উশার হাউসের আতঙ্ক ॥ এডগার এ্যালান পো-ভাষান্তর : আলম কোরেশী
বছরের শোষভাগে সেদিনটি ছিল গভীর অন্ধকারে পূর্ণ এবং ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধ। সারাদিন ধরে আমি ঘোড়ার পিঠে চড়ে প্রায় সন্ধ্যার সময় উশার হাউসের সামনে এসে পৌঁছুলাম। প্রথম দৃষ্টিতেই আমার সমস্ত মন একটা দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। বাড়ির চারপাশটা দেখলাম, ঠা-া পাথরের দেয়ালটা দেখলাম, আর দেখলাম কয়েকটা মরা গাছ।
একটা শীতল অনুভূতি যেন আমাকে স্পর্শ করে গেল। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, উশার হাউসে এত ভয়ের কী আছে?
বাড়ির সামনে একটা নিঝুম কালো লেকের পাড়ে এসে আমার ঘোড়া থামালাম। এখন আমি এই মৃত বাড়িটার মধ্যে কয়েক সপ্তাহ কাটাতে যাচ্ছি। এই বাড়ির মালিকের নাম রডারিক উশার। আমার ছেলেবেলার বন্ধু। বহুকাল ধরে আমাদের আর দেখা সাক্ষাত হয়নি। সম্প্রতি সে আমাকে একটা চিঠি লিখে জানিয়েছে যে, আমি যেন তার সঙ্গে অচিরেই দেখা করি। চিঠিতে এমন এক হৃদয়ের স্পর্শ ছিল যে আমি আর না করতে পারিনি।
সেই লেকের প্রতিবিম্বিত ছবি দেখে আমার মনে এক অদ্ভুত ধারণা জন্মাল। মনে হলো সেটা যেন পার্থিক ছিল না। বাড়িটার চারদিকের হাওয়াটা ছিল যেন ভিন্নতর। ভারী এবং ধূসর হাওয়াটা যেন খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং বিষণœময় ছিল। যদিও বাড়িটার দেয়াল তখনও ধসে পড়েনি তবুও ক্ষয়িষ্ণু পাথরগুলো পতনোম্মুখ বলে মনে হলো। একটা সরু লম্বা ফাটল বাড়িটার ওপর দিক থেকে শুরু হয়ে ক্রমশ নিচের দিকে নামতে নামতে সেই লেকের কালো পানির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।
ঘোড়ায় চড়ে ছোট ব্রিজ পেরিয়ে সেই বাড়িটার মধ্যে ঢুকলাম। একজন ভৃত্য এগিয়ে এসে আমার ঘোড়াটাকে ধরলো। আর একজন ভৃত্য আমাকে পথ দেখিয়ে অনেকগুলো অন্ধকার বাঁক পেরিয়ে আমাকে তার প্রভুর ঘরে নিয়ে গেল।
আমি যে ঘরে পৌঁছুলাম, সেটা খুব বড় এবং উঁচু ছিল। জানালাগুলো এত উঁচুতে যে মেঝে থেকে নাগাল পাওয়া যায় না। শুধু একটা সূক্ষ্ম আলো সেই জানালাগুলোর ভেতর থেকে ঘরে প্রবেশ করছিল। কিন্তু আমি অনেক চেষ্টা করেও ঘরের দূরের উঁচু কোণগুলো দেখতে পেলাম না। ঘরের দেয়ালগুলোতে কালো পর্দা ঝুলছিল। বহু চেয়ার-টেবিল বহুদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে মনে হলো। প্রত্যেকটা জিনিসের ওপর কেমন যেন একটা দুঃখভার চেপে বসে আছে বলে মনে হলো। সেই গভীর বিষাদাময় জগৎ থেকে বুঝি কখনও মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
আমি ঘরে ঢুকতেই উশার যে উষ্ণতার সঙ্গে আমাকে আলিঙ্গন করলো, তাতে আমি বুঝলাম যে সে চিঠিতে আমাকে যা যা লিখেছিল সবই সত্য।
রডারিক উশারের যে রকম পরিবর্তন হয়েছিল, অন্য কারো বোধ হয় সে রকম পরিবর্তন কখনো হয়নি। তার দেহের ত্বক ছিল ধূসর সাদা বর্ণের, চোখ জোড়া ছিল বড় বড় এবং উজ্জ্বল, ঠোঁটজোড়া উজ্জ্বল ছিল না, কিন্তু আকৃতি ছিল খুব সুন্দর, নাকটা ছিল বাঁশির মতো, আর মাথার চুলগুলো ছিল খুব কোমল এবং পাতলা। তার এমন একটা মুখ ছিল যা কখনো ভোলা যায় না। কিন্তু তার এমন পরিবর্তন ঘটেছিল যে আমি প্রথমে তাকে চিনতেই পারিনি।
