নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-নায়িকার মৃত্যু by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
চট্টগ্রাম শহরের ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদে ‘বনানী কমপ্লেক্স’ নামের একটি সিনেমা হল ছিল। বিজ্ঞাপনে বলা হতো ‘এশিয়ার স্বপ্নপুরী’। বিজ্ঞাপনের সঙ্গে তো বাস্তবের মিল খোঁজা চলে না, কিন্তু আশির দশকের গোড়ার দিকে এই প্রেক্ষাগৃহের জৌলুস আমার মতো অনেক কিশোরের যে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
অবশ্য সেকালে বাংলা সিনেমার দর্শকপ্রিয়তার সেই যুগে চট্টগ্রামে জলসা, নূপুর, অলংকার প্রভৃতি সিনেমা হলের চেহারা ছিল তাদের বাহারি নামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কি রমরমা বাণিজ্যে, কি সাজসজ্জার চাকচিক্যে এই মিলনায়তনগুলো ছিল হাজার দর্শকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
যা-ই হোক, এই সিনেমা হলগুলোর মতো ‘বনানী কমপ্লেক্স’ও আজ নেই। ভবনটি এখনো আছে, নামটিও কিন্তু সেখানে অজস্র সিনেমা-পাগল দর্শকের ভিড় নেই। এখন সেটি শুধুই কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়।
সিনেমা হলটি নেই, কিন্তু তাকে ঘিরে কৈশোরের একটি স্মৃতি মনে গেঁথে আছে। বহুকাল আগে একবার এই সিনেমা হলের সামনে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক নায়িকাকে দেখেছিলাম। কোনো একটি ছবির মুক্তি উপলক্ষে তিনি এসেছিলেন। ছবির নাম আজ মনে নেই, কিন্তু হলের সামনে একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি যে কোলাহলমুখর অগুনতি ভক্ত-দর্শকের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়েছিলেন, হেসেছিলেন—সেই রূপ, সেই লাস্য ভুলতে পারি না। রুপালি পর্দার মানবীকে বাস্তবের চর্মচক্ষে দেখার সেই অভিজ্ঞতার কথা ভেবে আজও রোমাঞ্চিত হই।
সেই নায়িকার নাম ‘কবিতা’। জংলী মেয়ে, ছোট সাহেব, কে আসল কে নকল, ধন্যি মেয়ে — এ রকম আরও অনেক দর্শকনন্দিত ব্যবসাসফল ছবির নায়িকা কবিতা। রাজ্জাক, উজ্জল, আলমগীরের মতো সেকালের তারকাশিল্পীদের নায়িকা কবিতা। পরে শুনেছি আসল নাম জোবায়দা খাতুন। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে করাচি শহরে জন্মেছিলেন তিনি। কাঞ্চনমালা ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে ছবির জগতে আসা।
এখানে বনানী কমপ্লেক্স প্রসঙ্গটি আরও একবার উল্লেখ করতে হচ্ছে। কারণ, এই সিনেমা হলের মালিক, চিত্র প্রযোজক ও চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গোলাম কবিরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল কবিতার। বিয়ের পর গোলাম কবিরের সিডিএ নাসিরাবাদ এলাকার বিলাসবহুল বাসভবনে এসে উঠেছিলেন কবিতা। কয়েক বছর এখানে ছিলেন। শুনেছি গোলাম কবিরের সেই বাড়ির সামনের রাস্তায় কত তরুণ দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থেকেছে, কখন নায়িকাকে একনজর দেখা যাবে, কখন কবিতা কয়েক মুহূর্তের জন্য এসে দাঁড়াবেন ব্যালকনিতে, সেই প্রতীক্ষায়।
এ রকম যাঁর জনপ্রিয়তা, সেই নায়িকার শেষ জীবন কেমন হতে পারত—এ প্রশ্নের জবাব নেই আমাদের কাছে। সুচিত্রা সেনের মতো লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেও ভক্ত-দর্শকদের কৌতূহলের কেন্দ্রে থাকা সবার ভাগ্যে থাকে না। কিন্তু আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো একটি স্বাভাবিক জীবনও তাঁর থাকবে না—এটা কি গ্রহণযোগ্য?
