হিগস বোসন কণার সন্ধান ইব্রাহিম নোমান

প্রোটনের দুটি বিম ঘড়ির প্রতি বিপরীত দিকে তাক করে সার্নের বিজ্ঞানীরা ছুড়ে দিয়েছিলেন ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকাজুড়ে অবস্থান নেয়া ট্যানেলে। এ প্রতি বিপরীতমুখী বিমের সংঘর্ষেই সৃষ্টি হয় বিগ ব্যাংয়ের সময়কার পরিবেশ। বিজ্ঞানীরা জানান, এ পরিবেশ সৃষ্টিতেই বিমগুলো ছুড়তে হয়েছিল আলোর কাছাকাছি বেগে।


ফলস্বরূপ সুইজারল্যান্ডের ইউরোপীয় কাউন্সিল ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ বা সার্ন গবেষকরা ঈশ্বর কণা বা হিগস বোসনের কণার সন্ধান লাভের ঘোষণা দিয়েছেন।
রহস্যময় এ কণার সন্ধানে পদার্থবিজ্ঞানীরা ৪৮ বছরের এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। এ যাত্রার সফল পরিণতিতেই ৪ জুলাই হিগস বোসনের অস্তিত্বের ঘোষণা দেয়া হলো। এটিই ভরের অন্তর্নিহিত কারণ। এ ভরের ব্যাখ্যা নিউটন শুধু নয়, আইনস্টাইনও দিতে পারেননি। তবে কাজ চালানোর মতো কিছু একটা করেছিলেন।
সার্নের পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক ও গুজব থাকলেও এটি যে মানব জাতির বোধে গভীরতার জন্য জরুরি তা অস্বীকারের উপায় নেই। এ হিগ বোসন পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কণিকা। এ কণিকাকে অনেকে মজা করে ঈশ্বরের কণিকাও বলে থাকেন। হিগস কণাকে বিজ্ঞানে হিগস বোসন বলেই উল্লেখ করা হয়। কারণ হিগস কণা একটি বোসন কণা। মহাবিশ্বে দুই ধরনের মৌলিক কণা আছে। এক. বোসন এবং দুই. ফার্মিয়ন। হিগ্স বোসন কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বের একটি বিষয়। হিগস বোসন হলো পদার্থ বিজ্ঞানের আদর্শ মডেল যেসব মৌলিক কণার ওপর ভিত্তি করে গঠিত তার অন্যতম এবং একমাত্র অশনাক্তকৃত কণা ছিল ৪ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত। জানা কণাগুলো হলো ফার্মিয়ন ও বোসন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত লেপ্টন, কোয়ার্ক, ফোটন, [ড+-, ত] বোসন, গ্গ্নুয়ন ইত্যাদি। আদর্শ মডেল (ঝঃধহফধৎফ গড়ফবষ) বর্তমানে পদার্থ বিজ্ঞানের সবচেয়ে সফল তত্ত্ব, যার দ্বারা প্রকৃতির চারটি বলের স্বরূপ ব্যাখ্যা করা যায়, যে বলের মহাবিশ্বের তাবত পদার্থ বা বস্তু গঠিত হয় মৌলিক কণাগুলোর সমন্বয়ে। আদর্শ মডেল অনুযায়ী হিগস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভরহীন কণিকাগুলো ভর অর্জন করে। হিগস্ বোসনের ক্ষেত্র খুব উচ্চশক্তিতে বিরাজ করে, শক্তির মাত্রা কমে গেলে হিগস ক্ষেত্র উবে যায়, আদৃশ্য হয়ে যায়। আদর্শ তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিস্ফোরণের ঠিক পর পরই অর্থাৎ এক সেকেন্ডের লক্ষ কোটি ভাগের এক ভাগ সময়ে।
মহাবিশ্বে চার ধরনের বলের কথা আমরা জানি। মহাকর্ষ বল, বিদ্যুতচুম্বকীয় বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল, শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল। এ বল বা মিথস্ক্রিয়াগুলো কার্যকর হয় বলবাহক কণাগুলোর আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে। বলবাহক এসব কণা হচ্ছে গ্রাভিটন, ফোটন, ডব্লিউজেড ও গ্গ্নুয়ন। এগুলোর সাধারণ নাম বোসন কণা। বোসনের একটি সাধারণ ধর্ম হচ্ছে স্পিন বা ঘূর্ণনবেগ পূর্ণ সংখ্যার। এই বোসন কণাগুলো বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে। এই তত্ত্বের আবিষ্কারক ছিলেন বাঙালী পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাই বিজ্ঞানী পল ডিরাক বসুর সম্মানে এই ধরনের কণার নামে বোসন ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। মহাবিশ্বে আরেক ধরনের কণা হচ্ছে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। এগুলোকে বলা হয় ফার্মিয়ন। ফার্মিয়নের স্পিন ভগ্নাংশ সংখ্যার। এ কণাগুলো ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান মেনে চলে। এনিরিকো ফার্মির নামানুসারে এগুলোর নাম করা হয়েছে ফার্মিয়ন।