পরক্ষণেই আমি দেখতে পেলাম যে তার ব্যবহারে যেন একটা দ্রুত পরিবর্তন ঘটে গেল। তার কাজ এবং কথাবার্তা প্রথমে খুব দ্রুত এবং পরক্ষণে আবার স্তিমিত হয়ে পড়ছিল। সে তার অদ্ভুত অসুস্থতার কথা আমাকে বললো। তার এই অসুস্থতা পারিবারিক এবং বংশগত এটা এমন এক অসুস্থতা যে, এ থেকে সে আর মুক্তি পাওয়ার আশা করে না। কিন্তু পরক্ষণেই আবার বললো যে এটা শুধু একটা মানসিক দুর্বলতা এবং অচিরেই ভালো হয়ে যাবে। এটা থেকে তার মনের ভিন্নধর্মী চিন্তাধারা প্রকাশ পেলো।
সে বললো, আমি মারা যাবো নিশ্চয়ই এই নির্বোধের মতো অসুখে মারা যাবো। আমি বুঝতে পারছি, আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমার জীবন আমার মন, আমার আশা-আকাক্সক্ষা আমি সব হারাবো সব হারাবো আমার সেই ভয়ঙ্কর শত্রু ভয়ের বিরুদ্ধে শেষ লড়াই করতে করতে। সব হারাবোÑ সেই মহা আতঙ্কে।
উশার বহুকাল যাবৎ কখনো এ বাড়ির বাইরে যায়নি। সে মনে করতো, বাড়িটার ধূসর দেয়ালগুলো এবং বাড়িটার চারপাশের নিঝুম লেকটা তার আত্মাকে অলৌকিকভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। সে আরও বললো তার একমাত্র সঙ্গী প্রিয় বোনের বহুদিন ধরে অসুখের কথা। যে নিশ্চিতভাবে মৃত্যু পথযাত্রী। উশার বললো যে তার ওই বোন যখন মারা যাবে তখন সে-ই একমাত্র উশার হাউসের শেষ বংশধর হিসেবে বেঁচে থাকবে।
উশারের বোন লেডি ম্যাডেলিনের চিকিৎসকরা বহু আগেই তার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ধীরে ধীরে তার শরীর ক্ষীণ এবং দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রায়ই সে এমন মৃতবৎ ঘুমিয়ে পড়ে যে, মনে হয় সে সত্যি সত্যি মারা গেছে।
উশার যে ছবিগুলো এঁকেছিল, সেগুলো দেখে আমি ভয় পেতাম। যদি কেউ কখনো ছবিতে কোন বক্তব্য এঁকে থাকে, তবে সে রডারিক উশার। অন্তত আমি তার প্রতিটি ছবিতে একটা বিস্ময় আর আতঙ্ক পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠতে দেখেছিলাম।
উশারের শ্রবণশক্তি ছিল অত্যন্ত দুর্বল। সেই শক্তিতে বহু সঙ্গীত শুনতে তার খুব কষ্ট হতো। সেজন্যই বোধহয় সে যে সব সঙ্গীত বাজাতো সেগুলো ভিন্ন ধরনের ছিল। অথচ তার বাজানোর মধ্যে যে ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য ছিল তা বর্ণনাতীত। তার গানের একটা কথা ছিল হানাবাড়ি। সে তার এই গানের মধ্যে এক সবুজ উপত্যকা, একটা বিরাট বাড়ি, একটা প্রাসাদের কথা বলতোÑ যে প্রাসাদে এক রাজা বাস করতো। সেখানে সবকিছুর মধ্যে ছিল আলো, রং আর সৌন্দর্য। সেখানে বাতাস ছিল সুরভিত। সেই প্রাসাদে উজ্জ্বল দুটি জানালা ছিল যে জানালা দিয়ে সেই সুখী উপত্যকার লোকজনেরা সঙ্গীত শুনতে পেতো এবং রাজার চারপাশে উৎফুল্ল প্রেতাত্মা আর অশরীরীদের ঘুরতে দেখা যেতো। সেই প্রেতাত্মাদের কাজ ছিল শুধু সুললিত কণ্ঠে রাজার স্তুতিগান করা। উশারের মনে আর একটা অদ্ভুত ধারণা জন্মেছিল যে গাছপালা, পাথর, এমনকি পানিরও অনুভূতি আছে। তারা চিন্তা করতে পারে। সে বিশ্বাস করতো যে, তার বাড়ির পাশের পাথর এবং পাথরের মধ্যে যে গাছপালা জন্মাচ্ছেÑ সেগুলো তার ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। সেজন্যই তার এই অবস্থা।
