পানগাঁও নৌ টার্মিনাল নিয়ে কী করতে চায় নৌ মন্ত্রণালয়? by টিপু সুলতান

২১ বছর ধরে নানা জটিলতা কাটিয়ে তৈরি হয়েছে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নৌ টার্মিনাল। ঢাকার কাছে কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে বুড়িগঙ্গার তীরে এই টার্মিনাল এখন ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু জটিলতা এর পিছ ছাড়ছে না। কে পরিচালনা করবে দেশের প্রথম নৌ কনটেইনার টার্মিনাল—বেসরকারি অপারেটর? চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ?


নাকি এটা চলবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে (পিপিপি)?
নৌ মন্ত্রণালয় ও বন্দর কর্তৃপক্ষ একই সঙ্গে এই তিন উপায়েই টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ কারণে এই টার্মিনাল বর্তমান সরকারের সময়ে আর চালু হবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং এ-সংক্রান্ত নথিপত্র থেকে জানা গেছে, বন্দর কর্তৃপক্ষ দুই ধাপ পদ্ধতিতে দরপত্র মূল্যায়ন চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠিয়েছে। একই সময়ে পিপিপিতে (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) অপারেটর নিয়োগ করার ব্যবস্থা করতে পিপিপির কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে নৌ মন্ত্রণালয়। আবার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেরা পরিচালনা করতে পারে কি না, তা খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি করেছে।
অবশ্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি চালু করে দেব।’
কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বেসরকারি অপারেটর নিয়োগ করলে যন্ত্রপাতি আমদানি করে কাজ শুরু করতে ছয় থেকে আট মাস লাগবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেরা করলে সরকারি আইনবিধি ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং জনবলকাঠামো অনুমোদন ও নিয়োগ করে টার্মিনাল চালু করতে কমপক্ষে দুই বছর লাগবে। আর পিপিপিতে করলে কবে শেষ হবে, তা বলা মুশকিল।
প্রকল্পের নথিপত্রে বলা হয়েছে, নৌপথে কনটেইনার পরিবহন সুবিধা সৃষ্টি, সড়কপথের ওপর চাপ কমানো, কম খরচে নদীপথে কার্গো পরিবহনের মাধ্যমে বাণিজ্যের প্রসার এবং চট্টগ্রাম বন্দরের গতিশীলতা বাড়াতে ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে ৮৮ একর জমির ওপর আধুনিক সুবিধাসহ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে এটি নির্মাণ করে। প্রকল্প পরিচালক মুজিবুর রহমান জানান, টার্মিনালের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে গত মাসে।
তিন বছর ধরে চলছে দরপত্র কার্যক্রম: নথিপত্র পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টার্মিনাল পরিচালনা বা পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজে বেসরকারি অপারেটর নিয়োগের জন্য ২০০৮ সালে প্রাকযোগ্যতা নির্ধারণের জন্য প্রস্তাব আহ্বান করা হয়। তাতে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান প্রাকযোগ্য বলে নির্বাচন করা হয়। প্রাকযোগ্যতা নির্ধারণ-প্রক্রিয়া শেষ করতে করতে পার হয় তিন বছর। ২০১১ সালের ২৬ অক্টোবর প্রাকযোগ্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর দরপত্র খোলা হয়। তাতে অংশ নেয় দুটি প্রতিষ্ঠান—চট্টগ্রামের এভারেস্ট এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স এ অ্যান্ড জে ট্রেডার্স। এর মধ্যে এভারেস্ট ৩৯৭ কোটি এবং এ অ্যান্ড জে ১২৯৫ কোটি টাকা দর দেয়। কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়ন শেষে চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি এভারেস্টকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ দিতে প্রস্তাব করে। এভারেস্ট ২৩ বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে একই কাজ করছে।
তবে এভারেস্টের দর প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৪৪ শতাংশ কম হওয়ায় এর ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। তারা টার্মিনাল চালু হলে ২০ বছরের সম্ভাব্য আয়ের ধাপওয়ারি দর উদ্ধৃত করে ব্যাখ্যা দেয়। এরপর মূল্যায়ন কমিটি কার্য সম্পাদন জামানত (পারফরম্যান্স গ্যারান্টি) ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করার প্রস্তাব করে কাজ দেওয়ার সুপারিশ করে।
গত ৫ মার্চ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব এ নিয়ে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের দর ভারসাম্যমূলক নয় দাবি করে মন্ত্রণালয় এর ব্যাখ্যা চায়। এরপর কমিটি এ বিষয়ে সম্পূরক প্রতিবেদন দিয়ে ব্যাখ্যা ও যুক্তি তুলে ধরে। তাতে বলা হয়, সর্বনিম্ন দরদাতার দর গ্রহণ না করে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করার ক্ষেত্রে দর বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। টার্মিনাল অপারেটরকে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে কার্যক্রম শুরু করতে শর্ত অনুযায়ী এক বছরের মতো সময় লাগবে। এতে টার্মিনালটি অব্যবহূত হয়ে পড়ে থাকবে এবং বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
নথিতে দেখা যায়, গত ১৮ এপ্রিল এ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য সারসংক্ষেপসহ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপন করেন। কিন্তু সারসংক্ষেপে মূল্যায়ন কমিটির সম্পূরক ব্যাখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। ২৬ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নৌ মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠিতে একই ব্যাখ্যা চায় এবং তা সারসংক্ষেপ আকারে আবার উপস্থাপন করতে বলে।
