তৈরি পোশাকশিল্প-ন্যায্য মজুরি দিয়েও শিল্পের বিকাশ সম্ভব by এম এম আকাশ
সম্প্রতি দেখা গেল আশুলিয়ার পোশাক কারখানার শ্রমিক, মালিক ও শিল্প-পুলিশের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এসব দ্বন্দ্ব-সহিংস ভাঙচুরে পরিণত হয়েছিল এবং পরিণতিতে অস্থায়ীভাবে প্রায় সাড়ে ৩০০ কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। একতরফাভাবে মালিকপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর শ্রমিক আন্দোলন প্রথম দিকে অবদমিত হয়নি; বরং আরও বেড়ে
গিয়েছিল এবং কারখানাগুলোর আশপাশে শ্রমিকেরা অবরোধ, ভাঙচুর ও বিক্ষোভ কিছুদিন চালিয়ে গেছেন। মালিকপক্ষ দাবি করেছে, নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। হাইকোর্টের আদেশের পর কারখানা অবশ্য পরে খুলে দেওয়া হয়। এখন মালিকেরা বলতে শুরু করেছেন যে, শ্রমিকদের কোনো সুনির্দিষ্ট দাবি তাঁদের জানা নেই! কেউ কেউ এ-ও বলছেন, ‘মজুরি তাঁরা অল্প দিন আগেই বাড়িয়েছেন, এখন আর মজুরি বৃদ্ধি সম্ভব নয়।’
কারখানা বন্ধ সমাধান নয়, উভয় পক্ষই এটা মনে করে। সুতরাং প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এই বন্ধ কারখানা চালু করার এবং পরবর্তী সময়ে চালু রাখার জন্য কী করা দরকার। কীভাবে শ্রমিক-মালিক সহিংস দ্বন্দ্বের অবসান করা যায়? আমরা যদি এ সমস্যার গভীরে যাই, তাহলে এ আন্দোলন শুরুর বিষয়গুলো সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে। আন্দোলন শুরু হয়েছিল আশুলিয়ার হা-মীম পোশাক কারখানায়। এটি একটি বিশাল কারখানা, যেখানে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক একত্রে কাজ করেন! শ্রমিকদের দাবি ছিল, তাঁদের মজুরি বৃদ্ধি করতে হবে। তাঁদের যে মজুরি তিন বছর আগে নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা দিয়ে এখন জীবন চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী ২০০৯ সালে এক হাজার ৬৬০ টাকার আগের মজুরির ৮১ শতাংশ বাড়িয়ে ন্যূনতম মজুরি তিন হাজার টাকা করা হয়েছিল। তখনই শ্রমিকেরা অবশ্য দাবি করেছিলেন পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি। ওই সময় অর্থনীতিবিদেরা মজুরি বোর্ডকে হিসাব করে দেখিয়েছিলেন যে, ২০০০ সালে একজন লোকের দারিদ্র্যসীমার মাসিক আয় তৎকালীন বাজারদরে ছিল ৭০৫ টাকার সমান। চারজন লোকের একটি পরিবার হলে সেই পরিবারের প্রয়োজনীয় শুধু ক্যালরির খরচ মেটাতে যে আয় দরকার, তা দাঁড়ায় এই হিসাব অনুসারে ২০০০ সালের বাজারদরে দুই হাজার ৮২০ টাকা। ২০০০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে মূল্যস্ফীতি যা হয়েছিল সেই মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে টাকাকে সমন্বয় করলে প্রকৃতপক্ষে ভরণপোষণের খরচ দাঁড়ায় ২০০৮ সালেই চারজনের একটি পরিবারের জন্য প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। সেই হিসাবে ২০০৮ সালে শ্রমিকদের সাধারণ দাবি ছিল চারজনের একটি পরিবারের খেয়ে-বেঁচে থাকতে হলে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা মজুরি দিতে হবে।