প্রিয় পাঠক, আপনারা অনেকেই জানেন, অনেকে জানেন না (কারণ সংবাদমাধ্যমগুলোও এ সংবাদ তেমন গুরুত্ব দিয়ে ছাপেনি) গত ৮ জুন কবিতা মৃত্যুবরণ করেছেন। তার চেয়েও বড় সংবাদ, তাঁর মৃত্যু হয়েছে ঢাকা শহরের একটি বস্তিতে। মৃত্যুর পর তাঁর ছোট্ট ঘরটিতে পাওয়া গেছে ছেঁড়া কাঁথা-বালিশ, ভাঙা একটি চেয়ার ও শোকেস।
প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাংবাদিক লিখেছেন, ‘স্তূপ করে রাখা কাঁথা ও কাপড়চোপড়ের মধ্যে একটি ফাইলে দেখা যায় বিয়ের কাবিননামা এবং তালাকনামার কাগজ দুটি যত্ন করে তিনি রেখে দিয়েছিলেন।...আরও ছিল লেমিনেটিং করা তাঁর বেশ কিছু ছবি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চেয়ে লেখা একটি আবেদনপত্রও।’ (এস এম আলমগীর, সকালের খবর, ২ জুলাই)
জানি না, প্রধানমন্ত্রী কবিতাকে চেনেন কি না। কিন্তু একজন প্রবীণ অভিনয়শিল্পী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান, এ কথাটি চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট কেউ অন্তত তাঁকে জানাতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ বা সরকারি সাহায্য পেলে হয়তো বদলে যেত কবিতার অন্তিম দিনগুলো।
দেশের কাছে, সরকারের কাছে এটুকু প্রত্যাশা তো একজন শিল্পীর থাকতেই পারে। কিন্তু একজন সহকর্মীর জন্য এটুকু দেনদরবার করতে এগিয়ে আসেননি আমাদের চলচ্চিত্র জগতের কেউ।
পাঠক, ডার্টি পিকচার ছবিটি দেখেছেন? সিল্ক স্মিতা নামের তামিল ছবির এক নায়িকার (মতান্তরে নর্তকী) জীবন নিয়ে তৈরি হিন্দি ছবিটি বক্স অফিস কাঁপিয়ে দিয়েছে কিছুদিন আগে। ফিল্মের জগতে দরিদ্র পরিবারের মেয়ে সিল্ক স্মিতার অসাধারণ উত্থান এবং সময়ের ব্যবধানে তাঁর ট্র্যাজিক পরিণতিকে উপজীব্য করা হয়েছে ছবিতে। খ্যাতির মধ্যগগন থেকে ছিটকে পড়া নক্ষত্র স্মিতা তাঁর করুণ জীবনের ইতি টেনেছিলেন আত্মহত্যা করে।
কবিতার জীবনকে তার চেয়েও করুণ মনে হয়। আত্মসম্মান ও মর্যাদার কারণে হাত পাততে পারেননি কারও কাছে। কিন্তু শেষ দিনগুলেতে কী চরম আর্থিক কষ্টের মধ্যে, অন্যের করুণা নিয়ে কেটেছে তাঁর জীবন, তা জানিয়েছেন তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল এক ব্যক্তি। হানিফ বাবু নামে তাঁর আশ্রয়দাতা এই ভদ্রলোক বলেছেন, ‘২০০৬ সালের কোনো এক মাসে রাতের বেলায় গলির মাথায় মধ্যবয়সী এক মহিলাকে ঘিরে কিছু মানুষ জটলা করছিল। কাছে গিয়ে দেখি মহিলা রাস্তার ওপর বসে আছেন। কী নাম, কোথা থেকে এসেছেন—জানতে চাইলে তিনি কিছুই বলেননি। দেখে মনে হচ্ছিল কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারের। আমি আমার বাসায় এনে আশ্রয় দিই।...তিনি যে নায়িকা কবিতা, সেটি আমরা দীর্ঘ দুই বছর কেউই বুঝতে পারিনি।’
অথচ কী ছিল না কবিতার! খ্যাতি ও যশের পাশাপাশি ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন, শিল্পপতি স্বামীর সংসার করেছেন। কিন্তু কী এক রহস্যময় কারণে কপর্দকশূন্য হয়ে পথে নামতে হয়েছে তাঁকে।
এটা শুধু কবিতার ক্ষেত্রে নয়, অনেক শিল্পীকেই আমরা দেখেছি, বিশেষ করে নারী শিল্পীরা সারা জীবন উপার্জন করলেও শেষ জীবনে অর্থকষ্টে দিন কাটান। কোনো না কোনোভাবে প্রতারণা বা বঞ্চনার শিকার না হলে এ রকম হওয়ার তো কথা নয়। এই রহস্য উদ্ঘাটন করবে কে? চলচ্চিত্র শিল্পী সংস্থা বা এ ধরনের সংগঠনের কাঁধেই তো এসব দায় বর্তায়। তারা কি ভবিষ্যতে এই দিকটা ভেবে দেখবে?
