হৃদয়নন্দন বনে-রূপালি পুঁটির ঝোল_ গরম ভাতের স্বাদ! by আলী যাকের

যে কোনো সীমিত সম্পদের সমাজে যদি কতিপয় মানুষকে ওপরে উঠতে হয়, তবে সম্পদের পুনর্বণ্টনের মাধ্যমেই কেবল সেটা সম্ভব। অর্থাৎ আমি যত ওপরে উঠব, তার মূল্য দিতে হবে অন্য কাউকে। এ রকম একটি পরিস্থিতিতেই বোধহয় পেঁৗছেছে আমাদের এই দেশ আজকে।


আর আমরা, যারা এই ধনিক শ্রেণীর অন্তর্গত তারা চাইছি আরও বিলাস-বৈভব, আরও মসৃণ জীবন, আরও নিশ্চিত নিরাপত্তা। এ প্রক্রিয়ায় নিচুতলার মানুষদের কার কী হলো, তাতে কী
আসে যায়?


খবর এসেছে, আমাদের গ্রামে নদী, খাল, বিলের কূল ছাপিয়ে ধানি জমিতে পানি ঢুকে পড়েছে। এটা অপ্রত্যাশিত নয়। এ রকম প্রতি বর্ষাতেই হয়। আমরা নিচু এলাকার মানুষ, বছরের সাত মাস খাল-বিল-নদী-নালা পানিতে একাকার হয়ে থাকে। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি তখন হয়ে যায় একেকটি দ্বীপ। এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যেতে নৌকা ছাড়া উপায় নেই। আমরা বাল্যকাল থেকেই এরকম বানভাসি গাঁয়ে, কোষা নৌকায় চড়ে বাড়ি থেকে বাড়ি কিংবা বাজার অথবা অন্য কোনোখানে ঘুুরে বেরিয়েছি মহাআনন্দে। ইদানীং অবশ্য জমির মধ্য দিয়ে ছোট ছোট মাটির রাস্তা তৈরি হয়েছে অনেক। ফলে অনেক জায়গায় এসব কাঁচা মাটির রাস্তায় চলাচল করা সম্ভব হয়। এসব রাস্তা দ্বারা এক ধরনের যোগাযোগ যেমন সম্ভব হয়েছে, তেমনি এই রাস্তাগুলো পানির অবাধ প্রবাহে প্রতিবন্ধকতারও সৃষ্টি করেছে। অনেক জায়গা বর্ষাকালেও শুকনো থাকে। আবার অনেক জায়গায় সারা বছরই পানি জমে থাকে। সময়ের আবর্তে সে পানি নষ্ট হয়ে যায় এবং মশা আর নানা ধরনের কীটপতঙ্গের প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়। তাছাড়া এসব অপরিকল্পিত রাস্তার কারণে অনেক ধানি জমিও নষ্ট হয়, যার ফলে বিভিন্ন ফসলের পরিমাণও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হ্রাস পায়।
যাকগে এসব কথা। এমন বাস্তবিক কথা বলার জন্য তো আমার এই কলাম নয়। হৃদয় নিয়ে আমার ব্যাপার-স্যাপার। অতএব, সেদিকেই চোখ ফেরানো যাক। এই সেদিন কোনো একটি বাংলা পত্রিকায় পড়লাম যে, উত্তরবঙ্গের দিকে বৃষ্টির পানির ঢল নামায় ছোট ছোট নদীর দু'কূল ছাপিয়ে পানি ঢুকে পড়েছে জমির ভেতবে। এর সঙ্গে এসেছে মাছ এবং গাঁয়ের নারী-পুরুষ একযোগে দু'হাত দিয়েই সেসব মাছ ধরছে। প্রতিবেদনটি অত্যন্ত সুলিখিত ছিল। 