কিন্তু মালিকেরা প্রথমে যুক্তি দেখান যে চারজনের পরিবারে দুজন উপার্জনকারী থাকলে এবং ওভারটাইমের সুযোগ থাকলে ৩০০০+৩০০০+ওভারটাইম দিয়ে শ্রমিকদের চলার কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু শ্রমিকেরা তখন বাড়িভাড়া দুই হাজার টাকা যোগ, যাতায়াত খরচ যোগ, এক-আধটু মানবিক অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদার কথা তুলে ধরেছিলেন। যা-ই হোক, বেশি লাভ করার স্বার্থে তা মালিকেরা দেননি। আমরা সামগ্রিকভাবে বলতে পারি, তিন বছর আগে যে মজুরি নির্ধারিত হয়েছিল, শ্রমিকদের মাঝে তা নিয়ে তখন থেকেই নানা চাপা ক্ষোভ ছিল বা মতভেদ ছিল। তা সত্ত্বেও তখন তাঁরা তা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিন বছর যেতে না যেতেই কেন তাঁরা মজুরি বৃদ্ধির দাবি তুললেন, তা খতিয়ে দেখতে হবে। এটাকে নিছক বিদেশি ষড়যন্ত্র বলে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হবে খুবই আত্মঘাতী।
আমরা জানি তিন বছরে ডলারের দাম বেড়েছে। যখন ডলারের দাম বেড়ে যায়, তখন মালিকেরা যেহেতু পোশাক বিক্রি করে ডলার আয় করেন, সেহেতু তখন টাকায় তাঁদের আয় বেড়ে যায়। তিন বছর আগে এক ডলারে পাওয়া যেত ৭০ টাকা। এখন এক ডলারে পাওয়া যায় ৮২ টাকা। সেই হিসাবে শ্রমিকেরা নিজেরাও দেখতে পারছেন ডলারের মানবৃদ্ধির কারণে মালিকদের আয় বেড়ে গেছে ১৮ শতাংশ। তিন বছর আগে যখন এক ডলার সমান ৭০ টাকা হিসাবে মজুরি নির্ধারণ হয়, তখন মজুরির পরিমাণ ছিল ডলারের হিসাবে প্রায় ৪৬ ডলার। ৪৬ ডলার তখন তিন হাজার টাকার সমান ছিল। এখন ৪৬ ডলারের সমান প্রায় তিন হাজার ৬০০ টাকা। সুতরাং শ্রমিকেরা স্বাভাবিকভাবেই ধরে রেখেছেন তাঁদের মজুরি বৃদ্ধি পাবে ১৮ শতাংশ। তাঁরা ন্যায়সংগতভাবেই এ প্রত্যাশা করেন।
এদিকে জিনিসপত্র ও বাড়িভাড়াও বেড়েছে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো। এবার মুদ্রাস্ফীতি যা হয়েছে, সেটা বছরে ১০ শতাংশ করে দুই বছরে মোট ২০ শতাংশ। সুতরাং ২০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি হওয়ায় তাঁদের ন্যূনতম রোজগার যা ছিল, তা ২০ শতাংশ কমে গেছে।
একটি কারখানায় আন্দোলন হয়েছে, তার মানে এই নয় যে, আন্দোলনটা সেই কারখানার শ্রমিকদেরই আন্দোলন। একই পরিস্থিতি আশপাশের সব কারখানায় বিরাজ করছিল। এ আন্দোলনের পরিবেশ উল্লিখিত কারণে আগেই তৈরি হয়েছিল, শ্রমিকেরা মনে মনে ফুঁসছিলেন, সুযোগ খুঁজছিলেন সমবেত হয়ে প্রতিরোধ সৃষ্টি করার। তাঁরা তিন বছর আগে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে ৮১ শতাংশ মজুরি বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। এবারও তাঁরা ভেবেছিলেন আন্দোলন-সংগ্রাম করে মজুরি অন্তত কিছুটা বাড়িয়ে নেবেন। কিন্তু ঠিক কতটুকু মজুরি বৃদ্ধি যুক্তিসংগত হবে, তা শ্রমিকদের জানা ছিল না। তাঁদের দুর্ভাগ্য, কোনো ট্রেড ইউনিয়ন তাঁদের দাবিগুলো সুনির্দিষ্ট আকার দিয়ে সঠিক সময়ে পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এত বেশি চিন্তা তাঁরা করেননি। তাঁরা ভেবেছেন বাড়িভাড়া, যাতায়াত খরচ বেড়ে গেছে, এটা পোষানোর জন্য মজুরি কিছুটা বাড়াতে হবে। সুতরাং আমি মনে করি মজুরি বৃদ্ধি আন্দোলনের বাস্তব ভিত্তি ছিল।
