ণ অতীতের রাজনৈতিক ধারা। প্রধান বিরোধী দল পৌর নির্বাচনে প্রাথমিকভাবে সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলার কাজে ব্যবহার করার দাবিতে সোচ্চার হয়। পৌরসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব দলভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ প্রথা অতীতে ছিল না। বিদ্যমান স্থানীয় সরকার আইনেও এর কোনো স্বীকৃতি নেই।
রাষ্ট্রীয় স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা অবশ্যই হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে সমালোচনা হতে হবে নৈর্ব্যক্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ। এর সঙ্গে জবাবদিহিতার বিষয়টি নিবিড়ভাবে জড়িত। সমালোচনা যেন প্রতিষ্ঠানের বা এর কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আন্দোলনে পর্যবসিত না হয়, সে দিকটা চিহ্নিত করতে হবে। স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনিয়ম বা দুর্নীতির প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা সংবিধানসহ ক্ষেত্রবিশেষে সংশ্লিষ্ট আইনেই রয়েছে। এর জন্য নির্দিষ্ট কাঠামো ও প্রক্রিয়াও বিদ্যমান। কাঠামো ও প্রক্রিয়াকেই সচল করা প্রয়োজন। এ দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রপতিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধানের ওপর বর্তায়। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে জাতি গঠনের জন্য সুযোগ্য ব্যক্তির প্রয়োজন থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বই অধিকতর। আন্দোলনের হুমকিতে প্রতিষ্ঠানই যদি দুর্বল হয়, তাহলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.