'রূপালি পুঁটি এই বর্ষায়'_ এ ধরনের একটি প্রতিবেদন। দীর্ঘদিন পরে একটি দৈনিকের প্রতিবেদন আমার ভেতরে এক ধরনের আর্দ্রতার সৃষ্টি করে। আমি ফিরে যাই আমার বাল্য-কৈশোরে। আমাদের দেশেও এই হঠাৎ একরাতের বৃষ্টিতে নদী থেকে ক্ষেতে-খামারে জল ঢুকে যাওয়ার ব্যাপারটি প্রতি বছরই ঘটে থাকে। তখন অজস্র মাছ জোয়ারের পানির সঙ্গে নদী থেকে উঠে আসে ওপরে। সব বয়সের মানুষ খালি হাতে, ঝাঁকি জাল কিংবা পলো নিয়ে নেমে পড়ে মাঠে মাঠে। মাছ ধরার মহোৎসব শুরু হয়। আমি স্বচক্ষে না দেখলেও বাবা-মার কাছে শুনেছি যে, আমার এক জেঠাতো ভাই বিশাল আকারের পলো দিয়ে বড় বড় আইড় অথবা পাঙ্গাশ মাছ অবলীলায় ধরতেন এই উজিয়ে ওঠা পানি থেকে। তবে এখন মাছের পরিমাণ কমে এসেছে, মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। অতএব, ছোটখাটো মাছ ছাড়া বড় মাছ আর দেখা যায় না। ওই প্রতিবেদনটিতে লেখক এই দৃশ্যটিকে আরও বিস্তৃত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন সেই রূপালি পুঁটির ঝোল দিয়ে গরম ভাত খাওয়ার কথা। বোধ করি তার মধ্যেও স্মৃতি ভর করেছিল। আমার তো জিভে জল এসে গিয়েছিল। যতই বলি পেছন ফিরে তাকালে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে, আমি বিশ্বাস করি, এই পেছনের আমি সামনের আমিকে সামনের দিকে অবিরত ঠেলে নিয়ে যায়।
কথায় কথায় কেমন নিজের অজান্তেই রবীন্দ্রনাথ এসে গেল আবার। কত অল্পতে তুষ্ট ছিলাম আমরা, কত অল্পতে পরিতৃপ্ত আমাদের গ্রামবাসী গণমানুষ এখনও। সেই পুঁটি মাছের ঝোল আর গরম ভাত_ এতেই এখনও স্বর্গসুখ আপামর সাধারণ বাঙালি সবার। ঢাকার রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রাণ অতিষ্ঠ করা যানজটের মধ্যে বসে থেকে ভাবি, এই ঢাকা থেকেই ২০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে এমন সব জায়গা, যেখানে রূপালি পুঁটি মাছের ঝোল আর গরম ভাত মানুষকে স্বর্গের সন্ধান দিতে পারে।
তাহলে আমাদের এত চাওয়া কিসের? কেন দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন গিয়ে ১২ হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়াবে? কী এমন সাহেব হয়েছি আমরা? অনেকে বলবেন যে, এ হচ্ছে ভাবাবেগের কথা। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো সংশ্রব নেই। হতেই পারে। কেননা, আমি তো ভাবাবেগেই চলি। তবে মহামতি আইনস্টাইন বলেছিলেন, 'কল্পনা যুক্তিবিদ্যার চেয়ে মানুষের কল্যাণে অনেক বেশি প্রয়োজন। কল্পনাই মানুষকে ব্রতী করে নতুনতর আবিষ্কারে উদ্যোগী হতে।' সেই কারণেই কল্পনাপ্রবণ মানুষের বড় প্রয়োজন আমাদের সমাজে এখন। ভাবছিলাম, ঢাকার আকাশচিত্রের দিকে তাকালে দেখতে পাই বিশাল উঁচু সব ভবন। এক এক সময় মনে হয় প্রতীচ্যীয় কোনো উন্নত শহরের মতোই বুঝি-বা আমার এই ঢাকা। এসব ভবন নানা বর্ণের, সবগুলোই প্রায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং একতলা থেকে আরেক তলায় যেতে সিঁড়ি বাইতে হয় না। সেখানে অতীব কার্যক্ষমতা সম্পন্ন লিফট রয়েছে। সহজেই তরতরিয়ে উঠে যাওয়া যায়, নেমে আসা যায়। এই বাক্যটি লিখেই মনে হলো ওঠা আর নামা_ এই