উশার যে বইগুলো পড়তো, তার মধ্যে একটা পুরনো বই সে পড়তে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতো। সে বইটা ছিল কোন ভুলে যাওয়া চার্চের জন্য লেখা মৃতের ওপর লক্ষ্য রাখা সম্পর্কে।
অবশেষে উশার একদিন আমাকে জানালো যে, লেডি ম্যাডেলিন আর বেঁচে নেই। সে আরও বললো যে সে ম্যাডেলিনের দেহটা তাদের বাড়ির বহু ভোল্টের মধ্যে একটা ভোল্টে কিছুদিনের জন্য রেখে দিতে চায়। সে এটা করতে চাইছিল লেডি ম্যাডেলিনের অসুস্থতার ধরনের কথা চিন্তা করে।
আমরা লেডি ম্যাডেলিনের দেহটা বহন করে যে ভোল্টে নামালাম, সেটা অত্যন্ত ছোট এবং অন্ধকারে ছিল। সেটা বাড়ির খুব গভীর নিচে ছিল। আমরা ম্যাডেলিনের দেহটা ভোল্টে নামিয়ে রাখার সময় আমি এই প্রথম ভাই বোনের মুখের সাদৃশ্য লক্ষ্য করলাম। উশার আমাকে জানালো যে, তারা যমজ ভাইবোন ছিল।
আমরা লেডি ম্যাডেলিনের মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। কেমন যেন একটা ভয় এবং বিস্ময় আমাদের মনে আতঙ্কের ছায়া ফেলেছিল। তখনও যেন তার মুখে সামান্য রং লেগে ছিল এবং ঠোঁটে মৃদু হাসি ছিল। আমরা লোহার তৈরি দরজাটা বন্ধ করে ওপরে চলে এলাম। এখন উশারের অসুস্থতার একটা পরিবর্তন ঘটলো। সে দ্রুত পদক্ষেপে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে লাগলো। বুঝলাম সে খুব ভয় পেয়েছে।
কখনো কখনো সে অনেকক্ষণ ধরে এমনভাবে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো যে, সে যেন কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছে যা আমি শুনতে পাচ্ছি না। আমি অনুভূত করলাম যে তার বন্য চিন্তাধারা ধীরে ধীরে আমার ওপরও প্রভাব বিস্তার করছে।
লেডি মেডেলিনকে ভোল্টে রেখে আসার সপ্তম বা অষ্টম রাতে তার প্রভাব আমার নিজের ওপর অনুভব করতে লাগলাম। একটা অহেতুক ভয় আমার অস্তিত্বে গেড়ে বসলো। আমি অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা মৃদু শব্দ শুনতে পেলাম। অথচ বাতাসে তখন ঝড়ের কোন বেগ ছিল না। আমি এক অজানা আতঙ্কে ঘরের মধ্যে পারচারি করতে গেলাম।
অল্পক্ষণ পরেই একটা মৃদু পদশব্দ এগিয়ে আসতে শুনলাম। আমি জানতাম যে সে পদশব্দটা উশারের। পরক্ষণেই আমি তাকে দরজার সামনে দেখতে পেলাম। কিন্তু তার চোখে মুখে ছিল কেমন যেন একটা বন্য হাসি। সে আমাকে বললো, তুমি কি এখনও দেখোনি? এই বলে সে দ্রুত জানালার কাছে গিয়ে জানালাটা খুলে দিতেই একটা দমকা ঝড় ঘরে এসে ঢুকলো। সেই প্রবল ঝড়ের দমকে আমরা প্রায় উড়ে যাচ্ছিলাম। আমি উশারকে ধরে জানালা থেকে সরিয়ে এনে একটা চেয়ারে বসাতে বসাতে বললাম, তুমি ওদিকে দেখো না। তোমার ওদিকে দেখা উচিত নয়। এ ধরনের দৃশ্য যা দেখে তুমি অবাক হচ্ছ এটা অন্য স্থানেও ঘটতে পারে। বোধ হয় লেকটাই এর কারণ। তার চেয়ে আমি তোমাকে তোমার প্রিয় বইটা থেকে পড়ে শোনাই। এভাবেই রাতটা কেটে যাবে।