শিল্পী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য নানা তৎপরতার খবর পত্রপত্রিকায় দেখি। এই সংগঠনগুলো কি শুধুই বার্ষিক বনভোজন আয়োজন বা পরিচালকের সঙ্গে শিল্পীর মনোমালিন্য ঘোচানোর দায়িত্ব পালন করেই সন্তুষ্ট? নইলে কবিতার মতো এককালের জনপ্রিয় নায়িকা বা রানী সরকারের মতো চরিত্রাভিনেত্রীর দুঃসময়ে তাদের দেখা মিলবে না কেন? তারাই তো এই শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে পারে, তহবিল গঠন করতে পারে, প্রয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য দেনদরবার করতে পারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে।
এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমেরও কিছু ভূমিকা আছে বলে মনে করি। বিনোদন প্রতিবেদকেরা হালের তারকাদের সাম্প্রতিক জনপ্রিয়তাকে অধিক মূল্য দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শাকিব, অপু, রেসি, সাহারার মতো একালের জনপ্রিয় তারকাদের তথ্যসংগ্রহের পাশাপাশি অন্তত কালেভদ্রে অলিভিয়া, সুচরিতা, অঞ্জু ঘোষদের মতো এককালের তারকা-শিল্পীদের খোঁজ রাখাটাও জরুরি।
কবিতার জীবন আমাদের আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল পাদপ্রদীপের আলো নিভে গেলে সত্যিকারের অন্ধকার নেমে আসে শিল্পীর জীবনে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
যা-ই হোক, এই সিনেমা হলগুলোর মতো ‘বনানী কমপ্লেক্স’ও আজ নেই। ভবনটি এখনো আছে, নামটিও কিন্তু সেখানে অজস্র সিনেমা-পাগল দর্শকের ভিড় নেই। এখন সেটি শুধুই কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়।
সিনেমা হলটি নেই, কিন্তু তাকে ঘিরে কৈশোরের একটি স্মৃতি মনে গেঁথে আছে। বহুকাল আগে একবার এই সিনেমা হলের সামনে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক নায়িকাকে দেখেছিলাম। কোনো একটি ছবির মুক্তি উপলক্ষে তিনি এসেছিলেন। ছবির নাম আজ মনে নেই, কিন্তু হলের সামনে একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি যে কোলাহলমুখর অগুনতি ভক্ত-দর্শকের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়েছিলেন, হেসেছিলেন—সেই রূপ, সেই লাস্য ভুলতে পারি না। রুপালি পর্দার মানবীকে বাস্তবের চর্মচক্ষে দেখার সেই অভিজ্ঞতার কথা ভেবে আজও রোমাঞ্চিত হই।
সেই নায়িকার নাম ‘কবিতা’। জংলী মেয়ে, ছোট সাহেব, কে আসল কে নকল, ধন্যি মেয়ে — এ রকম আরও অনেক দর্শকনন্দিত ব্যবসাসফল ছবির নায়িকা কবিতা। রাজ্জাক, উজ্জল, আলমগীরের মতো সেকালের তারকাশিল্পীদের নায়িকা কবিতা। পরে শুনেছি আসল নাম জোবায়দা খাতুন। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে করাচি শহরে জন্মেছিলেন তিনি। কাঞ্চনমালা ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে ছবির জগতে আসা।