পরে আমি খোঁজ নিয়ে দেখলাম, দর-কষাকষি করে ওই কারখানার মালিক মজুরি বৃদ্ধির জন্য কিছুটা সম্মত হন এবং সেখানে সেটা হয়তো হয়েই যেত। কিন্তু এই বিক্ষোভটা তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রথমে তা সমগ্র আশুলিয়ায় ছড়াল। তারপর নারায়ণগঞ্জ এলাকায় ছড়াল। আমার আরও মনে হয়, এ আন্দোলন পুরো শিল্প এলাকায় ছড়িয়ে যেতে পারে। যখন এই আন্দোলনটা ছড়াচ্ছে, তখন এখানে কিছু অনুপ্রবেশকারী সব সময় থাকে, এবারও হয়তো ছিল এবং সেই অনুপ্রবেশের সঙ্গে বৈদেশিক শক্তির যোগ থাকতে পারে। সেটা অস্বাভাবিক নয়।
আমাদের এ-ও জানা আছে যে, আমেরিকার রাষ্ট্রদূত কিছুদিন আগেই একটি ট্রেড ইউনিয়নের কর্মীকে কারা হাইজ্যাক করে মেরে ফেরেছে—সেই অভিযোগ উত্থাপন করে আসছিলেন। সে কারণে আমেরিকার পোশাক রপ্তানিকারকদের মাঝে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের ভাবমূর্তি খারাপ হয়ে গেছে এবং অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে তাঁরা সেখানকার বাজার হারানোর হুমকি দিয়েছেন—এ ধরনের ইঙ্গিতও তাঁর বক্তব্যে ছিল। জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক ও যুদ্ধাপরাধের বিচার যারা ঠেকাতে চায়, তারাও এর মধ্যে কলকাঠি নাড়ার চেষ্টা করতে পারে। এর মধ্য দিয়ে তারাও একটি অচলাবস্থা ও নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি করতে চায়। সুতরাং আমি এটা বলব না যে, এখানে অন্য কোনো ষড়যন্ত্রকারী এর পেছনে ছিল না। ষড়যন্ত্রকারী থাকতে পারে। এগুলো খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের, শ্রমিকদের নয়। সাম্প্রতিক এই আন্দোলনের ভিত্তি যেহেতু আছে। এই বাস্তবতার ভিত্তিতে একটি সমাধানে যেতে হবে। সমাধানে না যাওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন কখনো স্তিমিত হবে, কখনো চাঙা হয়ে উঠবে।
কিন্তু সমাধানের পথ কী? মালিকেরা বলতে পারেন, আমরা এখন ইউরোপের মন্দাক্রান্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের জিনিসপত্রের দাম কমে গেছে। এখন মজুরি বৃদ্ধি করতে হলে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়াতে হবে। তখন হয়তো বাজার হারাব। বাজার যদি না বাড়ে তাহলে টিকতে পারব না। এক গবেষণায় আমি (ছয় মাস আগে) মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, মালিকদের রেট অব প্রফিট গড়ে বর্তমানে মাত্র ৩ শতাংশ। তাঁদের এ লাভের ২০ শতাংশের ১ শতাংশ ছাড়তে রাজি হবেন কি? এটা করলে সমস্যার সমাধান কিন্তু হয়ে যাবে। কারণ এই ২০ শতাংশের ১ শতাংশ বা ৫ শতাংশ লভ্যাংশ যদি তাঁরা দেন, তাহলে দেশের মোট রপ্তানির শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ তাদের ত্যাগ করতে হবে। হিসাব করে দেখেছি, সেটার মোট পরিমাণ হচ্ছে প্রায় বছরে ১৫০ কোটি টাকা। ৩০ লাখ শ্রমিককে তা সমভাবে বণ্টন করে দিলে প্রত্যেকে পাবেন ৫০০ টাকা! এটা অবশ্য সবাইকে দিতে হবে না, যাঁরা লাভ করছেন শুধু তাঁরাই দেবেন। যাঁর কারখানা বন্ধ থাকবে বা রুগ্ণ আছে, কাজের অর্ডার নেই, মন্দায় যাঁরা সংকটে পড়েছেন, তাঁদের দেওয়ার দরকার নেই।