আমি হাতের কাছে যে বইটা পেলাম সেটাই তুলে নিয়ে পড়তে লাগলাম। উশার খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো। আমি পড়তে লাগলাম একজন বলিষ্ঠ লোক সম্পূর্ণ মাতাল অবস্থায় একটা দরজা ভাঙতে শুরু করে আর সেই দরজা ভাঙার শব্দ চারপাশের জঙ্গলের মধ্যে থেকে শোনা যেতে থাকে।
এখানে আমি আসলাম। কারণ আমার মনে হলো যে, বাড়ির দূর কোন অংশ থেকে বইতে পড়া শব্দের মতো একটা ক্ষীণ শব্দ আমার কানে এসে লাগলো। আমি আবার বইটা পড়তে শুরু করলাম। সেখানে লেখা ছিল লোকটা সেই দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে অদ্ভুত এক ভয়ঙ্কর জন্তুকে দেখতে পেলো। লোকটা জন্তুটাকে ভীষণভাবে আঘাত করলো এবং জন্তুটা ভীষণ শব্দ করতে করতে পড়ে গেল। এখানে আবার আমি থামলাম। আমার কোন সন্দেহ নেই যে, এবার আমি গল্পে লেখা জন্তুর মতো সত্যি সত্যি কোন জন্তুর বিকট শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। আমি ঠিক বুঝতে পারিনি যে উশারও আমার মতো শব্দটা শুনেছিল কিনা। তবে আমি স্পষ্ট দেখলাম যে, তারও একটা পরিবর্তন ঘটেছে। সে চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে নিয়েছে যাতে আমি তাকে সোজাসুজি দেখতে না পাই। সে তার দেহটা একটু একটু করে একপাশ থেকে আর এক পাশে ঘোরাচ্ছিল।
আমি আবার গল্পটা পড়তে লাগলামÑএকটা ভারী লোহার খ- ঝনঝন শব্দ করে মেঝের ওপর পড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। এখানে আমি শুনতে পেলাম যে, সত্যি সত্যি যেন মেঝেতে ভারী কিছু পতনের শব্দ হলো। আমি চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। উশার তার দেহটাকে কাত করতে তখনও চেয়ারে বসে ছিল। আমি দ্রুত তার কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বুঝলাম যে, সে থর থর করে কাঁপছে। এখন সে খুব নিচু এবং দ্রুত স্বরে বিড় বিড় করে কথা বলছিল। সে যেন জানে না যে আমি সেখানে আছি।
সে বিড় বিড় করে বলছিল, হ্যাঁ, আমিও শুনেছি। বহু মিনিট বহু ঘণ্টা, বহুদিন আমি শুনেছি কিন্তু আমি বলতে সাহস করিনি আমরা তাকে লেডি মেডেলিনকে জীবিত অবস্থায় ভোল্টে রেখে এসেছিলাম। আর এখন ওই ভয়ঙ্কর শব্দ আর কারো নয় ওটা তারই। হায়, আমি এখন কোথায় পালাবো। সে আসছে, সে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে আসছে যে, কেন আমি তাকে এত তাড়াতাড়ি ভোল্টে রেখে এসেছি। সিঁড়ির ওপর আমি তার পদশব্দ শুনতে পাচ্ছি। এখানে উশার হঠাৎ চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে এমনভাবে চিৎকার করলো যেÑ সে যেন তার আত্মাকে উৎসর্গ করছে। সে চিৎকার করে বললো আমি তোমাকে বলছি, সে এই মুহূর্তে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
উশার যে দরজাটার দিকে দেখাচ্ছিল সেই দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। দরজার ও পাশে একটা ক্ষীণ আকৃতি দাঁড়িয়ে আছে লেডি মেডেলিনের আকৃতি। তার সমস্ত শরীর সাদা পোশাকে আবৃত। আর সেই সাদা পোশাকে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। এক মুহূর্ত সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে কেঁপে উঠলো। তারপর অব্যক্ত কান্নায় ভেঙে পড়ে তার ভাইয়ের দেহের ওপর প্রভলভাবে আছড়ে পড়ে এবং অব্যক্ত যন্ত্রণায় অবশেষে মারা গিয়ে তার ভাইয়ের দেহটাকে বহন করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল। উশার মারা গিয়েছিলÑ আতঙ্ক তাকে হত্যা করেছিল।