এখানে বনানী কমপ্লেক্স প্রসঙ্গটি আরও একবার উল্লেখ করতে হচ্ছে। কারণ, এই সিনেমা হলের মালিক, চিত্র প্রযোজক ও চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গোলাম কবিরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল কবিতার। বিয়ের পর গোলাম কবিরের সিডিএ নাসিরাবাদ এলাকার বিলাসবহুল বাসভবনে এসে উঠেছিলেন কবিতা। কয়েক বছর এখানে ছিলেন। শুনেছি গোলাম কবিরের সেই বাড়ির সামনের রাস্তায় কত তরুণ দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থেকেছে, কখন নায়িকাকে একনজর দেখা যাবে, কখন কবিতা কয়েক মুহূর্তের জন্য এসে দাঁড়াবেন ব্যালকনিতে, সেই প্রতীক্ষায়।
এ রকম যাঁর জনপ্রিয়তা, সেই নায়িকার শেষ জীবন কেমন হতে পারত—এ প্রশ্নের জবাব নেই আমাদের কাছে। সুচিত্রা সেনের মতো লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেও ভক্ত-দর্শকদের কৌতূহলের কেন্দ্রে থাকা সবার ভাগ্যে থাকে না। কিন্তু আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো একটি স্বাভাবিক জীবনও তাঁর থাকবে না—এটা কি গ্রহণযোগ্য?
প্রিয় পাঠক, আপনারা অনেকেই জানেন, অনেকে জানেন না (কারণ সংবাদমাধ্যমগুলোও এ সংবাদ তেমন গুরুত্ব দিয়ে ছাপেনি) গত ৮ জুন কবিতা মৃত্যুবরণ করেছেন। তার চেয়েও বড় সংবাদ, তাঁর মৃত্যু হয়েছে ঢাকা শহরের একটি বস্তিতে। মৃত্যুর পর তাঁর ছোট্ট ঘরটিতে পাওয়া গেছে ছেঁড়া কাঁথা-বালিশ, ভাঙা একটি চেয়ার ও শোকেস।
প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাংবাদিক লিখেছেন, ‘স্তূপ করে রাখা কাঁথা ও কাপড়চোপড়ের মধ্যে একটি ফাইলে দেখা যায় বিয়ের কাবিননামা এবং তালাকনামার কাগজ দুটি যত্ন করে তিনি রেখে দিয়েছিলেন।...আরও ছিল লেমিনেটিং করা তাঁর বেশ কিছু ছবি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চেয়ে লেখা একটি আবেদনপত্রও।’ (এস এম আলমগীর, সকালের খবর, ২ জুলাই)
জানি না, প্রধানমন্ত্রী কবিতাকে চেনেন কি না। কিন্তু একজন প্রবীণ অভিনয়শিল্পী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান, এ কথাটি চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট কেউ অন্তত তাঁকে জানাতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ বা সরকারি সাহায্য পেলে হয়তো বদলে যেত কবিতার অন্তিম দিনগুলো।
দেশের কাছে, সরকারের কাছে এটুকু প্রত্যাশা তো একজন শিল্পীর থাকতেই পারে। কিন্তু একজন সহকর্মীর জন্য এটুকু দেনদরবার করতে এগিয়ে আসেননি আমাদের চলচ্চিত্র জগতের কেউ।
পাঠক, ডার্টি পিকচার ছবিটি দেখেছেন? সিল্ক স্মিতা নামের তামিল ছবির এক নায়িকার (মতান্তরে নর্তকী) জীবন নিয়ে তৈরি হিন্দি ছবিটি বক্স অফিস কাঁপিয়ে দিয়েছে কিছুদিন আগে। ফিল্মের জগতে দরিদ্র পরিবারের মেয়ে সিল্ক স্মিতার অসাধারণ উত্থান এবং সময়ের ব্যবধানে তাঁর ট্র্যাজিক পরিণতিকে উপজীব্য করা হয়েছে ছবিতে। খ্যাতির মধ্যগগন থেকে ছিটকে পড়া নক্ষত্র স্মিতা তাঁর করুণ জীবনের ইতি টেনেছিলেন আত্মহত্যা করে।