সবাই তো মন্দার মুখে একসঙ্গে সংকটে পড়েননি। এখনো তো আমরা জানি ৩৫০টি কারখানা বন্ধ হয়েছিল। আবার সেগুলো চালু হয়েছে। চার হাজার কারখানার মধ্যে মাত্র সাড়ে ৩০০ কারখানা বন্ধ করা হয়েছিল। বাকি আরও তিন হাজার ৬৫০টি কারখানা চালু আছে। এ কারখানাগুলো তাঁদের লাভের একটি সামান্য অংশ এই দুর্দিনে শ্রমিকদের দিলে শ্রমিকেরা স্বস্তি পেতেন।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী বললেন, রেশন দেওয়া সম্ভব নয়। তবে বাসস্থান দেওয়া যেতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু শহরের এসব মানুষকে কোনো ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ইচ্ছা করলে এই ভর্তুকির একটি অংশ বা মালিকদের লাভের একটি অংশ দিলে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সরকার এদিকে মনোযোগ দিতে পারে। তা ছাড়া স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকার যেটা করতে পারে তা হলো, প্রতিটি কারখানায় শ্রমিকদের নির্বাচিত ট্রেড ইউনিয়নের ব্যবস্থা করা। তাহলে গোলযোগ হলে মালিকেরা শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করতে পারবেন।
বাস্তবতা হলো, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পারস্পরিক আলোচনা ছাড়া সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। পশ্চিমারা যাকে স্টেকহোল্ডার বলে, কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে তারা আলোচনা করে সমাধান করবেন—এটাই প্রকৃত গণতান্ত্রিক রীতি বা নিয়ম। এটা না করা গেলে অন্য কোনো সমাধানের রাস্তা খোলা নেই।
ড. এম এম আকাশ, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কারখানা বন্ধ সমাধান নয়, উভয় পক্ষই এটা মনে করে। সুতরাং প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এই বন্ধ কারখানা চালু করার এবং পরবর্তী সময়ে চালু রাখার জন্য কী করা দরকার। কীভাবে শ্রমিক-মালিক সহিংস দ্বন্দ্বের অবসান করা যায়? আমরা যদি এ সমস্যার গভীরে যাই, তাহলে এ আন্দোলন শুরুর বিষয়গুলো সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে। আন্দোলন শুরু হয়েছিল আশুলিয়ার হা-মীম পোশাক কারখানায়। এটি একটি বিশাল কারখানা, যেখানে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক একত্রে কাজ করেন! শ্রমিকদের দাবি ছিল, তাঁদের মজুরি বৃদ্ধি করতে হবে। তাঁদের যে মজুরি তিন বছর আগে নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা দিয়ে এখন জীবন চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী ২০০৯ সালে এক হাজার ৬৬০ টাকার আগের মজুরির ৮১ শতাংশ বাড়িয়ে ন্যূনতম মজুরি তিন হাজার টাকা করা