কোয়ান্টাম সংখ্যাতত্ত্ব

পদার্থ বিজ্ঞানের পরিসংখ্যান তত্ত্বগুলোর জন্য যাদের আমরা সবচেয়ে বেশি স্মরণ করি তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
এ আবিষ্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ যে সত্যেন্দ্রনাথের হাতে শুরু হয়েছিল, সে কথা আইনস্টাইন এবং পল ডিরাক দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করেছেন। আইনস্টাইন পরে ভরযুক্ত কণিকার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে বসুর তত্ত্ব সাধারণীকরণ পর্যায়ে উন্নীত করেন। এ তত্ত্বের নামকরণ করা হয় বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান তত্ত্ব। ১৯২৬ সালে ফার্মি এবং ডিরাক আরেক ধরনের সংখ্যা তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। গুডস্মিথ এবং উলেনবেক বলেন, প্রতিটি মৌলিক কণার একটি নিজস্ব স্পিন বা ঘূর্ণন আছে। স্থূল অর্থে লাটিমের মতো ভাবা যায়। একটি সুষম গোলাকার বস্তুর স্পিন হলো শূন্য ডিগ্রী। সব দিকে তা দেখতে সমান। হাফ স্পিন কণাগুলোর মানে হচ্ছে, এগুলো দু’বার আবর্তন অর্থাৎ ৭২০ ডিগ্রী ঘুরলে আগের অবস্থায় ফিরে আসে। যেমন, ইলেকট্রন সেই ধরনের কণা।

হিগস বোসন কণা

হিগস কণাকে বিজ্ঞানে হিগস বোসন বলেই উল্লেখ করা হয়। কারণ হিগস কণা একটি বোসন কণা। এর স্পিনও পূর্ণসংখ্যার। এ রকম অসাধারণ আবিষ্কারের খবর দেশের গণমাধ্যমে প্রচারের ক্ষেত্রে এমন কিছু বক্তব্য আসছে যা তরুণ প্রজন্মের কাছে বিভ্রান্তিকর হয়ে দেখা দেবে। যেমন, ‘এই কণা আবিষ্কারে উৎফুল্ল বিজ্ঞানীরা স্মরণ করতেই ভুলে গেছেন বাঙালী বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু বা উপেক্ষিত সত্যেন্দ্রনাথ বসু।’ এ প্রসঙ্গে বলতে হয় সত্যেন্দ্রনাথ বসু উপেক্ষিত। তবে তা নিজ দেশে, বাইরে নয় এবং হিগস বোসন কণার আবিষ্কারে এসব কথা প্রাসঙ্গিকও নয়। ড. আলী আসগর বলেছেন, যে কোনো তত্ত্ব বিকশিত হয়ে শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়ে। এর তাৎপর্য সম্পর্কে ওই বিজ্ঞানীও অতটা অবগত থাকেন না। হিগস বোসন ভর বাহক বোসন বৈশিষ্ট্যের একটা কণা। বোস আইনস্টাইন পরিসংখ্যান তত্ত্ব মেনে চলে এটুকুই। এই ঈশ্বর কণা আবিষ্কারে সত্যেন বসুর কোন অবদান নেই। তবে হ্যাঁ, পরমাণুর চেয়ে ক্ষুদ্র ‘বোসন জাতের কণা সত্যেন বসুর সংখ্যাতত্ত্ব মেনে চলে। একই কথা ডয়চে ভেলেকে বললেন সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের হাই এনার্জি বিভাগের বিজ্ঞানী সুকল্যাণ চট্টোপাধ্যায়। ১৯২৪ সালে বোসন কণার অস্তিত্বের কথা সবাই জানতে পারেন। কিন্তু এর সঙ্গে বোসের কোন সম্পর্ক নেই তবে বোসের আবিষ্কৃত সংখ্যাতত্ত্বের অবদান আছে।
প্রদীপের আলোয় সত্যেন্দ্রনাথ বসু উদ্ভাসিত করতে চেয়েছিলেন বাঙালির অন্তরলোকথ এই পূর্ববঙ্গ, কি বাংলাদেশের বিজ্ঞানকে। কিন্তু ভুলে যেতে অভ্যস্ত বাঙালী তো বটেই, এমনকি তার দীর্ঘ ২৪ বছরের কর্মক্ষেত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও তেমন করে মনে রাখেনি বাংলার এ বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন বসুকে। তার অবদানকে তারা এতটাই অবহেলা করেছে যে, আজ সব স্মৃতিচিহ্নতেও পড়ে গেছে ধুলোর আস্তরণ। শুধু স্থাপনা উচ্ছেদের মাধ্যমে অধ্যাপক বোসকে অস্বীকার করা হচ্ছে না; যেসব ছাত্রছাত্রী তাদের বইয়ে বোসের বিখ্যাত কোয়ান্টাম পরিসংখ্যন তত্ত্ব পড়ছেন প্রতিনিয়ত, তারা জানেনও না অধ্যাপক বোসের অবদান।
অধ্যাপক বোসের কর্মক্ষেত্রে তার সঠিক স্বীকৃতি ও সম্মান না মিললেও তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব। তিনি লন্ডন রয়াল সোসাইটির নির্বাচিত ফেলো ছিলেন। ভারত সরকার তাকে দিয়েছে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি। তিনি ছিলেন সর্বভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের পদার্থ বিজ্ঞান শাখার সভাপতি এবং পরবর্তীকালে মূল সভাপতি। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইমেরিটাস’ প্রফেসরের পদ অলঙ্কৃত করেন এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দিয়েছে ‘দেশিকোত্তম’ পদবি। অথচ যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অবদান সর্বাপেক্ষা বেশি, যেখানে ছিল তার কর্মস্থল সেখান থেকে কিছুই পাননি তিনি। বছরে একবার মনেও করে না।
ব-সধরষ: সফরনৎধযরসহড়সধহ@ুধযড়ড়.পড়স

No comments

Powered by Blogger.