গত ৩ মে আবার ক্রয় কমিটিতে প্রস্তাব উপস্থাপন করেন নৌপরিবহনসচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার। কিন্তু এবারও সারসংক্ষেপে প্রস্তাবটি পাসের সুপারিশ ছিল না।
প্রস্তাব পিপিপির কার্যালয়ে: এই অবস্থায় ২৮ মে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় ‘অপারেটর নিয়োগের বিষয়টি পিপিপি প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়ন যুক্তিযুক্ত হবে বিধায়’ উল্লেখ করে প্রস্তাবটি পিপিপি সেলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে ৪ জুন পিপিপির কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়। পিপিপির কার্যালয় থেকে ২ জুলাই তারিখের স্মারকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়ে জানায়, পানগাঁও টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগের বিষয়টি পিপিআর (সরকারি ক্রয় নীতিমালা) পদ্ধতি অনুসরণ করে করা হয়েছে। এটিপিপিপি হিসেবে গ্রহণ করতে হলে পিপিপির কার্যালয়ের নির্ধারিত ছকে নির্দিষ্ট প্রকল্প প্রস্তাব করতে হবে। যদি অপারেটর নিয়োগসংক্রান্ত প্রকল্পের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই ও সম্ভাব্যতা যাছাই হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে প্রতিবেদনসহ পিপিপির কার্যালয়ে পাঠাতে হবে। তারপর এসব তথ্য সন্তোষজনক বলে বিবেচিত হওয়ার পর নীতিগত অনুমোদনের জন্য অর্থনীতিসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, প্রকল্পে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে সবকিছু প্রতিবন্ধকতামুক্তভাবে বাস্তবায়নের ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। আর পিপিপির নীতি নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রকল্প প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে প্রকল্পটি পুনরায় শুরু করতে আবশ্যিকভাবে অতিরিক্ত সময় লাগবে।
জানতে চাইলে গত ৯ জুলাই সচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এখন পিপিপির কার্যালয়ের চিঠি পাননি। তিনি বলেন, ‘পিপিপিতে নাহলে আমরা নিজেরা পানগাঁও টার্মিনাল পরিচালনা করব।’ সে ক্ষেত্রে চলমান দরপত্র-প্রক্রিয়া সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে কি না, জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘দরকার হলে দরপত্র বাতিল করব।’
পিপিপির বিপক্ষে সংসদীয় কমিটি: পিপিপিতে অপারেটর নিয়োগ ঠিক হবে না বলে মনে করেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি নূর-ই আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী)। তিনি বলেন, ‘আমাদের সুপারিশ ছিল, যদি অপারেটর নিয়োগে দরপত্রের কার্যাদেশ দেওয়ার প্রক্রিয়া সফল না হয়, তাহলে আর দরপত্র ডেকে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। প্রয়োজনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এটা চালাবে।’ তিনি বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষের টাকা আছে, তারা কেন এ জন্য অংশীদারি নিতে যাবে?’
বন্দর কর্তৃপক্ষের তৎপরতা: প্রকল্প পিপিপিতে পাঠানোর সিদ্ধান্তের পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত ২৭ জুন এভারেস্ট এন্টারপ্রাইজকে চিঠি দিয়ে জানায়, দরপত্র খোলার পর এর মেয়াদ ১৮০ দিন থাকে। তা গত ১৪ জুন শেষ হয়ে গেছে। দরপত্র-প্রক্রিয়া এখনো চলমান ও অগ্রগতি রয়েছে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য দরপত্রের মেয়াদ আরও তিন মাস বাড়াতে এভারেস্টের সম্মতি চাওয়া হয়। এভারেস্ট কর্তৃপক্ষ সম্মতি দেয়।
তবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল নিজাম উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘পানগাঁও টার্মিনাল আমরা নিজেরা চালাব। এতে কোনো সমস্যা হবে না।’ সে ক্ষেত্রে চলমান দরপত্র ও পিপিপি প্রস্তাবের কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দরপত্রের বিষয়ে চলমান প্রক্রিয়া শেষ হলে, তারপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পণ্য পরিবহনে সময় ও ব্যয় সাশ্রয়: বন্দরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা বলেন, সবকিছু মিলিয়ে পানগাঁও টার্মিনাল চালুর বিষয়টি আবার আটকে যাচ্ছে। এ সরকারের বাকি মেয়াদে এটা চালু করা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তাঁরা বলেন, পানগাঁও টার্মিনালটি যত দ্রুত চালু হবে, ততই মঙ্গল। কারণ, নৌপথে কনটেইনার পরিবহন হলে সময় অনেক কম লাগবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট ও ডাকাতির ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যাবে।
বন্দর সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে যেসব পণ্যসামগ্রী খালাস হয়, তার প্রায় ৭০ শতাংশ মালামাল ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার। এসব পণ্যের ১০ শতাংশ আসতে পারে রেলপথের মাধ্যমে। বাকি মালামাল সড়কপথে ঢাকায় আনা হয়।
প্রকল্প কার্যালয় থেকে জানানো হয়, নতুন টার্মিনালে একসঙ্গে দুটি জাহাজ মালামাল ওঠানামা করতে পারবে। প্রতিটি জাহাজের ধারণক্ষমতা ১০০ কনটেইনার। কনটেইনার পরিবহনে খরচ হবে সড়কপথের তিন ভাগের এক ভাগ।

No comments

Powered by Blogger.