হয়েছিল। তখনই শ্রমিকেরা অবশ্য দাবি করেছিলেন পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি। ওই সময় অর্থনীতিবিদেরা মজুরি বোর্ডকে হিসাব করে দেখিয়েছিলেন যে, ২০০০ সালে একজন লোকের দারিদ্র্যসীমার মাসিক আয় তৎকালীন বাজারদরে ছিল ৭০৫ টাকার সমান। চারজন লোকের একটি পরিবার হলে সেই পরিবারের প্রয়োজনীয় শুধু ক্যালরির খরচ মেটাতে যে আয় দরকার, তা দাঁড়ায় এই হিসাব অনুসারে ২০০০ সালের বাজারদরে দুই হাজার ৮২০ টাকা। ২০০০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে মূল্যস্ফীতি যা হয়েছিল সেই মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে টাকাকে সমন্বয় করলে প্রকৃতপক্ষে ভরণপোষণের খরচ দাঁড়ায় ২০০৮ সালেই চারজনের একটি পরিবারের জন্য প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। সেই হিসাবে ২০০৮ সালে শ্রমিকদের সাধারণ দাবি ছিল চারজনের একটি পরিবারের খেয়ে-বেঁচে থাকতে হলে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা মজুরি দিতে হবে।
কিন্তু মালিকেরা প্রথমে যুক্তি দেখান যে চারজনের পরিবারে দুজন উপার্জনকারী থাকলে এবং ওভারটাইমের সুযোগ থাকলে ৩০০০+৩০০০+ওভারটাইম দিয়ে শ্রমিকদের চলার কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু শ্রমিকেরা তখন বাড়িভাড়া দুই হাজার টাকা যোগ, যাতায়াত খরচ যোগ, এক-আধটু মানবিক অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদার কথা তুলে ধরেছিলেন। যা-ই হোক, বেশি লাভ করার স্বার্থে তা মালিকেরা দেননি। আমরা সামগ্রিকভাবে বলতে পারি, তিন বছর আগে যে মজুরি নির্ধারিত হয়েছিল, শ্রমিকদের মাঝে তা নিয়ে তখন থেকেই নানা চাপা ক্ষোভ ছিল বা মতভেদ ছিল। তা সত্ত্বেও তখন তাঁরা তা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিন বছর যেতে না যেতেই কেন তাঁরা মজুরি বৃদ্ধির দাবি তুললেন, তা খতিয়ে দেখতে হবে। এটাকে নিছক বিদেশি ষড়যন্ত্র বলে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হবে খুবই আত্মঘাতী।
আমরা জানি তিন বছরে ডলারের দাম বেড়েছে। যখন ডলারের দাম বেড়ে যায়, তখন মালিকেরা যেহেতু পোশাক বিক্রি করে ডলার আয় করেন, সেহেতু তখন টাকায় তাঁদের আয় বেড়ে যায়। তিন বছর আগে এক ডলারে পাওয়া যেত ৭০ টাকা। এখন এক ডলারে পাওয়া যায় ৮২ টাকা। সেই হিসাবে শ্রমিকেরা নিজেরাও দেখতে পারছেন ডলারের মানবৃদ্ধির কারণে মালিকদের আয় বেড়ে গেছে ১৮ শতাংশ। তিন বছর আগে যখন এক ডলার সমান ৭০ টাকা হিসাবে মজুরি নির্ধারণ হয়, তখন মজুরির পরিমাণ ছিল ডলারের হিসাবে প্রায় ৪৬ ডলার। ৪৬ ডলার তখন তিন হাজার টাকার সমান ছিল। এখন ৪৬ ডলারের সমান প্রায় তিন হাজার ৬০০ টাকা। সুতরাং শ্রমিকেরা স্বাভাবিকভাবেই ধরে রেখেছেন তাঁদের মজুরি বৃদ্ধি পাবে ১৮ শতাংশ। তাঁরা ন্যায়সংগতভাবেই এ প্রত্যাশা করেন।
এদিকে জিনিসপত্র ও বাড়িভাড়াও বেড়েছে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো। এবার মুদ্রাস্ফীতি যা হয়েছে, সেটা বছরে ১০ শতাংশ করে দুই বছরে মোট ২০ শতাংশ। সুতরাং ২০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি হওয়ায় তাঁদের ন্যূনতম রোজগার যা ছিল, তা ২০ শতাংশ কমে গেছে।