শব্দ দুটি বোধহয় আমাদের জন্য এই মুহূর্তে বড় প্রয়োজনীয়। আমরা ক্রমাগত ওপরে ওঠার সংগ্রামে ব্যতিব্যস্ত এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমরা সত্যি সত্যিই ওপরে উঠছি। মাঝে মধ্যে মনে হয় আমরা যত ওপরে উঠছি, ততই কি নিচে নামছি? আমি আমার নিজস্ব প্রভাব-প্রতিপত্তির দ্বারা নিজের বৈষয়িক সমৃদ্ধির জন্য যতই চেষ্টা করছি এবং তার ফলে যত ওপরে উঠছি, ততই আমাকে ওপরে তোলার জন্য অসংখ্য মানুষ নিচে নেমে যাচ্ছে। কথাটা একটু বুঝিয়ে বলি।
যে কোনো সীমিত সম্পদের সমাজে যদি কতিপয় মানুষকে ওপরে উঠতে হয়, তবে সম্পদের পুনর্বণ্টনের মাধ্যমেই কেবল সেটা সম্ভব। অর্থাৎ আমি যত ওপরে উঠব, তার মূল্য দিতে হবে অন্য কাউকে। এ জন্যই বোধহয় মার্কসীয় তত্ত্বকথায় একটি উক্তি আছে, 'দ্য রিচ গেটিং রিচার, পুওর পুওরার।' অর্থাৎ 'ধনী হবে আরও ধনী, দরিদ্রের জন্য তলানি।' তো এ রকম একটি পরিস্থিতিতেই বোধহয় পেঁৗছেছে আমাদের এই দেশ আজকে। আর আমরা, যারা এই ধনিক শ্রেণীর অন্তর্গত তারা চাইছি আরও বিলাস-বৈভব, আরও মসৃণ জীবন, আরও নিশ্চিত নিরাপত্তা। এ প্রক্রিয়ায় নিচুতলার মানুষদের কার কী হলো, তাতে কী আসে যায়?
সেদিন আমার এক অনুজপ্রতিম অবস্থাপন্ন বন্ধু আমায় বলছিল, বিদ্যুতের রেট এত বেড়ে গেছে যে, এটাই সরকারের পতনের কারণ হতে পারে। আমি বললাম, হতেই পারে। জানতে চাইলাম, কেমন বেড়েছে? সে আক্ষেপ করে বলল, মাসে ৪০০ ইউনিটের ওপরে খরচ হলে তা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমি ভাবলাম, তবে তো মুশকিলের কথা। তাহলে তো ফ্রিজ, পানির হিটার, এয়ার কন্ডিশনার ইত্যাদি চালাতে কষ্ট হবে! তারপর ভাবলাম, কী আর হবে? এখন যদি পাঁচ হাজার টাকা বিদ্যুতের বিল দেই, তখন না হয় ১৫ হাজার টাকা দেব! কী অসম্ভবের দেশে বাস আমাদের! যেখানে গ্রাম-গঞ্জ-জনপদে সাধারণ মানুষের সারাদিন-রাতের বিদ্যুৎ খরচ মাসে ১০০ কি ২০০ ইউনিট, সেখানে আমরা হাজার হাজার ইউনিটের কথা নিয়ে আক্ষেপ করছি। এই যে কৃত্রিম বিভাজন, এ বিষয়টি ভেবে দেখার মতো। ১০ কি ১৫ বছর আগেও বাংলাদেশবাসী অবস্থাপন্নরা অনেক বেশি স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। আজ তাদের প্রয়োজন বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, একে অশ্লীল বললেও কম বলা হয়।
আবারও আমার নিজের অজান্তেই হৃদয়নন্দন বন থেকে রূঢ় বাস্তবে কখন যে সরে এসেছি, টেরও পাইনি। একেক সময় কবির ভাষা ধার করে বলতে ইচ্ছা হয়_ 'দাও ফিরে সে অরণ্য, লহ এ নগর।' আপাতত রূপালি পুঁটির ঝোল আর গরম ভাতের স্বাদ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করাই বোধহয় শান্তির অন্যতম পথ।

আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
 

No comments

Powered by Blogger.