বাড়ির সামনে একটা নিঝুম কালো লেকের পাড়ে এসে আমার ঘোড়া থামালাম। এখন আমি এই মৃত বাড়িটার মধ্যে কয়েক সপ্তাহ কাটাতে যাচ্ছি। এই বাড়ির মালিকের নাম রডারিক উশার। আমার ছেলেবেলার বন্ধু। বহুকাল ধরে আমাদের আর দেখা সাক্ষাত হয়নি। সম্প্রতি সে আমাকে একটা চিঠি লিখে জানিয়েছে যে, আমি যেন তার সঙ্গে অচিরেই দেখা করি। চিঠিতে এমন এক হৃদয়ের স্পর্শ ছিল যে আমি আর না করতে পারিনি।
সেই লেকের প্রতিবিম্বিত ছবি দেখে আমার মনে এক অদ্ভুত ধারণা জন্মাল। মনে হলো সেটা যেন পার্থিক ছিল না। বাড়িটার চারদিকের হাওয়াটা ছিল যেন ভিন্নতর। ভারী এবং ধূসর হাওয়াটা যেন খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং বিষণœময় ছিল। যদিও বাড়িটার দেয়াল তখনও ধসে পড়েনি তবুও ক্ষয়িষ্ণু পাথরগুলো পতনোম্মুখ বলে মনে হলো। একটা সরু লম্বা ফাটল বাড়িটার ওপর দিক থেকে শুরু হয়ে ক্রমশ নিচের দিকে নামতে নামতে সেই লেকের কালো পানির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।
ঘোড়ায় চড়ে ছোট ব্রিজ পেরিয়ে সেই বাড়িটার মধ্যে ঢুকলাম। একজন ভৃত্য এগিয়ে এসে আমার ঘোড়াটাকে ধরলো। আর একজন ভৃত্য আমাকে পথ দেখিয়ে অনেকগুলো অন্ধকার বাঁক পেরিয়ে আমাকে তার প্রভুর ঘরে নিয়ে গেল।
আমি যে ঘরে পৌঁছুলাম, সেটা খুব বড় এবং উঁচু ছিল। জানালাগুলো এত উঁচুতে যে মেঝে থেকে নাগাল পাওয়া যায় না। শুধু একটা সূক্ষ্ম আলো সেই জানালাগুলোর ভেতর থেকে ঘরে প্রবেশ করছিল। কিন্তু আমি অনেক চেষ্টা করেও ঘরের দূরের উঁচু কোণগুলো দেখতে পেলাম না। ঘরের দেয়ালগুলোতে কালো পর্দা ঝুলছিল। বহু চেয়ার-টেবিল বহুদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে মনে হলো। প্রত্যেকটা জিনিসের ওপর কেমন যেন একটা দুঃখভার চেপে বসে আছে বলে মনে হলো। সেই গভীর বিষাদাময় জগৎ থেকে বুঝি কখনও মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
আমি ঘরে ঢুকতেই উশার যে উষ্ণতার সঙ্গে আমাকে আলিঙ্গন করলো, তাতে আমি বুঝলাম যে সে চিঠিতে আমাকে যা যা লিখেছিল সবই সত্য।
রডারিক উশারের যে রকম পরিবর্তন হয়েছিল, অন্য কারো বোধ হয় সে রকম পরিবর্তন কখনো হয়নি। তার দেহের ত্বক ছিল ধূসর সাদা বর্ণের, চোখ জোড়া ছিল বড় বড় এবং উজ্জ্বল, ঠোঁটজোড়া উজ্জ্বল ছিল না, কিন্তু আকৃতি ছিল খুব সুন্দর, নাকটা ছিল বাঁশির মতো, আর মাথার চুলগুলো ছিল খুব কোমল এবং পাতলা। তার এমন একটা মুখ ছিল যা কখনো ভোলা যায় না। কিন্তু তার এমন পরিবর্তন ঘটেছিল যে আমি প্রথমে তাকে চিনতেই পারিনি।