একটি কারখানায় আন্দোলন হয়েছে, তার মানে এই নয় যে, আন্দোলনটা সেই কারখানার শ্রমিকদেরই আন্দোলন। একই পরিস্থিতি আশপাশের সব কারখানায় বিরাজ করছিল। এ আন্দোলনের পরিবেশ উল্লিখিত কারণে আগেই তৈরি হয়েছিল, শ্রমিকেরা মনে মনে ফুঁসছিলেন, সুযোগ খুঁজছিলেন সমবেত হয়ে প্রতিরোধ সৃষ্টি করার। তাঁরা তিন বছর আগে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে ৮১ শতাংশ মজুরি বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। এবারও তাঁরা ভেবেছিলেন আন্দোলন-সংগ্রাম করে মজুরি অন্তত কিছুটা বাড়িয়ে নেবেন। কিন্তু ঠিক কতটুকু মজুরি বৃদ্ধি যুক্তিসংগত হবে, তা শ্রমিকদের জানা ছিল না। তাঁদের দুর্ভাগ্য, কোনো ট্রেড ইউনিয়ন তাঁদের দাবিগুলো সুনির্দিষ্ট আকার দিয়ে সঠিক সময়ে পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এত বেশি চিন্তা তাঁরা করেননি। তাঁরা ভেবেছেন বাড়িভাড়া, যাতায়াত খরচ বেড়ে গেছে, এটা পোষানোর জন্য মজুরি কিছুটা বাড়াতে হবে। সুতরাং আমি মনে করি মজুরি বৃদ্ধি আন্দোলনের বাস্তব ভিত্তি ছিল।
পরে আমি খোঁজ নিয়ে দেখলাম, দর-কষাকষি করে ওই কারখানার মালিক মজুরি বৃদ্ধির জন্য কিছুটা সম্মত হন এবং সেখানে সেটা হয়তো হয়েই যেত। কিন্তু এই বিক্ষোভটা তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রথমে তা সমগ্র আশুলিয়ায় ছড়াল। তারপর নারায়ণগঞ্জ এলাকায় ছড়াল। আমার আরও মনে হয়, এ আন্দোলন পুরো শিল্প এলাকায় ছড়িয়ে যেতে পারে। যখন এই আন্দোলনটা ছড়াচ্ছে, তখন এখানে কিছু অনুপ্রবেশকারী সব সময় থাকে, এবারও হয়তো ছিল এবং সেই অনুপ্রবেশের সঙ্গে বৈদেশিক শক্তির যোগ থাকতে পারে। সেটা অস্বাভাবিক নয়।
আমাদের এ-ও জানা আছে যে, আমেরিকার রাষ্ট্রদূত কিছুদিন আগেই একটি ট্রেড ইউনিয়নের কর্মীকে কারা হাইজ্যাক করে মেরে ফেরেছে—সেই অভিযোগ উত্থাপন করে আসছিলেন। সে কারণে আমেরিকার পোশাক রপ্তানিকারকদের মাঝে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের ভাবমূর্তি খারাপ হয়ে গেছে এবং অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে তাঁরা সেখানকার বাজার হারানোর হুমকি দিয়েছেন—এ ধরনের ইঙ্গিতও তাঁর বক্তব্যে ছিল। জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক ও যুদ্ধাপরাধের বিচার যারা ঠেকাতে চায়, তারাও এর মধ্যে কলকাঠি নাড়ার চেষ্টা করতে পারে। এর মধ্য দিয়ে তারাও একটি অচলাবস্থা ও নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি করতে চায়। সুতরাং আমি এটা বলব না যে, এখানে অন্য কোনো ষড়যন্ত্রকারী এর পেছনে ছিল না। ষড়যন্ত্রকারী থাকতে পারে। এগুলো খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের, শ্রমিকদের নয়। সাম্প্রতিক এই আন্দোলনের ভিত্তি যেহেতু আছে। এই বাস্তবতার ভিত্তিতে একটি সমাধানে যেতে হবে। সমাধানে না যাওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন কখনো স্তিমিত হবে, কখনো চাঙা হয়ে উঠবে।