কবিতার জীবনকে তার চেয়েও করুণ মনে হয়। আত্মসম্মান ও মর্যাদার কারণে হাত পাততে পারেননি কারও কাছে। কিন্তু শেষ দিনগুলেতে কী চরম আর্থিক কষ্টের মধ্যে, অন্যের করুণা নিয়ে কেটেছে তাঁর জীবন, তা জানিয়েছেন তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল এক ব্যক্তি। হানিফ বাবু নামে তাঁর আশ্রয়দাতা এই ভদ্রলোক বলেছেন, ‘২০০৬ সালের কোনো এক মাসে রাতের বেলায় গলির মাথায় মধ্যবয়সী এক মহিলাকে ঘিরে কিছু মানুষ জটলা করছিল। কাছে গিয়ে দেখি মহিলা রাস্তার ওপর বসে আছেন। কী নাম, কোথা থেকে এসেছেন—জানতে চাইলে তিনি কিছুই বলেননি। দেখে মনে হচ্ছিল কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারের। আমি আমার বাসায় এনে আশ্রয় দিই।...তিনি যে নায়িকা কবিতা, সেটি আমরা দীর্ঘ দুই বছর কেউই বুঝতে পারিনি।’
অথচ কী ছিল না কবিতার! খ্যাতি ও যশের পাশাপাশি ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন, শিল্পপতি স্বামীর সংসার করেছেন। কিন্তু কী এক রহস্যময় কারণে কপর্দকশূন্য হয়ে পথে নামতে হয়েছে তাঁকে।
এটা শুধু কবিতার ক্ষেত্রে নয়, অনেক শিল্পীকেই আমরা দেখেছি, বিশেষ করে নারী শিল্পীরা সারা জীবন উপার্জন করলেও শেষ জীবনে অর্থকষ্টে দিন কাটান। কোনো না কোনোভাবে প্রতারণা বা বঞ্চনার শিকার না হলে এ রকম হওয়ার তো কথা নয়। এই রহস্য উদ্ঘাটন করবে কে? চলচ্চিত্র শিল্পী সংস্থা বা এ ধরনের সংগঠনের কাঁধেই তো এসব দায় বর্তায়। তারা কি ভবিষ্যতে এই দিকটা ভেবে দেখবে?
শিল্পী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য নানা তৎপরতার খবর পত্রপত্রিকায় দেখি। এই সংগঠনগুলো কি শুধুই বার্ষিক বনভোজন আয়োজন বা পরিচালকের সঙ্গে শিল্পীর মনোমালিন্য ঘোচানোর দায়িত্ব পালন করেই সন্তুষ্ট? নইলে কবিতার মতো এককালের জনপ্রিয় নায়িকা বা রানী সরকারের মতো চরিত্রাভিনেত্রীর দুঃসময়ে তাদের দেখা মিলবে না কেন? তারাই তো এই শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে পারে, তহবিল গঠন করতে পারে, প্রয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য দেনদরবার করতে পারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে।
এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমেরও কিছু ভূমিকা আছে বলে মনে করি। বিনোদন প্রতিবেদকেরা হালের তারকাদের সাম্প্রতিক জনপ্রিয়তাকে অধিক মূল্য দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শাকিব, অপু, রেসি, সাহারার মতো একালের জনপ্রিয় তারকাদের তথ্যসংগ্রহের পাশাপাশি অন্তত কালেভদ্রে অলিভিয়া, সুচরিতা, অঞ্জু ঘোষদের মতো এককালের তারকা-শিল্পীদের খোঁজ রাখাটাও জরুরি।
কবিতার জীবন আমাদের আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল পাদপ্রদীপের আলো নিভে গেলে সত্যিকারের অন্ধকার নেমে আসে শিল্পীর জীবনে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
No comments