পরক্ষণেই আমি দেখতে পেলাম যে তার ব্যবহারে যেন একটা দ্রুত পরিবর্তন ঘটে গেল। তার কাজ এবং কথাবার্তা প্রথমে খুব দ্রুত এবং পরক্ষণে আবার স্তিমিত হয়ে পড়ছিল। সে তার অদ্ভুত অসুস্থতার কথা আমাকে বললো। তার এই অসুস্থতা পারিবারিক এবং বংশগত এটা এমন এক অসুস্থতা যে, এ থেকে সে আর মুক্তি পাওয়ার আশা করে না। কিন্তু পরক্ষণেই আবার বললো যে এটা শুধু একটা মানসিক দুর্বলতা এবং অচিরেই ভালো হয়ে যাবে। এটা থেকে তার মনের ভিন্নধর্মী চিন্তাধারা প্রকাশ পেলো।
সে বললো, আমি মারা যাবো নিশ্চয়ই এই নির্বোধের মতো অসুখে মারা যাবো। আমি বুঝতে পারছি, আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমার জীবন আমার মন, আমার আশা-আকাক্সক্ষা আমি সব হারাবো সব হারাবো আমার সেই ভয়ঙ্কর শত্রু ভয়ের বিরুদ্ধে শেষ লড়াই করতে করতে। সব হারাবোÑ সেই মহা আতঙ্কে।
উশার বহুকাল যাবৎ কখনো এ বাড়ির বাইরে যায়নি। সে মনে করতো, বাড়িটার ধূসর দেয়ালগুলো এবং বাড়িটার চারপাশের নিঝুম লেকটা তার আত্মাকে অলৌকিকভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। সে আরও বললো তার একমাত্র সঙ্গী প্রিয় বোনের বহুদিন ধরে অসুখের কথা। যে নিশ্চিতভাবে মৃত্যু পথযাত্রী। উশার বললো যে তার ওই বোন যখন মারা যাবে তখন সে-ই একমাত্র উশার হাউসের শেষ বংশধর হিসেবে বেঁচে থাকবে।
উশারের বোন লেডি ম্যাডেলিনের চিকিৎসকরা বহু আগেই তার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ধীরে ধীরে তার শরীর ক্ষীণ এবং দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রায়ই সে এমন মৃতবৎ ঘুমিয়ে পড়ে যে, মনে হয় সে সত্যি সত্যি মারা গেছে।
উশার যে ছবিগুলো এঁকেছিল, সেগুলো দেখে আমি ভয় পেতাম। যদি কেউ কখনো ছবিতে কোন বক্তব্য এঁকে থাকে, তবে সে রডারিক উশার। অন্তত আমি তার প্রতিটি ছবিতে একটা বিস্ময় আর আতঙ্ক পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠতে দেখেছিলাম।
উশারের শ্রবণশক্তি ছিল অত্যন্ত দুর্বল। সেই শক্তিতে বহু সঙ্গীত শুনতে তার খুব কষ্ট হতো। সেজন্যই বোধহয় সে যে সব সঙ্গীত বাজাতো সেগুলো ভিন্ন ধরনের ছিল। অথচ তার বাজানোর মধ্যে যে ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য ছিল তা বর্ণনাতীত। তার গানের একটা কথা ছিল হানাবাড়ি। সে তার এই গানের মধ্যে এক সবুজ উপত্যকা, একটা বিরাট বাড়ি, একটা প্রাসাদের কথা বলতোÑ যে প্রাসাদে এক রাজা বাস করতো। সেখানে সবকিছুর মধ্যে ছিল আলো, রং আর সৌন্দর্য। সেখানে বাতাস ছিল সুরভিত। সেই প্রাসাদে উজ্জ্বল দুটি জানালা ছিল যে জানালা দিয়ে সেই সুখী উপত্যকার লোকজনেরা সঙ্গীত শুনতে পেতো এবং রাজার চারপাশে উৎফুল্ল প্রেতাত্মা আর অশরীরীদের ঘুরতে দেখা যেতো। সেই প্রেতাত্মাদের কাজ ছিল শুধু সুললিত কণ্ঠে রাজার স্তুতিগান করা। উশারের মনে আর একটা অদ্ভুত ধারণা জন্মেছিল যে গাছপালা, পাথর, এমনকি পানিরও অনুভূতি আছে। তারা চিন্তা করতে পারে। সে বিশ্বাস করতো যে, তার বাড়ির পাশের পাথর এবং পাথরের মধ্যে যে গাছপালা জন্মাচ্ছেÑ সেগুলো তার ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। সেজন্যই তার এই অবস্থা।
উশার যে বইগুলো পড়তো, তার মধ্যে একটা পুরনো বই সে পড়তে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতো। সে বইটা ছিল কোন ভুলে যাওয়া চার্চের জন্য লেখা মৃতের ওপর লক্ষ্য রাখা সম্পর্কে।
অবশেষে উশার একদিন আমাকে জানালো যে, লেডি ম্যাডেলিন আর বেঁচে নেই। সে আরও বললো যে সে ম্যাডেলিনের দেহটা তাদের বাড়ির বহু ভোল্টের মধ্যে একটা ভোল্টে কিছুদিনের জন্য রেখে দিতে চায়। সে এটা করতে চাইছিল লেডি ম্যাডেলিনের অসুস্থতার ধরনের কথা চিন্তা করে।
আমরা লেডি ম্যাডেলিনের দেহটা বহন করে যে ভোল্টে নামালাম, সেটা অত্যন্ত ছোট এবং অন্ধকারে ছিল। সেটা বাড়ির খুব গভীর নিচে ছিল। আমরা ম্যাডেলিনের দেহটা ভোল্টে নামিয়ে রাখার সময় আমি এই প্রথম ভাই বোনের মুখের সাদৃশ্য লক্ষ্য করলাম। উশার আমাকে জানালো যে, তারা যমজ ভাইবোন ছিল।
আমরা লেডি ম্যাডেলিনের মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। কেমন যেন একটা ভয় এবং বিস্ময় আমাদের মনে আতঙ্কের ছায়া ফেলেছিল। তখনও যেন তার মুখে সামান্য রং লেগে ছিল এবং ঠোঁটে মৃদু হাসি ছিল। আমরা লোহার তৈরি দরজাটা বন্ধ করে ওপরে চলে এলাম। এখন উশারের অসুস্থতার একটা পরিবর্তন ঘটলো। সে দ্রুত পদক্ষেপে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে লাগলো। বুঝলাম সে খুব ভয় পেয়েছে।
কখনো কখনো সে অনেকক্ষণ ধরে এমনভাবে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো যে, সে যেন কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছে যা আমি শুনতে পাচ্ছি না। আমি অনুভূত করলাম যে তার বন্য চিন্তাধারা ধীরে ধীরে আমার ওপরও প্রভাব বিস্তার করছে।
লেডি মেডেলিনকে ভোল্টে রেখে আসার সপ্তম বা অষ্টম রাতে তার প্রভাব আমার নিজের ওপর অনুভব করতে লাগলাম। একটা অহেতুক ভয় আমার অস্তিত্বে গেড়ে বসলো। আমি অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা মৃদু শব্দ শুনতে পেলাম। অথচ বাতাসে তখন ঝড়ের কোন বেগ ছিল না। আমি এক অজানা আতঙ্কে ঘরের মধ্যে পারচারি করতে গেলাম।
অল্পক্ষণ পরেই একটা মৃদু পদশব্দ এগিয়ে আসতে শুনলাম। আমি জানতাম যে সে পদশব্দটা উশারের। পরক্ষণেই আমি তাকে দরজার সামনে দেখতে পেলাম। কিন্তু তার চোখে মুখে ছিল কেমন যেন একটা বন্য হাসি। সে আমাকে বললো, তুমি কি এখনও দেখোনি? এই বলে সে দ্রুত জানালার কাছে গিয়ে জানালাটা খুলে দিতেই একটা দমকা ঝড় ঘরে এসে ঢুকলো। সেই প্রবল ঝড়ের দমকে আমরা প্রায় উড়ে যাচ্ছিলাম। আমি উশারকে ধরে জানালা থেকে সরিয়ে এনে একটা চেয়ারে বসাতে বসাতে বললাম, তুমি ওদিকে দেখো না। তোমার ওদিকে দেখা উচিত নয়। এ ধরনের দৃশ্য যা দেখে তুমি অবাক হচ্ছ এটা অন্য স্থানেও ঘটতে পারে। বোধ হয় লেকটাই এর কারণ। তার চেয়ে আমি তোমাকে তোমার প্রিয় বইটা থেকে পড়ে শোনাই। এভাবেই রাতটা কেটে যাবে।
আমি হাতের কাছে যে বইটা পেলাম সেটাই তুলে নিয়ে পড়তে লাগলাম। উশার খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো। আমি পড়তে লাগলাম একজন বলিষ্ঠ লোক সম্পূর্ণ মাতাল অবস্থায় একটা দরজা ভাঙতে শুরু করে আর সেই দরজা ভাঙার শব্দ চারপাশের জঙ্গলের মধ্যে থেকে শোনা যেতে থাকে।
এখানে আমি আসলাম। কারণ আমার মনে হলো যে, বাড়ির দূর কোন অংশ থেকে বইতে পড়া শব্দের মতো একটা ক্ষীণ শব্দ আমার কানে এসে লাগলো। আমি আবার বইটা পড়তে শুরু করলাম। সেখানে লেখা ছিল লোকটা সেই দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে অদ্ভুত এক ভয়ঙ্কর জন্তুকে দেখতে পেলো। লোকটা জন্তুটাকে ভীষণভাবে আঘাত করলো এবং জন্তুটা ভীষণ শব্দ করতে করতে পড়ে গেল। এখানে আবার আমি থামলাম। আমার কোন সন্দেহ নেই যে, এবার আমি গল্পে লেখা জন্তুর মতো সত্যি সত্যি কোন জন্তুর বিকট শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। আমি ঠিক বুঝতে পারিনি যে উশারও আমার মতো শব্দটা শুনেছিল কিনা। তবে আমি স্পষ্ট দেখলাম যে, তারও একটা পরিবর্তন ঘটেছে। সে চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে নিয়েছে যাতে আমি তাকে সোজাসুজি দেখতে না পাই। সে তার দেহটা একটু একটু করে একপাশ থেকে আর এক পাশে ঘোরাচ্ছিল।
আমি আবার গল্পটা পড়তে লাগলামÑএকটা ভারী লোহার খ- ঝনঝন শব্দ করে মেঝের ওপর পড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। এখানে আমি শুনতে পেলাম যে, সত্যি সত্যি যেন মেঝেতে ভারী কিছু পতনের শব্দ হলো। আমি চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। উশার তার দেহটাকে কাত করতে তখনও চেয়ারে বসে ছিল। আমি দ্রুত তার কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বুঝলাম যে, সে থর থর করে কাঁপছে। এখন সে খুব নিচু এবং দ্রুত স্বরে বিড় বিড় করে কথা বলছিল। সে যেন জানে না যে আমি সেখানে আছি।
সে বিড় বিড় করে বলছিল, হ্যাঁ, আমিও শুনেছি। বহু মিনিট বহু ঘণ্টা, বহুদিন আমি শুনেছি কিন্তু আমি বলতে সাহস করিনি আমরা তাকে লেডি মেডেলিনকে জীবিত অবস্থায় ভোল্টে রেখে এসেছিলাম। আর এখন ওই ভয়ঙ্কর শব্দ আর কারো নয় ওটা তারই। হায়, আমি এখন কোথায় পালাবো। সে আসছে, সে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে আসছে যে, কেন আমি তাকে এত তাড়াতাড়ি ভোল্টে রেখে এসেছি। সিঁড়ির ওপর আমি তার পদশব্দ শুনতে পাচ্ছি। এখানে উশার হঠাৎ চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে এমনভাবে চিৎকার করলো যেÑ সে যেন তার আত্মাকে উৎসর্গ করছে। সে চিৎকার করে বললো আমি তোমাকে বলছি, সে এই মুহূর্তে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
উশার যে দরজাটার দিকে দেখাচ্ছিল সেই দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। দরজার ও পাশে একটা ক্ষীণ আকৃতি দাঁড়িয়ে আছে লেডি মেডেলিনের আকৃতি। তার সমস্ত শরীর সাদা পোশাকে আবৃত। আর সেই সাদা পোশাকে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। এক মুহূর্ত সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে কেঁপে উঠলো। তারপর অব্যক্ত কান্নায় ভেঙে পড়ে তার ভাইয়ের দেহের ওপর প্রভলভাবে আছড়ে পড়ে এবং অব্যক্ত যন্ত্রণায় অবশেষে মারা গিয়ে তার ভাইয়ের দেহটাকে বহন করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল। উশার মারা গিয়েছিলÑ আতঙ্ক তাকে হত্যা করেছিল।
No comments