কিন্তু সমাধানের পথ কী? মালিকেরা বলতে পারেন, আমরা এখন ইউরোপের মন্দাক্রান্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের জিনিসপত্রের দাম কমে গেছে। এখন মজুরি বৃদ্ধি করতে হলে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়াতে হবে। তখন হয়তো বাজার হারাব। বাজার যদি না বাড়ে তাহলে টিকতে পারব না। এক গবেষণায় আমি (ছয় মাস আগে) মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, মালিকদের রেট অব প্রফিট গড়ে বর্তমানে মাত্র ৩ শতাংশ। তাঁদের এ লাভের ২০ শতাংশের ১ শতাংশ ছাড়তে রাজি হবেন কি? এটা করলে সমস্যার সমাধান কিন্তু হয়ে যাবে। কারণ এই ২০ শতাংশের ১ শতাংশ বা ৫ শতাংশ লভ্যাংশ যদি তাঁরা দেন, তাহলে দেশের মোট রপ্তানির শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ তাদের ত্যাগ করতে হবে। হিসাব করে দেখেছি, সেটার মোট পরিমাণ হচ্ছে প্রায় বছরে ১৫০ কোটি টাকা। ৩০ লাখ শ্রমিককে তা সমভাবে বণ্টন করে দিলে প্রত্যেকে পাবেন ৫০০ টাকা! এটা অবশ্য সবাইকে দিতে হবে না, যাঁরা লাভ করছেন শুধু তাঁরাই দেবেন। যাঁর কারখানা বন্ধ থাকবে বা রুগ্ণ আছে, কাজের অর্ডার নেই, মন্দায় যাঁরা সংকটে পড়েছেন, তাঁদের দেওয়ার দরকার নেই।
সবাই তো মন্দার মুখে একসঙ্গে সংকটে পড়েননি। এখনো তো আমরা জানি ৩৫০টি কারখানা বন্ধ হয়েছিল। আবার সেগুলো চালু হয়েছে। চার হাজার কারখানার মধ্যে মাত্র সাড়ে ৩০০ কারখানা বন্ধ করা হয়েছিল। বাকি আরও তিন হাজার ৬৫০টি কারখানা চালু আছে। এ কারখানাগুলো তাঁদের লাভের একটি সামান্য অংশ এই দুর্দিনে শ্রমিকদের দিলে শ্রমিকেরা স্বস্তি পেতেন।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী বললেন, রেশন দেওয়া সম্ভব নয়। তবে বাসস্থান দেওয়া যেতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু শহরের এসব মানুষকে কোনো ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ইচ্ছা করলে এই ভর্তুকির একটি অংশ বা মালিকদের লাভের একটি অংশ দিলে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সরকার এদিকে মনোযোগ দিতে পারে। তা ছাড়া স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকার যেটা করতে পারে তা হলো, প্রতিটি কারখানায় শ্রমিকদের নির্বাচিত ট্রেড ইউনিয়নের ব্যবস্থা করা। তাহলে গোলযোগ হলে মালিকেরা শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করতে পারবেন।
বাস্তবতা হলো, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পারস্পরিক আলোচনা ছাড়া সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। পশ্চিমারা যাকে স্টেকহোল্ডার বলে, কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে তারা আলোচনা করে সমাধান করবেন—এটাই প্রকৃত গণতান্ত্রিক রীতি বা নিয়ম। এটা না করা গেলে অন্য কোনো সমাধানের রাস্তা খোলা নেই।
ড. এম এম আকাশ, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments